আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা
আসো যদি বাঁশবাগানে , আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা বন্ধু , আবার হবে দেখা ...
হঠাৎ বাঁশিতে টান পড়লে চমকে উঠলো রইচ । সত্যি সত্যি বাঁশবাগানের একপাশে বসে বাঁশি বাজিয়ে একমনে গান গাইছিল সে । মাথা ঘুরিয়ে দেখে জুলেখা দাঁড়িয়ে আছে । চোখ মুখ অন্ধকার । হাত ধরে জুলেখাকে পাশে বসালো রইচ ।
আশ্বিনের মাঝামাঝি । কোথাও কোন কাজ নেই । চারিদিকে অভাব অনটন । মঙ্গা শুরু হয়েছে । জুলেখার মুখ কেন অন্ধকার রইচ জানে । আবার নিশ্চয়ই চাল ফুরিয়ে গেছে । কয়েকদিন থেকেই সামান্য একটু করে চাল দিয়ে চলছে । ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সামান্য একটু করে ভাত আর বেশি করে ভাতের ফেন খেয়েই কাটাচ্ছে গত তিন দিন । কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা , চার বছর বয়স , আর ছোট মেয়েটা দুই বছর বয়স । ওদের তো না খাইয়ে রাখা যায় না ।
এই গ্রামে গেরস্ত পরিবার বেশি নাই । দুই-তিনটি পরিবার স্বচ্ছল আছে । কিন্তু ওরাই বা কয়জনকে সাহায্য করবে ? তবু ওদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এরই মাঝে কয়েকবার চাল আনা হয়ে গেছে ।
কামলা খাটা ছাড়া কোন কাজ জানা নেই রইচের । আর জানলেও বা কী হতো ? মুচি কামার কুমার সবার বাড়িতেই তো এখন অভাব অনটন ।
- ‘ কলিমের বাপ, এক বাটি চাউল আছে, রাইতটা কোনমতে চইলবে । কাইল কী খামো ?’
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জুলেখা বলেই ফেলে কথাটা । কলিম ওদের ছেলের নাম ।
রইচ বাঁশিটা হাতে নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করে । বাঁশবাগানের ভেতর একটা ঘুঘু ডাকছে । বুকটা হাহাকার করে ওঠে রইচের ।
জুলেখাকে কত আশা দিয়েছিল । কোনদিন কষ্ট দেবে না । রক্ত পানি করে হলেও জুলেখার মুখের হাসি ধরে রাখবে । আজ কোথায় সেসব আশ্বাস ! এখন কী করবে রইচ ?
পাশের গ্রামেই জুলেখার বাপের বাড়ি । বিয়ের আগের কথা, সেসময় বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করতে যেত রইচ । যাওয়া আসার পথে চোখ পড়েছিল জুলেখার ওপর । জুলেখাও কেন যেন তাকিয়ে থাকতো রইচের দিকে ! পড়ন্ত বিকেলে কাজ শেষে ফেরার পথে দরাজ গলায় গান গাইতো রইচ । আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
‘ভাইজান , মোর বুবু তোমাক ডাকায়’ । একদিন রইচকে ডেকে বলেছিল জুলেখার ছোটবোন ।
ভীরু পায়ে ছনের চালার নিচে গিয়ে দাড়িয়েছিল সে । বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিলো তার । ভালোলাগা নারীর সামনে কি সব পুরুষেরই এমন হয় ? কে জানে ! হয়তো মহাপুরুষদের হয়না । রইচ তো আর মহাপুরুষ নয় ! সে পুটিমারী গ্রামের সাধারণ কৃষকের ছেলে – রইচ উদ্দিন ।
সেই থেকে প্রতিদিন একটি দুটি করে কথা হয় যাওয়া আসার পথে । জুলেখাই কথা বলে, রইচ একনিষ্ঠ শ্রোতা । কথার পিঠে কথা খুঁজে পায় না সে । শোনে, আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে জুলেখার খিলখিল হাসি দেখে অবাক হয় ।
কাজের ফাঁকে বাঁশি বাজাত রইচ । বাঁশি বাজানো শুরু করলে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যায় সে । ভাওয়াইয়া গানের বিরহী সুর তার বাঁশির সুরে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে । দূর থেকে সে বাঁশির সুর কান পেতে শুনতো জুলেখা । রইচের প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যায় দিনকে দিন । কথাচ্ছলে বান্ধবীদের সে বলেও ফেলে সে কথা ।
এসব কথা গোপন থাকেনা । একান ওকান করে কথা চলে যায় রইচের বাবার কানে । রইচের বাবা তাঁর একমাত্র ছেলের কোন সাধ অপূর্ণ রাখেন না – যতটুকু সাধ্যে কুলায় । তিনি কথা বলেন জুলেখার বাপের সাথে । ছেলেরও তো বয়স হয়েছে । কথা পাকাপাকি হলে এক চৈত্রের রাতে জুলেখার সাথে বিয়ে হয়েছিল রইচের ।
-‘কী হইলো , কিছু কওনা ক্যানে ?’ জুলেখার তীক্ষ্ণ স্বর আবার কানে আসে ।
বর্তমানে ফিরে আসে রইচ । কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় জুলেখার চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে ।
***
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজনে । ঘুঘুটাও একটানা ঘু-ঘু করে ডেকে যায় । এই ভরদুপুরে সে ডাক অদ্ভুত লাগে । প্রকৃতির নিস্তব্ধতা যেন আরো গভীর করে তোলে ।
হঠাৎ করে রফিকের কথাটা মনে পড়ে গেল রইচের । পুবপাড়ার রফিক । রফিকের চুরির অভ্যাস আছে । অনেকেই জানে ব্যাপারটা , কিন্তু কোনদিন সে ধরা পড়ে নাই । তার বাড়িতে আহামরি কোন জিনিসপত্রও নাই । কোনদিন রফিকের বাড়ি থেকে কোন চুরির জিনিস উদ্ধারও হয় নাই । কিন্তু তার সংসারে অভাব জিনিসটাও নাই । এই মঙ্গায়ও রফিকের বাড়িতে নিয়মিত চুলায় হাড়ি ওঠে ।
দুইদিন আগে মন খারাপ করে নদীর ধারে হাটছিল রইচ । রফিকের সাথে দেখা । রফিকই এগিয়ে এসেছিল রইচকে দেখে ।
- ও রইচ , মন খারাপ নাকি ?
- রফিক ভাই, এইভাবে কয়দিন চলমো ? ঘরত চাউল নাই । ধার দেনা করি কয়দিন খামো কন ? আর এত ধার দিবে কায় হামাক ?
- মোর সাথে কাম করবু নাকি রে রইচ ?
- কী কাম ভাই ? কোন বাড়িত তো কাম কাজ নাই ।
- দিনের কাম নায় রে রইচ , রাইতের কাম । করবার চাইলে কও , তোক একদিন সাথে নিয়া যাইম । ভালো থাকার উপায় কি কও, প্যাটত ভাত না থাকলে সব কামই করা যায় । অভাব থাইকলে স্বভাব কয়দিন ভালো রাখবার পারবু কও ? তুই ভাই বেরাদর । তোর কষ্ট সইজ্য হয় না ।
ইঙ্গিতটা রইচ বোঝে । কিন্তু তার মন সায় দেয় না । ব্যবস্থা একটা না একটা হবেই । সেদিন রইচ শক্তকন্ঠেই বলেছিল – ‘না রফিক ভাই, ঐগুলা কাম মোর দ্বারা হইবে না’ ।
রইচ এখন জুলেখাকে কী বলবে ভেবে পায় না । কাঁচুমাচু করে বলে-
- ‘জুলেখা , আর একবার মেম্বার চাচার বাড়িত যাইয়া দেখনা । চাচীর হাত পাও ধরি এক সের চাউল দিবার কও’ ।
- ‘সে মুই সকালে গেছিনু । চাচী কইল, আর চাউল দেওয়া সম্ভব নায়’ ।
চোখ ছল ছল করে জুলেখার ।
আরো কিছুক্ষণ কোন কথা না বলে আবার বাঁশি বাজাতে শুরু করে রমিজ ।
আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা, আসো যদি বাশবাগানে...
আবার হবে দেখা বন্ধু... আবার হবে দেখা...
বাঁশি বাজাতে বাজাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রমিজ । আর বোধহয় ভালো থাকা সম্ভব না । বাচ্চাকাচ্চার কষ্ট আর সহ্য হয় না । বিকালেই রফিক ভাইর সাথে দেখা করে সম্মতির কথাটা জানাতে হবে । হ্যা, রইচ করবে- রাইতের কাজ করবে রফিকের সাথে ।
২।
- ‘উফ কী গরম ! জুলেখা, যাই একটু গায় হাওয়া লাগায় আসি । তুই ঘুমা’ ।
মধ্যরাত । রইচ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় । সন্ধ্যাবেলায় চাঁদ উঠেছিল এক ফালি , এখন কোন চিহ্ন নেই । চারিদিকে অন্ধকার । গাঁয়ের সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । মাঝে মাঝে দু-একটা প্যাঁচার গা হিম করা ডাক শোনা যাচ্ছে । বাশবাগানের ওপাশ থেকে কোন একটা খেকশিয়ালের হুয়া হুয়া শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ পরপর । রইচের এক দফা ঘুম হয়ে গেছে । ছোট বাচ্চাটা একটু পরপর কেঁদে উঠছিল । জ্বর এসেছে , গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে রইচ । আজ যদি ভালোয় ভালোয় কাজটা করে ফেলতে পারে , বাচ্চাটার জন্য ঔষধও কিনতে পারবে ।
চুপচাপ মাঠ পার হয়ে তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় রইচ । রাস্তার ধার থেকে উঠে আসে রফিকও । বিকালেই সব প্ল্যান করেছে । রইচের যেহেতু প্রথম দিন , ওকে বেশ কিছু কায়দা কানুন শিখিয়ে দিয়েছে রফিক ।
হেঁটে হেঁটে দুই মাইল পেরিয়ে এলো ওরা । এই এলাকার করিম সাহেব বেশ ধনী লোক । তার গোলাঘরটা বাড়ির একপাশে । সেখান থেকে ধান চুরি করে ওরা রাতেই চলে যাবে দূরের বটতলা হাটে । কাল হাটবার । সকাল সকাল বিক্রি করে ফেলবে ধান । টাকাটা ভাগ করে নিয়ে দুইজন ভিন্ন ভিন্ন পথে বাড়ি ফিরবে ওরা । এরকমই পরিকল্পনা করা আছে ।
- ‘রফিক ভাই, মোর ভয় নাগচে যে’...
- ‘ধুর, এই কামে ভয় হইলো এক নম্বর শত্রু বুঝলি রইচ । ভয় ডর বিন্দুমাত্র মনে রাখলে চইলবে না । তোক যা যা কইছিনু মনত আছে তো ? কোন শব্দ করা চইলবে না । শব্দ হৈছে দুই নম্বর শত্রু’ ।
খড়ের গাদার পেছনে লুকিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশের অবস্থা দেখলো ওরা । কুকুর নাই এ বাড়িতে এটা আগে থেকেই জানা আছে রফিকের । বাড়ির চাকরটাও আজ থাকার কথা না । তার মায়ের অসুখ , বাড়িতে গেছে । খোঁজখবর নিয়ে রেখেছে রফিক আগেই । রইচ না এলেও অবশ্য আজ রফিক আসতো চুরি করতে । বিকালে রইচ এসে বলাতে তাকেও সাথে নিতে হয়েছে । নতুন লোক নিয়ে এইসব কাজে নামা খুব রিস্কের ব্যাপার । কিন্তু এই মঙ্গায় রইচের কষ্ট সত্যিই রফিককে ব্যথিত করেছে । আর তাছাড়া কোন না কোনদিন তো ‘শুরু’ করতেই হবে । কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে সব শিখে ফেলবে রইচ ।
অবস্থা অনুকূলে বুঝে ধীরে ধীরে ওরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে । এইদিকটাতে কয়েকটি লেবুগাছ ঝোপের সৃষ্টি করেছে । লেবুগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেড়ার বাঁধন আলগা করে দিল রফিক । বের হবার সময় বড় জায়গা লাগবে ।
এবার আসল কাজের পালা । ধানের গোলা মাচানের ওপর । মাটি থেকে কোমর সমান উঁচু পর্যন্ত ফাঁকা । বস্তা নিয়ে দুজনেই ঢুকে পড়লো মাচানের নিচে । নিচ থেকে ছিদ্র করে দিলেই ধান পড়া শুরু হবে । নিচে মুখ খোলা বস্তা ধরলেই হবে ।
ভালো কায়দা জানে রফিক । ধারালো চাকু দিয়ে কীভাবে কীভাবে জানি ছিদ্র করে ফেললো সে । রইচ বস্তা মেলে ধরলো । আধা ঘণ্টার মধ্যে ধানে ভরে গেল বস্তা ।
৩।
ফযরের আযান হচ্ছে । আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার...আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম... মুয়াজ্জিনের কন্ঠটা খুব ক্ষীণ । খালি গলার আজান । এই গ্রামে এখনো মাইক আসে নাই । তবু আযানের সময় হলেই জুলেখার ঘুম ভাঙ্গে । ছোট বাচ্চাটা আবার কাঁদছে ।
- ‘কলিমের বাপ, ছাওয়াটাক থামান তো’ ।
উঠে বসে জুলেখা । রইচ বিছানায় নেই দেখে কিছুটা অবাক হয় । পরক্ষণে ভাবে, হয়তো বাইরে গেছে । জুলেখা উঠে অযু করে নামাজ পড়ে । বাচ্চাটার জ্বর আরো বেড়েছে । মাথায় পানি ঢালতে হবে । সকালের খাবারও জোগাড় নাই । কারো বাড়ি থেকে একটু পান্তাভাত চেয়ে বাচ্চাদুটাকে খাওয়াতে হবে । জুলেখা আজ রোযা রাখবে । উপায় নাই । নিয়াত করে ফেললো সে ।
থালা বাসন ধুয়ে বারান্দায় বসেছে জুলেখা । লোকটা গেল কৈ ? তার মনে পড়লো , রাতে শরীরে হাওয়া লাগানোর জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিল রইচ । তাইলে কি আর ঘরে ফেরে নাই কলিমের বাপ ?
- ‘ কই গো মা জুলেখা , রইচ আছে নাকি বাড়িত ?’
- ‘নাই চাচা, কাইল রাইতত একবার ঘর থাকি বাইর হছিল, আর দেখা নাই । কোনটে যে গেল লোকটা ?’
- ‘মাগো, একটা খবর পাইনু মা । কাইল্কাপুর গ্রামত নাকি একটা চোর ধরা পড়ছে, তার নাম নাকি রইচ । হামার রইচ তো ভালো ছাওয়া, কিন্তু এই মঙ্গায় কারো মাথার ঠিক থাকে ? মুই একবার দেখি আসিম নাকি মা ?শুনিনু কাইল্কাপুর বাজারত নিয়া আসছে চোরটারে’ ।
মসজিদের মুয়াজ্জিন রহমান চাচার কথা শুনে জুলেখার বুকটা ধ্বক ধ্বক করে উঠলো । আবার নিজেকেই নিজে বোঝালো সে । না , কলিমের বাপ এমন কাম কইরবার পারেনা ।
তবু মন মানেনা জুলেখার, নামটা যে রইচ !
আর তাছাড়া কাল রাতে বের হবার পর রইচ এখনো ঘরে ফেরে নাই । তাহলে কি...ভাবতে গিয়ে মাথা দুলে ওঠে জুলেখার । না না । এ কীভাবে হয় ?
বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে সে নিজেই বাজারের দিকে পা বাড়ালো ।
৪।
কাইল্কাপুর গ্রামের বাজারের বটগাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে চোরটাকে । সবাই ইচ্ছামত পেটাচ্ছে । কেউ খালিহাতে , কেউ লাঠি দিয়ে , কেউ গাছের ডাল ভেঙ্গে পিটাচ্ছে । প্রতিযোগিতা করে পেটাচ্ছে ।
কে কত জোরে , কতক্ষণ ধরে পেটাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে যেন । এই দেশে চোর পেটাতে আর বউ পেটাতে কেউ ক্লান্ত হয়না ।
নিঃসাড় হয়ে আসছে রইচের শরীর ।
সবকিছু ঠিকই ছিল । কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মাচানের নিচ থেকে বের হবার সময় । ইদুর মারার একটা ফাঁদ বসানো ছিল , ওটায় পা পড়ে যায় রইচের । সইতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে সে । লোকজন জেগে উঠে তাড়া করে ওদের । রফিক পালিয়ে যায় । রইচের পায়ে ইদুর মারার ফাঁদটা আটকে যাওয়ায় সে বেশিদূর দৌড়াতে পারেনি । ধরা পড়ে যায় ।
***
বেধড়ক পিটুনিতে প্রথম প্রথম খুব চিৎকার করলেও ধীরে ধীরে ব্যথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে রইচ । একটা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না । ডান কান থেকে রক্ত পড়ছে । হাত পায়ের একটা করে হাড় ভেঙ্গে গেছে । মাংস থেতলে গেছে । এখন আর কিছুই গায়ে লাগছে না তার । জুলেখা আর বাচ্চা দুটার চেহারা ভেসে আসছে ঝাপসা চোখের সামনে । মাঝে মাঝে মাগো, বাবাগো, জুলেখা- বলে গোঙ্গাচ্ছে রইচ ।
হাত পা বাধা রইচের । কতক্ষণ এভাবে কেটেছে হুঁশ নেই ।
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের ও আল্লা ও আল্লা চিৎকার শুনে চোখ খুললো সে । জুলেখা এসেছে । জুলেখা চিৎকার করে কাঁদছে – ‘কলিমের বাপ, ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন । সবায় না খেয়া মরি গেইলেও ভালো আছিলো । ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন...ও আল্লারে, কী হয়া গেলো রে...ও আল্লারে...’
কে একজন জুলেখাকে ধরে রইচের কাছ থেকে সরিয়ে দিল । দু’একজন পেছন থেকে বলে উঠলো – আইছে, চোরের বউ আইছে ।
রইচের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । ব্যথায়, কষ্টে , দুঃখে , অবসাদে ।
চোখ বন্ধ করার আগে অনেক কষ্টে শেষ কথাটা বললো রইচ- ‘জুলেখা, মোকে তুই মাফ করি দেইস গো বউ ...’।
ভালো না হাতের লেখা
আসো যদি বাঁশবাগানে , আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা বন্ধু , আবার হবে দেখা ...
হঠাৎ বাঁশিতে টান পড়লে চমকে উঠলো রইচ । সত্যি সত্যি বাঁশবাগানের একপাশে বসে বাঁশি বাজিয়ে একমনে গান গাইছিল সে । মাথা ঘুরিয়ে দেখে জুলেখা দাঁড়িয়ে আছে । চোখ মুখ অন্ধকার । হাত ধরে জুলেখাকে পাশে বসালো রইচ ।
আশ্বিনের মাঝামাঝি । কোথাও কোন কাজ নেই । চারিদিকে অভাব অনটন । মঙ্গা শুরু হয়েছে । জুলেখার মুখ কেন অন্ধকার রইচ জানে । আবার নিশ্চয়ই চাল ফুরিয়ে গেছে । কয়েকদিন থেকেই সামান্য একটু করে চাল দিয়ে চলছে । ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সামান্য একটু করে ভাত আর বেশি করে ভাতের ফেন খেয়েই কাটাচ্ছে গত তিন দিন । কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা , চার বছর বয়স , আর ছোট মেয়েটা দুই বছর বয়স । ওদের তো না খাইয়ে রাখা যায় না ।
এই গ্রামে গেরস্ত পরিবার বেশি নাই । দুই-তিনটি পরিবার স্বচ্ছল আছে । কিন্তু ওরাই বা কয়জনকে সাহায্য করবে ? তবু ওদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এরই মাঝে কয়েকবার চাল আনা হয়ে গেছে ।
কামলা খাটা ছাড়া কোন কাজ জানা নেই রইচের । আর জানলেও বা কী হতো ? মুচি কামার কুমার সবার বাড়িতেই তো এখন অভাব অনটন ।
- ‘ কলিমের বাপ, এক বাটি চাউল আছে, রাইতটা কোনমতে চইলবে । কাইল কী খামো ?’
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জুলেখা বলেই ফেলে কথাটা । কলিম ওদের ছেলের নাম ।
রইচ বাঁশিটা হাতে নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করে । বাঁশবাগানের ভেতর একটা ঘুঘু ডাকছে । বুকটা হাহাকার করে ওঠে রইচের ।
জুলেখাকে কত আশা দিয়েছিল । কোনদিন কষ্ট দেবে না । রক্ত পানি করে হলেও জুলেখার মুখের হাসি ধরে রাখবে । আজ কোথায় সেসব আশ্বাস ! এখন কী করবে রইচ ?
পাশের গ্রামেই জুলেখার বাপের বাড়ি । বিয়ের আগের কথা, সেসময় বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করতে যেত রইচ । যাওয়া আসার পথে চোখ পড়েছিল জুলেখার ওপর । জুলেখাও কেন যেন তাকিয়ে থাকতো রইচের দিকে ! পড়ন্ত বিকেলে কাজ শেষে ফেরার পথে দরাজ গলায় গান গাইতো রইচ । আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
‘ভাইজান , মোর বুবু তোমাক ডাকায়’ । একদিন রইচকে ডেকে বলেছিল জুলেখার ছোটবোন ।
ভীরু পায়ে ছনের চালার নিচে গিয়ে দাড়িয়েছিল সে । বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিলো তার । ভালোলাগা নারীর সামনে কি সব পুরুষেরই এমন হয় ? কে জানে ! হয়তো মহাপুরুষদের হয়না । রইচ তো আর মহাপুরুষ নয় ! সে পুটিমারী গ্রামের সাধারণ কৃষকের ছেলে – রইচ উদ্দিন ।
সেই থেকে প্রতিদিন একটি দুটি করে কথা হয় যাওয়া আসার পথে । জুলেখাই কথা বলে, রইচ একনিষ্ঠ শ্রোতা । কথার পিঠে কথা খুঁজে পায় না সে । শোনে, আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে জুলেখার খিলখিল হাসি দেখে অবাক হয় ।
কাজের ফাঁকে বাঁশি বাজাত রইচ । বাঁশি বাজানো শুরু করলে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যায় সে । ভাওয়াইয়া গানের বিরহী সুর তার বাঁশির সুরে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে । দূর থেকে সে বাঁশির সুর কান পেতে শুনতো জুলেখা । রইচের প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যায় দিনকে দিন । কথাচ্ছলে বান্ধবীদের সে বলেও ফেলে সে কথা ।
এসব কথা গোপন থাকেনা । একান ওকান করে কথা চলে যায় রইচের বাবার কানে । রইচের বাবা তাঁর একমাত্র ছেলের কোন সাধ অপূর্ণ রাখেন না – যতটুকু সাধ্যে কুলায় । তিনি কথা বলেন জুলেখার বাপের সাথে । ছেলেরও তো বয়স হয়েছে । কথা পাকাপাকি হলে এক চৈত্রের রাতে জুলেখার সাথে বিয়ে হয়েছিল রইচের ।
-‘কী হইলো , কিছু কওনা ক্যানে ?’ জুলেখার তীক্ষ্ণ স্বর আবার কানে আসে ।
বর্তমানে ফিরে আসে রইচ । কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় জুলেখার চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে ।
***
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজনে । ঘুঘুটাও একটানা ঘু-ঘু করে ডেকে যায় । এই ভরদুপুরে সে ডাক অদ্ভুত লাগে । প্রকৃতির নিস্তব্ধতা যেন আরো গভীর করে তোলে ।
হঠাৎ করে রফিকের কথাটা মনে পড়ে গেল রইচের । পুবপাড়ার রফিক । রফিকের চুরির অভ্যাস আছে । অনেকেই জানে ব্যাপারটা , কিন্তু কোনদিন সে ধরা পড়ে নাই । তার বাড়িতে আহামরি কোন জিনিসপত্রও নাই । কোনদিন রফিকের বাড়ি থেকে কোন চুরির জিনিস উদ্ধারও হয় নাই । কিন্তু তার সংসারে অভাব জিনিসটাও নাই । এই মঙ্গায়ও রফিকের বাড়িতে নিয়মিত চুলায় হাড়ি ওঠে ।
দুইদিন আগে মন খারাপ করে নদীর ধারে হাটছিল রইচ । রফিকের সাথে দেখা । রফিকই এগিয়ে এসেছিল রইচকে দেখে ।
- ও রইচ , মন খারাপ নাকি ?
- রফিক ভাই, এইভাবে কয়দিন চলমো ? ঘরত চাউল নাই । ধার দেনা করি কয়দিন খামো কন ? আর এত ধার দিবে কায় হামাক ?
- মোর সাথে কাম করবু নাকি রে রইচ ?
- কী কাম ভাই ? কোন বাড়িত তো কাম কাজ নাই ।
- দিনের কাম নায় রে রইচ , রাইতের কাম । করবার চাইলে কও , তোক একদিন সাথে নিয়া যাইম । ভালো থাকার উপায় কি কও, প্যাটত ভাত না থাকলে সব কামই করা যায় । অভাব থাইকলে স্বভাব কয়দিন ভালো রাখবার পারবু কও ? তুই ভাই বেরাদর । তোর কষ্ট সইজ্য হয় না ।
ইঙ্গিতটা রইচ বোঝে । কিন্তু তার মন সায় দেয় না । ব্যবস্থা একটা না একটা হবেই । সেদিন রইচ শক্তকন্ঠেই বলেছিল – ‘না রফিক ভাই, ঐগুলা কাম মোর দ্বারা হইবে না’ ।
রইচ এখন জুলেখাকে কী বলবে ভেবে পায় না । কাঁচুমাচু করে বলে-
- ‘জুলেখা , আর একবার মেম্বার চাচার বাড়িত যাইয়া দেখনা । চাচীর হাত পাও ধরি এক সের চাউল দিবার কও’ ।
- ‘সে মুই সকালে গেছিনু । চাচী কইল, আর চাউল দেওয়া সম্ভব নায়’ ।
চোখ ছল ছল করে জুলেখার ।
আরো কিছুক্ষণ কোন কথা না বলে আবার বাঁশি বাজাতে শুরু করে রমিজ ।
আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা, আসো যদি বাশবাগানে...
আবার হবে দেখা বন্ধু... আবার হবে দেখা...
বাঁশি বাজাতে বাজাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রমিজ । আর বোধহয় ভালো থাকা সম্ভব না । বাচ্চাকাচ্চার কষ্ট আর সহ্য হয় না । বিকালেই রফিক ভাইর সাথে দেখা করে সম্মতির কথাটা জানাতে হবে । হ্যা, রইচ করবে- রাইতের কাজ করবে রফিকের সাথে ।
২।
- ‘উফ কী গরম ! জুলেখা, যাই একটু গায় হাওয়া লাগায় আসি । তুই ঘুমা’ ।
মধ্যরাত । রইচ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় । সন্ধ্যাবেলায় চাঁদ উঠেছিল এক ফালি , এখন কোন চিহ্ন নেই । চারিদিকে অন্ধকার । গাঁয়ের সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । মাঝে মাঝে দু-একটা প্যাঁচার গা হিম করা ডাক শোনা যাচ্ছে । বাশবাগানের ওপাশ থেকে কোন একটা খেকশিয়ালের হুয়া হুয়া শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ পরপর । রইচের এক দফা ঘুম হয়ে গেছে । ছোট বাচ্চাটা একটু পরপর কেঁদে উঠছিল । জ্বর এসেছে , গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে রইচ । আজ যদি ভালোয় ভালোয় কাজটা করে ফেলতে পারে , বাচ্চাটার জন্য ঔষধও কিনতে পারবে ।
চুপচাপ মাঠ পার হয়ে তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় রইচ । রাস্তার ধার থেকে উঠে আসে রফিকও । বিকালেই সব প্ল্যান করেছে । রইচের যেহেতু প্রথম দিন , ওকে বেশ কিছু কায়দা কানুন শিখিয়ে দিয়েছে রফিক ।
হেঁটে হেঁটে দুই মাইল পেরিয়ে এলো ওরা । এই এলাকার করিম সাহেব বেশ ধনী লোক । তার গোলাঘরটা বাড়ির একপাশে । সেখান থেকে ধান চুরি করে ওরা রাতেই চলে যাবে দূরের বটতলা হাটে । কাল হাটবার । সকাল সকাল বিক্রি করে ফেলবে ধান । টাকাটা ভাগ করে নিয়ে দুইজন ভিন্ন ভিন্ন পথে বাড়ি ফিরবে ওরা । এরকমই পরিকল্পনা করা আছে ।
- ‘রফিক ভাই, মোর ভয় নাগচে যে’...
- ‘ধুর, এই কামে ভয় হইলো এক নম্বর শত্রু বুঝলি রইচ । ভয় ডর বিন্দুমাত্র মনে রাখলে চইলবে না । তোক যা যা কইছিনু মনত আছে তো ? কোন শব্দ করা চইলবে না । শব্দ হৈছে দুই নম্বর শত্রু’ ।
খড়ের গাদার পেছনে লুকিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশের অবস্থা দেখলো ওরা । কুকুর নাই এ বাড়িতে এটা আগে থেকেই জানা আছে রফিকের । বাড়ির চাকরটাও আজ থাকার কথা না । তার মায়ের অসুখ , বাড়িতে গেছে । খোঁজখবর নিয়ে রেখেছে রফিক আগেই । রইচ না এলেও অবশ্য আজ রফিক আসতো চুরি করতে । বিকালে রইচ এসে বলাতে তাকেও সাথে নিতে হয়েছে । নতুন লোক নিয়ে এইসব কাজে নামা খুব রিস্কের ব্যাপার । কিন্তু এই মঙ্গায় রইচের কষ্ট সত্যিই রফিককে ব্যথিত করেছে । আর তাছাড়া কোন না কোনদিন তো ‘শুরু’ করতেই হবে । কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে সব শিখে ফেলবে রইচ ।
অবস্থা অনুকূলে বুঝে ধীরে ধীরে ওরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে । এইদিকটাতে কয়েকটি লেবুগাছ ঝোপের সৃষ্টি করেছে । লেবুগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেড়ার বাঁধন আলগা করে দিল রফিক । বের হবার সময় বড় জায়গা লাগবে ।
এবার আসল কাজের পালা । ধানের গোলা মাচানের ওপর । মাটি থেকে কোমর সমান উঁচু পর্যন্ত ফাঁকা । বস্তা নিয়ে দুজনেই ঢুকে পড়লো মাচানের নিচে । নিচ থেকে ছিদ্র করে দিলেই ধান পড়া শুরু হবে । নিচে মুখ খোলা বস্তা ধরলেই হবে ।
ভালো কায়দা জানে রফিক । ধারালো চাকু দিয়ে কীভাবে কীভাবে জানি ছিদ্র করে ফেললো সে । রইচ বস্তা মেলে ধরলো । আধা ঘণ্টার মধ্যে ধানে ভরে গেল বস্তা ।
৩।
ফযরের আযান হচ্ছে । আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার...আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম... মুয়াজ্জিনের কন্ঠটা খুব ক্ষীণ । খালি গলার আজান । এই গ্রামে এখনো মাইক আসে নাই । তবু আযানের সময় হলেই জুলেখার ঘুম ভাঙ্গে । ছোট বাচ্চাটা আবার কাঁদছে ।
- ‘কলিমের বাপ, ছাওয়াটাক থামান তো’ ।
উঠে বসে জুলেখা । রইচ বিছানায় নেই দেখে কিছুটা অবাক হয় । পরক্ষণে ভাবে, হয়তো বাইরে গেছে । জুলেখা উঠে অযু করে নামাজ পড়ে । বাচ্চাটার জ্বর আরো বেড়েছে । মাথায় পানি ঢালতে হবে । সকালের খাবারও জোগাড় নাই । কারো বাড়ি থেকে একটু পান্তাভাত চেয়ে বাচ্চাদুটাকে খাওয়াতে হবে । জুলেখা আজ রোযা রাখবে । উপায় নাই । নিয়াত করে ফেললো সে ।
থালা বাসন ধুয়ে বারান্দায় বসেছে জুলেখা । লোকটা গেল কৈ ? তার মনে পড়লো , রাতে শরীরে হাওয়া লাগানোর জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিল রইচ । তাইলে কি আর ঘরে ফেরে নাই কলিমের বাপ ?
- ‘ কই গো মা জুলেখা , রইচ আছে নাকি বাড়িত ?’
- ‘নাই চাচা, কাইল রাইতত একবার ঘর থাকি বাইর হছিল, আর দেখা নাই । কোনটে যে গেল লোকটা ?’
- ‘মাগো, একটা খবর পাইনু মা । কাইল্কাপুর গ্রামত নাকি একটা চোর ধরা পড়ছে, তার নাম নাকি রইচ । হামার রইচ তো ভালো ছাওয়া, কিন্তু এই মঙ্গায় কারো মাথার ঠিক থাকে ? মুই একবার দেখি আসিম নাকি মা ?শুনিনু কাইল্কাপুর বাজারত নিয়া আসছে চোরটারে’ ।
মসজিদের মুয়াজ্জিন রহমান চাচার কথা শুনে জুলেখার বুকটা ধ্বক ধ্বক করে উঠলো । আবার নিজেকেই নিজে বোঝালো সে । না , কলিমের বাপ এমন কাম কইরবার পারেনা ।
তবু মন মানেনা জুলেখার, নামটা যে রইচ !
আর তাছাড়া কাল রাতে বের হবার পর রইচ এখনো ঘরে ফেরে নাই । তাহলে কি...ভাবতে গিয়ে মাথা দুলে ওঠে জুলেখার । না না । এ কীভাবে হয় ?
বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে সে নিজেই বাজারের দিকে পা বাড়ালো ।
৪।
কাইল্কাপুর গ্রামের বাজারের বটগাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে চোরটাকে । সবাই ইচ্ছামত পেটাচ্ছে । কেউ খালিহাতে , কেউ লাঠি দিয়ে , কেউ গাছের ডাল ভেঙ্গে পিটাচ্ছে । প্রতিযোগিতা করে পেটাচ্ছে ।
কে কত জোরে , কতক্ষণ ধরে পেটাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে যেন । এই দেশে চোর পেটাতে আর বউ পেটাতে কেউ ক্লান্ত হয়না ।
নিঃসাড় হয়ে আসছে রইচের শরীর ।
সবকিছু ঠিকই ছিল । কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মাচানের নিচ থেকে বের হবার সময় । ইদুর মারার একটা ফাঁদ বসানো ছিল , ওটায় পা পড়ে যায় রইচের । সইতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে সে । লোকজন জেগে উঠে তাড়া করে ওদের । রফিক পালিয়ে যায় । রইচের পায়ে ইদুর মারার ফাঁদটা আটকে যাওয়ায় সে বেশিদূর দৌড়াতে পারেনি । ধরা পড়ে যায় ।
***
বেধড়ক পিটুনিতে প্রথম প্রথম খুব চিৎকার করলেও ধীরে ধীরে ব্যথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে রইচ । একটা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না । ডান কান থেকে রক্ত পড়ছে । হাত পায়ের একটা করে হাড় ভেঙ্গে গেছে । মাংস থেতলে গেছে । এখন আর কিছুই গায়ে লাগছে না তার । জুলেখা আর বাচ্চা দুটার চেহারা ভেসে আসছে ঝাপসা চোখের সামনে । মাঝে মাঝে মাগো, বাবাগো, জুলেখা- বলে গোঙ্গাচ্ছে রইচ ।
হাত পা বাধা রইচের । কতক্ষণ এভাবে কেটেছে হুঁশ নেই ।
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের ও আল্লা ও আল্লা চিৎকার শুনে চোখ খুললো সে । জুলেখা এসেছে । জুলেখা চিৎকার করে কাঁদছে – ‘কলিমের বাপ, ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন । সবায় না খেয়া মরি গেইলেও ভালো আছিলো । ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন...ও আল্লারে, কী হয়া গেলো রে...ও আল্লারে...’
কে একজন জুলেখাকে ধরে রইচের কাছ থেকে সরিয়ে দিল । দু’একজন পেছন থেকে বলে উঠলো – আইছে, চোরের বউ আইছে ।
রইচের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । ব্যথায়, কষ্টে , দুঃখে , অবসাদে ।
চোখ বন্ধ করার আগে অনেক কষ্টে শেষ কথাটা বললো রইচ- ‘জুলেখা, মোকে তুই মাফ করি দেইস গো বউ ...’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন