এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

ডাক্তার জীবনের সুখ



প্রায় প্রতিদিনই এরকম হয় । হাসপাতালের করিডোরে কিংবা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি । হঠাৎ একজন লোক দৌড়ে এল ।
স্যার স্যার, কেমুন আছেন ?
আমি বলি, আছি ভালো ।
চিনতে না পারা চাহনি নিয়ে তাকাই ।
লোকটা বলে – স্যার আপনি আমার বাবা/ভাইয়ের চিকিৎসা করছিলেন স্যার ।
ওয়ার্ডে কতজনকেই তো চিকিৎসা দেয়া হয় । ক’জনের কথাই বা মনে থাকে ! তাই কখনো হয়তো চিনতে পারি, কখনো পারিনা ।
তবু বলি, ও হ্যা হ্যা – কেমন আছেন এখন ?
চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার ডালি নিয়ে বলে, ভালো স্যার । আপনার  কথা আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে স্যার । আপনার জন্যে আমরা দোয়া করি স্যার ।
আমি বলি- আবার যদি কখনো কোন সমস্যা হয়, হাসপাতালে আসবেন । চলে যাই । অনুভব করি, পেছনে এই লোকটা তাকিয়ে আছে আমার চলার পথের দিকে ।

কী করেছি আমি তার জন্যে ? হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসে । সবাই চিকিৎসা পায় । ক’জন রোগী ডাক্তারের কথা মনে রাখে ? কেন লোকটা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ?
আমি ভেবে দেখি । সবাই যা চিকিৎসা পায়, ঐ রোগীও হয়তো তাই পেয়েছে । আমার কাছ থেকে বেশি যেটুকু পেয়েছে তা হলো- একটু ভালো ব্যবহার, একটু মন খুলে কথা বলার সুযোগ । কোনকিছু না বুঝলে নিঃসংকোচে আমাকে বলার সুযোগ । হয়তো ওয়ার্ড বয়, নার্স বা অন্য সহকর্মী ডাক্তারের কাছে সে এতটা পায়নি । 

আমি সবসময় ভাবি, একজন ভালো মানুষ যখন রোগী হয়ে আসে তখন সে, তার পরিবার সবাই টেনশনে থাকে । এমন অনেকে আছে , হয়তো জীবনে এই প্রথমবার সে এসেছে এই বড় শহরে । বড় হাসপাতালে । সে ঠিকমত পথঘাটই চেনে না এই শহরের । চেনেনা অলিগলি এই হাসপাতালের । জানেনা কী করতে হবে  তাকে ।  যদি একটু বুঝিয়ে বলি, একটু আন্তরিকভাবে কথা বলি, আশ্বস্ত করি- ক্ষতি কী  ? মাঝে মাঝে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে রুমে ফেরার সময় পথে কথা বলতে ছুটে আসে কেউ । বিরক্ত লাগে, তবু হাসিমুখে দাঁড়াতে হয় । কারণ- ‘ভালো ব্যবহারই সওয়াব’ । এইটার অনেক প্রয়োজন ।  আমি জীবনে অসংখ্য রোগী দেখবো , কিন্তু হয়তো এই রোগী আর কখনোই আসবেনা এই হাসপাতালে ।
কিন্তু এই স্মৃতিটুকু সে বহন করবে সারাজীবন ।

সরকারী হাসপাতালে এত রোগী আসে , অনেক সময় মেজাজ গরম হয়ে যায় । এর মাঝে যদি থাকে ‘ডাক্তারকে বাড়ির চাকর মনে করা’ কিংবা ‘ডাক্তারের চেয়ে বেশি বোঝে’ টাইপের রোগী বা এটেন্ড্যান্ট- তাহলে তো মেজাজ সপ্তমে ওঠে । (এদেরকে ডেকে কখনো কখনো বোঝাই, কখনো ভদ্র ভাষায় কিঞ্চিৎ অপমানও যে করা হয়না তাও নয় । এটা তাদের প্রাপ্যই মনে হয় ।) 

এই সবের মাঝেও মেজাজ ঠান্ডা রেখে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং করাটাই ডাক্তারের জীবনের চ্যালেঞ্জ । যখন পথের ধারে এমন করে কেউ সালাম দিয়ে দোয়া করে, যখন বহুদিন পরে অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগী তার পুরনো ওয়ার্ডে এসে খোঁজ নেয়- অমুক স্যার আছে কিনা , তখন অন্তরে যে ভালোলাগা কাজ করে , তার সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয়না ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন