এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০১৩

খোয়াড়

সুর্য ডোবার আগে আগে একঝাক পাখি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল । সেলিমদের দলের পরাগ ফুটবলে একটা উড়ন্ত কিক করলে বলটা আকাশে উঠে গেল । পাখিগুলো কিঁচিরমিচির করে উঠলো । গোলকিপার হাসানের চোখটা কিছুক্ষণের জন্য আটকে গেল সেখানে। বলের দিকে তার আর নজর নেই । সে তাকিয়ে আছে পাখিগুলোর দিকে । পাখির ঝাঁকটা পশ্চিম দিকে ঘুরে গেলে হাসানের চোখে পড়লো, সুর্য ডুবে যাচ্ছে । সে আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না । সোজা উত্তর দিকে ছুট লাগালো । মাঝে একটা জংলার ওপাশে বাছুরটাকে খুট গেঁড়ে রেখে এসেছিল হাসান । মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছিল বাছুরটা । বয়স মাত্র তিন মাস । সুর্য ডোবার আগেই বাছুর নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে । নাহলে মা খুব রাগ করবে ।

হাসান এবার ক্লাস সেভেনে পড়ে । ক্লাসে তার রোল তিন । কালিকাপুর গ্রামের স্কুল থেকে অনেক বছর পরে একজন ছাত্র প্রাথমিক বৃত্তি পেয়েছে । হাসান । ট্যালেন্টপুল পায় নি , সাধারণ বৃত্তি । স্কুলের স্যাররা এতে খুবই খুশি । সেদিন হাসান অসুস্থ ছিল । স্কুলে যেতে পারেনি । স্কুলের স্যাররা সবাই মিলে এসেছিলেন হাসানের বাড়িতে । হাসানের মা আসমা খাতুন খবর শুনে হাসানকে বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষন কেঁদেছিলেন সেদিন । হাসান বোঝেনা- এতে কান্নার কী আছে !
তিনটা ঘর নিয়েই তাদের ছোট্ট বাড়ি । মানুষ মাত্র দুজন । হাসান আর তাঁর মা । মা সেলাই মেশিন চালিয়ে সংসার চালান । আরো দুটি প্রাণ এই বাড়িতে থাকে । গরুটা , আর তার বাছুর ।

জংলা পার হয়ে অবাক হয়ে গেল হাসান । বাছুরটা নেই । খুটের গোড়ায় দড়িটা ছেড়া । হাসান বাছুরটা খুজতে শুরু করলো । জংলার আশেপাশে খুজলো বেশ কিছুক্ষণ । দৌড়ে বাড়িতে গেল । মাকে বললো । মা তাকে কিছুক্ষণ বকলেন । হাসান ঘরে ঢুকে মাটির ব্যাংকটা ভেঙ্গে ফেললো । ৬০ টাকা বেরুলো । ওগুলো পকেটে নিয়ে সে আবার বের হলো ।
পাড়ার সব বাড়িতে খোঁজ নিয়ে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না । এশার আজান হয়ে গেছে । সারা বিকেল ফুটবল খেলার পর এই হাটাহাটি আর দুশ্চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে গেল হাসান । দোস্ত রিফাতের বাড়িতে গিয়ে তাকে সব কথা বললো । রিফাতের মা তাঁকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিলেন ।
- বাবা হাসান, পাড়ার সব বাড়িতে খুজেছ ?
- জ্বি খালা । কোথাও নেই ।
- ভাত খেয়ে রিফাত সহ পাশের গ্রামের জব্বারের খোয়াড়ে একবার যাও । হতে পারে কেউ বাছুরটাকে ওখানে দিয়ে এসেছে ।
- এতটুকু বাছুরকে খোঁয়াড়ে দেবে ?
- দিতেও তো পারে । টাকার লোভেও অনেক বদ ছেলেপেলে গরু-ছাগল খোয়াড়ে দিচ্ছে ।
দারুণ দুশ্চিন্তায় ভাত খেল হাসান । পাশের গ্রামে জব্বার খানের বাড়িতে খোয়াড় আছে । সেখানে গরু ধরে নিয়ে জমা দিলে তারা দশ টাকা দেয় । ছাগলের জন্য পাঁচ টাকা । গরু ছাড়িয়ে আনতে গরুর মালিককে গুনতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা । তারা গরুকে খাবার দেয় না । এক সপ্তাহের মধ্যে মালিকের খবর না পেলে সে গরু বিক্রি করে দেয়া হয় ।

খোয়াড়ে গিয়ে দেখলো সত্যি সত্যিই বাছুরটাকে ওখানে বেঁধে রাখা হয়েছে । খুব শক্ত করে বেঁধেছে । বাছুরটার মুখ শুকিয়ে গেছে । কতক্ষণ দুধ খায়নি ! দেখে হাসানের চোখ ভিজে উঠল । বাছুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল সে । খোয়াড়ওয়ালারা ৮০ টাকা দাবি করল বাছুরটাকে ছাড়ানোর জন্য । অনেক অনুরোধ করে ৬০ টাকা দিয়ে বাছুরটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলো তারা দুজন ।
বল্টুর কাজ এটা । গত সপ্তাহে বল্টুর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল হাসানের । বল্টুই বাছুরটাকে খোয়াড়ে দিয়েছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ।
................................................

চট্টগ্রাম কারাগারের হালদা-১৮ সেলের গ্রিল ধরে ছোটবেলার সেই দিনের কথা ভাবছিল হাসান । এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে হাসান এবার শহরের একটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে । থাকে হোস্টেলে । মা এখন বাড়িতে একা । সারাদিন সেলাই মেশিন চালান । বাবা তো মারা গেছেন সেই ছোটবেলায় , হাসান তখন ক্লাস ফাইভে পড়তো ।
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না । হাসান সেসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তাও করেনা । সে খুব গোছালো ছেলে । কলেজে যায়, ক্লাস করে । বিকেলে বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে । হোস্টেলের ছাদে উঠে মায়ের কথা ভাবে ।
মাগরিবের আযান হলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে । রুমে ফিরে কুরআন তেলাওয়াত করে । কুরআন শরীফ খানা মায়ের দেয়া । ও যেদিন শহরে আসে , মা তাঁর হাতে দুইশ টাকা আর এই কুরআন শরীফটি তুলে দিয়েছিল । এই কুরআন শরীফে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা তেলাওয়াত করে চুমু দিতেন মা ।
মঙ্গলবার এশার নামাজ শেষে রুমে ফিরে কুরআন তেলাওয়াত করছিল হাসান । হঠাৎ কয়েকজন পুলিশ এসে ঘরে ঢুকলো । ‘এইযে পাইছি আরেকটা, কোরান পড়তেছে !’ কুরআন তেলাওয়াত রত অবস্থায় ধরে নিয়ে গেল তাঁকে । পুলিশ ভ্যানে হাসান দেখলো আরো কয়েকজনকে ধরে আনা হয়েছে ।
তিনদিন হয়ে গেল সে জেলখানায় । মা এখনো জানে কিনা কে জানে ! জানলে মা কী করবে ? ছোটবেলায় বাছুরটাকে তাঁর মাটির ব্যাংকে জমানো ৬০ টাকা খরচ করে ছাড়িয়ে এনেছিল । মা কোথায় পাবে টাকা ? এই খোয়াড় থেকে মা কি তাঁকে ছাড়াতে পারবেন ?
মায়ের কথা ভেবে হঠাৎ তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ।

খোয়াড়/ ২৫-০৬-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন