এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

মেডিকেল ছাত্রীর আত্মহত্যাঃ দায় কার?

আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে । পরীক্ষায় ফেল করায় সে ডিপ্রেশনে ভুগছিল । চিন্তা ছিল টাকারও । কারণ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে একবার ফেল করা মানে অনেক টাকা গচ্চা । গতবছর বগুড়া মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে একই কারণে । বারবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারছিল না । চিটাগাং মেডিকেলে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র ফরিদ ভাই, ফ্রাস্ট্রেশান এবং ডিপ্রেশানে ভুগে মেডিকেল কন্টিনিউ করতে না পেরে বাড়িতে চলে যান । একদিন খবর পাই, তিনি আত্মহত্যা করেছেন ।
এইসব অকাল মৃত্যুর দায় কার ?
দায় খোঁজার আগে একটু বলা ভালো- মেডিকেলে পাস বলতে ৩৩ নম্বরে পাস নয় । এখানে প্রতি সাবজেক্টে পাঁচটা পার্ট- অবজেক্টিভ, রিটেন, ভাইভা(দুই বোর্ড), অস্পি এবং প্রাক্টিকাল । পাস করতে হলে প্রতিটি পার্টে আলাদা আলাদাভাবে ৬০% মার্কস পেতে হবে ।
যে আত্মহত্যা করেছে তার নিজের দায় অবশ্যই সবার আগে । কারণ, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, যত খারাপই হোক, আত্মহত্যা কোন সমাধান নয় । একটু ধৈর্য ধরলেই কোন না কোনভাবে মুক্তি মিলবেই । Time is the best Healer.
এরপরেই দায় নিতে হবে বাবা-মাকে । ছেলে/মেয়ে কে ডাক্তার বানানোর বাবা-মায়ের তথাকথিত ‘স্বপ্ন’ আর জেদের বলি হয়ে কতজনকে যে নিজের স্বপ্ন, ভালোলাগা বিসর্জন দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই । বাবা মা তাঁদের সন্তানকে জোর করে মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়েই খালাস। ছেলে আমার ডাক্তারি পড়ছে, তাধিন তাধিন ! এখানে যে একটা ছেলে/মেয়েকে কী পরিমাণ স্ট্রেস সহ্য করতে হয় তার ধারণা অনেকেরই নেই ।
শিক্ষকদের দায়ও কম না । একটা ছেলে আইটেম পরীক্ষা দিতে আসছে না, অথবা ক্লাসে আসছে না । কোন শিক্ষক তার খবর রাখেন ? কেন আসে না ? কেন পরীক্ষা দিচ্ছে না ? বরং কয়েকদিন পর যখন সে ক্লাসে আসে, হয়তো পেছনের দিকে গুটিয়ে বসে আছে । তখনই শিক্ষক মনে মনে বলেন, ‘আইজকা পাইছি তোরে’। সবার সামনে এনে বকাঝকা করে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেন । অনেকে টিচারের বকাঝকার ভয়ে আরো পিছিয়ে যায় । ক্লাসে আসেনা । ক্লাসে সবার সামনে জিজ্ঞেস করলে সব সমস্যা বলা যায় না । এইটুকু বোঝার মত জ্ঞানও বেশিরভাগ শিক্ষকের নেই।
সিনিয়র জুনিয়র অনেকের কথা জানি, যারা শুধুমাত্র শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের কারণে ইয়ার লস দিয়েছে । যে ছেলেটা ডিপ্রেশনে ভুগছে তাকে আপনি ক্লাসে পাওয়ামাত্রই সবার সামনে ডেকে বকাঝকা করলে সে কীভাবে এগিয়ে আসবে ? যে পড়াশোনায় মন বসাতে পারছেনা, তাকে আপনি বারবার আইটেম-কার্ড পেন্ডিং দিচ্ছেন, বকাবকি করে ফিরিয়ে দিচ্ছেন- সে আগাবে কীভাবে ?
পরীক্ষার পর যারা ফেল করেছে- কোন শিক্ষক কি খোঁজ নেন, এই ছেলেগুলো কেন ফেল করলো ? না । তাঁরা নিজেদের কোন দোষ দেখেন না, সিস্টেমের কোন দোষ দেখেন না, তাঁরা কোন বাস্তব সমস্যার ধার ধারেন না । তাঁদের কাছে উত্তর রেডি আছে- ‘পড়ালেখা করে না । খালি হোস্টেলে ঘুমায় ! গার্জিয়ানকে চিঠি দিতে হবে ।’
গার্জিয়ানকে চিঠি দেয়ার হয়তো দরকার হতে পারে, কিন্তু তার আগে কি যথাযথ মোটিভেশান দেয়া হয় ? স্টুডেন্টের প্রবলেম সলভ করার চেষ্টা করা হয়, সাহায্য করা হয় ?
Being a teacher not just reading, explaining & questioning from text, it’s something more than that.
একেকটা প্রফেশনাল পরীক্ষাকে আমি তুলনা করি লেবার পেইনের সাথে । লেবার পেইন নাকি অনেক অনেক বেশি । সাধারণভাবে কেউ এতটা পেইন সহ্য করার কথা না । মা ছাড়া অন্য কেউ যেমন সেই কষ্ট বোঝেনা, মেডিকেল স্টুডেন্ট ছাড়া অন্য কেউ প্রফ পরীক্ষার স্ট্রেস বুঝতে পারবেনা । প্রসবের বেদনা খুব তীব্র হলেও যেমন পৃথিবীতে মানুষের জন্ম থেমে নেই, যত কঠিনই হোক- ডাক্তার হওয়াও থেমে থাকবে না । কিন্তু সবারই নরমাল ডেলিভারি হয়না, কারো কারো কমপ্লিকেশান থাকে । সিজারিয়ান সেকশন করতে হয় । কারো কারো এসিস্টেড ডেলিভারি করতে হয় ।
পরীক্ষার পর যারা খারাপ করেছে-কেউ কি তাঁদের ডেকে একটু আদর দিয়ে বলে, একবার ফেল করলে জীবনে বেশি কিছু আসে যায় না ? অথচ যারা খারাপ করে, তাদের নিয়ে আলাদা ভাবে সাইকোলজিক্যাল মটিভেশান দেয়া দরকার । তাদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া দরকার । কিন্তু আমি জানি, কোথাও কেউ এই কাজটা করেনা ।
পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও ভাবা দরকার । সবগুলো সাবজেক্টের সবগুলো পরীক্ষা একটানা তিন চার মাস ধরে নিতে হবে কেন ? বিভিন্ন সময়ে ভাগ ভাগ করে বেশি বেশি সময় দিয়ে নেয়া যায় না ? শিক্ষাই আসল, নাকি পরীক্ষা ?
বাবা-মায়ের ইচ্ছামত ধরে বেঁধে মেডিকেলে ভর্তি করাতে থাকলে, আর টিচারদের মানসিকতা পরিবর্তন না হলে এভাবেই প্রতিবছর কাউকে না কাউকে হারাতে হবে। বাস্তবে কেউ দায় নিতে না চাইলেও , বাবামা, শিক্ষক, সমাজ, রাষ্ট্র- আসলে কেউই এর দায় এড়াতে পারেনা ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন