এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ১৩ মে, ২০১৭

হাওরের দুঃখগাঁথা

"আমার বয়স ৮০ বছরেরও বেশি হইছে। এই হাওরেই বড় হইছি। আমার জীবনে আমি এরকম বিপর্যয় দেখি নাই।"
বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জনাব মুসলিম উদ্দিন। হামলাদিঘা হাওরে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ। নিজে শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, জোরেসোরে হাঁটতে পারেন না। কিন্তু হাওরের এই মারাত্মক বিপর্যয়ে হাওরের মানুষকে তিনিই সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন। ত্রাণ নিতে আসা হাওরবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেনঃ আপনারা সাহস হারাবেন না। হতাশ হবেন না। আল্লাহ আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
হাওরের মানুষের বিপদে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায়। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। মাঝে জেগে আছে ছোট ছোট চর। সেখানেই মানুষের বাস। ১০-২০ টি পরিবার নিয়ে একেকটি পাড়া। এক পাড়া হতে আরেক পাড়ায় যাওয়ার জন্য নৌকাই একমাত্র বাহন। সেখানে হাওরবাসীদের দুর্দশা সচক্ষে দেখলে যে কারো মন কেঁদে উঠবে।
হাওরে বন্যা প্রতিবছরই হয়। পানির ঢল নামে, বাঁধ উপচে ঘরবাড়িতে পর্যন্ত পানি ঢুকে যায়। কিন্তু সেটা এই সময়ে নয়। আরো মাস দুই পরে। ততদিনে ফসল ঘরে তোলা হয়ে যায়। হাওরের থৈ থৈ পানি তখন কোন সমস্যা তৈরি করে না।
কিন্তু এবার সেই ঢল এসেছে বড় অসময়ে। ধান তখনো পাকেনি। এমনকি কাঁচাও নয়। হঠাৎ উজানী ঢলে সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। একটা দানাও ঘরে তোলা যায় নাই।
ক্ষেত নাই, শ্রমজীবি মানুষের হাতে কোন কাজ নাই। কাজ নাই, অতএব উপার্জনও নাই। তাদের দিন কাটছে তাই চরম অনিশ্চয়তায়। কিছু জমানো টাকা, কিছু সাহায্য, কিছু ত্রাণ, এই হচ্ছে এখন তাদের জীবন চালানোর উপকরণ।
হাওর থেকে লক্ষ লক্ষ টন ধান উৎপাদন হত। এবার হয়নি কিছুই।
ধান চাষের জন্য কৃষকরা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই ঋণও এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারো কাছে যে আবার ঋণ নেবে সেই অবস্থাও নাই। ঋণদাতারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর চাষীদের ঋণ দিলে তারা শোধ করতে পারবে কিনা সে নিশ্চয়তাও নেই। দোকানীরা বাকিতে বিক্রি করছেন না। বাকির টাকা শোধ করবে কী করে?
মাছ মরে গেছে। এর কারণ হিসেবে চাউর হয়েছে ইউরেনিয়ামের কথা। তবে ইউরেনিয়ামের বাইরে আরেকটা ব্যাখ্যা হলো- ধানক্ষেতে যে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেগুলো পানিতে মিশে গেছে। সেকারণেই মরে গেছে মাছ এবং বেশকিছু পশুপাখি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আশঙ্কা করছেন, পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিলে দুর্ভিক্ষ হতে পারে হাওর এলাকায়।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবীর দাশ বললেন, তার ইউনিয়নে ৬০০০ পরিবারের বসবাস। সরকারী সাহায্য থেকে দু'হাজার পরিবারকে কিছু সাহায্য করা যাচ্ছে। বাকি থাকছে আরো চারহাজার পরিবার। তিনি অনুরোধ করেছেন, হাওরের মানুষের কষ্টের কথা যেন আমরা ঢাকার মানুষদের কাছে বলি। সরকারের কাছে বলি। সবাই যেন বিপন্ন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
সবমিলিয়ে অনেক কষ্টে আছে হাওরের মানুষ। এখন তবুও কিছু জমানো টাকা খরচ করা যাচ্ছে। কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। দু-তিন মাস পরে যখন সবাই এই বিপর্যয়ের কথা ভুলে যাবে, তখন কী হবে ভাবতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন তারা।
হাওরের মানুষের সামনে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা। ভবিষ্যতের কথা ভাবলে এখন তাদের চোখে শুধুই অন্ধকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন