প্রায়
প্রতিদিনই এরকম হয় । হাসপাতালের করিডোরে কিংবা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি । হঠাৎ একজন লোক
দৌড়ে এল ।
স্যার
স্যার, কেমুন আছেন ?
আমি
বলি, আছি ভালো ।
চিনতে
না পারা চাহনি নিয়ে তাকাই ।
লোকটা
বলে – স্যার আপনি আমার বাবা/ভাইয়ের চিকিৎসা করছিলেন স্যার ।
ওয়ার্ডে
কতজনকেই তো চিকিৎসা দেয়া হয় । ক’জনের কথাই বা মনে থাকে ! তাই কখনো হয়তো চিনতে
পারি, কখনো পারিনা ।
তবু
বলি, ও হ্যা হ্যা – কেমন আছেন এখন ?
চোখে
মুখে কৃতজ্ঞতার ডালি নিয়ে বলে, ভালো স্যার । আপনার কথা আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে স্যার । আপনার
জন্যে আমরা দোয়া করি স্যার ।
আমি
বলি- আবার যদি কখনো কোন সমস্যা হয়, হাসপাতালে আসবেন । চলে যাই । অনুভব করি, পেছনে
এই লোকটা তাকিয়ে আছে আমার চলার পথের দিকে ।
কী
করেছি আমি তার জন্যে ? হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসে । সবাই চিকিৎসা পায় ।
ক’জন রোগী ডাক্তারের কথা মনে রাখে ? কেন লোকটা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ?
আমি
ভেবে দেখি । সবাই যা চিকিৎসা পায়, ঐ রোগীও হয়তো তাই পেয়েছে । আমার কাছ থেকে বেশি
যেটুকু পেয়েছে তা হলো- একটু ভালো ব্যবহার, একটু মন খুলে কথা বলার সুযোগ । কোনকিছু
না বুঝলে নিঃসংকোচে আমাকে বলার সুযোগ । হয়তো ওয়ার্ড বয়, নার্স বা অন্য সহকর্মী
ডাক্তারের কাছে সে এতটা পায়নি ।
আমি
সবসময় ভাবি, একজন ভালো মানুষ যখন রোগী হয়ে আসে তখন সে, তার পরিবার সবাই টেনশনে
থাকে । এমন অনেকে আছে , হয়তো জীবনে এই প্রথমবার সে এসেছে এই বড় শহরে । বড়
হাসপাতালে । সে ঠিকমত পথঘাটই চেনে না এই শহরের । চেনেনা অলিগলি এই হাসপাতালের ।
জানেনা কী করতে হবে তাকে । যদি একটু বুঝিয়ে বলি, একটু আন্তরিকভাবে কথা
বলি, আশ্বস্ত করি- ক্ষতি কী ? মাঝে মাঝে
ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে রুমে ফেরার সময় পথে কথা বলতে ছুটে আসে কেউ । বিরক্ত লাগে,
তবু হাসিমুখে দাঁড়াতে হয় । কারণ- ‘ভালো ব্যবহারই সওয়াব’ । এইটার অনেক প্রয়োজন
। আমি জীবনে অসংখ্য রোগী দেখবো , কিন্তু
হয়তো এই রোগী আর কখনোই আসবেনা এই হাসপাতালে ।
কিন্তু
এই স্মৃতিটুকু সে বহন করবে সারাজীবন ।
সরকারী
হাসপাতালে এত রোগী আসে , অনেক সময় মেজাজ গরম হয়ে যায় । এর মাঝে যদি থাকে
‘ডাক্তারকে বাড়ির চাকর মনে করা’ কিংবা ‘ডাক্তারের চেয়ে বেশি বোঝে’ টাইপের রোগী বা
এটেন্ড্যান্ট- তাহলে তো মেজাজ সপ্তমে ওঠে । (এদেরকে ডেকে কখনো কখনো বোঝাই, কখনো
ভদ্র ভাষায় কিঞ্চিৎ অপমানও যে করা হয়না তাও নয় । এটা তাদের প্রাপ্যই মনে হয়
।)
এই সবের
মাঝেও মেজাজ ঠান্ডা রেখে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং করাটাই
ডাক্তারের জীবনের চ্যালেঞ্জ । যখন পথের ধারে এমন করে কেউ সালাম দিয়ে দোয়া করে, যখন
বহুদিন পরে অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগী তার পুরনো ওয়ার্ডে এসে খোঁজ নেয়- অমুক
স্যার আছে কিনা , তখন অন্তরে যে ভালোলাগা কাজ করে , তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা
হয়না ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন