আগের পোস্টে বলেছি বাংলাদেশের তথা এই পাক-ভারত উপমহাদেশের মানুষ ইসলাম বলতে বোঝে ‘ধর্ম’ ইসলাম । দ্বীন ইসলাম নয় । কেন এই অবস্থা ?
এই উপমহাদেশের মানুষ ইসলাম সম্পর্কে জানতে পেরেছে খুব কম । প্রাথমিক যুগে যেসব সাহাবা ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন , তাঁরা ঈমানের দাওয়াত দিতে দিতেই তাদের জীবন শেষ হয়ে যায় । এরপর ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিম দক্ষিণ পাঞ্জাবের সিন্ধ ও মুলতান বিজয়ের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসনের সূচনা হয় । মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইসলামের রাজনৈতিক আগমন ঘটে । কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই তৎকালীন পরশ্রীকাতর খলিফা ও তার সাগরেদ দের ষড়যন্ত্রে হত্যা করা হয় মুহাম্মদ বিন কাসিমকে । গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন কাসিম , অংকুরেই তার বিনাশ ঘটে ।
এরপর এই অঞ্চলে দীর্ঘসময় শাসন করে মুসলিম নামধারী শাসকরা । খিলজী-তুর্কি-মোঙ্গল-তুঘলক বংশীয় শাসকগন । তারা অধিকাংশই ব্যস্ত ছিল তাদের ভোগ-বিলাসে । ব্যস্ত ছিল পারস্পরিক দ্বন্দ্ব- সংঘাতে । যুদ্ধে- রাজ্যদখলে । সিংহাসন দখলের পাঞ্জা লড়তে ।
কী করেছে তারা মুসলিমদের শিক্ষাদীক্ষার উন্নয়নের জন্য ? অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ? কী অবদান রেখেছে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে ? কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেনি । কোন লাইব্রেরি তৈরি করেনি । তেমন কোন মাদ্রাসা তৈরি করেনি যেখানে ইসলামের সাথে সমসাময়িক জ্ঞানের শিক্ষা দেয়া হয়, চর্চা হয় । কী করেছে ? বউয়ের প্রেমের নিদর্শন স্বরুপ তাজমহল বানিয়েছে !
যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল, বেশিরভাগই বেসরকারি উদ্যোগে । যেটুকু পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তা যথেষ্ট ছিল বলে আমি মনে করি না ।
মাদ্রাসাগুলো ছিলো বেশিরভাগ মসজিদ ভিত্তিক । অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াকফ ও উইলের সম্পত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। দীনদার লোকেরা পারলৌকিক পূণ্য লাভের জন্য ওয়াকফ এবং সম্পত্তি প্রদানের অসিয়ত করে যান।
পাক ভারতীয় মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্রাসার এ অবস্থা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল পর্যন্ত বলবত থাকে।
এরই মাঝে হিন্দু-খৃষ্টান-বৃটিশ শাসনে এই অঞ্চল শাসিত হয়েছে দুইশ বছর । এসময় মুসলমানদের অবস্থা হয়েছে আরো করুণ । আরো অধঃপতিত ।
এমনকি অবস্থা এই পর্যায়ে গিয়েছিল যে ধুতি হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের পোষাক । তারা লুঙ্গি পড়তে লজ্জা পেত । সেলাইবিহীন লুঙ্গি কেউ পড়লে গাছের আড়াল থাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে টেনে খুলে ফেলা হয়ে উঠেছিল ছেলেপেলেদের কাছে এক মজার-আনন্দের খেলা ! মুসলমানদের নামের আগে শ্রী লেখা শুরু হয়েছিল ।
(আত্নকথাঃ আবুল মনসুর আহমদ )
[ তাবলীগ জামাতের বয়ান ও ইতিহাসের গতিধারা শীর্ষক আগামী একটি পোস্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখব ইনশাআল্লাহ ]
আমি অনেককেই দেখি মুসলমানদের দুরবস্থার জন্য বৃটিশদের গালিগালাজ করে তাদের গোষ্ঠিসুদ্ধ উপড়ে ফেলেন । বৃটিশরা অবশ্যই মুসলমানদের পক্ষে ছিল না । কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শাসকগোষ্ঠির দুর্বলতা-অনৈতিকতা আর মুসলিম জনগনের শিক্ষাদীক্ষা হীনতা , অজ্ঞতা যে পর্যায়ে গিয়েছিল তাতে মুসলমানরা ক্ষমতায় থাকার সকল যোগ্যতাই হারিয়েছিল । একজন বৃটিশ নাকি লিখেছিলেন , ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়ী বাহিনীর ওপর যদি রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো লোকেরা একটি করে ঢিলও ছুড়তো তাহলেই ঐ বাহিনী ধ্বংস হয়ে যেত । এ থেকেই তৎকালীন মুসলিম জনগনের রাজনৈতিক অজ্ঞতা-অসচেতনতার মাত্রা বোঝা যায় ।
তবুও উর্দু এবং ফার্সি ভাষায় যাও কিছুটা ইসলামী বই-পুস্তক ছিল, বাংলা ভাষায় ছিল আরো কম । বাংলা ভাষাকে মনে করা হত হিন্দুয়ানী ভাষা । এখনো কওমি গোষ্ঠীর অনেকেই এরকম মনে করে থাকে । আর ইংরেজিও ছিল বিধর্মীর ভাষা । ( এ বিষয়ে তৎকালীন আলেমদের যুক্তি নিয়ে সামনে লিখা হবে )
বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন অনুবাদ হলো ১৮০৮ সালে । রংপুরের মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়া ১৮০৮ সালে করলেন আংশিক অনুবাদ । এরপর অনুবাদ করলেন গিরিশচন্দ্র সেন । এছাড়াও এ প্রসঙ্গে নাম পাওয়া যায় রাজেন্দ্রনাথ মিত্র এবং মৌলভী নঈমুদ্দিন এর ।
বাংলায় প্রথম ইসলামী সাহিত্য হলো ‘ মোকসেদুল মোমেনিন’ (?) ।
এই বইয়ে যে কী পরিমাণ ভুল তা নিয়ে লিখলে সে আরেকটা বই হয়ে যাবে !
এই বইয়ে যে কী পরিমাণ ভুল তা নিয়ে লিখলে সে আরেকটা বই হয়ে যাবে !
হাদীস গ্রন্থগুলোর অনুবাদ তো হলো আরো পরে । এই সাম্প্রতিক ৫০-৬০ বছরের মধ্যে । আল্লামা আজিজুল হক বুখারি শরীফের বাংলা অনুবাদ শুরুই করেন ১৯৫২ সালে ।
প্রকৃত অর্থে বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের ভান্ডার এখনো সমৃদ্ধ হয়নি ।
এর মাঝে যারা যেটুকু জানতেন , তাই নিয়ে তারা হয়ে গেলেন ‘পীর’ ।
এভাবেই এই অঞ্চলে ইসলামের শিক্ষা হয়ে গেল পীরনির্ভর । আর পীরদের নানান তরিকার মাধ্যমে কী পরিমাণ ভ্রান্ত বিশ্বাস ও শিরক যে ঢুকল সেইটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছিনা । কেউ আগ্রহী হলে মতিউর রহমান মাদানীর এ সংক্রান্ত লেকচার থেকে শুনে নিয়েন ।
এভাবেই এই অঞ্চলে ইসলামের শিক্ষা হয়ে গেল পীরনির্ভর । আর পীরদের নানান তরিকার মাধ্যমে কী পরিমাণ ভ্রান্ত বিশ্বাস ও শিরক যে ঢুকল সেইটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছিনা । কেউ আগ্রহী হলে মতিউর রহমান মাদানীর এ সংক্রান্ত লেকচার থেকে শুনে নিয়েন ।
মক্কা-মদীনা ফেরত কয়েকজন নেতা যেমন নেসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ইসলামের রাজনৈতিক রুপ বুঝতেন । কিন্তু তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে শহীদ হয়ে যাওয়ায় তাদের মাধ্যমে ইসলামের রাজনৈতিক শিক্ষা ও ধ্যান-ধারণা প্রচার- প্রসারের যে সুযোগ ছিল তাও শেষ হয়ে যায় ।
এভাবে দেখা গেল, বাংলার মানুষ এবং এই উপমহাদেশের মানুষ কখনোই ইসলামকে পরিপুর্ণরুপে দেখার সুযোগ পাননি । সুযোগ পায়নি তাঁরা ইসলামকে পরিপুর্ণ দ্বীন হিসেবে শেখার ।
সেজন্যই এই উপমহাদেশ , বাংলাদেশের মানুষের ইসলাম ‘ধর্মীয়’ আচার অনুষ্ঠানভিত্তিক । ইসলামের রাজনৈতিক রুপটা তাদের কাছে তাই অনেকটাই অপরিচিত, নতুন । মনে করে- বাপ দাদা কারো কাছে শুনি নাই , এরা কোত্থেকে পাইছে এইসব কথা ? ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নতুন হাদীস বানাইছে এই বদমাইশের দল !
মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর 11, 2012
http://goo.gl/p7Rr4
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন