এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১২

সাম্প্রদায়িকতা জাতীয়তাবাদ বর্ণবাদ

নিজ সম্প্রদায়কে , নিজের এলাকাকে, এলাকার মানুষকে একটু বেশি ভালোবাসা মানুষের স্বাভাবিক সহজাত বৈশিষ্ট্য । এটাতে দোষের কিছু নেই বরং এটা হওয়া উচিত্‍ । কিন্তু কখন এই 'প্রীতি' সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট হয় ? 

এই বিষয়ে যাওয়ার আগে আমরা দেখি সম্প্রদায় বলতে আমরা কী বুঝি ?

সম্প্রদায় বলা যায় যেকোন একটি মানবগোষ্ঠিকে যা হতে পারে ভৌগলিক অঞ্চল , ভাষা , ধর্ম ,বর্ণ , পেশা ইত্যাদির ভিত্তিতে ।

মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য , ভাষা ধর্ম বর্ণ পেশার ভিন্নতা এটা অবশ্যম্ভাবী সত্য , বরং বলা যায় পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এমনটিই হতে হবে । কিন্তু এই ভিন্নতা কখন দোষণীয় হয়ে ওঠে ? যখন শুধুমাত্র ধর্মীয়/দেশ/ ভাষা/বর্ণ/পেশার ভিন্নতার কারণে একজন মানুষ আরেকজনের/আরেক গোষ্ঠির প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে ওঠে । বিদ্বেষাত্নক মনোভাব ধারণ করে এমনকি ক্ষতি করে বা করতে চেষ্টা করে কিংবা অপরকে উত্‍সাহ দেয় । 

বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় 'সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। 
-[বদরুদ্দীন উমর/সাম্প্রদায়িকতা/মুক্তধারা, ১৯৮০, পৃ: ৯] 

একটা উদাহরণ দেয়া যায় । ধরা যাক আমার কাছে দুজন লোককে উপস্থিত করা হলো । একজন মুসলমান অন্যজন হিন্দু । দুজনে মিলে একজন মানুষকে খুন করেছে । এখন আমি যদি উভয়ের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরে শুধু যে হিন্দু তাকে কঠোর শাস্তি দেই আর মুসলমান যে তাকে মাফ করে দেই বা লঘু শাস্তি দেই তাহলে এতে আমার সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পায় ।
কিংবা যদি একজন বাংলাদেশি আর একজন ইন্ডিয়ান সমান অপরাধ করে আর আমি ইন্ডিয়ানকে শাস্তি দিয়ে বাংলাদেশিকে বাঁচাই তাহলে এটাও সাম্প্রদায়িকতা । 

ধর্মগুলোর মধ্যে বিশ্বাস , আচার ও আইনে অনেক ভিন্নতা আছে । যেমন আমরা মুসলিমরা এক আল্লাহকে প্রভু মানি , মূর্তি-প্রতিমা তৈরিকে আমাদের জন্য 'বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত' বলে বিশ্বাস করি । আমরা একে ঠিক মনে করিনা ।
আবার হিন্দু ধর্মীয়রা মূর্তি তৈরি করে , পূজা করে । তারা তেত্রিশ কোটি দেবতায় বিশ্বাস করে । এবং গরু জবাই করা তাদের ধর্মে মহাপাপ ।

এখন দেখা যাক কখন সাম্প্রদায়িকতা বলা যাবে । আমি যখন মুসলিম হিসেবে মূর্তির অযৌক্তিকতার কথা বলি , এক প্রভুর প্রতি বিশ্বাসের কথা বলি কিংবা গরু জবেহ করি তখন কি আমাকে সাম্প্রদায়িক বলা যাবে ?
একজন হিন্দু যদি গরু জবাই করার নিন্দা করেন সেটাকি তার সাম্প্রদায়িকতা হবে ? বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার ।

আমার বিশ্বাসের কথা বলাটাই কেন সাম্প্রদায়িকতা হবে ? তাহলে বিশ্বাস ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কোথায় রইলো ? সাম্প্রদায়িকতা তখন হবে যখন আমি বা আমার গোষ্ঠি হিন্দুদের ঘরের ভেতরের পূজামন্ডপগুলো ভেঙ্গে দিয়ে আসব শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসভিন্নতার কারণে । ( ইসলাম এটা করতে বলেনা ) মূর্তি তৈরির কারণে যখন তাদের নির্যাতন করা হবে ।

আবার হিন্দুধর্মীয় কেউ বা কোন গোষ্ঠি যখন গরু জবাই করার 'অপরাধে' মুসলিমদের নির্যাতন করবে সেটাও হবে সাম্প্রদায়িকতা ।

কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো নিজনিজ ধর্মের বিশ্বাস ও প্রচারই সাম্প্রদায়িকতা নয় যদিও তাতে অন্য ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক উপাদান থাকে এবং আপাতদৃষ্টিতে তা অন্য ধর্মের কুত্‍সা মনে হয় । বর্তমান সময়ে ডাঃ জাকির নায়েক ও তাঁর কাজ এর একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে । 

আমার জানামতে মুসলিমদেরকেই সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িকতার দোষে অভিযুক্ত করা হয় । মুসলিমদের মধ্যে কেউ ধর্মের কথা বললে , মুসলিমদের প্রতি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাদের সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া হয় । অথচ মুসলিমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত হয়েছে অন্যান্য গোষ্ঠির সাম্প্রদায়িকতায় । ৪৭ এ পুর্ব পান্জাবের হত্যাযজ্ঞ , গুজরাট হত্যাকান্ড , বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞ , চীনের উইঘুর হত্যাযজ্ঞ , ফিলিস্তিন কাশ্মীর চেচনিয়া বসনিয়ার হত্যাযজ্ঞ , আসামের নেইল হত্যাযজ্ঞ , বার্মার আরাকান হত্যাযজ্ঞ সহ সাম্প্রদায়িকতাবাদী নিপীড়নের অনেক কালো অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে মুসলিমদের । এখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে চলছে মুসলিম নিধন । এসব ঘটনায় নিপীড়িত হাজার হাজার মানুষের দোষ শুধু এটাই যে তারা 'মুসলিম' । 

কয়েকদিন আগে আমি লিখলাম যে কবিগুরু রবিঠাকুর এবং বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে । তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট । এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য ।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো কয়েকজনকে দেখলাম তারা কবিগুরুর এ আচরণে দুঃখিত না হয়ে তাঁদের সাম্প্রদায়িকতার কথা বলায় আমাকেই সাম্প্রদায়িক ঠাওরালেন!! এদের দৃষ্টিভঙ্গিটা যেন এমন ,উগ্র সাম্প্রদায়িকদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সমালোচনা করাটাও সাম্প্রদায়িকতা !! 

সাম্প্রদায়িকতা , জাতীয়তাবাদ , বর্ণবাদ বিষয়গুলি আসলে একই । কিন্তু জাতীয়তাবাদ নাকি অনেকের কাছে 'আদর্শ' ! জাতীয়তাবাদ কীভাবে আদর্শ হয় আমার বুঝে আসেনা । জাতীয়তাবাদ যদি আদর্শ হয় তাহলে সাম্প্রদায়িকতা কি দোষ করলো ? 

একইভাবে বর্ণবাদও এক ধরণের সাম্প্রদায়িকতা । শরীরের বর্ণকে ঘৃণা করে মানুষকে দুরে সরিয়ে রাখা , নির্যাতন করা ।

যাহোক , আসুন আমরা সারাবিশ্বের সকল উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই । পাশে দাঁড়াই মজলুমের ।



বৃহস্পতিবার, আগস্ট 23, 2012
http://goo.gl/pB7pL

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন