বাবা মা নাম রেখেছিলেন এরশাদ,
কিন্তু মেডিকেল কলেজে এসে কীভাবে কীভাবে যেন তাঁর নাম হয়ে গেল ‘আরশাদ’ ।
এতে অবশ্য ভালই হয়েছে, নইলে ‘এরশাদ’ নামের যন্ত্রণায় তাঁকে অনেক ভোগান্তি
পোহাতে হত । এরশাদ শব্দের অর্থ আজকাল যা দাঁড়িয়েছে – অনেকে অনেক কথা বলে
হাসাহাসি করে । এক কথায় প্রকাশ করুন – ‘সকালে এক কথা , বিকালে আরেক কথা’ ।
উত্তরঃ এরশাদ । ‘সরকারের গৃহে পালিত হয় যে পশু’ । উত্তরঃ এরশাদ ! আরো কত কী
! সেদিক থেকে আরশাদের রক্ষে হয়েছে বৈকি ! বাবা-মা’রই বা দোষ কী ? যখন ওর
জন্ম হলো- সেই ১৯৮৬ সালে , তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের জয়জয়কার , বাংলাদেশের
একচ্ছত্র অধিপতি ! বিপুল জনপ্রিয়তা ! কে জানতো, সেই এরশাদের এই অবস্থা হবে ?
মীরজাফরের বাবা-মা কি জানতেন, তাঁদের ছেলের নাম যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকের
প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হবে ?
আরশাদ এখন আর শুধু ‘আরশাদ’ নেই । হয়ে গেছে ডাঃ আরশাদ । কিন্তু তাঁর অবস্থা ছুটি গল্পের ফটিকের মত । রবীঠাকুর বলেছিলেন , তের-চৌদ্দ বছরের ছেলের মত এমন বালাই আর নাই । কিন্তু আরশাদের মনে হয়- কবিগুরু যদি এই ২৫-২৬ বছরের সদ্য পাশ করে বেরুনো কোন ডাক্তারের কথা জানতেন তাহলে তিনি লিখতেন, ২৫-২৬ বছর বয়সের নবীন ডাক্তারের মত এমন বালাই আর নাই । না পারে কিছু কইতে, না পারে সইতে ।
একজন ডাক্তারের জীবনে সবচেয়ে কঠিন যে সময়গুলো পার হতে হয়- আরশাদ এখন সেরকম একটি পিরিয়ড অতিক্রম করছে । কুয়োর ব্যাঙকে হঠাৎ গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা হবে , সেই অবস্থা । চোখের সামনে শুধু অন্ধকার । আশা আকংখার সাথে বাস্তবতার আর প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে হিমশিম । কোথায় অর্থ, কোথায় সম্মান – কোথায় কী ? এই বয়সে হঠাৎ করে ‘ডাক্তার’ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি থেকে আর টাকা চাওয়াও যায় না – লজ্জার ব্যাপার । মধ্যবিত্ত সংসারে সে বিলাসিতার সুযোগও নেই । এখন নিজের পেটের দায় নিজেকেই মেটাতে হবে । ছেলে ‘ডাক্তার’ হয়েছে, মা-বাবা ভাইবোনেরও কি একটু আশা আকাঙ্ক্ষা থাকেনা – টানাটানির সংসারে এবার সুদিন আসবে । সংসারের হাল ধরবে ‘ডাক্তার’ ছেলে ! হাল যদি নাও ধরে, অন্তত কিছুনা কিছু কন্ট্রিবিউট করবে । সে প্রত্যাশার দায় কিছুটা হলেও তো মেটানো দরকার । বাবা-মার বয়েসও হয়েছে । এমন সময় যদি কিছু খেদমত করা না যায়- তাহলে আর এত পড়াশোনা, এত ডিগ্রী দিয়ে হবেটা কি ?
এই বয়সে আরশাদের ভার্সিটি পড়ুয়া বন্ধুরা তো অনেকেই ‘জবে’ ঢুকে গেছে । মাসে মাসে বেতন পাচ্ছে । কেউ কেউ বিয়েও করেছে । হুম, বিয়ে- সেতো আরেক দীর্ঘশ্বাসের নাম । বিয়ে যে করবে, কাকে করবে ? কীভাবে করবে ? খাওয়াবে কী ? নিজের তো এখনো চালও হলোনা, চুলোও হলোনা । ‘ডাক্তারে’র সাথে বিয়ে হবে, মেয়েটার মনে নিশ্চয়ই অনেক আশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা , অনেক প্রত্যাশা থাকবে । কিন্তু বাস্তবে কী পাবে ? ‘এক বুক ভালোবাসা’ ছাড়া আর কিছুই তো নেই তাঁর এখন ! হয়তো একসময় সবই হবে- অনেক কিছুই হবে, অর্থ, খ্যাতি, সম্মান । কিন্তু সেতো অনেক অনেক দেরি । এখন বাদাম চিবানোর জন্য ইচ্ছা আছে, দাঁত আছে কিন্তু টাকা নাই । টাকা হবে যখন , তখন আর বাদাম চিবানোর জন্য দাঁতই থাকবে না । অতদিনের সংগ্রামে নবযৌবনা একটি মেয়ে কেন সঙ্গ দেবে ? কার অতটা সাহস আছে ?
ইন্টার্ণশিপ শেষ মানে মেডিকেল প্রফেশনে শুরু মাত্র । নট ইভেন দা ভেরি বেগিনিং অব দা এন্ড । ক্যারিয়ার লাগবে । এফিসিপিএস, এমডি , এমআরসিপি লাগবে । নইলে যে ডাক্তার সমাজেই তৃতীয় শ্রেণী হয়ে থাকতে হবে । বাইরের কথা আর নাইবা ভাবা গেলো ! সেও কি যা-তা কথা ? সারাদেশের সকল ডাক্তারদের সাথে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে অল্প কিছু সিটের একটি বাগিয়ে নাও । বেগার খেঁটে ট্রেনিং নাও পাঁচ বছর । পরীক্ষা দিয়ে, থিসিস দিয়ে পাস করতে আরো ১-২ বছর । তার মানে আরো ৭-৮ বছরের ধাক্কা ।
বিসিএস ? হা হা । আনমনে হেসে ওঠে আরশাদ । সে তো আরেক দিল্লীকা লাড্ডু । মধ্যবিত্তের সন্তান , বিসিএস ক্যাডার হলে খারাপ হয়না । অন্তত মাসে মাসে কিছু টাকার তো নিশ্চয়তা আছে ! বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে বিসিএস এর মর্যাদাও বেশ আছে বৈকি ! কিন্তু এর অপর পৃষ্ঠে যে আরেক বেদনার হাহাকার । কোন গ্রামে পোস্টিং হবে কে জানে ? হয়তো বসারই ব্যবস্থা নাই । থাকার ব্যবস্থা, পিওন আর্দালি ফ্যান এসি সেসব তো আকাশের চাঁদ । গ্রামে ফেলে রাখবে তিন বছর । আরো বেশিও হতে পারে । কবে ট্রেনিং পোস্ট পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই । পোস্ট গ্রাজুয়েশন দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে উঠবে । বয়স বাড়বে । পড়ালেখার ঝোক-অভ্যাস কমে যাবে ।
অন্যান্য ক্যাডারে বয়স বাড়ে, অভিজ্ঞতা বারে , প্রমোশন হয় । হেলথ ক্যাডারে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ছাড়া প্রমোশন নাই । চাকরির বয়স যত বছরই হোক , থাকতে হবে একই পদে- উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে ।
পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে আরশাদ । কী করবে, কী করবেনা – সিদ্ধান্তহীনতার এক অকূল পাথারে ভাসছে সে । শুধু ভবিষ্যৎ চিন্তাই নয়, ক্যাম্পাস জীবনের অনেক স্মৃতিও তাঁকে তাড়া করে ফিরছে আজ । কত স্মৃতি ! বন্ধুরা আজ সবাই বিচ্ছিন্ন । যে যার পথে নেমে গেছে । ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে , জীবনের প্রয়োজনে । কারো কারো সাথে হয়তো এই জীবনে আর দেখাই হবে না । নীরবে নিভৃতে অনেকেই চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে । হয়তো কারো কারো খবর পাওয়া যাবে , কারো কারো সেটাও পাওয়া যাবেনা ।
ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের যেকোন আন্দোলন-সংগ্রামে আরশাদ ছিল সদা তৎপর । তারুণ্যে টগবগ তাজা রক্ত । আন্দোলন সংগ্রাম অধিকার আদায় এইসবের ভেতর যেমন আছে বিবেকের দায়শোধের তাড়না , তেমনি আছে এডভেঞ্চারও । যারা এগুলোর ভেতরে ছিলনা, তারা কখনো সেটা বুঝবেনা ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় ।
কিংবা
মানবজন্মের নামে কলংক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তরপুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই ।
এইগুলো টগবগে বিদ্রোহী তরুণদের প্রিয় কবিতা । আরশাদেরও তাই ছিল । কখনো কখনো ভরাট কন্ঠে বক্তৃতা দিতে হত আরশাদকে । ছাত্রছাত্রীদের সামনে । শ্লোগান উঠতো । হাততালি পড়তো । এডভেঞ্চারের শিহরণ বয়ে যেত শরীরে !
আকাশে মেঘ করেছে । গ্রীষ্মের শেষাশেষি । এই সময়ে আকাশ যখন তখন কালো মেঘে ঢেকে যায় । বৃষ্টি নামে । আজও পশ্চিম দিকে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দও হচ্ছে । সেদিকে অবশ্য আরশাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
পেছন থেকে হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শে অনেকটা চমকে ওঠে আরশাদ । একটা রিনরিনে কন্ঠ- পরিচিত লাগে, ‘কিরে আরশাদ, কেমন আছিস ?’
হতচকিত আরশাদ মুখ ফিরিয়ে তাকায় । একটা মেয়ে- পরিচিত , হ্যা খুব পরিচিত আরশাদের । ক্লাসমেট । অবশ্য শুধু ক্লাসমেট বললে ভুলই হবে হয়তো । একদিন... থাক সেসব কথা । কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ?
‘এখানে কী করছিস ? এখুনি বৃষ্টি নামবে, চল আমাদের গাড়িতে’ । আবার কন্ঠটা রিনরিন করে ওঠে ।
আরশাদ বিব্রত ভাবে উঠে দাঁড়ায় । ‘না মানে এমনি বসে আছি । কী খবর তোর ? কোত্থেকে হঠাৎ ?’
‘নে হ্যান্ডশেক কর । তোর দুলাভাই’ । সাথের ছেলেটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নীলা ।
আরশাদ হ্যান্ডশেক করে । ধন্যবাদ দিয়ে বলে , ‘না, তোরা যা । আমি আরো কিছুক্ষণ বসবো’ ।
আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা হয় । ‘এই কি করছিস এখন, কোথায় আছিস’ টাইপের । বৃষ্টির ফোঁটা পরতে শুরু করেছে । নীলা তাঁর স্বামীসহ গাড়িতে ওঠে । গাড়িটা চলতে শুরু করে । ‘ভালই আছে মেয়েটা’ । ভাবে এরশাদ ।
সুজাতাই আজ শুধু সব চেয়ে সুখে আছে , শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তাঁর । হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মোড়া সে, বাড়ি গাড়ি সবকিছু দামী তাঁর ।
মান্নাদে-র গান আপনা আপনি বেজে ওঠে আরশাদের বুকের গভীরে কোথাও ।
সেই নীলা । হাহ । আরশাদের একটু চোখের ইশারা পাবার জন্য কতইনা ব্যাকুল ছিল । কিন্তু আরশাদ একজন মুসলিম হিসেবে কখনো তাঁর অন্যায় চাওয়াকে প্রশ্রয় দেয়নি । আরশাদের এই দৃঢ়তা নীলাকে আরো বেশি আকর্ষিত করেছিল কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না । কিন্তু আরশাদের পুরুষালী ভরাট কন্ঠ যে নীলাকে খুব ভালোভাবেই টেনেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনি নীলা নিজেই । আরশাদ যেন আজ এত বছর পরেও স্পষ্ট শুনতে পায়- ‘আরশাদ , জানিস- আমি তোর কন্ঠের প্রেমে পড়ে গেছিরে’ ।
আরশাদের উপায় ছিলনা । বিয়ে করতে পারতো ? না, সে সুযোগ ছিলনা তাঁর ।
বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে । মোবাইলটা আজ আরশাদ সাথে করে আনেনি । ভালোই হয়েছে । আরশাদ বাঁধের ওপর বসলো আবার । ভাবনায় ফিরে গেলো সে । এই এতকিছুর মাঝেও সবই করতে হবে । ক্যারিয়ার, অর্থোপার্জন , সংসারের দায়িত্বগ্রহন, বিয়ের প্রস্তুতি- সব । বন্ধুরা তো অনেকেই বিয়েথা করে ফেলেছে । নীলা তো চোখের সামনেই চলে গেলো , দেখিয়ে গেলো । আর তাছাড়া বিয়ের ব্যাপারে আরশাদের চিন্তা হলো- দিল্লীকা লাড্ডু হোক আর করাচীকা লাড্ডু হোক, যদি পস্তাতেই হয় তবে খেয়ে পস্তানোই ভালো !
নাহ । এতসব চিন্তা করে লাভ নেই । যেসব ভয়ংকর দিন আরশাদ পার করে এসেছে তার তুলনায় সামনের এই অনিশ্চয়তা কিছুই নয় ।
জনশূন্য সমূদ্র সৈকতে ঝড়ো বাতাসের মাঝে, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, নীলার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আরশাদ চিৎকার করে আবৃত্তি করতে লাগলো –
এখন যৌবন যার , মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার , যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় ।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে আরশাদের বৃষ্টিভেজা মুখ একবার ঝলক দিয়ে উঠলো । কেউ দেখলে হয়তো মনে করবে – সে চিৎকার করে কাঁদছে । কিন্তু না – আরশাদ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।
এ জীবন যুদ্ধে তাঁকে যে জিততেই হবে ।
{আরেক সংগ্রাম / ১২-০৫-২০১৪}
[ পিঠবাঁচানোঃ সব চরিত্র কাল্পনিক । ইহার কোন অংশ কারো সহিত মিলিয়া গেলে তা কাক ও তালগাছের দোষ । লেখককে অহেতুক দায়ী করিয়া প্রতারিত হইবেন না !]
আরশাদ এখন আর শুধু ‘আরশাদ’ নেই । হয়ে গেছে ডাঃ আরশাদ । কিন্তু তাঁর অবস্থা ছুটি গল্পের ফটিকের মত । রবীঠাকুর বলেছিলেন , তের-চৌদ্দ বছরের ছেলের মত এমন বালাই আর নাই । কিন্তু আরশাদের মনে হয়- কবিগুরু যদি এই ২৫-২৬ বছরের সদ্য পাশ করে বেরুনো কোন ডাক্তারের কথা জানতেন তাহলে তিনি লিখতেন, ২৫-২৬ বছর বয়সের নবীন ডাক্তারের মত এমন বালাই আর নাই । না পারে কিছু কইতে, না পারে সইতে ।
একজন ডাক্তারের জীবনে সবচেয়ে কঠিন যে সময়গুলো পার হতে হয়- আরশাদ এখন সেরকম একটি পিরিয়ড অতিক্রম করছে । কুয়োর ব্যাঙকে হঠাৎ গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা হবে , সেই অবস্থা । চোখের সামনে শুধু অন্ধকার । আশা আকংখার সাথে বাস্তবতার আর প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে হিমশিম । কোথায় অর্থ, কোথায় সম্মান – কোথায় কী ? এই বয়সে হঠাৎ করে ‘ডাক্তার’ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি থেকে আর টাকা চাওয়াও যায় না – লজ্জার ব্যাপার । মধ্যবিত্ত সংসারে সে বিলাসিতার সুযোগও নেই । এখন নিজের পেটের দায় নিজেকেই মেটাতে হবে । ছেলে ‘ডাক্তার’ হয়েছে, মা-বাবা ভাইবোনেরও কি একটু আশা আকাঙ্ক্ষা থাকেনা – টানাটানির সংসারে এবার সুদিন আসবে । সংসারের হাল ধরবে ‘ডাক্তার’ ছেলে ! হাল যদি নাও ধরে, অন্তত কিছুনা কিছু কন্ট্রিবিউট করবে । সে প্রত্যাশার দায় কিছুটা হলেও তো মেটানো দরকার । বাবা-মার বয়েসও হয়েছে । এমন সময় যদি কিছু খেদমত করা না যায়- তাহলে আর এত পড়াশোনা, এত ডিগ্রী দিয়ে হবেটা কি ?
এই বয়সে আরশাদের ভার্সিটি পড়ুয়া বন্ধুরা তো অনেকেই ‘জবে’ ঢুকে গেছে । মাসে মাসে বেতন পাচ্ছে । কেউ কেউ বিয়েও করেছে । হুম, বিয়ে- সেতো আরেক দীর্ঘশ্বাসের নাম । বিয়ে যে করবে, কাকে করবে ? কীভাবে করবে ? খাওয়াবে কী ? নিজের তো এখনো চালও হলোনা, চুলোও হলোনা । ‘ডাক্তারে’র সাথে বিয়ে হবে, মেয়েটার মনে নিশ্চয়ই অনেক আশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা , অনেক প্রত্যাশা থাকবে । কিন্তু বাস্তবে কী পাবে ? ‘এক বুক ভালোবাসা’ ছাড়া আর কিছুই তো নেই তাঁর এখন ! হয়তো একসময় সবই হবে- অনেক কিছুই হবে, অর্থ, খ্যাতি, সম্মান । কিন্তু সেতো অনেক অনেক দেরি । এখন বাদাম চিবানোর জন্য ইচ্ছা আছে, দাঁত আছে কিন্তু টাকা নাই । টাকা হবে যখন , তখন আর বাদাম চিবানোর জন্য দাঁতই থাকবে না । অতদিনের সংগ্রামে নবযৌবনা একটি মেয়ে কেন সঙ্গ দেবে ? কার অতটা সাহস আছে ?
ইন্টার্ণশিপ শেষ মানে মেডিকেল প্রফেশনে শুরু মাত্র । নট ইভেন দা ভেরি বেগিনিং অব দা এন্ড । ক্যারিয়ার লাগবে । এফিসিপিএস, এমডি , এমআরসিপি লাগবে । নইলে যে ডাক্তার সমাজেই তৃতীয় শ্রেণী হয়ে থাকতে হবে । বাইরের কথা আর নাইবা ভাবা গেলো ! সেও কি যা-তা কথা ? সারাদেশের সকল ডাক্তারদের সাথে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে অল্প কিছু সিটের একটি বাগিয়ে নাও । বেগার খেঁটে ট্রেনিং নাও পাঁচ বছর । পরীক্ষা দিয়ে, থিসিস দিয়ে পাস করতে আরো ১-২ বছর । তার মানে আরো ৭-৮ বছরের ধাক্কা ।
বিসিএস ? হা হা । আনমনে হেসে ওঠে আরশাদ । সে তো আরেক দিল্লীকা লাড্ডু । মধ্যবিত্তের সন্তান , বিসিএস ক্যাডার হলে খারাপ হয়না । অন্তত মাসে মাসে কিছু টাকার তো নিশ্চয়তা আছে ! বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে বিসিএস এর মর্যাদাও বেশ আছে বৈকি ! কিন্তু এর অপর পৃষ্ঠে যে আরেক বেদনার হাহাকার । কোন গ্রামে পোস্টিং হবে কে জানে ? হয়তো বসারই ব্যবস্থা নাই । থাকার ব্যবস্থা, পিওন আর্দালি ফ্যান এসি সেসব তো আকাশের চাঁদ । গ্রামে ফেলে রাখবে তিন বছর । আরো বেশিও হতে পারে । কবে ট্রেনিং পোস্ট পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই । পোস্ট গ্রাজুয়েশন দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে উঠবে । বয়স বাড়বে । পড়ালেখার ঝোক-অভ্যাস কমে যাবে ।
অন্যান্য ক্যাডারে বয়স বাড়ে, অভিজ্ঞতা বারে , প্রমোশন হয় । হেলথ ক্যাডারে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ছাড়া প্রমোশন নাই । চাকরির বয়স যত বছরই হোক , থাকতে হবে একই পদে- উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে ।
পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে আরশাদ । কী করবে, কী করবেনা – সিদ্ধান্তহীনতার এক অকূল পাথারে ভাসছে সে । শুধু ভবিষ্যৎ চিন্তাই নয়, ক্যাম্পাস জীবনের অনেক স্মৃতিও তাঁকে তাড়া করে ফিরছে আজ । কত স্মৃতি ! বন্ধুরা আজ সবাই বিচ্ছিন্ন । যে যার পথে নেমে গেছে । ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে , জীবনের প্রয়োজনে । কারো কারো সাথে হয়তো এই জীবনে আর দেখাই হবে না । নীরবে নিভৃতে অনেকেই চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে । হয়তো কারো কারো খবর পাওয়া যাবে , কারো কারো সেটাও পাওয়া যাবেনা ।
ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের যেকোন আন্দোলন-সংগ্রামে আরশাদ ছিল সদা তৎপর । তারুণ্যে টগবগ তাজা রক্ত । আন্দোলন সংগ্রাম অধিকার আদায় এইসবের ভেতর যেমন আছে বিবেকের দায়শোধের তাড়না , তেমনি আছে এডভেঞ্চারও । যারা এগুলোর ভেতরে ছিলনা, তারা কখনো সেটা বুঝবেনা ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় ।
কিংবা
মানবজন্মের নামে কলংক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তরপুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই ।
এইগুলো টগবগে বিদ্রোহী তরুণদের প্রিয় কবিতা । আরশাদেরও তাই ছিল । কখনো কখনো ভরাট কন্ঠে বক্তৃতা দিতে হত আরশাদকে । ছাত্রছাত্রীদের সামনে । শ্লোগান উঠতো । হাততালি পড়তো । এডভেঞ্চারের শিহরণ বয়ে যেত শরীরে !
আকাশে মেঘ করেছে । গ্রীষ্মের শেষাশেষি । এই সময়ে আকাশ যখন তখন কালো মেঘে ঢেকে যায় । বৃষ্টি নামে । আজও পশ্চিম দিকে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দও হচ্ছে । সেদিকে অবশ্য আরশাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
পেছন থেকে হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শে অনেকটা চমকে ওঠে আরশাদ । একটা রিনরিনে কন্ঠ- পরিচিত লাগে, ‘কিরে আরশাদ, কেমন আছিস ?’
হতচকিত আরশাদ মুখ ফিরিয়ে তাকায় । একটা মেয়ে- পরিচিত , হ্যা খুব পরিচিত আরশাদের । ক্লাসমেট । অবশ্য শুধু ক্লাসমেট বললে ভুলই হবে হয়তো । একদিন... থাক সেসব কথা । কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ?
‘এখানে কী করছিস ? এখুনি বৃষ্টি নামবে, চল আমাদের গাড়িতে’ । আবার কন্ঠটা রিনরিন করে ওঠে ।
আরশাদ বিব্রত ভাবে উঠে দাঁড়ায় । ‘না মানে এমনি বসে আছি । কী খবর তোর ? কোত্থেকে হঠাৎ ?’
‘নে হ্যান্ডশেক কর । তোর দুলাভাই’ । সাথের ছেলেটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নীলা ।
আরশাদ হ্যান্ডশেক করে । ধন্যবাদ দিয়ে বলে , ‘না, তোরা যা । আমি আরো কিছুক্ষণ বসবো’ ।
আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা হয় । ‘এই কি করছিস এখন, কোথায় আছিস’ টাইপের । বৃষ্টির ফোঁটা পরতে শুরু করেছে । নীলা তাঁর স্বামীসহ গাড়িতে ওঠে । গাড়িটা চলতে শুরু করে । ‘ভালই আছে মেয়েটা’ । ভাবে এরশাদ ।
সুজাতাই আজ শুধু সব চেয়ে সুখে আছে , শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তাঁর । হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মোড়া সে, বাড়ি গাড়ি সবকিছু দামী তাঁর ।
মান্নাদে-র গান আপনা আপনি বেজে ওঠে আরশাদের বুকের গভীরে কোথাও ।
সেই নীলা । হাহ । আরশাদের একটু চোখের ইশারা পাবার জন্য কতইনা ব্যাকুল ছিল । কিন্তু আরশাদ একজন মুসলিম হিসেবে কখনো তাঁর অন্যায় চাওয়াকে প্রশ্রয় দেয়নি । আরশাদের এই দৃঢ়তা নীলাকে আরো বেশি আকর্ষিত করেছিল কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না । কিন্তু আরশাদের পুরুষালী ভরাট কন্ঠ যে নীলাকে খুব ভালোভাবেই টেনেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনি নীলা নিজেই । আরশাদ যেন আজ এত বছর পরেও স্পষ্ট শুনতে পায়- ‘আরশাদ , জানিস- আমি তোর কন্ঠের প্রেমে পড়ে গেছিরে’ ।
আরশাদের উপায় ছিলনা । বিয়ে করতে পারতো ? না, সে সুযোগ ছিলনা তাঁর ।
বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে । মোবাইলটা আজ আরশাদ সাথে করে আনেনি । ভালোই হয়েছে । আরশাদ বাঁধের ওপর বসলো আবার । ভাবনায় ফিরে গেলো সে । এই এতকিছুর মাঝেও সবই করতে হবে । ক্যারিয়ার, অর্থোপার্জন , সংসারের দায়িত্বগ্রহন, বিয়ের প্রস্তুতি- সব । বন্ধুরা তো অনেকেই বিয়েথা করে ফেলেছে । নীলা তো চোখের সামনেই চলে গেলো , দেখিয়ে গেলো । আর তাছাড়া বিয়ের ব্যাপারে আরশাদের চিন্তা হলো- দিল্লীকা লাড্ডু হোক আর করাচীকা লাড্ডু হোক, যদি পস্তাতেই হয় তবে খেয়ে পস্তানোই ভালো !
নাহ । এতসব চিন্তা করে লাভ নেই । যেসব ভয়ংকর দিন আরশাদ পার করে এসেছে তার তুলনায় সামনের এই অনিশ্চয়তা কিছুই নয় ।
জনশূন্য সমূদ্র সৈকতে ঝড়ো বাতাসের মাঝে, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, নীলার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আরশাদ চিৎকার করে আবৃত্তি করতে লাগলো –
এখন যৌবন যার , মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার , যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময় ।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে আরশাদের বৃষ্টিভেজা মুখ একবার ঝলক দিয়ে উঠলো । কেউ দেখলে হয়তো মনে করবে – সে চিৎকার করে কাঁদছে । কিন্তু না – আরশাদ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।
এ জীবন যুদ্ধে তাঁকে যে জিততেই হবে ।
{আরেক সংগ্রাম / ১২-০৫-২০১৪}
[ পিঠবাঁচানোঃ সব চরিত্র কাল্পনিক । ইহার কোন অংশ কারো সহিত মিলিয়া গেলে তা কাক ও তালগাছের দোষ । লেখককে অহেতুক দায়ী করিয়া প্রতারিত হইবেন না !]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন