এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

নারী নেতৃত্ব হারাম ?-১৫

নারী নেতৃত্বকে ঢালাওভাবে সরাসরি হারাম যারা বলে থাকেন তারা তাঁদের পক্ষে সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতের একটি ভগ্নাংশ খুব জোরালো যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন । এতে বলা হয়েছে-
‘পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল’ । -নিসাঃ ৩৪
কিন্তু তাঁদের এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় ।
১।
এটি আয়াতের একটি ক্ষুদ্র অংশ । এটুকু উল্লেখ করে বাকিটা এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই । কিন্তু সেটাই করা হয় । আয়াতের পূর্বাপর ধারাবাহিকতা এবং পুরো আয়াতের বক্তব্য আমলে না নিলে ভুল অর্থ আসাটা খুবই স্বাভাবিক । যেমন- কেউ যদি বলে, পবিত্র কুরআনে আছে-‘তোমরা নামাজের ধারেকাছেও যেও না’ । অথচ এর আগের শব্দগুলি উল্লেখ করা নাহয় যেখানে বলা হয়েছে- ‘মদ্যপ অবস্থায়’ , তাহলে কি এই অর্থ গ্রহণ করার কোন সুযোগ আছে ?
আয়াতটা নাজিল হয়েছে বিয়ে, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক অর্থনৈতিক বিষয়কে সামনে রেখে । পুরো আলোচনাটি দেখুন-
“আর তোমরা আকাঙ্ক্ষা করো না এমন সব বিষয়ে যাতে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। পিতা-মাতা এবং নিকটাত্নীয়গণ যা ত্যাগ করে যান সেসবের জন্যই আমি উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। আল্লাহ তা’আলা নিঃসন্দেহে সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন। পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে । সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযত যোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না । নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত।” -নিসাঃ ৩২-৩৫
আয়াতে নারী নেতৃত্বকে হারাম/নিষেধ করা হয় নি । সাধারণভাবে এটা বলা হয়েছে যে- যেহেতু পুরুষেরা উপার্জন করে এবং পরিবারের জন্য খরচ করে তাই তারা কর্তৃত্বশীল । এছাড়া চরিত্রগতভাবে পুরুষেরা বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে । হরমোনগত/শারিরীক বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরুষরা হয় বেশি আগ্রাসী মানসিকতার ।
আর পুরুষেরা যে স্বভাবগতভাবে কর্তৃত্বশীল মানসিকতা লালন করে তার একটি প্রমাণ এটাও যে- পুরুষেরা যেকোন মূল্যে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ঘোষণা করতে বদ্ধপরিকর !
২। এই আয়াতে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে – বাংলায় ‘কর্তৃত্বশীল’ অনুবাদ করা হলেও ইংরেজী বিভিন্ন অনুবাদে তার অর্থ করা হয়েছে protector, maintainer । নেতা বা শাসক নয় । কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে, 'কাওয়াম'। এমন এক ব্যক্তিকে 'কাওয়াম' বা 'কাইয়েম' বলা হয়, যে কোন ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠানের বা ব্যবস্থাপনার যাবতীয় বিষয় সঠিকভাবে পরিচালনা, তার হেফাজত ও তত্বাবধান এবং তার প্রয়োজন সরবরাহ করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল হয়।
স্বভাবতই যিনি অর্থনৈতিক যোগান দেন তিনিই হন যেকোন প্রতিষ্ঠানের ‘কাওয়াম’, আর এ কারণটিই বলা হয়েছে এই আয়াতে । একটা পরিবারে যদি ‘মা’ বা ‘বড় বোন’ হন অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি- তাহলে ঐ পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ থাকলেও ‘কাওয়াম’ হবেন ‘মা’ অথবা ‘বড় বোনই’ – এটাই স্বাভাবিক ।
৩ । অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন-
“আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।” -তাওবাঃ ৭১
এখানে দেখুন নারী ও পুরুষকে পরস্পরের সহযোগী বলা হয়েছে । সত্যিকারার্থে এটিই নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সাধারণ বক্তব্য । এখানে পুরুষকে নারীর ওপর ‘প্রভুত্ব’ দেয়া হয়নি, কিংবা নারীকেও ‘দেবী’ বানিয়ে দেয়া হয়নি । তারা মঙ্গলের জন্য পরস্পরের সহযোগী হবে- এটাই আল্লাহর ইচ্ছা । আরো কয়েকটি আয়াতে নারী-পুরুষের পরস্পরের ওপর সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে ।
৪।
সুরা নিসার ঐ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহীমুল কুরআন, মা’আরেফুল কুরআন, তাফসীর ইবনে কাছির – কোন তাফসীরেই এই অর্থ গ্রহণ করা হয়নি যে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ।
মা’আরেফুল কুরআনে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বরং বলা হয়েছে যে- এর দ্বারা এটা বুঝায় না যে- পুরুষ নারীর ওপর জোর জবরদস্তি করে ক্ষমতা চর্চা করবে ।
৫।
আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল সাঃ কে জিজ্ঞেস করলো- কে আমার কাছ থেকে বেশি সদাচরণ পাবার হকদার ? রাসুল সাঃ বলেন- তোমার মা, অতঃপর তোমার মা, অতঃপর তোমার মা । অতঃপর তোমার বাবা ।
এখানে কী দেখছি আমরা ? পুরুষকে কি নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে ? না, বরং নারীকে পুরুষের ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে । আর এটা এজন্য যে- সন্তান জন্মদান ও আদরে ভালোবাসায় লালন পালনে মায়ের ভূমিকাই বেশি । সেজন্য এক্ষেত্রে মায়ের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মা-কে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে । একইভাবে সুরা নিসার ঐ আয়াতে পুরুষের কর্তৃত্বশীলতার কথা বলা হয়েছে – এবং সাথে সাথে এর কারণ হিসেবে স্পষ্ট উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে ‘পুরুষরা উপার্জন করে ও ব্যয় করে’ ।
৬।
যারা ঢালাওভাবে পুরুষদেরকে নারীর ওপর কর্তৃত্বশীল বা শ্রেষ্ঠ বলতে চান- তাঁদের কাছে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে – একজন মু’মিন মুত্তাকী নারীর চেয়েও একজন মুশরিক-কাফির পুরুষ শ্রেষ্ঠ হবে – শুধু এ কারণে যে সে ‘পুরুষ’ ?
পুরুষ হবার কারণে হযরত আছিয়ার ওপরে ফেরাওনই কি শ্রেষ্ঠ হবে ? সুমাইয়া (রাঃ) এর চেয়ে কি একজন কাফির পুরুষ শ্রেষ্ঠ হতে পারে ?
অথচ বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে নবী করীম সাঃ বলেছেন- ‘অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতাও এক; সুতরাং কোন অনারবের উপর কোন আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই । সাদার উপর কালোর কিংবা কালোর ওপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই । তাকওয়া ও পারহেজগারী হল মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড’ ।
এ থেকেও প্রমাণিত হয় , শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি সাদা-কালো-আরব-অনারব-নারী-পুরুষ ভেদে নয়, তাকওয়ায় ।
৭।
রাসুল (সাঃ) এর স্ত্রী খাদিজা(রাঃ) নিজেও একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন । বলা যেতে পারে-একসময় স্বয়ং রাসূল(সাঃ) খাদিজার(রাঃ) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, তাঁর অধীনে কাজ করেছেন । এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা । তাই বলে কি রাসুল (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্বের কোন ঘাটতি হয়েছে ?(নাউযুবিল্লাহ)
রাসুল (সাঃ) এর যুগের সামাজিক বাস্তবতায় নারীদের যে অবস্থা ছিল , সে অবস্থায়ও মুসলিম নারীরা সবধরনের কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেছেন । মসজিদে-ঈদগাহে নামাজ পড়েছেন । আর এখন নারীদের ঘরে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয় ! ইসলামের মৌলিক ইবাদতে কি নারী-পুরুষে কোন পার্থক্য করা হয়েছে ? নারীদের জন্য কি হজ্ব, যাকাত, রোযার ফরজিয়াত থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে ? হয়নি ।
সুতরাং নারীদের ওপর ছড়ি ঘুরানোর পুরুষতান্ত্রিক খায়েশকে অযথাই ইসলামের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা । শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা কর্তৃত্ব পেতে চান- তাকওয়া এবং যোগ্যতা-দক্ষতায় এগিয়ে যান । পুরুষ হওয়ার দোহাই দিয়ে নয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন