এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০১৪

সেন্টমার্টিনে গলাচিপা !



সেন্টমার্টিন আসার সবকিছু ঠিকঠাক, এর মধ্যে বেঁকে বসলো মামুন । অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম , কিন্তু না । কোন এক অজানা – রহস্যজনক কারণে সে আসবেই না । অবশেষে ওকে ছাড়াই আসতে বাধ্য হলাম আমরা ।

এবারের ট্যুরটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন । ব্যাচমেটদের সাথে হতে পারে এটাই শেষ ট্যুর । সেন্টমার্টিন হয়তো আবার আসা হবে – কিন্তু ব্যাচের বন্ধুরা সবাই একসাথে , এইভাবে কি আর আসা হবে ? এইতো আর একটা বছর । সবাই পাশ করে কোথায় চলে যাবো ! কতদিন পর কার সাথে দেখা হবে , কারো সাথে আর এ জীবনে আদৌ দেখা হবে কিনা, কে জানে ! আমার কাছে এটা হলো – অন্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট । কিন্তু কোনভাবেই মামুনকে রাজী করানো গেলনা । সেন্টমার্টিনে এসেছি- অন্যরকম ভালো লাগছে । কিন্তু তারপরেও কোথাও যেন একটু অপূর্ণতা রয়ে গেলো ।

হাঁটছি সেন্টমার্টিনের বালুকাময় পশ্চিম তীর ধরে । সাথে আছেন – সিনিয়র ভাই , ডাক্তার , ‘আব্দুল্লাহ’ ভাই । ছোটখাটো চেহারার, হাস্যোজ্জ্বল , নিরীহ লোক । কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ডেঞ্জারাস । সবাই বলে- বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল, তাঁর ভেতরে কী চলছে ! 

চরম ভ্রমণপাগল মানুষ । হাতে যদি তাঁর কিছুটা সময় থাকে – তাহলে তিনি আপনার কোন ভ্রমণবিষয়ক অফার ফিরিয়ে দেবেন না । আমি গ্যারান্টি দিতে পারি । বিয়ের পর কী হবে কে জানে – উনার  অনেক বন্ধুই নাকি বিয়ে করে হয়ে গেছে ‘সম্পূর্ণ পরাধীন’ । সেজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – বিয়ের আগেই যত পারেন ঘুরে বেড়াবেনবাংলাদেশের চৌষট্টিটি জেলায় পা রাখার ইচ্ছা তাঁর । ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক কাভার করেছেন । পাগল একটা ।

কয়েকদিন আগে একটা কাজে ঢাকায় গিয়েছিলাম । আব্দুল্লাহ ভাইকে বলেছিলাম- ভাই, সেন্টমার্টিন যাচ্ছি আমরা সামনের তিন তারিখ । চলেন না আমাদের সাথে ! ভদ্রতার খাতিরেই বলেছিলাম অনেকটা । কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে আব্দুল্লাহ ভাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে হাজির ! হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজ করে চলে এসেছেন । ফোন করে জানালেন – ‘আসিফ, চলে এলাম । টেকনাফের বাস কয়টায় ?’

রাতে বাসে উঠে সকালে টেকনাফ । কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন শিপে করে সেন্টমার্টিন ।  পশ্চিম সৈকতে হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল- এসে উঠেছি সেখানে । দুপুরবেলা সাগরে নেমে অনেকক্ষণ ঢেউয়ের সাথে খেললাম । এখানকার ঢেউগুলো কক্সবাজারের মত অত জোরালো না । বেশ মিষ্টি ঢেউ । তবে প্রবালের জ্বালায় ঠিকমত হাঁটা যায়না পানিতে । পা কেটে গেছে আমার । তীরের কাছাকাছি বেশ কিছু মাছ ধরার জেলে নৌকা নোঙ্গর করা আছে । নৌকায় উঠে দুললাম কিছুক্ষণ । তারপর খেয়েদেয়ে বের হয়েছি হাঁটতে । বাকিরা প্রায় সবাই রুমের ভেতরে – রেস্ট নিচ্ছে । আঁতেল পোলাপান ।

আগামীকাল ভোরে বিচ ফুটবল , সকালে নাস্তা সেরে ট্রলারে ছেঁড়া দ্বীপ । বিকেলে কেয়ারী সিন্দাবাদে ফিরবো ।
ভাবলাম – আজ বিকেলেই হেঁটে হেঁটে পুরো সেন্টমার্টিন দ্বীপ এক চক্কর দেবো । আব্দুল্লাহ ভাই এবং অসীম ভাইকে বলা মাত্রই উনারাও রাজি হলেন । আব্দুল্লাহ ভাইকে বলামাত্রই তিনি বললেন – ‘চলো যাওয়া যাক’ ! কে জানে- হয়তো তিনিও এমন সময় হন্টনোপযোগী সঙ্গী খুঁজছিলেন !
বিকেল বেলা সেন্টমার্টিনের পশ্চিম তীরে ঢেউয়ের শো শো শব্দ , হু হু বাতাস আর জনমানবহীন নিস্তব্ধ প্রকৃতি – সত্যিই অসাধারণ লাগছে ।

অসীম ভাই তাঁর হ্যাট মাথায় দুলকি চালে এগিয়ে চলেছেন । অসীম পিয়াস । গল্পকার । কথাশিল্পী । আমাদের সিনিয়র ভাই । উনিও আছেন আমাদের সাথে ।  অসাধারণ সব গল্প লেখেন তিনি । বেশিরভাগ গল্পই রহস্যে ভরা । ফরেনসিক মেডিসিনের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি রহস্য উদঘাটন করেন । রাইগর মর্টিস, এবরশন এইসব নিয়ে তাঁর গল্প । তাঁর পাঠকপ্রিয়তাও তুঙ্গে । তাঁর সাথে কোথাও বের হওয়াই দায় । কখন কোত্থেকে কে ছুটে আসে – ‘আপনি অসীম ভাই না ?’


বছর দুই আগে অসীম ভাই তাঁর রুমমেট আকবর ভাইকে পঁচিয়ে একটা গল্প লেখেন – ‘গাধা আকবর’ । গল্পটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় । সেইযে শুরু । তারপর থেকে লিখছেন তো লিখছেনই । উনি লেখেন , আর আমি পড়েই শেষ করতে পারিনা । একজন মানুষ এতকিছু কেমনে লেখে ?

‘গাধা আকবর’ লেখার পর থেকে তাঁকে বন্ধুরা আর সহজে কেউ ঘাটাতে চায় না । কখন আবার কার নামে গল্প লিখে মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দেয় ! ইজ্জত বলে একটা কথা আছেনা , শেষে ঐটা নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে । কী দরকার সাপের লেজে পা দেয়ার !

অসীম ভাইয়ের এক বন্ধু , কবি । উজবুক কবি নদ্দিউ ফরিশ । উল্টা করে পড়লে নামটা একটা সুন্দর নাম হয় । কিন্তু কবি হতে গেলে নাকি বিদঘুটে নামধারণ করতে হয় ! সেজন্যেই তাঁর নামের এই অবস্থা । নদ্দিউ ফরিশ ।  অবশ্য লেখার চেয়ে পড়েন বেশি । তাঁকেও সাথে নেবার ইচ্ছা ছিলো । কিন্তু অসীম ভাই আসছেন জেনে তিনি আর এপথে পা মাড়ালেন না । উজবুক কবিকে সাথে পেলে অবশ্য মন্দ হতো না ! কবি সাহিত্যিকদের আমার এইজন্যে ভালো লাগে- এঁরা জীবনকে অনেক গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে পারেন , উপলব্ধি করতে পারেন ।


অনেক দূর চলে এসেছি । একটার পর একটা বাঁক পেরিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই । মনে হয় এইতো সামনের বাঁকটাই শেষ । কিন্তু ঐ বাঁক পেরিয়ে দেখি সামনে আরো একটা বাঁক । সেন্টমার্টিন দ্বীপটা উত্তর দক্ষিণেই লম্বা । দক্ষিণের শেষ প্রান্তে আছে ছেঁড়া দ্বীপ । 

আব্দুল্লাহ ভাইকে পেলে আমি নানান প্রশ্ন করিশুনি জীবনের নানা দর্শনগত ব্যাখ্যা । অভিজ্ঞতা । আব্দুল্লাহ ভাই প্রায়ই বলেন – ‘আসিফ, ক্ষুদ্র এ জীবনে অভিজ্ঞতা তো কম হলনা রে !’ নানান ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে ব্যাখ্যা শুনি তাঁর কাছে । সবকিছুর ব্যাপারে নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে আব্দুল্লাহ ভাইয়ের । সিনিয়র হলেও যথেষ্ট খোলামেলা কথা বলা যায় তাঁর সাথে । জিজ্ঞেস করলাম- ভাই, এইযে আজকালকার তরুণীরা রাস্তাঘাটে বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করে – নজর না দিয়ে – চোখ অক্ষত রেখে পথচলা কী করে সম্ভব ? আব্দুল্লাহ ভাইয়ের ব্যাখ্যা হলো – দিস ইজ নাথিং বাট এ  ম্যাটার অব ডিসিশান । প্রথমে তোমাকে দেখতে হবে – তোমার অবস্থান কী ? তুমি জীবনে কী চাও, এই মুহূর্তে তোমার পক্ষে কতটুকু কী করা সম্ভব ? তুমি যদি জানো  যে – তোমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না । তাহলে তুমি কারো দিকে নজর দিয়ে কী করবে ? যেহেতু তোমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না , সুতরাং কেউ যত সুন্দরীই হোক তাতে তোমার কিছু যায় আসেনা । তুমি হয়তো মনে করতে পারো- কাউকে পছন্দ করে রাখবা । সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো- যে মেয়ে তাঁর রুপ-সৌন্দর্য ‘সবার জন্যে উন্মুক্ত’ বা ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ বানিয়ে রেখেছে , যাকে চাইলেই রাস্তার ফকির থেকে মেথর সবাই আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে পারে – তাঁকে তুমি পছন্দ করবে কীভাবে ? সুতরাং ঐ দিকটা বাদ গেলো । আর যারা পর্দা করে বের হয় – তাঁদের দিকে তো তুমি সারাদিন তাকিয়ে থেকেও লাভ নেই । সুতরাং বুঝতেই পারছো , ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই ব্যস । দেখবা রাস্তাঘাটে যতই ক্লিওপেট্রা থাকুক তোমার চোখ কোথাও আটকাবে না !  আর চোখ পড়ে গেলে সরিয়ে নিবা , ব্যস !

আমাদের হোটেলটা একেবারে সৈকতের ওপরেই বলা যায় ।  আজ রাতে ওখানে বসে রাতের সেন্টমার্টিন দেখবো । ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের শীতল আমেজ – অন্ধকারে বসে বসে নিজের জীবন নিয়ে আরো অনেক কিছু ভাববো আজ । আব্দুল্লাহ ভাই নিশ্চয়ই থাকবেন  । তখন আরো কথা বলা যাবে । মনে মনে প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম । 
আমরা যোহরের নামাজের সাথেই আসরের নামাজ পড়ে নিয়েছি । মুসাফিরের জন্য এটার সুযোগ আল্লাহ্‌ দিয়েছেন ।  সুতরাং আমাদের আসরের নামাজের তাড়া নেই ।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর অসীম ভাই এবার কুইজ শুরু করলেন । বিদঘুটে নামের বিভিন্ন এলাকার নাম তিনি বলবেন , আমাদের বলতে হবে- কোন জেলায় অবস্থিত ।  ভেড়ামারা, শিয়ালদহ , আড়াইহাজার , ঠেঙ্গামারা, গলাচিপা, ছাগলনাইয়া ...


আব্দুল্লাহ ভাই ভালই উত্তর দিলেন । তারপর আরো অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ হাটলাম । পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা  চলে এসেছি দ্বীপের প্রায় দক্ষিণ অংশে । দ্বীপের এদিকটা ধীরে ধীরে সরু হয়ে ছুরির ফলার মত রূপ নিয়েছে ।  কথা বলতে বলতে এতক্ষণ খেয়ালই করিনি কতদূর চলে এসেছি । এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে প্রায় । হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো একটা সাইনবোর্ডে ।  ‘ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জনাব নজরুল ইসলাম , গাজীপুর । জমির পরিমাণ  ৩ কাঠা । গলাচিপা, সেন্টমার্টিন’ ।

‘আরে এইখানে দেখি গলাচিপা আছে । আগে তো জানতাম শুধু পটুয়াখালিতেই গলাচিপা আছে !’ উত্তেজিত কন্ঠে আমি প্রায় চিৎকার করেই বললাম

অসীম ভাই , আব্দুল্লাহ ভাই কারো কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ডানপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম – কেউই নেই । কোথায় গেলেন তাঁরা ? উনারা কি পেছনে পড়ে গেছেন ? আমার হাঁটার গতি একটু বেশি । আর ওদিকে অসীম ভাই মোটাসোটা মানুষ – একটু ধীরেই হাঁটেন । আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করলেই চলে আসবেন তাঁরা ।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও তাঁদের দুজনের কারো চিহ্ন দেখতে না পেয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম । পেছনের দিকে কি একটু এগিয়ে যাবো নাকি জোরে জোরে চিৎকার করে ডাক দেবো ?

***
বেশিক্ষণ ভাবতে পারলো না আসিফ । আব্দুল্লাহ ভাইকে চিৎকার করে ডাক দিতে যাবে এমন সময় সে অনুভব করলো- সাঁড়াশি হাতে কে যেন তার গলা চেপে ধরেছে । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন