এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০১৫

আবদার

-এই রিকশা যাইবা?
-যামু ।
-কত?
-রোযা রমজানের মাস, ঈদের বাজার, ন্যায্য ভাড়া দিয়েন ।
-পরে আবার ক্যাচাল করবানাতো?
-না ভাই, আপনেরা আমারে ঠকাইবেন না, হেই বিশ্বাস আমার আছে ।
ঈদে কিছু বাড়তি ইনকামের আশায় ঢাকায় এসেছে আব্বাস । পথঘাট সব যে ভালো চেনে তা নয় । যদিও গতবছরও এসেছিল সে । দিন পনেরো রিক্সা চালিয়ে কিছু টাকা নিয়ে ঈদের আগের দিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিল । নিউমার্কেট থেকে দেখে শুনে বড় ছেলেটা আর কোলের মেয়েটার জন্য জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছিল ।
এবারও সেই আশাতেই ঢাকায় আসা আব্বাসের । কয়েকটা দিন একটু বেশি কষ্ট হলেও বাচ্চাগুলো আর বউটার মুখে ঈদের দিন যদি একটু হাসি ফোটাতে পারে, সেটাই আব্বাসের জন্য চরম আনন্দ ।
আব্বাস গ্রামেও রিক্সা চালায় । কিন্তু গ্রামে রিক্সা চালিয়ে যা ইনকাম তা দিয়ে কোনরকম দিন গুজরান করা যায়, ঈদে-বরাতে বাড়তি খরচ করা যায় না । সেজন্যেই ঈদের আগে শহরে চলে আসে সে । ভাড়া নিয়ে সে কারো সাথে কোন ক্যাচালে যায় না । আব্বাস দেখেছে, যারা যাত্রীদের সাথে ক্যাচাল বাঁধায় তারা যে ভাড়া বেশি পায় তা নয় । বরং যাত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করলেই ভাড়া বেশি পাওয়া যায় । খুশি হয়ে অনেকে ভাংতি টাকা ফেরত নেয় না । কোন যাত্রী যদি অযথা মেজাজ গরম করে, আব্বাস নরম গলায় বিনয়ের সাথে বলে- স্যার আপনারা দুই চার টাকা বেশি না দিলে আমরা কই যামু?
আব্বাসের বিশ্বাস, ভদ্রলোকেরা তাঁকে ঠকাবেন না । আর কেউ যদি ঠকায় তাহলে আল্লাহ তায়ালাই তার শাস্তি দিবেন । আল্লাহ চাইলে অন্য কোন ভাবে আব্বাসকে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন । বাস্তবেও আব্বাস অনেকবার এর প্রমাণ পেয়েছে ।
রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে আব্বাস । রিকশায় বসে আছে এক ভদ্রলোক আর তার পাঁচ ছয় বছর বয়সের ছেলে । টুকটুক করে কথা বলছে তারা । খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব কথা শুনছে আব্বাস । বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় আব্বাসের । বাড়িতে তার ছেলেটা এখন কী করছে? নিশ্চয়ই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে । আব্বাসের ছেলের বয়স দশ বছর । আবির । গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফাইভে উঠেছে এবার । খুবই ভালো ছেলে । সবসময় আব্বাসের কথা শোনে । কোন কথার অবাধ্য হয় না । এমন লক্ষ্মী ছেলে পেয়ে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হয় আব্বাসের। প্রতিদিন সে ছেলেকে রিক্সায় করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে । ছেলে রিক্সায় বসে এদিক ওদিক তাকায়, আব্বাসের সাথে টুকটুক করে কথা বলে, কী যে ভালো লাগে তখন ! ছেলেটা এবার একটা ঘড়ি কিনে চেয়েছে আব্বাসের কাছে । অনেক দিন ধরেই বায়না করছিল, কিন্তু আব্বাসের উপায় ছিলনা । অভাবের সংসার, ঠিকমত ভাত কাপড়ই জোটেনা । সেখানে ঘড়ি কেনার টাকা কোথায় পাবে? নানা কথায় বুঝ দিয়ে রেখেছিল ছেলেকে । ঈদে কিনে দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল । ঈদ এসেই গেল প্রায়, আর তাছাড়া সামনে আবিরের বৃত্তি পরীক্ষা । ঘড়ি না হলে পরীক্ষার সময়ের হিসাব ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যায় । যত কষ্টই হোক, এবার ঘড়ি কিনে দিতেই হবে ।
ঢাকায় এসে আব্বাস একদিন গিয়েছিল ঘড়ির দোকানে । দাম দস্তুর কেমন জানতে । ঘড়ির দোকানদার কেমন যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল । আব্বাস অবশ্য তেমন কিছু মনে করেনি । লুঙ্গি গেঞ্জি পরা, গলায় গামছা বাঁধা একজন লোক যদি ঘড়ির দোকানে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করে, তারা অবাক হতেই পারে । কিন্তু কারও অবজ্ঞাকে পাত্তা দেয়না আব্বাস । একদিন পরেই ঈদ । চাঁদ রাতে বাড়ির পথ ধরবে সে। ছেলেটার জন্য একটা ঘড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে, এটাই শেষ কথা ।
*********
ঈদের ভোর । ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে চলেছে আব্বাস । মনটা ভীষণ খারাপ । কাঁধের ব্যাগটা যেন পাহাড়সমান । যতই বাড়ির নিকটবর্তী হচ্ছে ততই হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে আব্বাসের ।
সারারাত বাসে কাটিয়েছে । ক্লান্ত দেহে বাসের সিটে বসে ঘুমিয়েই পড়েছিল । আবিরের জন্য কেনা ঘড়িটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিল আব্বাস । সকালে যখন বাসের কন্ডাকটর ডেকে বললো যে তারা পৌঁছে গেছে, পকেটে হাত দিয়েই ছ্যাত করে উঠেছিল আব্বাসের বুক ।
ঘড়ি নেই পকেটে !
সিটের নিচে খোঁজাখুঁজি করেছিলো কিছুক্ষণ । কিন্তু পাওয়া যায়নি আবিরের জন্য কেনা ঘড়ি ।
আব্বাসের পাশের যাত্রী আগেই নেমে গিয়েছিল । যে দুএকজন তখনো নামেনি, তাদেরকে জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হলোনা । কেউ কিছুই বলতে পারলো না । আব্বাসের বুক খা খা করছে । ছেলেটা একটা আবদার করেছিল, সেটা পুরণ করতে পারলো না সে ! কী জবাব দেবে সে আবিরকে? ঐটুকু ছেলে, ঘড়ি হারিয়ে গেছে বললে বিশ্বাস করবে তো? বাবাকে মিথ্যাবাদী ভেবে বসবে নাতো?
ব্যাগের ভেতর নিজের একটা নতুন লুঙ্গি, বউয়ের জন্য একটা শাড়ি আছে । কিন্তু ছেলের জন্য কেনা ঘড়ি হারিয়ে ঐ দুটোকে এখন অনেক বড় বোঝা মনে হচ্ছে তার । ছোট ব্যাগটার ওজন যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজার টন ।
পা দুটোও খুব ভারী মনে হচ্ছে আব্বাসের । হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার । কষ্টের একটা দলা পাকানো স্তুপ যেন আটকে আছে গলার কাছে । এ এক অন্যরকম কষ্ট, কাউকে বোঝানো যাবে না ।
একজন 'পিতা'ই শুধু বোঝে, সন্তানের সামান্য আবদার মেটাতে না পারার কষ্ট ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন