এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৪

চিকিৎসা যখন বণিকের হাতেঃ স্বাস্থ্যসেবা নাকি স্বাস্থ্যব্যবসা ?

চিকিৎসা যখন বণিকের হাতেঃ স্বাস্থ্যসেবা নাকি স্বাস্থ্যব্যবসা ?
তিক্ত অভিজ্ঞতা-১:
কয়েকমাস আগে আমার বড় ভাই বান্দরবান সফরে গিয়েছিলেন । ফেরার পথে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন । ট্রাভেলারস ডায়রিয়া । কুমিল্লায় নেমে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন রাতেই। ফোন বন্ধ থাকায় রাতে খবর পাইনি । সকালে খবর পেয়ে ঢাকা থেকে রওনা হলাম । কুমিল্লা পৌঁছতে দশটা পার হয়ে গেলো ।
গিয়ে ভাইয়ের অবস্থা দেখে তো আমি হতবাক । Severe Dehydration এর পেশেন্টকে ওরা ১২ ঘন্টায় দিয়েছে মাত্র দেড় লিটার ফ্লুইড ! ক্যাথেটার দিয়ে রেখেছে । ১৪ ঘন্টা ধরে কোন Urine output নাই ।
মাথা এত গরম হলো যে বলার মত না । নিজ দায়িত্বে ফ্লুইড দেয়ার ব্যবস্থা করে ঢাকায় নিয়ে এলাম । দেখা গেল Serum Creatinine দাঁড়িয়েছে 3.5 এ । আমি যদি ডাক্তার না হতাম, আর সকাল সকাল গিয়ে না পৌঁছতাম তাহলে এরা ভাইয়ের কিডনির অবস্থা কী করতো ভেবে আমার এখনো গায়ে কাটা দেয় ।

তিক্ত অভিজ্ঞতা-২:
ঈদুল আযহার পরে ঢাকা চলে এসেছি । রাতে ফোন পেলাম আব্বা মোটর সাইকেল সহ গর্তে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন । নিউরোসার্জন দেখানোর কথা বলে আমি রাতেই রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । সকালে গিয়ে পৌঁছলাম । আব্বাকে নিউরোসার্জন দেখিয়ে একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে । অবস্থা দেখে আবারো মাথা গরম হয়ে গেল । আব্বার স্পাইনাল ইনজুরি হয়েছে, নিউরোসার্জন Methyl Prednisolone প্রেসক্রাইব করেছেন । এই ড্রাগ স্পাইনাল ইনজুরির পর যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায় তত ভালো । অন্তত আট ঘন্টার মধ্যে দিতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায় । পেশেন্ট ভর্তি হবার ১২ ঘন্টা হয়ে গেছে, এরা তখনো এক এম্পুলও দেয়নি । তারচেয়ে বড় ব্যাপার, পেশেন্ট ডায়াবেটিক জেনেও এরা একবারও ব্লাড গ্লুকোজ চেক করেনি । ইনপুট আউটপুটের হিসাব নাই । ইউরিন আউটপুট এডিকোয়েট না । ১৪ ঘন্টায় এরা একটা নরমাল স্যালাইনও দেয়নি ।
.........
৬৪ জেলার বাংলাদেশে এখন সরকারি মেডিকেল কলেজ ২৯ টি । আরো ১১ টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার । আগামী জানুয়ারি থেকে সেগুলোর কার্যক্রম শুরু হবে । এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৫৬ টি । আরো ১১ টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার । এই নিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে প্রতিবছর । এর উদ্দেশ্য কী ? স্বাস্থ্যসেবা ? টাকা থাকলেই খুলে বসছে মেডিকেল কলেজ । পনেরো বিশ লাখ টাকা করে নিচ্ছে প্রতি স্টুডেন্টে । টিচার নিয়োগের খবর নাই, অবকাঠামো উন্নয়নের খবর নাই । জায়গামত টুপাইস ঢাললে মিলছে অনুমোদন । একজন রোগীর কাছ থেকে যদি দশহাজার টাকা বিল আসে, ডাক্তার হয়তো পাচ্ছেন পাঁচশ টাকা । বাকিটার অন্তত অর্ধেক লাভ ! স্বাস্থ্য খাত যখন বণিকদের হাতে চলে গেছে, বণিকেরা যখন লাভের গুড় খেতে শিখেছে তখন স্বাস্থ্য- ‘সেবা’ থাকবে তা হতে পারেনা । ব্যবসায়ীর কাছে সবকিছু বিবেচিত হয় টাকার অংকে । ভালোবাসাও । মানবতাও ।

সরকার ৬৮হাজার গ্রামে গ্রামে মেডিকেল কলেজ করার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন আর অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । স্বাস্থ্যখাত এখন রমরমা ব্যবসার ক্ষেত্র । পকেটে টাকা আছে তো একটা মেডিকেল কলেজ দিন । মন্ত্রী হয়েছেন ? এখন কী করবেন ? গ্রামে গ্রামে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিন । এই দাঁড়িয়েছে অবস্থা । ভর্তি পরীক্ষায় ১০ মার্ক পেয়েও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে গেল বছর । অথচ ক্লাস ওয়ানে পড়া একটা বাচ্চাকেও যদি কলম নিয়ে বসিয়ে দেয়া যায়, ইচ্ছেমত গোল্লা ভরাট করেও কমছে কম ২০ মার্ক তুলে ফেলবে । সামনে হয়তো এমন দৃশ্যও দেখতে হবে- কমার্স থেকে মেডিকেলে ভর্তি হচ্ছে । টাকায় কিনা হয় !
বেসরকারি খাতে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক হতে পারে । কিন্তু সেগুলোর একটা মিনিমাম মান রক্ষা করা দরকার । শত শত ভার্সিটি খোলেন, ইতিহাস পড়ান, ডিগ্রী দেন অসুবিধা নাই । কোন মুঘল সম্রাটের কতটা হেরেম ছিল, হলোকাস্টে কতজন ইহুদি মারা গিয়েছিল সেই সংখ্যার ভিত্তিতে ইচ্ছেমত পিএইচডি দেন- অসুবিধা নাই । কিন্তু মেডিকেল কলেজ আর ক্লিনিক হাসপাতাল দিয়েন না । ডায়রিয়ার রোগী মেরে ফেলে এমন মেডিকেল কলেজ শত শত দিয়েও লাভ হবে না । পাতার পর পাতা পড়ার নাম ডাক্তার হওয়া নয়, এখানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে হয় । জীবন একবার গেলে আর ফেরানো যায় না ।
দু’দিন আগেও অধ্যক্ষদের বরাতে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, পুরাতন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ছাড়া বেশিরভাগ মেডিকেলেই প্রয়োজনীয় টিচার নেই । প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই । হাতেকলমে চিকিৎসা শেখার সুযোগ নেই । বাবা মায়েরা হয়তো চাইতেই পারেন তাঁর ছেলে মেয়ে ডাক্তার হোক, টাকারও অভাব নেই । প্রয়োজনে এক বিঘা জমি বিক্রি করলেই তো হয় । বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন-আমার ছেলে/মেয়ে ডাক্তার। প্রতিবছর নামের সামনে ডাঃ লেখা অনেক মানুষ হয়তো বের হবে, কিন্তু চিকিৎসার অবস্থা হবে আমার অভিজ্ঞতার মত ।
এমবিবিএস পাস করে যখন সত্যিকার প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, তখন হতাশ ডাক্তারের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবেনা । ডাক্তার মানেই টাকা- বাস্তবে যখন এই হিসেব মিলবেনা তখন অনেকেই জড়িয়ে পড়বে দুর্নীতিতে । এটা তো ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ।
আর সর্বোপরি যা ঘটবে- প্রকৃত মেধাবী ডাক্তাররা, এরা তো সারাবিশ্বের যেকোন প্রান্তে অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম । এদের একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন । এখনই অনেক ডাক্তারের প্রথম টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশ ছেড়ে যাওয়া । যারা আছেন, বাবামা ভাই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে, দেশের মানুষের দিকে তাকিয়ে থেকে যাচ্ছেন । এই সংখ্যাটা হয়তো দিন দিন কমে যাবে । প্রকৃত মেধাবীরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে, রয়ে যাবে ভর্তি পরীক্ষায় ১০ মার্ক পাওয়া, কমার্স থেকে মেডিকেলে আসা মেধাবীরা । হ্যা, মন্ত্রী এমপি রাষ্ট্রপতি হয়তো সিঙ্গাপুরে ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন’ । আমার আপনার বাবা মা-র কী হবে ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন