এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সোমবার, ২০ আগস্ট, ২০১২

ভুল চিকিত্‍সায় রোগীর মৃত্যু : ডাক্তারকে পিটিয়েছে জনতা (জনগন ও একজন ডাক্তার- ৭)

ভুল চিকিত্‍সায় রোগীর মৃত্যু : ডাক্তারকে পিটিয়েছে জনতা

এরকম খবর আমরা প্রায়ই দেখি পত্রিকায় । ব্যাপারটা ভালো করে খেয়াল করুন । রোগীরা চিকিত্‍সা পেয়ে সুস্থ হবে এটাই সবার কাম্য । কিন্তু সবসময় যে সুস্থ হবেই এরতো কোন নিশ্চয়তা নেই । যদি তাই হতো তাহলে তো কোন ডাক্তার কখনোই মারা যেতনা !


রোগী যে সমস্যা নিয়েই আসুক মেডিকেল ট্রিটমেন্ট এর প্রথম ধাপই হলো জীবন বাঁচানো । পরে অন্য চিকিত্‍সা । রোগীর চিকিত্‍সা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর । রোগী কোন অবস্থায় কতক্ষণ পরে এলো Early নাকি Late, সমস্যার প্রকৃতি Acute না Chronic , ঠিকমত সমস্যা বলা (Proper History) , যে হাসপাতালে এসেছে তাতে লোকবল , অবকাঠামো , প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জরুরী ওষুধপত্রের মজুদ ইত্যাদি সহ আরো অনেক বিষয়ের ওপর । Patient compliance ও একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ । রোগীর আর্থিক সঙ্গতিও নজরে আনতে হয় ।

এরমধ্যে ডাক্তারের জ্ঞান- দক্ষতা- আচরণ কিংবা অবহেলা একটি অংশ মাত্র । অন্য যে ফ্যাক্টরগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো কোনটাই কিন্তু ডাক্তারের আওতার মধ্যে নেই । কিছু রোগীর আওতায় , কিছু পরিচালনাকারি প্রশাসনের কাজ । ডাক্তারের কাজ শুধু বিদ্যমান Condition এর আওতায় চিকিত্‍সা করা - যতটুকু সম্ভব সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো । কিন্তু এখন পর্যন্ত পত্রিকায় কখনো দেখলাম না যে লোকজন হাসপাতালের অবকাঠামো উন্নয়নের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছে ! কিংবা কোন কর্তাব্যক্তিকে মেরেছে ! তারা পারে শুধু কর্তব্যরত ডাক্তারকে পেটাতে । আর পত্রিকার পাতায় এই সংবাদ এমনভাবে দেয়া হয় যাতে একজন মানুষ পড়ার সাথে সাথে নিজের অজান্তে বুঝে ফেলে 'উচিত্‍ কাজ হয়েছে । সব দোষ ঐ ব্যাটা ডাক্তারের !' এ যেন এক পৈশাচিক আনন্দ ! ডাক্তারদের নিরাপত্তার পক্ষে কোন পত্রিকার সম্পাদকীয়ও এখন পর্যন্ত দেখিনি । 

ডাক্তারের কর্তব্যে অবহেলা কিংবা কোন Misconduct এর জন্য রয়েছে আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ ।এতে ডাক্তারের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে , জেলও হতে পারে । (ডাক্তারিপেশার আইনগত দিক শিক্ষার জন্য মেডিকেল কারিকুলামে ফরেনসিক মেডিসিন নামে একটি সাবজেক্ট ২ বছর পড়ানো হয় । তাতে মেডিকেল ইথিকস সহ আইনগত বিভিন্ন দিক পড়ানো হয় ।) কিন্তু সেইটা কেউ করেছে বলে শুনিনি , সবাই ডাক্তারকে পিটিয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে । স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপত্তার দিকটা এখন ডাক্তারদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের প্রতি ডাক্তারদের সহিংস আচরণ এর একটা নমুনা সূচনা বলা যায় ।

শিরোনামটা আবার দেখুন । 'ভুল চিকিত্‍সায় রোগীর মৃত্যু' ! এভাবেই সংবাদের শিরোনাম করা হয় ।চিকিত্‍সা ভুল ছিল এটা রোগীর আত্নীয় কীভাবে বুঝলেন ? সাংবাদিক কীভাবে বুঝলেন ? চিকিত্‍সায় ভুল ছিল কিনা এটা বলতে পারবেন ঐ বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্‍সক । কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো চিকিত্‍সাবিজ্ঞানের এক লাইনও না পড়েই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বিশেষজ্ঞ চিকিত্‍সক এবং বিচারকের ভূমিকা পালন করেন !

Calculated risk বলে একটা কথা আছে । মেডিকেল টার্ম হিসেবে আমরা Prognosis শব্দটি বেশি ব্যবহার করি । লাখ লাখ রোগীর ওপর দীর্ঘমেয়াদী জরিপ ও গবেষণা চালিয়ে চিকিত্‍সাবিজ্ঞানীরা এগুলো বের করেছেন । রোগীর সার্বিক অবস্থা দেখে অনেক সময় ডাক্তার বলে দিতে পারেন , রোগী কতক্ষণ বাঁচবে !

ডাক্তারের প্রতি অভিযোগ থাকলে তাঁর সাথে কথা বলা যেতে পারে , আদালতে বিচার হতে পারে । সেখানেই প্রমাণিত হবে চিকিত্‍সায় 'অবহেলা' বা 'ভুল' ছিল কিনা । কিন্তু ডাক্তার পেটানো আর নিজেই 'চিকিত্‍সায় ভুল' হওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে , ডাক্তারকে কসাই গালি দিয়ে বিকৃত পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতে থাকলে আখেরে এটা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবেনা । (সাংবাদিক ভাইদের জন্য যে মঙ্গল হবেনা সেটাতো ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে নাকি!) 

একদিন পত্রিকায় দেখলাম আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন ওয়ার্ড নিয়ে একটা রিপোর্ট । সম্ভবত প্রথম আলো তে । তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই । 
শিরোনামটা এরকম 'চমেক হাসপাতালের বারান্দায় রোগীদের দুর্ভোগঃ পরীক্ষার অজুহাত !'

মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে এমনিই চাপ বেশি থাকে । স্বাভাবিক সময়েই অনেক রোগী বেড পায়না । অতিরিক্তদেরকে তো আর বিনা চিকিত্‍সা ঘাড় ধরে বের করে দেয়া যায়না ! তাদের স্থান দেয়া হয় 'X' বেডে । অর্থাত্‍ এক্সটেনসনে- ফাঁকা মেঝেতে অথবা বারান্দায় । তো ঐদিন প্রফ অথবা এমডি পরীক্ষা চলছিল । বারান্দায় তো আগে থেকেই রোগী ছিল , পরীক্ষার জন্য আরো কয়েকজন এক্সটেনসন বেডের রোগীকে বারান্দায় পাঠাতে হয়েছিল । এমন সময় মহানহৃদয় সাংবাদিক মহোদয় উপস্থিত । এই অবস্থা দেখে তার অন্তর কেঁদে উঠল । তিনি দুএকজন রোগীর সাথে কথা বললেন । এরপর ক্ষিপ্ত হলেন । 'ব্যাটা ডাক্তাররা কসাই , অসুস্থ মানুষগুলোকে কত কষ্ট দিচ্ছে !' এরপর তিনি তার অগ্নিঝরা কলম দিয়ে লিখে দিলেন পত্রিকায় । শিরোনামটা আগেই উল্লেখ করেছি । 
বলাবাহুল্য , তিনি সব দায় মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান বেচারা এফসিপিস এমডি পিএইচডি ডিগ্রীধারী কসাই 'ডাক্তারের' ওপর চাপিয়েছিলেন !

সব দোষ ডাক্তারদের । ওদের আবার কিসের এমডি পরীক্ষা ? যত্তসব ফাউল ! পরীক্ষার নামে রোগীদের কষ্ট দেয়া ! বসার দরকার হলে ডাক্তার বারান্দায় বসবে , পরীক্ষা বারান্দায় হবে ! শুনেছি ডাক্তারদের বাড়িতে নাকি নরম বিছানা আছে । সব রক্তচোষা , কেন ওদের বাসায় বিছানা থাকবে ? ওগুলো সব হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে ।

একটা বিনোদনমূলক কথা দিয়ে শেষ করছি । একটি পত্রিকায় খবর দিয়েছে , ঈদ উপলক্ষে গতকাল শনিবার সরকারি ছুটি থাকা সত্বেও 'বিশেষ ব্যবস্থায়' খোলা রাখা হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ বিভাগ ! 

বেকুব আর কাকে বলে ! পত্রিকার নামটা শুনতে মনচায় ? তাহলে শুনুন , আপনারই প্রিয় পত্রিকা দৈনিক....। থাক , ওতে আর কাজ নেই । 

আমি পালাই । মহানহৃদয় সাংবাদিক জানলে নিশ্চিত আমার বিরুদ্ধে ভুল চিকিত্‍সার অভিযোগ তুলবেন ! কসাই-রক্তচোষা , সেতো বলবেনই !



সোমবার, আগস্ট 20, 2012
http://goo.gl/idxeW

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন