এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

নেশা



রাত প্রায় বারোটা বাজে । এখনো চেম্বার থেকে বের হতে পারিননি ডাঃ আব্দুল্লাহ  । পিএস জানালো, আরো একজন রোগী আছে । নাহ । আজও বাসায় ফিরতে সাড়ে বারোটা বাজবে ।
অবশ্য যত রাতই হোক , সারাদিন যত কষ্টই হোক- বাসায় ফিরে তার কোনকিছুই মনে থাকেনা । আরো কারণ আছে, কিন্তু আপাতত যে কারণটা তিনি অনুভব করেন- আলেয়ার হাসিমাখা মুখ ।
বিয়ের প্রায় চল্লিশ বছর হয়েছে , দুজনেরই বয়স ষাটের কোঠায় । আজো আলেয়ার মুখের হাসিটুকু যেন এতটুকু মলিন হয়নি । সে জানে , কী করে মুখের হাসিতে মুহূর্তেই উড়িয়ে দেয়া যায় দিনের সব কষ্ট !  

পিএস রুমে ঢুকে বললো,
-  স্যার , শেষজনকে কি পাঠাবো ?
-               -  হ্যা, পাঠাও ।

তিনি ভালো করে কোটের ওপর চাঁদরটা পেচিয়ে নিলেন। এই শেষজনকে দেখেই আর দেরি করবেন না । আর বাইরে ঠান্ডাও অনেক । ছোট হাতব্যাগটাতে কলম, চশমা, ওষুধ সবকিছু আছে কিনা দেখে নিচ্ছিলেন । এমন সময়েই দরজা খুলে উঁকি দিল একটা ছেলের মুখ ।
-      ‘আসসালামু আলাইকুম । স্যার, আসবো ?’
-      ‘ওয়ালাইকুম সালাম । এসো’
একনজরে দেখে নিলেন তিনি ছেলেটাকে । ডাক্তার হিসেবে এটা তাঁর প্রথম কাজ । প্রথম দেখাতেই অনেক কিছু বুঝে নিতে হবে । পেশেন্টের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন , হাঁটা-চলার ভঙ্গি , পোষাক আষাক, আচার-আচরণ, কথা বলার ভঙ্গি । পুরুষ হলে হ্যান্ডশেক । এসব থেকেই অনেক রোগের অর্ধেক ডায়াগনোসিস হয়ে যায় । বাকি থাকে শুধু কিছুটা হিস্ট্রি, কিছুটা ক্লিনিকাল এগজামিনেশান আর কিছু ল্যাবরেটরি টেস্ট করে ডায়াগনোসিস কনফার্মেশন । 

ছেলেটার পায়ে কালো কেডস,  পরণে নীল জিন্সের প্যান্ট, হোয়াইট অফ কালারের একটা জ্যাকেট গায়ে । গলায় মাফলার নেই, চোখে চশমা নেই । বাচ্চা বাচ্চা চেহারা ।
-      ‘স্যার কেমন আছেন ?’ হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা ।
-      ‘আছি আলহামদুলিল্লাহ্‌’ । তুমি কেমন আছ ?
-      ‘ভালো স্যার । বেশ রাত হয়ে গেছে স্যার । আপনাকে বিরক্ত করছি...অবশ্য এসেছি আগেই । আমি কি স্যার আরেকদিন আসবো ?’
ছেলেটা বেশ বিনয়ী । দেখে মনে হচ্ছে না কোন অসুখ আছে । তবে এর সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছে ।
-      ‘না না । আরেকদিন কেন আসবে ? তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছেনা কোন অসুখ আছে’ ।
-      ‘স্যার আমি আপনার ছাত্র । কিছুদিন হলো ইন্টার্ণশিপ শেষ করেছি । আসলে স্যার আপনার কাছে আমি কিছু পরামর্শের জন্য এসেছিলাম’ ।
-      ‘হুম । এতক্ষণে বুঝলাম’ ।
ডাঃ আব্দুল্লাহ তাঁর পিএসকে ডেকে দু’কাপ কফি দিতে বললেন । চেম্বারেই কফি মেকার মেশিন আছে । তিনি চা পছন্দ করেন না । কফি-ই পছন্দ । ছেলেটা এসেছে , কিছুটা গল্প করা যাক । সত্যি বলতে কি- জীবনতো বলতে গেলে শেষের পথে । এখন জীবনের গল্পগুলো কারো সাথে শেয়ার করতে ভালোই লাগে । তার ওপর যদি ইয়াং জেনারেশনের কেউ হয় তাহলে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো বলে যাওয়াটাকে দায়িত্ব মনে হয় ।
কফি চলে এসেছে । একটা চুমুক দিয়ে তিনি বললেন –
-      ‘আচ্ছা, এবার বলো , কী প্রশ্ন তোমার ?’
-      ‘স্যার – আর তো পড়াশুনা করতে ভালো লাগে না । আপনারা কীভাবে করেন জানিনা । এত কষ্ট- পড়াশোনা, ট্রেনিং, হাসপাতাল, চেম্বার । এত কষ্ট ভালো লাগেনা স্যার । আমার শুধু মনে হয়- আমি পারবো না এতকিছু করতে’ ।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললো ছেলেটা । যেন এসব কথা আটকে ছিল ওর  গলার কাছে । অনুমতি পেয়েই উগরে দিল । 

একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন ডাঃ আব্দুল্লাহ । যেন শক্তি সঞ্চয় করলেন । তাঁর শ্বাস নেবার শব্দটা শোনা গেল বাইরে থেকেই । পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর । এরকম সময়ের কথা – এই ছেলেটার মত বয়স ছিল যখন । আজ ওকে বলতে হবে সেইসব কথা । এইরকম বয়সে সবাই যেন হঠাৎ করে একটা অথই সমুদ্রে হাবুডুবু খায় । এমন একটা ঘরের মাঝখানে নিজেকে মনে হয়- যার অনেকগুলো দরজা আছে । কোন একটা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়তে হবে । কিন্তু সেটা কোথায় গিয়ে থামবে, কবে থামবে , কতদূর পথ পাড়ি দিতে হবে , শেষে কতটা সুখ আছে কি আদৌ নেই তা জানা নেই । কোন দরজাটা ভালো হবে কে জানে ! যেন এক অনিশ্চিত যাত্রার প্রারম্ভিকা ।
-      ‘আমি তোমাকে কোন পরামর্শ দেবোনা । নিজের জীবনের ব্যাপারে সবাই নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে । তুমিও নেবে । নিতে তোমাকে হবেই । আমি শুধু তোমাকে বলবো আমার কথা’ ।
বলতে শুরু করলেন ডাঃ আব্দুল্লাহ ।
-      ‘উড়ুউড়ু মন ছিলো আমার । কোথাও বেশিক্ষণ ভালো লাগে না । এখানে সেখানে ঘুরতে ভালো লাগতো । মুক্ত-স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে ভালো লাগতো । তোমার মতই আমিও ভেবেছিলাম- নাহ, ডাক্তারি করবো না । বরং আমার যে মেধা আছে- আমি চাইলে সরকারের যেকোন ক্যাডারে ঢুকে যেতে পারবো । সচিব-আমলা-রাষ্ট্রদূত হতে পারবো । রাজনীতি করলে মন্ত্রী হতে পারবো । খুব বেশি আত্মবিশ্বাস ছিল । ছোটবেলা থেকেই সবখানে বিজয়ী হয়ে এসেছি ।
বাবা-মায়ের ইচ্ছায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম । তোমার মতই একসময় পাস করে বের হলাম । ভেবেছিলাম, ইন্টার্ণশিপই করবো না । ডাক্তারিই যখন করবো না , ইন্টার্ণশিপ করেই আর কী করবো । একদিন বাবাকে বললাম, আমি ডাক্তারি করবো না । আমি সরকারের অন্য ক্যাডারে যোগ দেব । নয়টা চারটা ডিউটি করবো , সরকারের বাসায় থাকবো, সরকারের গাড়িতে চড়বো , সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি থাকবে , লোকজন আমাকে দেখে স্যালুট দিতে দিতে অস্থির হয়ে যাবে । আমি অফিসে বসে বসে ফাইল সই করবো, বড় বড় প্রোগ্রামে অতিথি হয়ে গিয়ে ভাষণ দিয়ে আসবো । টেলিভিশনের টকশোতে বক্তব্য দেবো বুদ্ধিজীবি হিসেবে ।  ডাক্তারি করে আমার কী লাভ ? দিন নাই, রাত নাই – মানুষের চিকিৎসা করো । এটা একটা জীবন হলো ? এত চিকিৎসা করেই বা কী লাভ ? একদিন তো মরতেই হবে সবাইকে ।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, পরে যা করার করিস । এখন ইন্টার্ণশিপটা অন্তত কর । ধর, আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম । তখন তুই কী করবি ? চিকিৎসার শুরুটা তো তোকে করতে হবে নাকি ? আর প্র্যাকটিস করিস বা নাই করিস, অন্তত রেজিস্ট্রেশনটা করে রাখতে অসুবধা কী ?

কথাটা খুব যুক্তিযুক্ত মনে হলো । বাবা ঠিকই বলেছেন । শুরু করলাম হাসপাতালে ডিউটি । ট্রেনিং । ছাত্র অবস্থা আর ডাক্তার অবস্থার মধ্যে অনেক তফাৎ । বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিভিন্ন ধরণের রোগী আসে । তুমি তো জানোই । কারো বুকে খুব ব্যথা , এখনি মারা যাবে অবস্থা । কারো পেটে ব্যথা । কারো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে , কষ্ট হচ্ছে খুব । কেটে গেছে শরীর- গলগল করে রক্ত ঝরছে । হাত-পা ভেঙ্গে গেছে । মাথা ফেটে গেছে । কত রকমের কষ্ট মানুষের । কত দুঃখ মানুষের । তুমি তো দেখেছ সব ।
দিনরাত ছোটাছুটি । ডায়াগনোসিস করো, চিকিৎসা দাও । রক্ত দাও । পেইন কিলার দাও । এন্টিবায়োটিক দাও । স্টেরয়েড দাও ।  সিপিআর দাও । শক দাও । কেমোথেরাপি দাও । ডেলিভারি করো । বাচ্চার জীবন বাঁচাও । গরীব রোগীর টাকা নাই, বন্ধুরা চাঁদা তুলে দাও । রক্ত ম্যানেজ হয়নি , ম্যানেজ করে দাও । জুনিয়রদের ফোন করো কার ব্লাড গ্রুপ কী । সে এক কঠিন সংগ্রামের জীবন । ঠিকমত নাস্তা করা হয়না । দুপুরের খাবার খেতে খেতে আসরের আযান হয়ে যায় । রাতের পর রাত পার হয়ে যায়- বিছানার ছোঁয়া পায়না শরীর ।
রোগীকে বুঝাও, রোগীর এটেন্ড্যান্টকে বোঝাও । মানুষের দুর্ব্যবহার হাসিমুখে সহ্য করো , নিজেকে বোঝাও ‘ওরা অবুঝ’ ।

এতোকিছু ।
এতকিছুর পরে একজন রোগী যখন ভালো হয়ে যায় , যখন একটা জীবন ফিরে আসে অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে , যখন একটা জীবন ফিরে আসে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তখন শুধু মনে হয় – জীবনটা স্বার্থক ।
তারপর ছাড়পত্র দেই । হয়তো তখনো কোন রোগীর চোখে, রোগীর আত্মীয়দের চোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ দেখা যায়না , হয়তো তখনো কেউ কেউ ছাড়পত্রটা হাতে নিয়ে ফিরে যাবার সময় বলে ফেলে ‘ডাক্তাররা কসাই’ । তবু ভালো লাগে । কারণ , আমি জানি – এই লোকের হাতে দুনিয়া হতে চলে যাবার ছাড়পত্র চলে এসেছিল । কিন্তু আমরা লড়াই করে সে ছাড়পত্র কেড়ে নিয়ে তাঁর হাতে আজ ধরিয়ে দিলাম হাসপাতাল ছাড়ার ছাড়পত্র । নিজ ঘরে ফিরে যাবার ছাড়পত্র ।

আমার ভালো লেগে গেল । বোঝার চেষ্টা করো- মানুষ হয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর যে আনন্দ- আমি হঠাৎ সেটা পেয়ে গেলাম । আমার নেশা ধরে গেল । মানুষের জীবন বাঁচানোর নেশা । নিজের জীবনে হয়তো আর সুখ থাকলো না , কিন্তু তবু আমি সুখ পেতে লাগলাম । এই সুখ বর্ণনা করা যায় না ।
এইযে দেখো, রিটায়ার করেছি । ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত । আমার নিজেরও টাকা-পয়সার অভাব নেই । চাইলে আরো অনেক বছর আমি বসে বসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি- যদি বেঁচে থাকি কিন্তু দেখো, এখনো রাত বারোটা পর্যন্ত রোগী দেখি । ফি নিচ্ছি বটে, কারণ ফি না নিলে আমাদের দেশে মান থাকে না । তাও কত টাকাই বা ফি নিচ্ছি ? দু’শো, তিনশো ? অথচ এই লেভেলে আমার ফি হবার কথা কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা । গরীব রোগীদের গোপনে ওষুধ কিনে দেই । এখনো গভীর রাতে কেউ কল করলে চেষ্টা করি পরামর্শ দেবার । হয়তো আমার একটা কথায় বেঁচে যাবে একটা জীবন । একটা স্বপ্ন । বুঝলে – এটা একটা নেশা । টাকার নেশা নয়- কারণ আমার তো আর টাকার দরকার নেই । আমার তো জীবন চালানোর মত সবই আছে । এটা মানুষের কষ্ট লাঘবের নেশা । মানুষের জীবন বাঁচানোর নেশা । ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ এই কাজ করতে পারে না’ ।

কফি শেষ হয়ে গিয়েছিল । চোখে সামান্য ঝাপসা দেখছিলেন ডাঃ আব্দুল্লাহ । কথা বলতে বলতে চোখটা কি সামান্য ভিজে উঠেছে ? সুখে ? সারাজীবন শত শত মানুষকে সুস্থ করেছেন, জীবন বাচিয়েছেন – সেই সুখে ? 
তিনি টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিলেন । চোখটা মুছে চশমাটা পড়লেন । বাসায় যেতে হবে । ছেলেটা বসে আছে সামনে । একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ডাঃ আব্দুল্লাহর দিকে । ওর চোখটা স্থির, কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় - ভেতরে বয়ে যাচ্ছে ঝড় ।  কী ভাবছে সে ? কী সিদ্ধান্ত নেবে সে ?


https://www.facebook.com/muhsin.abdullahmu/posts/10200635866412988

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন