এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

স্বাধীন হয়েছি, গোলামী ছাড়ি নাই

প্রতিবার বিসিএস এর গেজেটের পর দেখা যায়, বিসিএস এর প্রিলিমিনারী, লিখিত, ভাইভা সকল ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্মকমিশন(পিএসসি) কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হবার পরেও অনেকেই চূড়ান্ত গেজেটে বাদ পড়ছেন। তাদেরকে 'বাদ দেয়া' হচ্ছে। গত তিন বিসিএস থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত ২৮১ জনকে চূড়ান্ত গেজেটে বাদ দিয়ে নিয়োগবঞ্চিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ৩৫ তম বিসিএস এও বাদ দেয়া হয়েছে পিএসসির সুপারিশকৃত শ'খানেক প্রার্থীকে।
বাদ দেয়া হয় মূলত পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে। এইটা একটা চরম হাস্যকর ব্যাপার যে, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন থেকে পাস করে, লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর ভেতর থেকে ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ন যারা, তাদের চাকরি দেয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নেয় কিনা থানার একজন এসআই অথবা ওসি!! সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এতে পিএসসির অপমান হয় কিনা তা আমার জানা নাই। পিএসসি মানী প্রতিষ্ঠান, জুতা দিয়ে পেটালেও বোধহয় তার মান যায় না।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বিদগ্ধ প্রফেসররা ভাইভা নিয়ে যাদের ক্লিয়ারেন্স দেন, তাদের আটকে দেয় কিনা থানার এসআই!!! কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়, ও ভাইরে!!
এবার যেটা হয়েছে সেটা ভয়ংকর, জঘন্য। প্রার্থীর নিজেরসহ তার বাবা মা ভাই বোন চাচা মামা খালু নানা দাদা সবার রাজনৈতিক পরিচয় নেয়া হয়েছে। বাবা কিংবা চাচা বিরোধী দলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন- সেই কারণ দেখিয়ে নিয়োগ বঞ্চিত করা হয়েছে প্রার্থীদের। পড়ালেখা কোন যোগ্যতা নয়, বাপের রাজনৈতিক পরিচয়ই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কিংবা অযোগ্যতা!!! সেলুকাস! বড় বিচিত্র সিস্টেম!!!
পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য প্রতিবেশি, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে তথ্য নেয়া হয়। এইটা কতটা বাস্তবসম্মত? একই পরিবারেও তো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক থাকে। থাকে পারিবারিক বিরোধ। থাকে ভিলেজ পলিটিক্স। থাকে জায়গা জমি সম্পত্তি বা ব্যবসা নিয়ে বিরোধ। ঐ স্থানীয় নেতা বা ঐ প্রতিবেশি যে ঠিক তথ্য দিচ্ছে তার নিশ্চয়তা কী?
তাহলে কি প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে স্থানীয় নেতাদের তৈলমর্দনের যোগ্যতাই বড়?
একজন প্রার্থীর পরিবারের সব সদস্যও যদি সরকারবিরোধী হয়, তাতেই কি এটা নিশ্চিত হয় যে সেও সরকারবিরোধী হবে? কিংবা একজন মানুষ যদি ছাত্রজীবনে অন্য মতাদর্শ পোষণ করে, জীবনের বাকি সময়েও সে যে একই চিন্তায় থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা আছে? মানুষের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয় না? তাও আমাদের মত দেশে, যেখানে বছর বছর দল পাল্টানোই নিয়ম।
পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার যে মাঠ কর্মকর্তা, তিনি যে বায়াসড হন না তার নিশ্চয়তা কী? উপেক্ষা করার মত বিষয়কে তিনি কি বড় করে দেখাতে পারেন না? ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই আবার আসে- তাহলে কি পিএসসির চেয়ে পুলিশের একজন এসআই এর ক্ষমতা বেশি? গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার ক্ষমতা বেশি? একজন ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, বরং গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট করাটাই তার প্রধান যোগ্যতা?
গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ কর্মকর্তাকে দম্ভভরে এমন কথা বলতে শুনেছি- আপনার চাকরি তো আমার হাতে। আমি যা লিখবো তার ওপর নির্ধারণ হবে আপনার নিয়োগ!!
আর ভেরিফিকেশনের নামে কার পকেটে কত জমা পড়ে, সে হিসাব নাহয় নাই করলাম।
আসি মামলার কথায়। কয়েকজনের নিয়োগ আটকে দেয়া হয়েছে, কারণ- তাদের নামে নাকি মামলা আছে। কারো নামে মামলা থাকলেই তার নিয়োগ আটকে যাবে- কী অদ্ভুত নিয়ম!!! মামলা তো যেকেউ করতে পারে শত্রুতা বশত। এই অযুহাতে চাকরি আটকানো কি বিচারের আগেই শাস্তি দেয়া নয়? এইটা কে না জানে যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মামলাই হয়রানিমূলক, ষড়যন্ত্রমূলক। এমন ঘটনাও আমার জানা আছে, অমুকের ছেলে বিসিএস পাশ করেছে শুনে পরদিনই তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে তমুক।
মজার ব্যাপার হলোঃ মামলা নিয়ে দেশের মন্ত্রী এমপি হওয়া যাবে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের সামান্য কর্মচারী হওয়া যাবে না। সেলুকাস! কী বিচিত্র নিয়ম!!
বিসিএস উত্তীর্ণরা সবাই দীর্ঘদিন ধরে বিসিএস এর প্রিপারেশন নিয়েছে, ধৈর্য ধরে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। প্রজাতন্ত্রের সেবা করার ইচ্ছা ও মানসিকতা না থাকলে কেউ কি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়ার জন্য এত কষ্ট করে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদেরকে সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বঞ্চিত করাতে দল বা প্রজাতন্ত্রের কী উপকারটা হবে?
ব্রিটিশ আমলে আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) এ নিয়োগের জন্য ব্রিটিশরা পুলিশের মাধ্যমে খবর নিত, প্রার্থী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত কিনা। স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত কিনা।
ভারত স্বাধীন হবার পর সত্তুর বছর কেটে গেছে। আমরা দুইবার স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু ঔপনিবেশিক গোলামীর সিস্টেম ছাড়তে পারি নাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন