এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৩

শিকার

‘বদ পোলাডা সারাদিন কোথায় যে থাকে আল্লা মালুম । কোন সময় ডাক দিয়া পাই না’ ।
উঠান ঝাড়ু দিতে দিতে গজগজ করছিলেন আনোয়ারা বেগম । তার একমাত্র ছেলে বাপ্পির উদ্দেশ্যে এই বকবকানি । প্রতিদিন বিকাল বেলা শোনা যায় একই কথা । স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়েই ছেলে উধাও হয়ে যায় ।
আনোয়ারা বেগমের স্বামী লোকমান হোসেন রিক্সা চালান । সেও সকালেই পেট পুরে পান্তা ভাত খেয়ে রিক্সা নিয়ে বের হয় । তার ইচ্ছা বাপ্পি আরেকটু বড় হলেই গণি সাহেবের কাছ থেকে লোন নিয়ে আরেকটা রিক্সা কিনবে । ছেলেসহ রিক্সা চালাবে । তার একার রোজগারে চলে না । কোনমতে সংসার টানা । ছেলেটা মাঝে মাঝে এটাসেটা আবদার করে, পুরণ করতে পারেনা লোকমান । গণি সাহেব এই এলাকার একজন সজ্জন ব্যক্তি । গরীবদের যেকোন সমস্যায় তিনি হাত বাড়িয়ে দেন । তার কাছে চেয়ে বিমুখ হতে হয় না ।

লোকমান বের হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় বাপ্পি । সে এবার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র । বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের স্কুলে পড়ে । স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ে । কখনো খেলাধুলা করে , কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঘুরে বেড়ায় । বড় বিল্ডিং গুলোর সামনে দাড়িয়ে উচ্চারণ করে পড়ে – খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, ইংরেজী বিভাগ, গণিত বিভাগ আরো অনেক কিছু । শিক্ষকদের নাম দেখে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টে । খুব ভালো লাগে তার । মাঝে মাঝে কেউ কেউ ছোটখাট কাজ করতে দেয় । সে খুশিমনে করে দেয় । স্যার বলে ডাকে । কেউ কেউ তাকে দিয়ে সিগারেট আনায় । বাপ্পি অবাক হয়- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সিগারেট খায় কেন ? সিগারেটের প্যাকেটে সে লেখা দেখেছে – ‘ধুমপান হৃদরোগের কারণ’ ।
কোন কোনটাতে লেখা থাকে ‘ধুমপান মৃত্যু ঘটায়’ ।
ছাত্ররা কি এগুলো দেখে না ?

কিছু কিছু স্যার খুব ভালো । রফিক স্যার তাদেরই একজন । আসরের নামাজের পর রফিক স্যারকে মসজিদের সামনে পাওয়া যায় । বাপ্পি খুব খেয়াল করেছে- রফিক স্যার একদিনের জন্যও আসরের নামাজ মিস করে না । রফিক স্যার একদিন বাপ্পিকে বললেন- বাপ্পি, তুমি আমাকে স্যার না বলে ভাই বলবে । আমি তোমার বড় ভাই ।
বাপ্পি তবু রফিক স্যারকে ‘ভাই’ বলতে পারে না । তার লজ্জা লাগে । কিন্তু রফিক ভাই তাকে দেখলেই কাছে ডাকেন । চকোলেট , চিপস খেতে দেন । পরিবারের খোজখবর নেন । বাপ্পির খুব ভালো লাগে ।
যেদিন চকোলেট খেতে ইচ্ছে করে , সেদিন বাপ্পি আসরের নামাজের সময় মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । রফিক ভাই অনেক সুন্দর করে কথা বলেন । কুরআন হাদীস জানেন । বাপ্পি দেখেছে , একদিন রফিক ভাই মসজিদের সামনে বসে আরেকজনের সাথে কথা বলছিলেন । কত সুন্দর করে কত কিছু যে বললেন । বাপ্পি পেছনে বসে সব শুনেছে । রফিক ভাই টের পাননি । রফিক ভাই কুরআনের আয়াত মুখস্ত বলে গেলেন , আবার বাংলা অর্থ বলছিলেন । মাঝে মাঝে ইংরেজীতেও কথা বলছিলেন , সেগুলো অবশ্য বাপ্পি বুঝতে পারে নি ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের একটি পথে আনমনে হাঁটছিল বাপ্পি । অনেক কথা মনে পড়ছিল তার । একদিন মসজিদের সামনে গিয়ে রফিক ভাইয়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলো । কিন্তু রফিক ভাইকে পেল না । পরপর কয়েকদিন দাড়ানোর পরও রফিক ভাইকে পেল না । একদিন সাহস করে- রফিক ভাইয়ের সাথে অনেকবার দেখেছে এরকম একজন কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো – স্যার, রফিক স্যার নামাজে আসেন না কেন ?
তার প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন রফিক ভাইয়ের বন্ধু । বাপ্পিকে একদিকে নিয়ে বলেছিলেন- বাপ্পি, রফিক ভাই কোথায় আছেন কেমন আছেন কেউ জানে না । তিনি আর ফিরে আসবেন কিনা তাও কেউ জানে না । তাঁকে গুম করা হয়েছে । বলতে বলতে রফিক ভাইয়ের বন্ধু কেঁদে ফেলেন । বাপ্পিও সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল । বাপ্পি ভাইর মত মানুষকে কে গুম করবে ? তারা কি মানুষ না ?

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আন্দোলন হলো । মিছিল মিটিং হলো । রফিক ভাইকে তবু পাওয়া যায়নি । মসজিদের সামনে গেলে বাপ্পির মনটা আকুপাকু করে রফিক ভাইয়ের জন্য । রফিক ভাই কি আর ফিরে আসবে না ?

- হেই বাপ্পি , কই যাস ? কাল সেমিফাইনাল খেলা , মনে আছে তো ? ঠিক সময় মত আসবি কিন্তু । দেরি করবি না ।
বাপ্পিকে দেখে চিৎকার করে বললো ওর বন্ধু মনির । বাপ্পি কোন উত্তর দিল না । নির্বিকার মনে হাটতেই লাগলো ।

.............................................

‘আনোয়ারা বু , ও আনোয়ারা বু । তোর পোলা গুলি খাইছে গো’ ।
ভার্সিটিত সরকারের দলের ছেলেরা দুই দলে গুলাগুলি করিছে । তোর পোলায় গুলি খাইছে আনোয়ারা বু গো ।
আনোয়ারা বেগমের হাত থেকে ঝাড়ুটা পড়ে গেল । ভার্সিটির দিকে দৌড়াতে লাগলো পাগলের মত । আমার পোলা আমার পোলা বলে চিৎকার করতে করতে রাস্তায় উঠতেই দেখতে পেল তার স্বামীর রিক্সায় বাপ্পির নিথর দেহ । বাপ্পির রক্তমাখা শরীরের দিকে একবার নজর পড়তেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল আনোয়ারা ।

(কোন ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেলে সেজন্য লেখক দায়ী থাকিবেন ।)
শিকার / ২৭-০৬-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন