এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৩

খ্যাতি ও জীবন

১।
মানুষের একটা ন্যাচারাল ইন্সটিংক্ট হলো – মানুষ সম্মান চায়, খ্যাতি চায় । ছোটবেলায় ক্লাসের বইয়ে পড়েছিলাম – ভালো কাজ করার একটা উদ্দেশ্য হলো, মৃত্যুর পরেও মানুষ আমার কথা মনে রাখবে । আমি মরে যাবো, কিন্তু আমার নাম বেঁচে থাকবে আমার কাজের মাধ্যমে ।

খ্যাতির জন্য মানুষ কতকিছুই না করে ! ‘গিনেস বুক অব রেকর্ডস’ এ নাম ওঠানোর জন্য আজগুবি কত কিছুযে হয় ! কেউ খেয়ে খেয়ে ওজন বাড়ায়, কেউ বছরের পর বছর নখ কাটে না, দাড়িগোঁফ-চুল কাটে না, কেউ লোহা খায় । আরও কতকি ! ফেসবুকেও দেখি সামান্য খ্যাতির জন্য কতজনে মিথ্যা তথ্য ছড়ায় ।

আচ্ছা এই খ্যাতি দিয়ে কী হবে ? পৃথিবীর আদি থেকে আজ পর্যন্ত কত কবি জন্মেছিলেন তাদের কতজনের কথা আমরা জানি ? কত ঔপন্যাসিক, কত দার্শনিক, শিক্ষক , গায়ক জন্মেছিলেন তার ক’জনের কথা আমরা জানি ?যে সাহিত্য সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখে, তার কাছেও অনেক সাহিত্যিকের নাম শেষ পর্যন্ত অজানাই থেকে যায় । বিজ্ঞান নিয়ে যে পড়াশোনা করে, চিন্তা –গবেষণা করে , তার কাছেও অনেক বিজ্ঞানীর নাম এবং কাজ অজানাই থেকে যায় ।

ধরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা । তিনি আসলেই একজন জিনিয়াস কবি ছিলেন । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন । কিন্তু তবুও পৃথিবীর কতজন মানুষ তার নাম জানে ? অন্যান্য দেশের কথা বাদই দিলাম, বাংলাদেশ এবং ভারতেরই কমপক্ষে অর্ধেক মানুষ তার নাম জানে না । কতজন তার সাহিত্য পড়েছে ? অধিকাংশ মানুষই পড়েনি । আরও একশত বছর পরে হয়তো এই সংখ্যা আরও কমে যাবে । একসময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ্যপুস্তক থেকেও হারিয়ে যাবে ।

ধরে নিলাম , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর অনেক বছর পরেও তার নাম মানুষ স্মরণ করে । আচ্ছা তাতে রবিঠাকুরের লাভটা কী হচ্ছে ? তার মৃত্যুর পরেও তো লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম রাখা হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ ! শুধু এই নামটা থাকাতে কী পার্থক্য হয়েছে ? তিনি জীবিত থাকাতে যতটুকু সম্মান পেয়েছেন , আসলে ততটুকুই তার লাভ । এরপর সবকিছু শুন্য ।

সত্যিকারার্থে মৃত্যুর পরের জীবনে তিনি এখান থেকে আর কিছুই পাচ্ছেন না ।

২।
তাহলে কি কিছু করার দরকার নেই ? খেয়েদেয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারাটাই সফলতা ?
আসলে তাও নয় । আমাদের কাজ করতে হবে , অনেক কাজ । তবে সেসবের শুরুতে প্রয়োজন ঈমান । ঈমানবিহীন সব কাজের মুল্য শুন্য । দ্বিতীয়ত, করতে হবে এমন কাজ যাতে মানুষ সত্যের পথ খুঁজে পায়, সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে পারে । মানুষের উপকার হয় এমন কাজ । ঈমানদার ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, ভালো কাজের পুরস্কার মৃত্যুর পরের জীবনে পাওয়া যাবে । শুধু ‘নাম’ থাকার মত বায়বীয় কোন অবাস্তব পুরস্কার নয়, সত্যিকার পুরস্কার । অনন্ত কালের জন্য সুখ সাচ্ছন্দ্য । একটু সুখের জন্য পৃথিবীতে মানুষ কী না করে !

সাহিত্য রচনা করতে হবে , যে সাহিত্য মানুষকে শেখায় ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে । অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে দাড়াতে । শেখায় মানুষকে ভালোবাসতে, পশুপাখি, গাছপালাকে ভালোবাসতে । শেখায় স্রস্টাকে ভালোবাসতে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে ।

বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হবে , যাতে মানুষের জীবন হতে পারে আরো সহজ । মানুষ থাকতে পারে আরো শান্তিতে । মানুষকে কষ্ট দেয়া স্রস্টার উদ্দেশ্য নয় । আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যাকিছু দিয়েছেন- মানুষের সুখের জন্যই । প্রয়োজনীয় উপকরণ সেখান থেকে মানুষকে খুঁজে নিতে হবে , আর মানতে হবে নির্ধারিত সীমা । কাজ করতে হবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য । কাজ করতে দারিদ্র্য থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য । দুনিয়ায় ‘নাম’ থাকুক আর না থাকুক, মৃত্যুর পর অনন্ত কালের জীবনে সত্যিকার পুরস্কার পাওয়া যাবে – থাকতে হবে সেই বিশ্বাস ।

৩।
তাই বলে কি আমরা কৃতি ব্যক্তিদের নাম সংরক্ষণ করবো না ? অবশ্যই করতে হবে । কারণ- প্রত্যেককে দিতে হবে তাঁর প্রাপ্য সম্মান । প্রাপ্য মজুরী । শ্রমিককে যেমন মজুরী দিতে হয়, তেমনি কৃতি ব্যক্তিকে দিতে হবে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা । একজন মানুষের কাজ তাঁর নিজস্ব সম্পদ । তিনি যদি সেটা মানুষের জন্য করেন , তবু তা তারই । অস্বীকার করার উপায় নেই । কাউকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান না দেওয়াটা অবিচার, অন্যায় । আল্লাহর প্রেরিত নবীও সেটাই বলে গেছেন ।
আর তাছাড়া, সম্মান চাওয়াটা মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য । ভালো কাজে আমরা যত বেশি উৎসাহ দেব, সম্মান দেব – মানুষ ভালো কাজে তত বেশি উদ্বুদ্ধ হবে । ক্রমে পৃথিবীটা হয়ে উঠবে আরো শান্তিময় ।

..............................
খ্যাতি ও জীবন/ ২৫-০৮-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন