এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৩

কিংকর্তব্যবিমূঢ়

‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানিনে জানিনে , কিছুতে কেনযে মন ভরে না
ঝরোঝরো মুখর বাদল দিনে ......’
গুনগুন করে গাইতে গাইতে আনমনে হাঁটছিল জুয়েল । ডাঃ জুয়েল । আগে শুধু জুয়েল বললেই হতো । এখন আর তাতে কাজ হয়না । জুয়েল নিজে কখনো নামের সামনে ডাক্তার লেখেনা , তার ভালো লাগেনা । মনে হয় ‘জুয়েল’ নামটা ডাক্তার শব্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে । কিন্তু সবাই এখন ডাঃ জুয়েল বলেই চেনে । ফোনে যদি কখনো সে বলে –‘ আমি জুয়েল বলছি’, ওপাশ থেকে জবাব আসে ‘ডাঃ জুয়েল’ ? জুয়েলের বিরক্ত লাগে । কখনো কখনো ভালোও লাগে । অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে বোধহয় ।

আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে । আজ কত তারিখ সেটা অবশ্য জানা নেই । মাকে ফোন করলে ঠিকই বলে দেবে । বাংলা মাসের কত তারিখ , চাঁদের কত তারিখ – মা এগুলো ঠিক ঠিক হিসাব রাখেন । জুয়েল প্রতি মাসে ফোন করে জেনে নেয় – পুর্নিমার রাত কবে । ঐদিন কোন ডিউটি সে করেনা । সেই রাতটা যেন ‘শুধুই আমার’ ।
জোছনায় একা একা হাঁটে, কবিতা আবৃত্তি করে । মাঝে মাঝে নিজেও লিখে ফেলে দুয়েকটা কবিতা ।

সকাল বেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । রাস্তার খানাখন্দে জমে আছে বৃষ্টির পানি । গাড়ি চলাচলের কারণে পুরো রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে আছে । তবু রিক্সা নিতে ভালো লাগছে না । রিক্সায় ঘুরতে ভালো লাগে , কিন্তু মাঝে মাঝে মনটা খচ খচ করে । অমানবিক মনে হয় । আগেকার দিনে কলকাতায় একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে মাথায় করে খাল পার করে দিত । রিক্সাকে জুয়েলের কাছে সেটারই একটা উন্নত ভার্সন মনে হয় । একজন মানুষ রিক্সায় বসে থাকবে , আরেকজন মানুষ সেই রিক্সা টেনে নিয়ে যাবে- এটা কি ঠিক ? আজকাল অবশ্য বেশ কিছু ব্যাটারিচালিত রিক্সা বের হয়েছে । ভালোই ।

জুয়েল আজ পড়েছে ফর্মাল পোষাক । একটা বেসরকারি মেডিকেলে ‘মেডিকেল অফিসার’ হিসেবে যোগ দিয়েছে আজ থেকে । তরুণ ডাক্তারদের জীবনটা যে কতটা চ্যালেঞ্জিং- কেউ বোঝে না । সাধারণ মানুষ সব ডাক্তারকেই এক পাল্লায় মাপে । ডাক্তার মানেই যেন ‘টাকার থলি’ ।
আত্মীয় স্বজনদেরও অনেক প্রত্যাশা । ছেলে ডাক্তার হয়েছে , অনেক টাকা পয়সা কামাবে । সবার জন্য ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে । সবার দেখাশোনা করবে । টাকাপয়সার তো আর অভাব নাই !
পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়াশোনা, গাধার মত খাটুনি খেটে বিনেপয়সায় ট্রেনিং, নিজের পেট চালানো , পরিবারের দিকে নজর দেয়া সব মিলে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি । জুয়েল অল্পে সন্তুষ্ট । জীবন চালানোর জন্য মোটামুটি ব্যবস্থা হলেই সে খুশি । হাসপাতালে তাকে সপ্তাহে ৭ টা ডিউটি করতে হবে । হাজার বিশেক টাকা পাওয়া যাবে । টেনেটুনে চলে যাবে হয়তো ।

সামনে রাস্তার মাঝখানটায় পুরোটাই ঢালু । ওখানে পানি জমে আছে । চরমভাবে ঘোলা হয়ে গেছে । একপাশে কয়েকটা ইট একটু উঁচু হয়ে আছে । পা টিপে টিপে সেগুলোর ওপর দিয়েই পার হতে হবে । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জুয়েল সুযোগ পেল পার হবার । কয়েকটা ইট তখনো বাকি আছে , এমন সময় একটা কার সাৎ করে চলে গেল । কাঁদা পানি ছিটকে এসে পড়লো জুয়েলের কাপড় চোপড়ে । মহা বিরক্ত হয়ে কারের দিকে তাকালো জুয়েল । পাঁচ ছয় বছরের একটা ফুটফুটে বাচ্চা জানালা দিয়ে মুখ বের করে হিহি করে হাসছে । ড্রাইভারকে গালি দিতে গিয়েও থেমে গেল জুয়েল । নাহ । বাচ্চাটা মজা পেয়েছে, এটাই বা কম কিসে !

....................................

বাসায় পৌঁছুতে আরো এক কিলোর মত হাঁটতে হবে । জুয়েল ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো । সামনে রাস্তার একপাশে সেই কারটা দাঁড়িয়ে । ব্যাপার কি ? বাসা মনে হয় এখানেই । কিছুই বলবে না, আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে । তাই নির্বিকার ভাবে উদাস ভঙ্গিতে হাঁটছিল । কারের পাশে পৌছতেই দরজা খুলে পিচ্চি ছেলেটা এসে জাপ্টে ধরলো ।
‘চাচ্চু’, ‘আমি খুব সরি । আপনি কষ্ট পেয়েছেন তাই না ? আমাকে মাফ করে দিবেন । আমাদের বাসায় যাবেন চলুন’ ।
জানালা খুলে তাকিয়ে আছে একজন মহিলা, মুচকি হাসছেন । পিচ্চিটার মা হবে হয়তো ।
জুয়েল কী করবে বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ।

- কিংকর্তব্যবিমূঢ় / ২৯-০৬-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন