গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ...
চট্টগ্রামে যখন পা রাখলাম তখনো সূয্যিমামার মুখ দেখা যায় নি। পৌষের প্রথম সকাল। বাস থেকে নেমেই শীতের আমেজ টের পাওয়া গেলো। চাঁদর জড়াতে হলো গায়ে।
বাসায় কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়েই ভ্রমণপিপাসুদের বিশেষ গ্রুপ "ভ্রমরের" কয়েকজন তরতাজা যুবক রওয়ানা হলাম "অক্সিজেনে"র উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটায় সকাল আটটা পেরিয়ে গেছে। মানুষের পদচারণায় চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড়ের বাতাসে তখন অক্সিজেনের তুলনায় কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
আমাদের বাসে উঠতে হলো ঠিক সাড়ে আটটায়। গন্তব্য... রাঙ্গামাটি.... তবে আপাতত রাঙ্গামাটি নয়। যাচ্ছি খাগড়াছড়ির পথ ধরে সাজেকের সবুজ উপত্যকায়। সাজেক পড়েছে রাঙ্গামাটি জেলায়, কিন্তু পুরোটা পথ পড়বে খাগড়াছড়ির মাটিতে।
চান্দি গরম!!
ভ্রমর গ্রুপের দু'জন সদস্য আগের দিন বিকেলেই শান্তি পরিবহনের টিকেট কাটতে এসেছিলেন। তাদেরকে বলা হয়েছিলো সামনের দিকে কোন সিট খালি নেই। অতএব বাধ্য হয়ে তারা পেছনের দিকের কয়েকটি সিটের টিকেট কিনে নিয়ে যান। কিন্তু সকালে এসে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র!! হেল্পার চিৎকার করে ডাকছে... আসেন খাগড়াছড়ি... সিট খালি...
এবং দেখা গেলো এইমাত্র এসে অনেকেই বাসের সামনের সিট পেয়ে যাচ্ছেন!! শান্তি পরিবহনের চট্টগ্রাম কাউন্টারের এই প্রতারণায় আমরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। এই শীতের সকালে আমাদের চান্দি গরম গেল। ব্যাটাদের একহাত দেখে নেয়া দরকার। কাউন্টারে যে দুজন বসা ছিল তাদের সাথে বেশ উচ্চবাচ্য হলো। ওদেরকে বেশ করে শাসিয়ে দিলাম। বাসে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু যাত্রার শুরুতেই শান্তি পরিবহনের এই প্রতারণামূলক আচরণ যে অশান্তির সৃষ্টি করলো তার শেষ কোথায় কে জানে!!
জানালায় ভোরের আলো
চারজন অলস বাস মিস করেছে। অতএব চারটা সিট খালি। অলসরা পরের বাসে পারলে আসবে। না পারলে নাই। ব্যাকপ্যাক গুলো খালি সিটে রেখে আয়েশ করে বসলাম আমরা। আর বাস ছুটলো গন্তব্যের টানে। হাটহাজারী, নাজিরহাট, মানিকছড়ি... পথের দুপাশে সবুজ গাছের সারি। কখনো কাটা ধানের ক্ষেত। শহর ছেড়ে আমরা গ্রামের আলোহাওয়ার ভেতর এগিয়ে চলেছি। ততক্ষণে সূর্য তার আলো ছড়াতে শুরু করেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে গায়ে। যেন আলতো করে মুখে চোখে বুলিয়ে দিচ্ছে উষ্ণ পরশ।
এই পথ যদি না শেষ হয়?
মানিকছড়ি পার হলে শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। দু'পাশে পাহাড়, টিলা। টিলার ঢালে সবুজের সমারোহ। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। এরকম পথে চলতে আমার এত ভালো লাগে, এজন্যই আমি শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে বারবার ফিরে আসি পাহাড়ের কোলে। অদ্ভুত সুন্দর আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু এইসব নির্জন রাস্তায় এলেই গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে হয়- এই পথ যদি না শেষ হয়!! তবে কেমন হত, তুমি বলতো!! (তবে শেষ পর্যন্ত গলা ছাড়লাম না। নিজেকে কন্ট্রোল করেছি আরকি! বিকজ, আমার গানের গলা এতই মধুর যে, সুরের মূর্ছনায় রাস্তার সবকিছু থেমে যেতে পারে, ইউ নো!!)
টেনশন টেনশন!!
খাগড়াছড়ি নেমে নামায আর খাওয়া সেরে আমরা উঠলাম পাহাড়ী পথের জন্য বিশেষ জীপ- চান্দের গাড়িতে। শুরু হলো চান্দের গাড়ির দুরন্ত গতির সাথে আমাদের রোমাঞ্চকর যাত্রা। আমরা জানতাম যে দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকর্ট টীম সাজেক যায় বিকেল সাড়ে তিনটায়। কিন্তু খাগড়াছড়িতে নেমে জানা গেল সময়টা এখন এগিয়ে আনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর টীম যাবে পৌনে তিনটায়। অর্থাৎ এর মধ্যে দীঘিনালা পৌঁছতে না পারলে আজ আমাদের সাজেক যাওয়া হবে না।
বাস মিস করা সেই চারজন অলস পরের বাসে রওনা দিয়েছিল। তারা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে আরো কিছুটা দেরি হয়ে গেল। সবাই কিছুটা টেনশন বোধ করতে লাগলাম। তবে কি তীরে এসে ডুবে যাবে তরী?
অবশেষে ঘুমকাতুরে অলসরা এসে পৌঁছলো। আর দেরি নয়। উল্কার বেগে ছুটলো চান্দের গাড়ি। গন্তব্য সাজেক, যেখানে মেঘের ওপর বাড়ি।
পথে পথে চেকপোস্ট!
আমাদের গাড়ি যখন আর্মি ক্যাম্পের কাছে পৌঁছলো, ততক্ষণে অন্যসব গাড়ি নিয়ে সেনাবাহিনীর টিম রেডি হয়ে গেছে। আর পাঁচ মিনিট দেরি করলেই মিস হয়ে যেত আজকের এসকর্ট।
পর্যটকদের নিয়ে ৩৮ টি গাড়ির দীর্ঘ বহর এগিয়ে চললো সাজেকের উদ্দেশ্যে।
দীর্ঘ পাহাড়ী পথ। আর পথে পথে চেকপোস্ট। কখনো সেনাবাহিনীর, কখনো বিজিবির, কখনো পুলিশের। মাঝে মাঝে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিলো, এ কি নিজের দেশে আছি? এখনো এতটা অনিরাপদ রয়ে গেছে পার্বত্য অঞ্চল!
কিছুদূর এগিয়েই উঠে পড়লাম গাড়ির ছাদে। হাওয়ার বেগে ছুটছে গাড়ি। আর হাওয়ায় উড়ছে আমাদের মন।

উড়ু উড়ু মন নিয়ে চান্দের গাড়ির ছাদে
দীঘিনালা পেরিয়ে বাঘাইহাট। পথে কাচালং নদী, কাচালং বাজার, মাসালং বাজার। আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু রাস্তা, তবে বান্দরবানের মত অতটা ভয়ংকর নয়। বলতে গেলে, সত্যিকারের এডভেঞ্চারারদের কিছুটা খারাপও লাগতে পারে। বিশেষ করে যারা আগেই বান্দরবানের গহীনে ঘুরে এসেছেন তাদের কাছে সাজেকের পথ হয়তো নতুন কোন অনুভূতি জাগাবে না। নতুন যা, রাস্তার পাশে প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উপজাতি শিশুরা আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াচ্ছিলো। ওরা কী বলছিলো শোনা যায় নি। তবে আমরা নিজেরাই ভেবে নিলামঃ নিশ্চয় ওরা বলছে- "ডিয়ার ট্রাভেলার্স, ওয়েলকাম টু সাজেক"!!!

সতর্কবানী
পাহাড়চূড়ায় পূর্ণিমা স্নান
সাজেকে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে। রুইলুই পাড়ায় আমাদের জন্য বুক করা কটেজ "মেঘালয়" তে ব্যাগপত্তর রেখে বেরিয়ে পড়লাম দূর পাহাড়ের দেশে অস্তগামী সূর্যকে বিদায় জানাতে।

সাজেকের প্রবেশমুখ
আরো উত্তরে হেঁটে গেলে পাওয়া গেল মসজিদ। সেখানেই মাগরিব এবং এশার নামাজ পড়লাম। পুবের আকাশে তখন অন্য দৃশ্য। ভোরের সূর্যের মত লাল হয়ে উঠে আসছে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ, তার ওপরে চাঁদ।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রাত ন'টা পর্যন্ত চললো আমাদের খুনসুটি আড্ডা। ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল, আরো সুন্দর, আরো মোহিনী রুপ ধারণ করলো চাঁদের আলো। হাজার ফুট উপরে, পৌষের প্রথম রাতে হিম হিম বাতাসে, এ যেন অদ্ভুত পূর্ণিমা স্নান। এ যেন মুগ্ধতার নতুন মাত্রা।
মেঘের ওপর বাড়ি
রাতে খেয়েদেয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিনের ভ্রমণের ক্লান্তি আর পাহাড়ের নীরব নিস্তব্ধতায় জম্পেশ ঘুম হলো। ভোরে উঠেই দৌড়। মসজিদে ফযরের নামায পড়ে আমরা উঠে এলাম সাজেকের হেলিপ্যাডে। দু'পাশে পাহাড়ী খাদ মেঘে মেঘে ভরে আছে। প্রথমবার মেঘের ওপরে উঠেছিলাম বিমানে। এবার মেঘের ওপর উঠেছি পায়ে হেঁটে!! ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি হলো।

হেলিপ্যাডের নিচে জমাট বেঁধে আছে সাদা মেঘের দল
সূর্যের তাপ আরেকটু বাড়লে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম আরো উত্তরে কংলাক পাড়ার উদ্দেশ্যে। আরোহন করলাম কংলাক পাহাড়ে। অনেকেই হাঁপিয়ে উঠলো, কিন্তু কেওক্রাডং বিজয়ী পর্বতারোহী হিসেবে আমার কাছে এ যেন ছিল নিতান্তই ডালভাত!! বিনাক্লেশে উঠে পড়লাম কংলাক চূড়ায়। সেখানে লুসাই উপজাতির দুয়েকটা বাড়ি আছে। বাড়ির আঙিনায় তখনো জমাট মেঘ!! এ যেন সত্যিকারের- মেঘের ওপর বাড়ি।

মেঘের ওপর বাড়ি
ফেলে আসি নীলাকাশ
সকাল দশটায় সাজেক থেকে ফিরতি যাত্রা। আবার সেনাবাহিনীর একটি টিম আমাদের সাথে নিয়ে যাবে দীঘিনালা পর্যন্ত। মূলত আমরাই যাবো ওদের সাথে। সেনাবাহিনীর এসকর্ট ছাড়া যাওয়া আসা করা যায় না।
এবার আর ছাদে নয়। বসেছি গাড়ির পেছনের দিকে মুখ করে। সূর্যের তাপ বাড়ছে। আকাশে কোন মেঘ নেই। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর নীল আকাশ। এমন দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ বহুদিন দেখা হয়নি।
ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে পাহাড়ী পথ, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি শহুরে জীবনে।

পেছনে ফেলে আসি নীল আকাশ
বিকেলে ঘুরলাম আলুটিলার রহস্যময় গুহায়। দিনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটিয়ে দিলাম রিসাং ঝর্ণার গান শুনে।

রিসাং ঝর্ণার গান
সূর্য ডুবে গেলে সাঙ্গ হলো এবারের খেলা। অন্ধকারে ডুবে গেল পাহাড়, মেঘ, ঝর্ণা আর দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন