এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪

গুলি

-স্যার, দশটারে গাড়িতে উঠাইছি ।
-ঠিক আছে, থানায় নিয়া যাও । বিস্ফোরক আইনে একটা মামলা রেডি করো । আর কেউ যোগাযোগ করতে আসলে কী করতে হবে বুঝাইয়া বইলো । আমার যেন  কিছু বলতে না হয় ।
-দুইজনের গুলি লাগছে স্যার, একজনের পেটে আরেকজনের পায়ে । এদের কী করুম স্যার ?
-আচ্ছা আগে থানায় লও । তারপর দেখা যাইবো ।
-স্যার এদের বয়স কম, অবস্থাও ভালো না ।
-আচ্ছা ঠিকাছে, ঐ দুইটারে হাসপাতালে পাঠাও ।
-জ্বি স্যার ।


***
জরি, আরেক কাপ চা দে ।

সকাল আটটা বাজতে বাজতে তিন কাপ চা খেয়ে ফেলেছেন আরিফ সাহেব ।  ইদানিং চা খাওয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে । অবশ্য স্ট্রেস কিছুটা বেশি যাচ্ছে এখন । কিন্ত তাই বলে এত চা খাওয়া ঠিক না । ঘন ঘন প্রস্রাব হয় আজকাল, ডায়াবেটিস হয়ে গেল কিনা কে জানে ! চা খাওয়ার কারণেও হতে পারে, কিন্তু তারপরেও একবার সুগারটা চেক করে নেয়া দরকার । বাবা মা দুজনেরই ডায়াবেটিস ছিল, সেজন্যে ভয়টা বেশি ।

আরিফ সাহেব কোতোয়ালী থানার ওসি । পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন একরকম  ক্ষোভের বশে । যুবক বয়সে একবার বিনা কারণে পুলিশের হাতে পড়েছিলেন । বাবা  গিয়ে ছাড়িয়ে আনার আগেই বেশ কিছু লাঠির আঘাত সইতে হয়েছিল তাকে । তারপর মাথায় জেদ চেপে গেল । আরো বিভিন্ন জায়গায় দেখেছেন, ডান্ডার ক্ষমতা ভালোই । বাঙালি ডাণ্ডাকেই একমাত্র ভয় করে । সিভিল পোষাকে একজন  ম্যাজিস্ট্রেট আর হাতে লাঠি নিয়ে একজন কন্সটেবল যদি পাশাপাশি হেঁটে যায়,  মানুষ কন্সটেবলকেই সালাম দিবে । ডান্ডা মানেই পাওয়ার । নানা কিছু ভেবে  শেষমেশ পুলিশেই জয়েন করেন তিনি ।

পুলিশে জয়েন করেই বুঝতে পারেন, জায়গাটা অত সোজা না । সবাইকে ডিল  করতে হয় । চোর বাটপার ছিনতাইকারী ডাকাত নেশাখোর চোরাচালান এইসব  নিয়ে কারবার । সারাক্ষণ এইসব নিয়ে থাকতে ভালো লাগে না । নিজের  মেজাজটাও কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে আজকাল । বুঝতে পারেন, কিন্তু বেশিক্ষণ  ঠিক রাখতে পারেন না । থানার সবার সাথে সবসময় অর্ডার দিয়ে কথা বলতে হয়, আর উপরের অর্ডার স্যার স্যার করে শুনতে হয় । অর্ডার শোনা আর অর্ডার পালন  করা- এই হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন ।

কেউ অনুরোধ করে, কেউ টাকা সাধে, কেউ উপরের লেভেল থেকে ফোন করায় । প্রথম প্রথম একটা ইচ্ছা ছিল মনে- সমাজ থেকে অন্যায় দূর করবেন । দূর্নীতি  করবেন না । আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু এখন আর বলতে গেলে এর কোনটাই অবশিষ্ট নেই । ছিঁচকে অপরাধী ধরা যায়, বড়দের ধরা যায় না । দুএকজনকে ধরে খুশি হয়েছিলেন, ভেবেছিলেন সবাই প্রশংসা করবে  । প্রশংসা করেছিলও বটে । কিন্তু মাস না পেরোতেই হাতে এসেছিল বদলির অর্ডার । কখনো কখনো এমপি মন্ত্রীদের গালি শুনতে হয়েছে । থানা থেকেই ছেড়ে দিতে হয়েছে বড় বড় সন্ত্রাসীকে ।

প্রথম প্রথম টাকা নিতে পারতেন না । কিন্তু দিনে দিনে সব সয়ে এলো । একা টাকা না নিলে কী হবে, উপরে নিচে ঠিকই লেনদেন চলছে । ঐসব বন্ধ করার সামর্থ তার  নেই । দেখা গেল- তার নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা নিচ্ছে এসআই-রা । তার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছে এসআই দের পরিবার । ব্যাংকে বউয়ের নামে বিরাট অংকের টাকা, ছেলেমেয়েদের নামিদামি স্কুল কলেজে লেখাপড়া । একসময় তিনিও ঢুকে গেলেন সিস্টেমে । কাউকে কিছু বলতে হয় না । কীভাবে কীভাবে যেন এখানে একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে । দিনশেষে তার ড্রয়ারে কয়েকটা হলুদ খাম জমা হয়ে থাকে । বাসায় যাওয়ার সময় উনি শুধু সেগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নেন । ব্যাস ।

আগে চোর ডাকাত ধরার একটা আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল, ইদানিং সেটাও আর নেই তেমন । সরকারের নির্দেশ হলো- সরকার বিরোধী কোন কার্যক্রম সেটা রাজনৈতিক হোক কি অরাজনৈতিক- হতে দেয়া যাবে না । ফলে সবসময়ই থাকতে হয় সেই কাজে । আর আরিফ সাহেবের থানাটা হলো শহরের মূল থানা । যতসব পলিটিকাল মিটিং মিছিল সমাবেশ ভাংচুর হাঙ্গামা এই থানার এরিয়াতেই হয় । সব সময় খোঁজ রাখতে হয় কোথায় কখন মিটিং হচ্ছে, কোথায় মিছিল হচ্ছে এইসব । বিরোধী দলও এখন বেশ চালাক হয়ে গেছে । এরা অসময়ে মিছিল মিটিং করে । দুপুরে খাওয়ার পর একটু রেস্ট নেয়ারও সুযোগ পাওয়া যায় না । হঠাৎ খবর আসে- অমুক জায়গায় মিছিল শুরু করেছে ! সরকারী দলের লোকেরাই খবর দেয় । সকালে মিছিল করে, রাতে মিছিল করে । যখন তখন ফোর্স নিয়ে যেতে হয় । বেশিরভাগ সময়ই আসল মিছিলকারী কাউকে পাওয়া যায়না । পথচারী হোক আর যাই হোক ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় । আর অসময়ে কষ্ট দেয়ার রাগ ঝাড়া হয় তাঁদের ওপর । এটা অবশ্য খারাপ না । বেশ কাঁচা টাকা পয়সা আসে ।
বিশেষ করে পাজামা পাঞ্জাবী পরা থাকলে বা মুখে দাড়ি থাকলে সুবিধা হয় ।

চা খেতে খেতে টিভিতে খবর দেখছিলেন আরিফ সাহেব ।  একটু পরেই বের হতে হবে । আজকের দিনটাও মনে হয় হাঙ্গামায় যাবে । সরকারের এক মন্ত্রী মুখ ফসকে বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে । ইসলাম ধর্মের নামে উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন । নবীর নামে উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন । তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের ডাক দিয়েছে ধর্মীয় দলগুলি ।

বিরক্তি লাগছে আরিফ সাহেবের । তিনি নিজেও সরকারের সমর্থক । কিন্তু মন্ত্রী এমপিরা মাঝে মাঝে এমন এমন কথা বলে, মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । ক্ষমতায় আছে পুলিশের ঘাড়ে পা দিয়ে, আবার বড় বড় কথা বলে । তাও আবার ধর্ম নিয়া । কোন মানে হয় ? এখন সামলাও ঠেলা । এইদেশের মানুষ এমনিতেই ধর্মকর্ম নিয়ে চিন্তিত না । কিন্তু আল্লাহ–রসুল–কোরআন–হাদীস নিয়া উল্টাপাল্টা কথা বললে মাথা গরম হয়ে যায় । আরিফ সাহেব নিজেও তেমন একটা নামাজ রোযা করেন না, কিন্তু ধর্ম নিয়া উল্টাপাল্টা কিছু বললে তারও আসলে ভালো লাগে না ।

থানা থেকে গাড়ি চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই । ছেলেমেয়ে দুটাকে ওদের কলেজে-স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যেতে হবে । উপর থেকে অর্ডার এসেছে কোনরকম মিছিল মিটিং হতে দেয়া যাবেনা । প্রয়োজনে গুলি করতে হবে ।

আরিফ সাহেবের এক ছেলে এক মেয়ে । আরমান ও আনিতা । আরমান কলেজে উঠেছে , ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে । যথেষ্ট ভদ্র হয়েছে । মাঝে মাঝে নামাজও পড়তে যায় মসজিদে । ওর মায়ের কিছুটা পেয়েছে বোধহয় । লেখাপড়ায়ও ভালো ।  এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে ।
মেয়েটা ছোট । ক্লাস ফাইভে উঠেছে এবার ।

‘বাবা আটটা বাজে । নয়টায় ক্লাস আছে আমার’ । তাগাদা দিয়ে গেল আরমান ।

সত্যিই আর দেরি করা যায় না । ডাইনিং এ খেতে বসলেন আরিফ সাহেব । ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খবর নিলেন । এই সময়টায় সবার সাথে একসাথে দেখা হয় । রাতে কখন আসতে পারেন তার কোন ঠিক নেই ।

গাড়ি চলে এসেছে । পোষাক পরে নিলেন আরিফ সাহেব । আরমান ও আনিতাকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবেন ।


***
-‘স্যার, স্যার । জ্বী স্যার । স্যার । কোন সমস্যা হবেনা স্যার’ ।

কমিশনার সাহেবের ফোন । আরিফ সাহেব শুধু শুনে গেলেন । এটাই নিয়ম । স্পষ্ট নির্দেশ, কোনরকম মিটিং শোভাযাত্রা হতে দেয়া যাবে না ।

ফোর্স রেডি করে বেরিয়ে পড়লেন আরিফ সাহেব । খবর এসেছে, পূর্বঘোষিত স্থানে জড়ো হতে শুরু করেছে মানুষ । কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিল শুরু করবে ।

ফোর্স সহ গিয়ে প্রথমে মাইকে ঘোষণা দিলেন জনতাকে ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যাবার জন্য । কিন্তু দেরি না করে তখনই মিছিল শুরু করে দিলো তারা ।
শুরু হলো লাঠিচার্জ । টিয়ার শেল ছুড়তে হলো । কিন্তু কোনভাবেই নিবৃত করা যাচ্ছেনা জনতাকে । বরং ওরাও ইট পাটকেল মারা শুরু করলো ।

এরপরই গুলি করার নির্দেশ দিলেন আরিফ সাহেব ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল মানুষ । যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেলো ।

গ্রেপ্তারকৃতদের থানায় পাঠিয়ে নিজেও অফিসে চলে এলেন আরিফ সাহেব । এসেই শুনলেন আহত দুজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে । বাকিদেরকে হাজতে রাখা হয়েছে ।

অফিসে বসে টিভিটা অন করলেন তিনি । কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিকরা চলে আসবে মতামত নেয়ার জন্য । তার আগে একবার দেখা দরকার স্ক্রলিং এ ওরা কী দিয়েছে ।

রিমোট হাতে একের পর এক চ্যানেল চেঞ্জ করতে লাগলেন আরিফ সাহেব । অনেকগুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল এখন । চ্যানেলগুলোতে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের সংঘাতের খবর দেখাচ্ছে । একটা চ্যানেলের পর্দায় চোখ পড়তেই সারা শরীরে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল আরিফ সাহেবের। লাইভ দেখাচ্ছে, তাঁর এরিয়ায় তাঁর অধীনস্ত ফোর্সের গুলিতে আহত হওয়া দুইজনের একজন তাঁরই ছেলে আরমান । ভুলেই গিয়েছিলেন, ঐ পথ দিয়েই তো কলেজ থেকে ফেরার কথা আরমানের । স্পষ্ট দেখলেন তিনি, স্ট্রেচারের ওপর আরমানের নিথর দেহটা পড়ে আছে হাসপাতাল এমার্জেন্সির ভেতর । এমনও কি হতে পারে, আরমানও প্রতিবাদ মিছিলে গিয়েছিল ?

মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো আরিফ সাহেবের । ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে গেলেন তিনি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন