এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩

ডঃ আব্দুল্লাহর চা- বিদ্বেষ

ডঃ আব্দুল্লাহ মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞানী হলেও এবার তিনি ভাবলেন – অর্থনীতি নিয়ে লিখবেন । কারণ অর্থনীতির সাথে অনেক কিছুই জড়িত । দেশের অর্থনীতি উন্নত হলে সবকিছুই উন্নত হবে ।
কী লিখবেন ? এ নিয়ে বেশ কিছুদিন চিন্তা করে অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হলেন । মোক্ষম শিরোনাম দিলেন ‘চা পান বন্ধ করুন’ ।
তিনি প্রথমেই তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর । কবি নাকি লিখেছিলেন-
ওহে চৈনিক,
চা খাবে দৈনিক ।  
গায়ে বল হলে পরে,  
তবে হবে সৈনিক !!

এইটা কেমন কথা ? চা খেলে গায়ে বল হবে এই কথা কে বললো ? কোন বিজ্ঞানীও যদি বলে থাকে , তবে সে বেকুব বিজ্ঞানী । চৈনিক দের উদ্দেশ্যে লিখলেও চীনা ভাষায় এই লেখার অনুবাদ হয়েছে কিনা সেরকম কোন তথ্য নেই । অনুবাদ হলে কেমন হতো ? চ্যাং চুং প্যাং পুং ছাড়া আর কী হবে !

কিন্তু এইযে চা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত কবি লিখে গেলেন, তিনি কি ভেবেছিলেন বাঙ্গালিদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া কত খারাপ হতে পারে ?
কবি সাহিত্যিকদের এই এক সমস্যা । এরা নিজেরা অলস, আর কীসব হাবিজাবি লেখে- দেশের অর্থনীতির ওপর তার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করেনা ।
আজ যদি বাঙালিরা চা না খেত, তাহলে দেশের কত টাকা বেঁচে যেত ! ডঃ আব্দুল্লাহ তাঁর প্রবন্ধে খুব গুরুত্বের সাথে এই তথ্যটা তুলে ধরলেন । চা-খাদক দের তিনি ‘অপচয়কারী’ ও ‘জাতির শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করলেন ।
বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ । এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানুষ চা খায় । অনেকে আবার দিনে কয়েক কাপ করে খায় । গড়ে প্রতিদিন ২০ কোটি কাপ চা খায় বাংলাদেশের মানুষ । চায়ের দোকানগুলো আসলে একেকটা অলসের আড্ডাখানা !
প্রতি কাপ চায়ের দাম কত ? ৫ টাকা করে ধরলে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকা চা খেয়ে নষ্ট করছে বোকা বাঙালি । এক বছরে ৩৬৫ দিন । তাহলে বছরে ৩৬৫০০ কোটি টাকা শুধুমাত্র চা খেয়ে নষ্ট করছে বাংলাদেশের মানুষ । উফ ! যা-তা কথা ? ৩৬৫০০ কোটি টাকা ! এটা তো বাংলাদেশের মোট বার্ষিক বাজেটের ৫ ভাগের এক ভাগ !
যদি আজ থেকে বাংলাদেশের মানুষ চা খাওয়া বন্ধ করে তাহলে সাশ্রয় হবে ৩৬৫০০ কোটি টাকা । শুধু কি তাই ? এইযে না খেয়ে চা বিদেশে রপ্তানী করা হবে – তাতে কি কম টাকা আসবে ? দ্বিগুন লাভ । দেশ ও জাতির উন্নতি চাইলে দেশের মানুষকে এটা বুঝতে হবে ।
তিনি প্রবন্ধে জাতির উদ্দেশ্যে আহবান জানালেন, ‘ভাইয়েরা , আসুন চা খাওয়া বন্ধ করি, দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার শপথ নেই’ ।
আর সরকারের প্রতি অনুরোধ করলেন, দাবি জানালেন- যদি জনগন নিজে থেকে চা খাওয়া বন্ধ না করে তাহলে যেন আইন করে দেশের ভেতরে চা বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ।

এরপর তিনি স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্ষতি সম্পর্কে লিখলেন । চা-তে যে কেমিক্যাল থাকে সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর । চায়ে থাকে ট্যানিন, এটা আয়রন সহ আরো অনেক মিনারেল ও ভিটামিন এবজরপশনে বিঘ্ন ঘটায় । গবেষণায় দেখা গেছে , এক কাপ চা ১১% আয়রন এবজরপশন কমিয়ে দেয় । ফলে আয়রন ডেফিশিয়েন্সি এনিমিয়া সহ আরো নানান অসুখ হতে পারে ।
এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে – যারা বেশি বেশি চা খায় তাদের প্রস্টেট ক্যান্সার বেশি হয় ।

সবশেষে তিনি এক মোক্ষম যুক্তি তুলে ধরলেন । ডঃ আব্দুল্লাহ ভালো করেই জানেন বাঙ্গালির চরিত্র কী । কী লিখলে বাঙালি হৈ হৈ রৈ রৈ রব তুলবে ।
বাঙালি জাতি সন্দেহপ্রবণ এবং অন্যের ওপর দোষ চাপাতে সিদ্ধহস্ত । চোগলখুরীতে এদের জুড়ি নেই । সবকিছুর পেছনে এরা ষড়যন্ত্র খুঁজে পায় । বিশেষ করে বিদেশী ইন্ধন !
কোন কিছু লিখে যদি মোটামুটি বুঝিয়ে দেয়া যায় যে- এর পেছনে ‘বৈদেশিক’ ইন্ধন আছে তাহলেই কেল্লা ফতেহ । পত্র-পত্রিকা, রাস্তা-ঘাট সবজায়গায় তুলকালাম হয়ে যাবে । চায়ের কাপে ঝড় উঠবে ।
এবার অবশ্য চিন্তার ব্যাপার হলো- চায়ের বিরুদ্ধেই তো লেখা , চায়ের কাপে ঝড় তোলার সুযোগ থাকবে না ।
ডঃ আব্দুল্লাহ তাঁর প্রবন্ধে লিখলেন- ‘অতীব দুঃখের বিষয়, আমরা বাঙালি জাতি বিদেশীদের চক্রান্তের শিকার হয়েছি । এই চা খাওয়ার প্রচলন করেছে চীনারা । এর বৈজ্ঞানিক নাম- ক্যামেলিয়া সিনেনসিস । বহুকাল আগ থেকে চীনারা চা খাওয়া শুরু করে । তারা একে বলতো চি । কালক্রমে সেই চি – আমাদের দেশে চা হিসেবে পরিচিত হয়েছে । ব্রিটিশরা এদেশে চা খাওয়ার প্রচলন করে । চীনারা ষড়যন্ত্র করে ব্রিটিশদের মাধ্যমে আমাদের দেশে চা খাওয়ার চল ঘটায় । আমরা ব্রিটিশদের হটিয়েছি । কিন্তু আফসোস ! চা-কে আজো হটাতে পারিনি । আজ ব্রিটিশ জাতি উন্নত হয়েছে, চীনারা উন্নত হচ্ছে কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা চা খেয়ে খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি । আসুন এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাড়াই’ ।
লিখতে লিখতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন ডঃ আব্দুল্লাহ । তিনি লিখে চললেন -
‘চা খাওয়ার ফলে শুধু কি অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে ? প্রতি কাপ চা খেতে কমছে কম পাঁচ মিনিট করে সময় ব্যয় হয় । বিশ কোটি কাপ চা খেতে লাগে ১০০ কোটি মিনিট । এর মাধ্যমে আমাদের জনগনের প্রতিদিন ১কোটি ৬৭ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে । মানুষজন অলস হয়ে পড়ছে । আর এর ফলাফল গিয়ে পড়ছে আমাদের অর্থনীতির ওপর । ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি । চিন্তা করুন তো ১ কোটি ৬৭ লাখ ঘন্টা কাজ করলে কত কাজ করা যেত ? তাই অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে, দেশ ও জাতিকে উন্নত করতে হলে অবশ্যই আমাদের চা খাওয়া বন্ধ করতে হবে’ ।

যেহেতু চা খাওয়া বন্ধ হলে চায়ের কাপে ঝড় তোলার সুযোগ থাকবে না , সেজন্য তিনি প্রবন্ধে জনগনকে দুধ খাওয়ার পরামর্শ দিলেন । তিনি দুধের নানা পুষ্টিগুন সম্পর্কে লিখলেন । সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে , চা খাওয়া বন্ধ করলেই তো হবেনা – এর বিকল্প কিছু তো দিতে হবে । ভালো কিছু দিয়ে মন্দকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে ।
.................................

লেখা শেষ করে চেয়ারে হেলান দিলেন ডঃ আব্দুল্লাহ । তিনি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন- কীভাবে কাল এই প্রবন্ধ নিয়ে ‘দুধের কাপে ঝড়’ উঠবে সারাদেশে । আগামী কয়েক দিন আলোচনার বিষয় হবে একটিই । চা কীভাবে আমাদের অর্থনীতিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে ! গ্রামে গঞ্জে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে চা নিষিদ্ধ করার দাবিতে । হাইকোর্টে রিট হবে । টেলিভিশনের টকশোতে আলোচনা জমে উঠবে । দর্শকরা ফোন করে আলোচকদের বেকায়দায় ফেলে দেবে । পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম হবে । সরকারী দল ও বিরোধী দল সামনের নির্বাচনে তাদের ইশতেহারে চা-নিষিদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিবে । কোন কোন স্থানে চায়ের দোকানে ভাংচুর হবে । দোকান মালিক সমিতি ধর্মঘট ডাকবে । রাস্তায় প্যাঁ- পুঁ করে ছুটবে পুলিশের গাড়ি । বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে । সব মিলে এক হুলস্থুল পড়ে যাবে সারাদেশে ।
মুচকি হেসে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলেন ডঃ আব্দুল্লাহ ।
তিনি এখন তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করবেন । এরা চেইন চা-খোর । তাদেরকে পরামর্শ দিবেন, জীবনে শেষবারের মত এক কাপ চা খেয়ে নেয়ার জন্য – কারণ কাল থেকেই হয়তো আর কোথাও চা পাওয়া যাবেনা ।

ছাত্রজীবন থেকেই ডঃ আব্দুল্লাহ চা-বিরোধী । তাঁর এখনো মনে পড়ে, হোস্টেলের বাইরে টং দোকানে বন্ধুরা সবাই চা খেতে যেত । দিনে কমপক্ষে পাঁচবার । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে পাঁচ কাপ চা । বন্ধু কিবরিয়া, জনি, রাগিব, মাসুম, রিয়াদ, জুয়েল এরাই ছিল মূল চা-খোর । ডঃ আব্দুল্লাহ চা না খেলেও ওদের সাথে যেতেন । ওরা চা খায়, আর তিনি খান ‘বন্ধুত্ব’ , ‘ভালোবাসা’ । তিনি খেয়াল করেছেন, চায়ের কাপে যেসব ঝড় ওঠে সেগুলো বেশিরভাগই বেহুদা । বন্ধুদের সাথে একসাথে থাকাটাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য । সেটাই তো ভালোবাসার দাবি নাকি ?
মাঝে মাঝে ওরা জোর করে চা খাওয়াতো । মানে আগেই অর্ডার দিয়ে দিত । এখন কী আর করা ! অর্ডার যখন দিয়েই ফেলেছে, তখন তো আর বসে থাকা যায় না নাকি ! তাই একটু আধটু মাঝে মাঝে ডঃ আব্দুল্লাহকেও খেতেই হত । বন্ধুদের অবশ্য অনেকবারই তিনি অর্থনীতিতে চায়ের এই মহা-ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে বলেছেন কিন্তু তারা কান দেয়নি । এবার বাছাধন যাবি কোথায় ? এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার সাথে সাথে দেশ থেকে চা উঠে যাবে । ডঃ আব্দুল্লাহর মত বিজ্ঞানী একটা প্রবন্ধ লিখলে সেটা সরকার আমলে না নিয়ে পারবে না । দেখি তোরা এখন কেমনে চা খাস ! হুহ !  

হঠাৎ ডঃ আব্দুল্লাহর মনে পড়লো, তাঁর ঘরেও কয়েকটা টি-ব্যাগ আছে । তাঁর স্ত্রী মিমু প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে চা খায় । এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর তো আর খেতে পারবে না ! উম্ম... ডঃ আব্দুল্লাহ ভাবলেন, শেষবারের মত তিনি নিজেও এক কাপ চা খেতেই পারেন !

তিনি স্ত্রী মিমুকে ডাকলেন । ‘দু’কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসো । ব্যালকনিতে চাঁদের আলো এসে পড়েছে । একসাথে বসে চা-খেতে খেতে কথা বলি ।
অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন ডঃ আব্দুল্লাহর স্ত্রী মিমু । আর ডঃ আব্দুল্লাহ মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন । আর কেউ না দেখলেও দেয়ালের একটা টিকটিকি ঠিকই দেখে ফেললো- ডঃ আব্দুল্লাহ তার দু’পাটি প্রসারিত দাঁত ডানহাত দিয়ে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন !


[ডঃ আব্দুল্লাহর যুগান্তকারী আবিস্কার ও মহানুভবতা সম্পর্কে পড়ুন কমেন্টে দেয়া লিংক থেকে !] 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন