ও নদীরে...
ও নদীরে ভেসে চলে, লখিন্দরের ভেলা
উথাল পাথাল ভরা নদী
ঢেউযে কুটিলা ...
কন-নাগিনীর বিষে লখার দেহ হইলো কালা রে
ভেসে চলে ... লখিন্দরের ভেলা ...
একতারা বাজিয়ে গান গাইছে রমিজুদ্দিন । মাথায় লম্বা চুল, লম্বা গোঁফ । মেহেদী রাঙ্গা দাড়ি । পরণে লম্বা আলখেল্লা । পাশে রাখা একটা চটের ঝোলা । বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে সেখানে কী কী আছে । কয়েকটা পুরনো কাপড় , থালা , বাটি ও মগ ।
রমিজের বয়স ৩৩ বছর । কিন্তু এখন বয়স আন্দাজ করা মুশকিল রমিজের । ৪০ এর আশেপাশেই হবে । হয়তো বেশি হবে । এমনভাবে নিজেকে সাজিয়েছে যাতে তাকে দেখেই বয়স ৫০ এর কোটায় মনে হয় ।
সুমন চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে বটগাছের তলায় বসেছে আসর । অনেকদিন পর মন খুলে গান শুনছে এলাকার লোকজন । উদাস-ভরাট কন্ঠে রমিজ শোনাচ্ছে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী ।
কান্দে বনের পশু পাখি
কান্দে প্রিয়জন
আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে
কান্দে ত্রিভুবন
ঢেউ চলে বুকে নিয়ে...উজানী ঐ ভেলা
কন-নাগিনীর বিষে লখার দেহ হইলো কালারে...
ভেসে চলে...লখিন্দরের ভেলা...
উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকেরই চোখ ছলছল করছে । বিশেষ করে মহিলাদের । রমিজের মত আবেগ দিয়ে কে-ই বা গাইতে পারবে এই গান ? এই গান যে মিশে আছে রমিজের হৃদয়ের ভেতরে । রমিজের চোখও বারবার সিক্ত হয়ে আসে । আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা । গান শেষ হলে এক ফোঁটা অশ্রু তার গাল স্পর্শ করলো ।
মোবাইলের স্কৃনে ভিডিওটা পজ করলেন শিশির । ডাঃ শিশির । ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে ভিডিওটা দেখছিলেন তিনি । গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও । রমিজের আবেগ তাঁকেও কিছুটা স্পর্শ করলো যেন । ডাঃ শিশির এখন বসে আছেন বান্দরবানের নিরিবিলি এলাকায় তাঁর ভাড়া করা বাংলোতে ।
যেখানে রমিজ এই গান গেয়েছিল, সেখান থেকে দুই মাইল পুবেই শুয়ে আছে রমিজের বেহুলা । হয়তো এতদিনে তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই , হয়তো সবকিছু মিশে গেছে মাটিতে । কিন্তু রমিজের মনে সে আছে অমলিন । মানুষরুপী কালনাগ সাপের ছোবলে প্রাণ দিতে হয়েছিল রমিজের বেহুলাকে ।
রমিজ তার কাজ ভালোমতই করেছে । তার এতবছরের সঞ্চিত ক্ষোভ এবার তার চোখের সামনেই মেটানো হবে । সার্জারিটা আজ সকালেই হবে ।
পরিকল্পনামত আসর সমাপ্ত করে চেয়ারম্যানের বাড়ির পেছনের দিকে গাছতলায় ছোট তাঁবু খাটিয়েছিল রমিজ । তিনদিন ধরে সেখানেই ছিল সে । খাবার দাবারও পেয়েছিল চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকেই । চেয়ারম্যানের গতিবিধির সব তথ্য জানিয়ে দিয়েছিল সময়মত ।
গত রাতে সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ডাঃ শিশিরের স্পেশাল টিম রংপুর থেকে ধরে নিয়ে এসেছে সুমন চেয়ারম্যানকে । রাখা হয়েছে গোপন কক্ষে । ভ্রাম্যমান অপারেশন থিয়েটারের সবকিছু রেডি আছে । যদিও রাতের অভিযানের পর টিমের সবাই ক্লান্ত । তবুও অপারেশনটা আজ সকালেই করা হবে । কারো যেন তর সইছে না আর ।
রমিজকে ডাকলে কেমন হয় ? রমিজের কাছে তার জীবনের কথাগুলো আরেকবার শুনলে খারাপ হয় না । রমিজকে কল করলেন ডাঃ শিশির । কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌছলো রমিজ । এখন পুরোপুরি ফিটফাট ।
-রমিজ ভাই, বলো তোমার কাহিনী । অপারেশন শুরুর আগে আরেকবার শুনি ।
২।
অল্পবয়সে বিয়া করছিলাম ভাই । কতইবা হইবো তহন বয়স ? ২২ কি ২৩ । এরকম বয়সে মন থাকে রঙ্গিন । নারীর প্রতি আকর্ষন সবচেয়ে বেশি থাকে এসময়টাতেই ।
বাপে ব্যবসা করতো । আমি বাপের এক পোলা । সেই জন্যে লেখাপড়া বেশি করলাম না । বাপে কয়- লাগবো না তোর এত লেহাপড়া । ব্যবসা দ্যাখ । অল্পবয়স থেইকাই আব্বার সাথে ব্যবসা দেখি । ব্যবসার কাজে পাশের জেলায় যাইতে হইছিল । সেখানেই জুলেখারে দেখলাম । প্রথম দেখাতেই চউখ আটকাইয়া গেল । খোজখবর নিলাম, ঠিকানাপাতি নিলাম । বাড়িতে আইসা লাজ লজ্জার মাথা খাইয়া আব্বাকে মুখ ফুটে বইলা দিলাম সেই কথা । সময় কইরা আব্বা গেলেন একদিন মাইয়া দেখতে । তারও পছন্দ হইলো । মেয়ে সুন্দরী, বংশও খারাপ না । আমার মা মারা গেছেন ৩ বছর । বাপ ছেলেই সংসার । বাড়িতে ছেলের বউ আসলে খারাপ হয়না । আর মেয়েও মাশাল্লাহ খুব সুন্দর ।
বিয়াটা হয়া গেলো । বউয়ের সাথে তহন কী উথাল পাথাল প্রেম । এক মাস তো বাড়ি থেইক্কা বাইরই হই নাই ।
বিয়ার তিন মাসের মাথায় চট্টগ্রাম যাইতে হইলো আমাকে । ১০ বছর আগের কথা । তখন আজকের মত মোবাইল ফোন আছিলনা । টেলিফোনও আছিলনা খুব একটা । জুলেখা খুব কানলো বিদায় বেলায় । নীল রুমালে সুতার গাথুনিতে লিখে দিলো ‘ভালো থেকো’ । ‘ভুলোনা আমায়’ । সেই রুমাল দিলো আমার পাঞ্জাবীর পকেটে ।
বারবার কইরা বললো সাবধানে থাকতে । আর তাড়াতাড়ি ফিরা আসতে ।
আমি বইলা গেলাম , যদি বাড়িতে একা একা ভালো না লাগে , বাবাকে বইলো , তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি রাইখা আসব ।
চট্টগ্রাম হইতে তাড়াতাড়িই ফিরছিলাম । ফিরা দেখি বাড়ি খা খা করছে । কেউ নাই । জুলেখাকে নাকি হাসপাতালে ভর্তি করছে ।
রমিজ আবারো কাঁদতে শুরু করলো । যতবারই রমিজ তার কাহিনী বলা শুরু করে , এই পর্যন্ত এলেই আর নিজেকে আটকাতে পারেনা । কাঁদুক রমিজ ।
ডাঃ শিশির নিজেই স্মরণ করেন রমিজের শেষের কথাগুলো । এর আগেও তো শুনেছেন তিনি রমিজের কাহিনী ।
রমিজ হাসপাতালে গিয়েছিল । জুলেখার তখন শেষ সময় উপস্থিত । অনেক কষ্টে কী ঘটেছে বলেছিলো জুলেখা । সে রাতেই জুলেখা সেই যে ঘুমিয়ে পড়লো আর তাকে জাগানো গেলনা ।
সে বছরেই রমিজের বাবাও মারা গেলেন । সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এলাকা ছাড়ল রমিজ । কোথায় গেলো কেউ জানেনা । বুকে নিয়ে গেলো প্রতিশোধের ঝিকি ঝিকি আগুন ।
৩।
রমিজকে খুঁজে পেয়েছিলেন ডাঃ শিশির তাঁর ইন্টার্ণশিপ ট্রেনিং এর সময় । এমবিবিএস টা হলো ডাক্তারি পেশায় বলতে গেলে ‘মাদার ডিগ্রী’ । এমবিবিএস পাসের পর বেছে নিতে হয় কোন একটি সাবজেক্টকে – বিশেষজ্ঞ হবার জন্য । মেডিকেল সায়েন্স এত বিশাল একটা ব্যাপার, কোন একজন মানুষের পক্ষে সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব না ।
ডাঃ শিশির সার্জারিকেই বেছে নেন । জীবনের দুইটি ঘটনা তাঁকে সার্জারি বিশেষজ্ঞ হতে প্রেরণা জোগায় । ঠিক প্রেরণা নয়, বলা চলে একপ্রকার ‘বাধ্য করে’ ।
এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্ণশিপ করছেন তখন শিশির । শৈশবের সেই ভয়ংকর ঘটনা ভুলেই গিয়েছিল । ভুলে থাকতেই তো চেষ্টা করে সে । কিন্তু রমিজ আবারো সেটা মনে করিয়ে দেয় । আর তখনই নতুন একটা চিন্তা মাথায় আসে শিশিরের । সিদ্ধান্ত নেয় সার্জারিতেই ক্যারিয়ার করার ।
হাসপাতালের রোগীদের সাথে অতি আপনজনের মত মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতো শিশির । হাসপাতালে আসা এই মানুষগুলো- কত অসহায় অবস্থায় আসে । কত কষ্ট । অসুস্থতার চেয়ে বড় দুঃখ আর কী ? খেতে ইচ্ছে করছে , খেতে পারছে না । পা আছে, হাঁটতে পারছে না । কারো পা-ই নেই । একজন তাগড়া মানুষ , বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে । কী কষ্ট ! গরীব হলে তার কষ্ট তো এমনিতেই আরো কয়েকগুন বেশি হয়ে যায় ।
প্রত্যেক অসুস্থ মানুষের পরিবার পরিজনের কষ্টটাও অপরিসীম । নিজে অসুস্থ না হয়ে , নিজের কেউ অসুস্থ না হলে হয়তো সেই অনুভূতিটা পাওয়া যায় না । ডাক্তাররা চেষ্টা করেন যতটুকু জ্ঞান, যতটুকু সামর্থ আছে তা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শারীরিক কষ্টটা দূর করতে । যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে ।
শিশির চেষ্টা করতো শারীরিক অসুস্থতার হিস্ট্রির বাইরে আরো কিছু জানতে । মানুষগুলোর মনের খবর জানতে । এভাবেই একদিন রমিজের কাহিনী জানতে পারে শিশির ।
তখন মেডিসিন ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট । একদিন একজন অজ্ঞান মানুষকে ভর্তি করা হলো । লোকটার পোষাক আশাক মলিন । শরীরের কোন যত্ন নেয়না বোঝাই যায় । পাগলের মত অবস্থা । এই লোক নাকি বাউল । গান গেয়ে গেয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় । আজ সকালে এই শহরের এক আসরে গান গাইছিল । মানুষজন জড়ো হয়ে গান শুনছিল । গান গাইতে গাইতেই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে । দুই-তিনজনে ধরে নিয়ে এসেছে সরকারি হাসপাতালে ।
ঐ রোগীর বেড পড়লো শিশিরের দায়িত্বে । তার ওষুধ কেনার মত টাকা পয়সাও নাই । শিশিরের উদ্যোগে ইন্টার্ণ ডাক্তাররা চাঁদা তুলে তার ঔষধের ব্যবস্থা করলো । দু-তিন দিনের মধ্যে তার খুব আপন হয়ে উঠলো শিশির । শিশির গল্পচ্ছলে জিজ্ঞেস করেছিল- আচ্ছা রমিজ ভাই, আপনি যে গান করেন- তা কোন গানটা আপনার বেশি প্রিয় ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রমিজ বলেছিল – ভাইজান, আমি শুধু একটা গানই গাই ।
- মাত্র একটা গান ? অবাক হয় শিশির ।
- হ ভাইজান ।
- কিন্তু ... কেন ? মাত্র একটা গান কেন ? গানটা আমাকে শোনাবেন ?
রমিজ বলেছিল- ঠিক আছে ভাইজান , আপনার ওয়ার্ডে যেইদিন রোগী ভর্তি হয়না সেইদিন ব্যবস্থা করেন । এই খানেই শোনামু গান । সবাই শুনবে । এরপরে আপনারে কমু ক্যান আমি খালি একটা গান গাই ।
হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ভেতরে গান – ব্যাপারটা কেমন হয় এ নিয়ে কিছুটা চিন্তায় ছিল শিশির । কিন্তু কথাটা তুলতেই ইন্টার্ণ ডাক্তাররা সবাই উৎসাহে হৈ হৈ করে উঠলো । ওয়ার্ডে রোগীরা এখন সবাই স্ট্যাবল । নন-এডমিশন ডে । কোন বাদ্যযন্ত্র নাই- শুধু একটা একতারার টুংটাং শব্দ আর খালিমুখে গান – সমস্যা নাই । অসাধারণ হবে ব্যাপারটা ।
সেদিন ইভেনিং রাউন্ডের পর রমিজ তার একতারা নিয়ে দাড়িয়েছিল মেডিসিন ওয়ার্ডের বিশাল রুমটার একপাশে । ইন্টার্ণ ডাক্তাররা পাশের দুটি খালি বেডে বসেছিল । ওয়ার্ডের বাকি রোগীরা হঠাৎ অবাক হয়ে শুনতে লাগলো রমিজের ভরাট গলায় দরদী কন্ঠের গান-
ও নদীরে ভেসে চলে, লখিন্দরের ভেলা
কন-নাগিনীর বিষে লখার , দেহ হইল কালারে...
ভেসে চলে লখিন্দরের ভেলা...
এত আবেগ দিয়ে কেউ গাইতে পারে ? চোখ বন্ধ ছিল রমিজের । চোখের কোণ হতে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুবিন্দু ।
আবেগ স্পর্শ করেছিল শিশিরকেও । নিশ্চয়ই কোন ঘটনা আছে । জানতে হবে , কী সেই ঘটনা ?
৪।
হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় রমিজকে কী বলেছিল জুলেখা ? প্রথম দিনও সেইসব কথা বলার সময় রমিজ কিছুটা কেঁদে ফেলেছিল । কিন্তু তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে সবকথাই শিশিরকে বলেছিল রমিজ ।
সেইরাতে জুলেখার ওপর পাশবিক নির্যাতন হয়েছিল । মন্ডল চেয়ারম্যানের ছেলে, আজকের চেয়ারম্যান সুমন মন্ডল তার পাঁচ-ছয়জন সাঙ্গপাঙ্গ সহ গভীর রাতে হামলে পড়েছিল রমিজের বাড়িতে । প্রথমেই তারা হাত-পা মুখ বেঁধে ফেলে জুলেখার । তারপর কয়েকঘন্টা ধরে পশুগুলো তাদের পশুত্ব ফলায় জুলেখার ওপর ।
জুলেখার শ্বশুর, রমিজের বাবার কী হয়েছিল তা জুলেখা জানতে পারেনি । অজ্ঞান জুলেখাকে সকালে হাসপাতালে ভর্তি করায় প্রতিবেশিরা । রমিজের বাবাকেও অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় । তাঁর হাত পা বাঁধা ছিল । মাথায় আঘাত ছিল । সেই আঘাতেই ঐ ঘটনার মাস চারেকের মাথায় মৃত্যুর কোলে নিজেকে সপে দেন তিনিও । একা হয়ে যায় রমিজ । বাড়ির প্রতিটি আসবাব, প্রতিটি বালুকণাও একসময় অসহ্য হয়ে ওঠে রমিজের কাছে । সবসময় শুধু জুলেখার কথা মনে পড়ে । হ্যালুসিনেশন হয় তার । সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠলে একদিন এলাকা ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় রমিজ ।
রেলস্টেশনে এক বাউল ফকিরের সাথে দেখা হয়ে যায় তার । দলে ভিড়ে যায় রমিজ । কী আছে আর এই জীবনে ? সব তো শেষ হয়ে গেলো । উস্তাদ বয়াতির সাথে থেকে একতারা বাজানো শেখে , গান শেখে । বেহুলা-লখিন্দরের গান যেন তার নিজেরই গান । সাপের বিষে লখিন্দর মারা গিয়েছিল, রমিজের বেলায় বেহুলাই মারা গেছে সাপের বিষে । এই সাপের নাম ‘মানুষ’ সাপ । সেই থেকে ঐ একটা গানই গেয়ে চলেছে রমিজ । কী দরকার অন্য গানের ?
সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো শিশির । তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের ছোটবেলার কথা ।
৫।
রাতে নিজের রুমে ফিরে শিশির তাঁর ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা বের করেছিল । পত্রিকার একটি কাটিং-এর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল । শিরোনাম- ‘ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা’ ।
খবরের বিবরণে জানা যায় – অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী শিথীকে বেশ কিছুদিন ধরে উত্যক্ত করে আসছিল স্থানীয় কয়েকজন বখাটে যুবক । গত বৃহস্পতিবার স্কুলে যাবার পথে স্কুলছাত্রী শিথীকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় মুখোশ পরিহিত বখাটেরা । পরে বিকেলে সেই ছাত্রীকে স্কুলের পাশে রেখে যায় তারা ।
পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজ ঘরে ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী শিথী । ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণ করার পর ঐ স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে বখাটেরা । অপমানে লজ্জায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে সে ।
পুলিশ অপহরনকারী বখাটদের খুঁজছে’ ।
বারকয়েক পুরনো খবরের কাগজটি পড়েছিল শিশির । শিথীর কথা খুব করে মনে পড়ছিল শিশিরের । শিথী ছিল শিশিরের কাজিন, খালাতো বোন । মনে মনে শিথীকে ভালোবাসতো শিশির । শিথীও তাই । শিশিরকে লেখা শিথীর নকশাকরা চিঠিগুলির পরতে পরতে কি তার ভালোবাসার কথা লেখা ছিলনা ?
পারিবারিকভাবেও কিছুটা কথা হয়ে ছিল । শিশির নিজেই একদিন খালাকে আম্মার সাথে আলাপ করতে দেখেছে ওদের দুজনকে নিয়ে । শিশির একমাত্র ছেলে , শিথীরও কোন ভাইবোন ছিলনা তখন । বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেবে । লজ্জাও লাগতো , ভালোও লাগতো শিশিরের । কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা শিরশিরে অনুভূতি হতো !
কিন্তু তা আর হলো কই ?
পুলিশ সেই বখাটেদের ধরেছিল । কিন্তু এই দেশে কারো বিচার হয় ? রাজনৈতিক কানেকশন আর টাকার জোরে ঠিকই ছাড়া পেয়ে যায় ওরা ।
দু-তিনটি চিঠি বের করে সেরাতে আবার চোখের জলেই ভিজিয়ে ফেলেছিল শিশির । আরো একটি নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিল সে । ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল তার । তখনই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছিল, সার্জারিতেই স্পেশালিস্ট হতে হবে ।
৬ ।
গত ছয় বছর ধরে রমিজকে সাথে নিয়ে পত্রিকা ঘেটে আরো কয়েকজনকে খুঁজে বের করেছে শিশির । যাদের নিকটাত্মীয় কেউ এমন বর্বরতার শিকার হয়েছে , কিন্তু বিচার পায়নি । তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করে নিশ্চিত হয়েছে –প্রকৃত দোষী কে ? তাদেরকে চোখে চোখে রেখেছে । প্ল্যান করেছে । কীভাবে তাদেরকে ধরা যাবে । এই দেশের আইনের প্রতি শিশিরের আর ভরসা নেই । সিদ্ধান্ত নিয়েছে- নিজেই শাস্তি দেবে এই নরপশুদের । গড়ে তুলেছে ভ্রাম্যমান অপারেশন থিয়েটার । আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার শিখিয়ে তৈরি করেছে দক্ষ স্পেশাল টিম । সেই টিম প্রথম সফল অভিযান চালিয়ে ধরে এনেছে রমিজের স্ত্রী জুলেখার ওপর নির্যাতনকারী নরপশু চেয়ারম্যান সুমন মন্ডলকে । এরপরের টার্গেট শিথীকে অপহরণকারীরা । একে একে সবাইকে শাস্তি দেয়া হবে ।
মেরে ফেললেই তো হয় ? রমিজের প্রশ্ন ছিল । সেটা নিয়ে চিন্তা করেছিল শিশির । তারপর ওদেরকে বলেছে- নাহ, আমরা খুনি হতে পারিনা । আর মেরে ফেললেতো শেষ হয়ে গেলো । আমরা বরং এমন শাস্তি দেবো ওদের, যেন জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এই নরপশুগুলোকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় । কষ্ট পেতে হয় । আমরা ওদের লিঙ্গ কেটে দেবো । অণ্ডকোষ ফেলে দেবো । হাতের আঙুলগুলো কেটে ফেলে দেবো । এই হবে ওদের দুনিয়ার শাস্তি । আর বাকিটা পরকালে পাবে ওরা ।
৭।
রমিজের কান্না থেমেছে । ডাঃ শিশিরের পাশের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে এখন । ডাঃ শিশির বললেন-
-‘ঠিক আছে রমিজ ভাই , ওকে দিয়েই আমরা আমাদের কাজ শুরু করছি । যাও , সবাইকে রেডি করো । দশ মিনিট পরে আমি আসছি’ ।
ওটিতে ঢুকে ডাঃ শিশির দেখলেন, সুমন চেয়ারম্যানকে বেঁধে ফেলা হয়েছে । এনেস্থেশিয়া ছাড়াই ,অর্থাৎ অজ্ঞান বা অবশ না করেই- চরম কষ্ট দিয়ে করা হবে এই Emasculation and Castration (লিঙ্গ কর্তন) অপারেশন । পেনিস কেটে ফেলা হবে । অণ্ডকোষও রিমুভ করা হবে । পুরোপুরি পুরুষত্বহীন করে ফেলা হবে । কেটে ফেলা হবে হাতের আঙ্গুল । বাকি জীবনটা এই নরপশুদের এভাবেই কাটাতে হবে ।
অণ্ডকোষ (Testes) ফেলে দেয়ায় এদের শরীরে হরমোনাল ইম্ব্যালেন্স হবে । ফলে ধীরে ধীরে আরো নানারকম রোগের কবলে পড়বে এই নরপশুরা ।
জীবনে যতদিন বাঁচবে, প্রতিটি মুহূর্ত এরা যেন ভাবতে বাধ্য হয়- কী ভুল জীবনে করেছিলাম ।
একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে হাতে গ্লাভস পরলেন ডাঃ শিশির ।
ও নদীরে ভেসে চলে, লখিন্দরের ভেলা
উথাল পাথাল ভরা নদী
ঢেউযে কুটিলা ...
কন-নাগিনীর বিষে লখার দেহ হইলো কালা রে
ভেসে চলে ... লখিন্দরের ভেলা ...
একতারা বাজিয়ে গান গাইছে রমিজুদ্দিন । মাথায় লম্বা চুল, লম্বা গোঁফ । মেহেদী রাঙ্গা দাড়ি । পরণে লম্বা আলখেল্লা । পাশে রাখা একটা চটের ঝোলা । বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে সেখানে কী কী আছে । কয়েকটা পুরনো কাপড় , থালা , বাটি ও মগ ।
রমিজের বয়স ৩৩ বছর । কিন্তু এখন বয়স আন্দাজ করা মুশকিল রমিজের । ৪০ এর আশেপাশেই হবে । হয়তো বেশি হবে । এমনভাবে নিজেকে সাজিয়েছে যাতে তাকে দেখেই বয়স ৫০ এর কোটায় মনে হয় ।
সুমন চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে বটগাছের তলায় বসেছে আসর । অনেকদিন পর মন খুলে গান শুনছে এলাকার লোকজন । উদাস-ভরাট কন্ঠে রমিজ শোনাচ্ছে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী ।
কান্দে বনের পশু পাখি
কান্দে প্রিয়জন
আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে
কান্দে ত্রিভুবন
ঢেউ চলে বুকে নিয়ে...উজানী ঐ ভেলা
কন-নাগিনীর বিষে লখার দেহ হইলো কালারে...
ভেসে চলে...লখিন্দরের ভেলা...
উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকেরই চোখ ছলছল করছে । বিশেষ করে মহিলাদের । রমিজের মত আবেগ দিয়ে কে-ই বা গাইতে পারবে এই গান ? এই গান যে মিশে আছে রমিজের হৃদয়ের ভেতরে । রমিজের চোখও বারবার সিক্ত হয়ে আসে । আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা । গান শেষ হলে এক ফোঁটা অশ্রু তার গাল স্পর্শ করলো ।
মোবাইলের স্কৃনে ভিডিওটা পজ করলেন শিশির । ডাঃ শিশির । ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে ভিডিওটা দেখছিলেন তিনি । গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও । রমিজের আবেগ তাঁকেও কিছুটা স্পর্শ করলো যেন । ডাঃ শিশির এখন বসে আছেন বান্দরবানের নিরিবিলি এলাকায় তাঁর ভাড়া করা বাংলোতে ।
যেখানে রমিজ এই গান গেয়েছিল, সেখান থেকে দুই মাইল পুবেই শুয়ে আছে রমিজের বেহুলা । হয়তো এতদিনে তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই , হয়তো সবকিছু মিশে গেছে মাটিতে । কিন্তু রমিজের মনে সে আছে অমলিন । মানুষরুপী কালনাগ সাপের ছোবলে প্রাণ দিতে হয়েছিল রমিজের বেহুলাকে ।
রমিজ তার কাজ ভালোমতই করেছে । তার এতবছরের সঞ্চিত ক্ষোভ এবার তার চোখের সামনেই মেটানো হবে । সার্জারিটা আজ সকালেই হবে ।
পরিকল্পনামত আসর সমাপ্ত করে চেয়ারম্যানের বাড়ির পেছনের দিকে গাছতলায় ছোট তাঁবু খাটিয়েছিল রমিজ । তিনদিন ধরে সেখানেই ছিল সে । খাবার দাবারও পেয়েছিল চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকেই । চেয়ারম্যানের গতিবিধির সব তথ্য জানিয়ে দিয়েছিল সময়মত ।
গত রাতে সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ডাঃ শিশিরের স্পেশাল টিম রংপুর থেকে ধরে নিয়ে এসেছে সুমন চেয়ারম্যানকে । রাখা হয়েছে গোপন কক্ষে । ভ্রাম্যমান অপারেশন থিয়েটারের সবকিছু রেডি আছে । যদিও রাতের অভিযানের পর টিমের সবাই ক্লান্ত । তবুও অপারেশনটা আজ সকালেই করা হবে । কারো যেন তর সইছে না আর ।
রমিজকে ডাকলে কেমন হয় ? রমিজের কাছে তার জীবনের কথাগুলো আরেকবার শুনলে খারাপ হয় না । রমিজকে কল করলেন ডাঃ শিশির । কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌছলো রমিজ । এখন পুরোপুরি ফিটফাট ।
-রমিজ ভাই, বলো তোমার কাহিনী । অপারেশন শুরুর আগে আরেকবার শুনি ।
২।
অল্পবয়সে বিয়া করছিলাম ভাই । কতইবা হইবো তহন বয়স ? ২২ কি ২৩ । এরকম বয়সে মন থাকে রঙ্গিন । নারীর প্রতি আকর্ষন সবচেয়ে বেশি থাকে এসময়টাতেই ।
বাপে ব্যবসা করতো । আমি বাপের এক পোলা । সেই জন্যে লেখাপড়া বেশি করলাম না । বাপে কয়- লাগবো না তোর এত লেহাপড়া । ব্যবসা দ্যাখ । অল্পবয়স থেইকাই আব্বার সাথে ব্যবসা দেখি । ব্যবসার কাজে পাশের জেলায় যাইতে হইছিল । সেখানেই জুলেখারে দেখলাম । প্রথম দেখাতেই চউখ আটকাইয়া গেল । খোজখবর নিলাম, ঠিকানাপাতি নিলাম । বাড়িতে আইসা লাজ লজ্জার মাথা খাইয়া আব্বাকে মুখ ফুটে বইলা দিলাম সেই কথা । সময় কইরা আব্বা গেলেন একদিন মাইয়া দেখতে । তারও পছন্দ হইলো । মেয়ে সুন্দরী, বংশও খারাপ না । আমার মা মারা গেছেন ৩ বছর । বাপ ছেলেই সংসার । বাড়িতে ছেলের বউ আসলে খারাপ হয়না । আর মেয়েও মাশাল্লাহ খুব সুন্দর ।
বিয়াটা হয়া গেলো । বউয়ের সাথে তহন কী উথাল পাথাল প্রেম । এক মাস তো বাড়ি থেইক্কা বাইরই হই নাই ।
বিয়ার তিন মাসের মাথায় চট্টগ্রাম যাইতে হইলো আমাকে । ১০ বছর আগের কথা । তখন আজকের মত মোবাইল ফোন আছিলনা । টেলিফোনও আছিলনা খুব একটা । জুলেখা খুব কানলো বিদায় বেলায় । নীল রুমালে সুতার গাথুনিতে লিখে দিলো ‘ভালো থেকো’ । ‘ভুলোনা আমায়’ । সেই রুমাল দিলো আমার পাঞ্জাবীর পকেটে ।
বারবার কইরা বললো সাবধানে থাকতে । আর তাড়াতাড়ি ফিরা আসতে ।
আমি বইলা গেলাম , যদি বাড়িতে একা একা ভালো না লাগে , বাবাকে বইলো , তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি রাইখা আসব ।
চট্টগ্রাম হইতে তাড়াতাড়িই ফিরছিলাম । ফিরা দেখি বাড়ি খা খা করছে । কেউ নাই । জুলেখাকে নাকি হাসপাতালে ভর্তি করছে ।
রমিজ আবারো কাঁদতে শুরু করলো । যতবারই রমিজ তার কাহিনী বলা শুরু করে , এই পর্যন্ত এলেই আর নিজেকে আটকাতে পারেনা । কাঁদুক রমিজ ।
ডাঃ শিশির নিজেই স্মরণ করেন রমিজের শেষের কথাগুলো । এর আগেও তো শুনেছেন তিনি রমিজের কাহিনী ।
রমিজ হাসপাতালে গিয়েছিল । জুলেখার তখন শেষ সময় উপস্থিত । অনেক কষ্টে কী ঘটেছে বলেছিলো জুলেখা । সে রাতেই জুলেখা সেই যে ঘুমিয়ে পড়লো আর তাকে জাগানো গেলনা ।
সে বছরেই রমিজের বাবাও মারা গেলেন । সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এলাকা ছাড়ল রমিজ । কোথায় গেলো কেউ জানেনা । বুকে নিয়ে গেলো প্রতিশোধের ঝিকি ঝিকি আগুন ।
৩।
রমিজকে খুঁজে পেয়েছিলেন ডাঃ শিশির তাঁর ইন্টার্ণশিপ ট্রেনিং এর সময় । এমবিবিএস টা হলো ডাক্তারি পেশায় বলতে গেলে ‘মাদার ডিগ্রী’ । এমবিবিএস পাসের পর বেছে নিতে হয় কোন একটি সাবজেক্টকে – বিশেষজ্ঞ হবার জন্য । মেডিকেল সায়েন্স এত বিশাল একটা ব্যাপার, কোন একজন মানুষের পক্ষে সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব না ।
ডাঃ শিশির সার্জারিকেই বেছে নেন । জীবনের দুইটি ঘটনা তাঁকে সার্জারি বিশেষজ্ঞ হতে প্রেরণা জোগায় । ঠিক প্রেরণা নয়, বলা চলে একপ্রকার ‘বাধ্য করে’ ।
এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্ণশিপ করছেন তখন শিশির । শৈশবের সেই ভয়ংকর ঘটনা ভুলেই গিয়েছিল । ভুলে থাকতেই তো চেষ্টা করে সে । কিন্তু রমিজ আবারো সেটা মনে করিয়ে দেয় । আর তখনই নতুন একটা চিন্তা মাথায় আসে শিশিরের । সিদ্ধান্ত নেয় সার্জারিতেই ক্যারিয়ার করার ।
হাসপাতালের রোগীদের সাথে অতি আপনজনের মত মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতো শিশির । হাসপাতালে আসা এই মানুষগুলো- কত অসহায় অবস্থায় আসে । কত কষ্ট । অসুস্থতার চেয়ে বড় দুঃখ আর কী ? খেতে ইচ্ছে করছে , খেতে পারছে না । পা আছে, হাঁটতে পারছে না । কারো পা-ই নেই । একজন তাগড়া মানুষ , বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে । কী কষ্ট ! গরীব হলে তার কষ্ট তো এমনিতেই আরো কয়েকগুন বেশি হয়ে যায় ।
প্রত্যেক অসুস্থ মানুষের পরিবার পরিজনের কষ্টটাও অপরিসীম । নিজে অসুস্থ না হয়ে , নিজের কেউ অসুস্থ না হলে হয়তো সেই অনুভূতিটা পাওয়া যায় না । ডাক্তাররা চেষ্টা করেন যতটুকু জ্ঞান, যতটুকু সামর্থ আছে তা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শারীরিক কষ্টটা দূর করতে । যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে ।
শিশির চেষ্টা করতো শারীরিক অসুস্থতার হিস্ট্রির বাইরে আরো কিছু জানতে । মানুষগুলোর মনের খবর জানতে । এভাবেই একদিন রমিজের কাহিনী জানতে পারে শিশির ।
তখন মেডিসিন ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট । একদিন একজন অজ্ঞান মানুষকে ভর্তি করা হলো । লোকটার পোষাক আশাক মলিন । শরীরের কোন যত্ন নেয়না বোঝাই যায় । পাগলের মত অবস্থা । এই লোক নাকি বাউল । গান গেয়ে গেয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় । আজ সকালে এই শহরের এক আসরে গান গাইছিল । মানুষজন জড়ো হয়ে গান শুনছিল । গান গাইতে গাইতেই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে । দুই-তিনজনে ধরে নিয়ে এসেছে সরকারি হাসপাতালে ।
ঐ রোগীর বেড পড়লো শিশিরের দায়িত্বে । তার ওষুধ কেনার মত টাকা পয়সাও নাই । শিশিরের উদ্যোগে ইন্টার্ণ ডাক্তাররা চাঁদা তুলে তার ঔষধের ব্যবস্থা করলো । দু-তিন দিনের মধ্যে তার খুব আপন হয়ে উঠলো শিশির । শিশির গল্পচ্ছলে জিজ্ঞেস করেছিল- আচ্ছা রমিজ ভাই, আপনি যে গান করেন- তা কোন গানটা আপনার বেশি প্রিয় ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রমিজ বলেছিল – ভাইজান, আমি শুধু একটা গানই গাই ।
- মাত্র একটা গান ? অবাক হয় শিশির ।
- হ ভাইজান ।
- কিন্তু ... কেন ? মাত্র একটা গান কেন ? গানটা আমাকে শোনাবেন ?
রমিজ বলেছিল- ঠিক আছে ভাইজান , আপনার ওয়ার্ডে যেইদিন রোগী ভর্তি হয়না সেইদিন ব্যবস্থা করেন । এই খানেই শোনামু গান । সবাই শুনবে । এরপরে আপনারে কমু ক্যান আমি খালি একটা গান গাই ।
হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ভেতরে গান – ব্যাপারটা কেমন হয় এ নিয়ে কিছুটা চিন্তায় ছিল শিশির । কিন্তু কথাটা তুলতেই ইন্টার্ণ ডাক্তাররা সবাই উৎসাহে হৈ হৈ করে উঠলো । ওয়ার্ডে রোগীরা এখন সবাই স্ট্যাবল । নন-এডমিশন ডে । কোন বাদ্যযন্ত্র নাই- শুধু একটা একতারার টুংটাং শব্দ আর খালিমুখে গান – সমস্যা নাই । অসাধারণ হবে ব্যাপারটা ।
সেদিন ইভেনিং রাউন্ডের পর রমিজ তার একতারা নিয়ে দাড়িয়েছিল মেডিসিন ওয়ার্ডের বিশাল রুমটার একপাশে । ইন্টার্ণ ডাক্তাররা পাশের দুটি খালি বেডে বসেছিল । ওয়ার্ডের বাকি রোগীরা হঠাৎ অবাক হয়ে শুনতে লাগলো রমিজের ভরাট গলায় দরদী কন্ঠের গান-
ও নদীরে ভেসে চলে, লখিন্দরের ভেলা
কন-নাগিনীর বিষে লখার , দেহ হইল কালারে...
ভেসে চলে লখিন্দরের ভেলা...
এত আবেগ দিয়ে কেউ গাইতে পারে ? চোখ বন্ধ ছিল রমিজের । চোখের কোণ হতে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুবিন্দু ।
আবেগ স্পর্শ করেছিল শিশিরকেও । নিশ্চয়ই কোন ঘটনা আছে । জানতে হবে , কী সেই ঘটনা ?
৪।
হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় রমিজকে কী বলেছিল জুলেখা ? প্রথম দিনও সেইসব কথা বলার সময় রমিজ কিছুটা কেঁদে ফেলেছিল । কিন্তু তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে সবকথাই শিশিরকে বলেছিল রমিজ ।
সেইরাতে জুলেখার ওপর পাশবিক নির্যাতন হয়েছিল । মন্ডল চেয়ারম্যানের ছেলে, আজকের চেয়ারম্যান সুমন মন্ডল তার পাঁচ-ছয়জন সাঙ্গপাঙ্গ সহ গভীর রাতে হামলে পড়েছিল রমিজের বাড়িতে । প্রথমেই তারা হাত-পা মুখ বেঁধে ফেলে জুলেখার । তারপর কয়েকঘন্টা ধরে পশুগুলো তাদের পশুত্ব ফলায় জুলেখার ওপর ।
জুলেখার শ্বশুর, রমিজের বাবার কী হয়েছিল তা জুলেখা জানতে পারেনি । অজ্ঞান জুলেখাকে সকালে হাসপাতালে ভর্তি করায় প্রতিবেশিরা । রমিজের বাবাকেও অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় । তাঁর হাত পা বাঁধা ছিল । মাথায় আঘাত ছিল । সেই আঘাতেই ঐ ঘটনার মাস চারেকের মাথায় মৃত্যুর কোলে নিজেকে সপে দেন তিনিও । একা হয়ে যায় রমিজ । বাড়ির প্রতিটি আসবাব, প্রতিটি বালুকণাও একসময় অসহ্য হয়ে ওঠে রমিজের কাছে । সবসময় শুধু জুলেখার কথা মনে পড়ে । হ্যালুসিনেশন হয় তার । সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠলে একদিন এলাকা ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় রমিজ ।
রেলস্টেশনে এক বাউল ফকিরের সাথে দেখা হয়ে যায় তার । দলে ভিড়ে যায় রমিজ । কী আছে আর এই জীবনে ? সব তো শেষ হয়ে গেলো । উস্তাদ বয়াতির সাথে থেকে একতারা বাজানো শেখে , গান শেখে । বেহুলা-লখিন্দরের গান যেন তার নিজেরই গান । সাপের বিষে লখিন্দর মারা গিয়েছিল, রমিজের বেলায় বেহুলাই মারা গেছে সাপের বিষে । এই সাপের নাম ‘মানুষ’ সাপ । সেই থেকে ঐ একটা গানই গেয়ে চলেছে রমিজ । কী দরকার অন্য গানের ?
সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো শিশির । তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের ছোটবেলার কথা ।
৫।
রাতে নিজের রুমে ফিরে শিশির তাঁর ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা বের করেছিল । পত্রিকার একটি কাটিং-এর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল । শিরোনাম- ‘ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা’ ।
খবরের বিবরণে জানা যায় – অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী শিথীকে বেশ কিছুদিন ধরে উত্যক্ত করে আসছিল স্থানীয় কয়েকজন বখাটে যুবক । গত বৃহস্পতিবার স্কুলে যাবার পথে স্কুলছাত্রী শিথীকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় মুখোশ পরিহিত বখাটেরা । পরে বিকেলে সেই ছাত্রীকে স্কুলের পাশে রেখে যায় তারা ।
পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজ ঘরে ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী শিথী । ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণ করার পর ঐ স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে বখাটেরা । অপমানে লজ্জায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে সে ।
পুলিশ অপহরনকারী বখাটদের খুঁজছে’ ।
বারকয়েক পুরনো খবরের কাগজটি পড়েছিল শিশির । শিথীর কথা খুব করে মনে পড়ছিল শিশিরের । শিথী ছিল শিশিরের কাজিন, খালাতো বোন । মনে মনে শিথীকে ভালোবাসতো শিশির । শিথীও তাই । শিশিরকে লেখা শিথীর নকশাকরা চিঠিগুলির পরতে পরতে কি তার ভালোবাসার কথা লেখা ছিলনা ?
পারিবারিকভাবেও কিছুটা কথা হয়ে ছিল । শিশির নিজেই একদিন খালাকে আম্মার সাথে আলাপ করতে দেখেছে ওদের দুজনকে নিয়ে । শিশির একমাত্র ছেলে , শিথীরও কোন ভাইবোন ছিলনা তখন । বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেবে । লজ্জাও লাগতো , ভালোও লাগতো শিশিরের । কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা শিরশিরে অনুভূতি হতো !
কিন্তু তা আর হলো কই ?
পুলিশ সেই বখাটেদের ধরেছিল । কিন্তু এই দেশে কারো বিচার হয় ? রাজনৈতিক কানেকশন আর টাকার জোরে ঠিকই ছাড়া পেয়ে যায় ওরা ।
দু-তিনটি চিঠি বের করে সেরাতে আবার চোখের জলেই ভিজিয়ে ফেলেছিল শিশির । আরো একটি নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিল সে । ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল তার । তখনই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছিল, সার্জারিতেই স্পেশালিস্ট হতে হবে ।
৬ ।
গত ছয় বছর ধরে রমিজকে সাথে নিয়ে পত্রিকা ঘেটে আরো কয়েকজনকে খুঁজে বের করেছে শিশির । যাদের নিকটাত্মীয় কেউ এমন বর্বরতার শিকার হয়েছে , কিন্তু বিচার পায়নি । তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করে নিশ্চিত হয়েছে –প্রকৃত দোষী কে ? তাদেরকে চোখে চোখে রেখেছে । প্ল্যান করেছে । কীভাবে তাদেরকে ধরা যাবে । এই দেশের আইনের প্রতি শিশিরের আর ভরসা নেই । সিদ্ধান্ত নিয়েছে- নিজেই শাস্তি দেবে এই নরপশুদের । গড়ে তুলেছে ভ্রাম্যমান অপারেশন থিয়েটার । আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার শিখিয়ে তৈরি করেছে দক্ষ স্পেশাল টিম । সেই টিম প্রথম সফল অভিযান চালিয়ে ধরে এনেছে রমিজের স্ত্রী জুলেখার ওপর নির্যাতনকারী নরপশু চেয়ারম্যান সুমন মন্ডলকে । এরপরের টার্গেট শিথীকে অপহরণকারীরা । একে একে সবাইকে শাস্তি দেয়া হবে ।
মেরে ফেললেই তো হয় ? রমিজের প্রশ্ন ছিল । সেটা নিয়ে চিন্তা করেছিল শিশির । তারপর ওদেরকে বলেছে- নাহ, আমরা খুনি হতে পারিনা । আর মেরে ফেললেতো শেষ হয়ে গেলো । আমরা বরং এমন শাস্তি দেবো ওদের, যেন জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এই নরপশুগুলোকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় । কষ্ট পেতে হয় । আমরা ওদের লিঙ্গ কেটে দেবো । অণ্ডকোষ ফেলে দেবো । হাতের আঙুলগুলো কেটে ফেলে দেবো । এই হবে ওদের দুনিয়ার শাস্তি । আর বাকিটা পরকালে পাবে ওরা ।
৭।
রমিজের কান্না থেমেছে । ডাঃ শিশিরের পাশের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে এখন । ডাঃ শিশির বললেন-
-‘ঠিক আছে রমিজ ভাই , ওকে দিয়েই আমরা আমাদের কাজ শুরু করছি । যাও , সবাইকে রেডি করো । দশ মিনিট পরে আমি আসছি’ ।
ওটিতে ঢুকে ডাঃ শিশির দেখলেন, সুমন চেয়ারম্যানকে বেঁধে ফেলা হয়েছে । এনেস্থেশিয়া ছাড়াই ,অর্থাৎ অজ্ঞান বা অবশ না করেই- চরম কষ্ট দিয়ে করা হবে এই Emasculation and Castration (লিঙ্গ কর্তন) অপারেশন । পেনিস কেটে ফেলা হবে । অণ্ডকোষও রিমুভ করা হবে । পুরোপুরি পুরুষত্বহীন করে ফেলা হবে । কেটে ফেলা হবে হাতের আঙ্গুল । বাকি জীবনটা এই নরপশুদের এভাবেই কাটাতে হবে ।
অণ্ডকোষ (Testes) ফেলে দেয়ায় এদের শরীরে হরমোনাল ইম্ব্যালেন্স হবে । ফলে ধীরে ধীরে আরো নানারকম রোগের কবলে পড়বে এই নরপশুরা ।
জীবনে যতদিন বাঁচবে, প্রতিটি মুহূর্ত এরা যেন ভাবতে বাধ্য হয়- কী ভুল জীবনে করেছিলাম ।
একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে হাতে গ্লাভস পরলেন ডাঃ শিশির ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন