নভেম্বরের মাঝামাঝি । শীত পড়া শুরু হয়েছে । সেজন্য
অবশ্য চিন্তা নেই , গায়ে চাঁদর আছে মুনিরের । মুনিরের সাথে আছে ওর দাদা ডাঃ
আব্দুল্লাহ । একমাত্র নাতিকে
নিয়ে তিনি বসে আছেন নির্জন এই এলাকায় । ধূধূ প্রান্তর , কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই ।
আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ । আলোয় ভরে
গেছে চারপাশ । ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক কানে আসছে । দূরে কোথাও থেকে মাঝে মাঝে
ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ।
মাথার ওপর ছোট্ট তাঁবু । ঠিক তাঁবু বলা যায় না । এটাকে
স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ধুরা’ । ধান কাটার পর পাহারা দেয়ার জন্য চারটে খুঁটির ওপর ধানসমেত কাটা ধানগাছ দিয়ে
বানানো হয় চালা । কোন দেয়াল নেই । নিচে মাটি আর উপরে ধানগাছের চালা ছাড়া সবদিকেই
খোলা । কাথামুড়ি দিয়ে ধানগাছের বালিশে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে
দেখা যায় আকাশ । আকাশের তারার মেলা, মাঝে মাঝে ছুটে আসা উল্কা । আর এরকম চাঁদনী রাত
হলে তো কথাই নেই । এ যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ ।
যতদূর চোখ যায় শুধু ধানক্ষেত । এখন অবশ্য বেশিরভাগ জমির
ধানই কাটা হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে এরকম ছোট্ট চালা বানিয়ে পাহারা দিচ্ছে লোকজন ।
একটু পরপর হাক ছাড়ে- ‘ঐ
কে রে হাহ ?’
এর মাধ্যমে জানান দেয়া হয়- আমরা জেগে আছি, চোরেরা যেন না আসে । প্রত্যেক তাঁবুতেই
টর্চলাইট থাকে । মাঝে মাঝে বিনা কারণেই টর্চের আলো ফেলা হয় এদিক-সেদিকে । সেই একই
উদ্দেশ্য, চোরদের সতর্ক করা । ‘আমরা কিন্তু জেগে আছি’ ।
ডাঃ আব্দুল্লাহ ও মুনির যে তাবুতে আছেন সেটার একটু দূরে
একটা বাঁশঝাড় । ওখানে একটা কবরস্থানও আছে । বাড়িঘরগুলো আর আগের মত নেই, কিন্তু
তবুও সেই পুরনো আবেশটা একেবারে হারিয়েও যায়নি ।
-
‘বুঝলে দাদুভাই, আমরা গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ।
এই জমিগুলো আমার দাদার আমলের । সেই থেকে এই জমিগুলোতে ধান চাষ করা হয় । এই জমির ধানের
ভাত খেয়ে বড় হয়েছি । তোমাদের মত বয়সে ধান কাটা, গরুর
গাড়িতে করে ধান বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, স্তুপ করে রাখা সেইসব কাজ দেখাশোনা করেছি ।
নিজেও কাজ করেছি । জীবনের ভিত্তিটা এখানেই । রাতের বেলা এরকম করে ধান পাহারা
দিয়েছি । আর সকালবেলা ফযরের নামাজ পড়েই গরম গরম ভাপা পিঠা খেয়েছি কাঁচা মরিচ আর
লবণ মিশিয়ে । ঐ যে বাড়িটা দেখছো – ওখানেই আমরা পিঠা খেতে যেতাম । আমি, বড় ভাই, জ্ঞাতি
চাচারা, আমাদের বাড়ির চাকর কাওছার ভাই । চাকর বলছি- কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতাম
ভাইয়ের মতই’ ।
চুপ করলেন ডাঃ আব্দুল্লাহ । ভাবলেন , অনেক্ষণ তো বসে
থাকা হলো । এবার শুয়ে শুয়ে গল্প করা যাক । মুনিরকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি । মুনীর
ক্লাস নাইনে পড়ে । বার্ষিক পরীক্ষা শেষ । মুনীরের দাদু ডাঃ আব্দুল্লাহ ওকে খুব
পছন্দ করেন । তিনি প্রায়ই বলেন, এইভাবে শুধু শহরে থেকে বাসা আর স্কুল যাওয়া আসা
করতে থাকলে জীবনকে উপলব্ধি করতে পারবা না । জীবনকে চিনতে হবে গোড়া থেকে । তবেই
উপলব্ধি করতে পারবে জীবনের আসল রূপ ।
এজন্য তিনি মুনীরকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যান । কখনো
গ্রামে , কখনো শহরের বস্তিতে । কখনো রেলস্টেশনের ভাসমান টোকাইদের আস্তানায় । জীবনের নানান রুপ দেখান তিনি মুনিরকে । মুনিরেরও
খুব ভালো লাগে । আজ মুনিরকে নিয়ে তিনি এসেছেন গ্রামে, ধানক্ষেতে । ধান কেটে রাখা
হয়েছে । পাহারা দেবার জন্য ‘ধুরা’
তৈরি করা হয়েছে । সেখানেই এখন শুয়ে আছে ওরা । আজ রাতটা এখানেই কাটাবে ।
মুনির বললো , ‘দেখেছ দাদু, ঐ বাঁশঝাড়টায় কী অন্ধকার’ ।
ডাঃ আব্দুল্লাহ যেন উৎসাহ পেলেন । তিনি আবার বলতে শুরু
করলেন,
-
সবাই বলতো , ঐ বাঁশঝাড়টাতে জ্বিনের
আনাগোনা আছে । অনেকে নাকি রাত দুপুরে সাদা ঘোড়ায় চড়ে লম্বা লম্বা সাদা আলখেল্লা
পড়া লোকদের এই বাঁশঝাড়ে ঢুকতে দেখেছে । আদৌ কেউ কোনদিন দেখেছিল কিনা কে জানে,
কিন্তু কথায় কথায় সেই গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল মুখে মুখে । ঐ বাশঝাড় থেকে কেউ বাঁশ কাটতো
না । এখনো বোধ হয় কাটেনা । সেজন্যেই তো এত ঘন অন্ধকার ওখানে ।
একবার কী হলো শোন , তখন আমি ক্লাস
এইটে । বার্ষিক পরীক্ষা , বৃত্তি পরীক্ষা শেষ । এদিকে ধান কাটা শুরু হয়েছে ।
সুতরাং আমাকে আর পায় কে । আমি দিনরাত ধানক্ষেতে সময় কাটাই । হাতে থাকে শরৎচন্দ্র
অথবা বিভূতিভুষণের কোন উপন্যাস । একটা রেডিও । রেডিওতে গান শুনি, আর গল্পের বই পড়ি
। সন্ধ্যে হলে ঐ পাড়া থেকে এক বুড়োমত লোক আসতো – তাঁকে আমি দাদা বলে ডাকতাম । তিনি
আমাকে গল্প শোনাতেন । তাঁর নামটা পরে জেনেছি – শমশের দাদা । কেন যেন আমাকে খুব
ভালোবাসতেন তিনি । হয়তো তাঁর কথা বলার খুব বেশি কেউ ছিলনা । অথবা কেউ আর তাঁর গল্প
শুনতে চাইতো না । কিন্তু আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম । জোলা জুলির গল্প, গাজী কালু
চম্পাবতীর গল্প ।
মাঝে মাঝে পুঁথির সুরে আবৃত্তি করতেন,
আর আমাকে সহজ বাংলায় কাহিনী শোনাতেন ।
মুকুট রাজার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়
বৈরাগনগরের সিকান্দর শাহর ছেলে গাজীর ভাই কালু । কালুকে বন্দী করে রাজা । সেজন্য
রাজার সাথে গাজীর যুদ্ধ বাঁধে-
‘সাত
শত গাড়ল লয়ে
দাবার ঘাট পার হয়ে
গাজী চলিলেন খুনিয়া নগরে
খুনিয়ানগরে যেয়ে মুকুট রাজার মেয়ে
গাজী বিয়া করিলেন কৌশল্যা সুন্দরী।
গাজী চলিলেন খুনিয়া নগরে
খুনিয়ানগরে যেয়ে মুকুট রাজার মেয়ে
গাজী বিয়া করিলেন কৌশল্যা সুন্দরী।
চম্পাবতীর মা চম্পাকে গাজীর হাতে তুলে
দিলেন –
বড় আহ্লাদের মোর কন্যা চম্পাবতী
সাতপুত্র মধ্যে সেই আদরের অতি।
তার প্রতি দয়া তুমি সদয় রাখিবা
অনিষ্ট করিলে কোন মার্জনা করিবা ।
সাতপুত্র মধ্যে সেই আদরের অতি।
তার প্রতি দয়া তুমি সদয় রাখিবা
অনিষ্ট করিলে কোন মার্জনা করিবা ।
চম্পাবতীর রুপে গাজী বেহুশ হয়ে গেলেন-
জ্বলিতেছে রূপ যেন লক্ষ কোটি
শশী
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেনিয়া
মুর্ছিত হইয়া গাজী পড়িল ঢলিয়া।
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেনিয়া
মুর্ছিত হইয়া গাজী পড়িল ঢলিয়া।
প্রতিবছরই এই সময়ে তাঁর কাছে গল্প
শুনতাম । তারপর পড়াশোনার জন্য আমি শহরে চলে গেলাম । তাঁর সাথে আর দেখা হয়নি । আজও যেন কানে বাজছে সমশের দাদার কন্ঠ । তিনি আর
নেই- ঐ বাঁশঝাড়ের পাশেই তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে ।
এই দেখো –
বয়স তো আমারও কম হলো না । কী বলতে গিয়ে কী বলি । কত কথাই তো মনে পড়ছে । যাহোক,
যেকথা বলছিলাম – সেদিনও রাত দশটা পর্যন্ত গল্প
শুনেছি । বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার এনেছে বড় ভাই । খেয়ে দেয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছি ।
সে রাতেও ছিল এরকম পুর্ণিমা । আমার যখন ঘুম ভাংলো, তখন চাঁদের
আলোয় চারদিক প্লাবিত । দেখে মনে হয় যেন সকাল হয়ে গেছে । দেখলাম বড় ভাইও পাশে নেই ।
ভাবলাম, বোধহয় ফযর হয়ে গেছে । ভাই হয়তো মসজিদে গেছেন নামাজ পড়তে । সাধারণত
আমরা মসজিদে ফযরের নামাজ পড়ে ভাপা পিঠা
খেতে যাই ।
আমি নিজের মত করে হাঁটতে লাগলাম ।
আমার যাওয়ার কথা মসজিদের দিকে, কিন্তু আমি নিজের অজান্তে হাঁটছিলাম ঐ বাঁশঝাড়ের
দিকে । জ্বিনের বাসা ওখানে । হাঁটছি তো হাঁটছিই... কোনদিকে খেয়াল নেই । প্রায়
বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি এমন সময় বড় ভাই কোত্থেকে এসে খপ করে আমাকে ধরে
ফেললো । এই কোথায় যাস তুই ? আমি বললাম, কেন- মসজিদে যাই । দেখোনা –
সকাল হয়ে গেছে !
ভাই আমাকে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে
গেলেন আবার তাঁবুতে । বলছিস কি তুই হ্যা ? এখন তো কেবল রাত তিনটা বাজে ! ঐ দ্যাখ
চাঁদের আলো । আর মসজিদ তো উল্টাদিকে , তুই ঐদিকে যাচ্ছিলি কেন ? ভাগ্যিস, আমি ঠিক
সময়ে তোকে ধরেছি । নইলে আজ নিশ্চিত তোকে জ্বিনেরা ধরে নিয়ে যেত !’’
মুনির চুপচাপ শুনে গেল । ওর কাছে সবকিছু অন্যরকম ঠেকছে
। এই রাত, এই গল্প, এই ধূধূ প্রান্তরে অসীম আকাশের নিচে শুয়ে থাকা ।
দূর থেকে গাঁয়ের কোন কৃষকের কন্ঠের গান ভেসে আসছে ।
আমি বা কে আমার মনটা বা কে
আজও
পারলাম না আমার মনকে চিনিতে
পাগল মনরে , মন কেনো এত কথা বলে...
জীবন এমনও হয় ? চাষীর কন্ঠের গানে বোঝা যাচ্ছে, জীবন
আসলে খুবই রহস্যময় । এক জীবনে নিজেকেই চেনা হয়ে ওঠে না । কয়েকদিন আগে মুনির জহির রায়হানের উপন্যাস পড়েছে
। ‘হাজার বছর ধরে’ । মুনিরের মনে হলো-
এ যেন সেই হাজার বছরের রাত ।
এ যেন শত শত বছরের পুঁথি কাহিনী গাজী কালু চম্পাবতীর
রাত ।
এরকম একটা রাত জীবনের অমূল্য প্রাপ্তি । অসামান্য
স্মৃতি । হয়তো বয়স হলে দাদুর মত একদিন সেও
এই রাতের গল্প করবে অন্য কারো কাছে !
(গাজী কালু চম্পাবতীর রাত / ২৫-১২-২০১৩)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন