এমন পরিবেশে থাকতে হবে কোনদিন কল্পনাও করেনি ফারহানা । একটা রুম । নোংরা
মেঝে । রুমের একপাশে পর্দা দেয়া টয়লেট । সেখান থেকে দুর্গন্ধ আসছে ।
কোনমতে গাদাগাদি করে এখানে বসে আছে ফারহানা সহ মোট ২৩ জন মেয়ে । ফারহানারা
বিশ জন । আর ৩ জন আগে থেকেই ছিল । একজন শাশুড়ী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত । আরো
দুজনকে অসামাজিক কাজের দায়ে আটক করেছে ।
ক্ষুধা পেয়েছে বেশ । সেইযে সকালে নাস্তা করেছে ফারহানা এরপর আর কিছু পেটে যায়নি । শরীরটা ক্লান্ত লাগছে । দেয়ালে যে একটু হেলান দেবে সে রুচি হচ্ছেনা । থুথুর রেশ দেখা যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে ।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একঝলক দেখেছে ফারহানা, আব্বা হাতে একটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঘুরছেন । নিশ্চয়ই খাবারটা দেয়ার উপায় করতে পারেননি এখনো । অন্য দিন ফারহানা তার আব্বার ওপর খুব রাগ করে , সকাল দুপুর রাত আব্বা যেখানেই থাকুক ফোন করে খবর নেবে কী খেয়েছে । মনে হয় এই পৃথিবীতে ফারহানার জন্মই হয়েছে খাওয়ার জন্য । আর একবেলা ফারহানা ঠিকমত না খেলে যেন আব্বার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে ! কিন্তু আজ ক্ষুধায় ফারহানার পেট মোঁচড় দিচ্ছে । বাইরে আব্বাকে খাবারের প্যাকেট হাতে এক পলক দেখে হঠাৎ করে খুব কান্না পেতে লাগলো ফারহানার । ইচ্ছে হচ্ছিলো আব্বা বলে ঝাপিয়ে পড়ে । কিন্তু উপায় নেই । যে রুমে ওরা বসে আছে তার একপাশে গ্রিলের দরজায় তালা লাগানো । আর আব্বাও যে কোথায় আছে কে জানে ? সেই যে এক পলক দেখা গেল, এরপর আর দেখা যায়নি ।
থুথুর চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নোংরা দেয়ালেই হেলান দিল ফারহানা । কান্নার দমকে ওর নাক ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো ।
****
কপালে মুনা আপুর হাত অনুভব করলো ফারহানা । কিছুটা রাগও হচ্ছিল মুনা আপুর ওপর । কেন এমন হলো ? সব দোষ যেন মুনা আপুর । বিপদে পড়লে কারো ওপর দোষ চাপালে মনটা হালকা হয় । ফারহানা একবার ভাবলো, অকারণে মুনা আপুর ওপর রাগ ঝাড়বে । কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এই সময় রাগ করা যায়না ।
কী অদ্ভুত ! এরকম একটা বিপদে পড়েছে ওরা, অথচ মুনা আপুর কোন বিকার নেই । একদম শান্ত । এমনভাবে এখানে আসছিলেন যেন তিনি নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন । যখন সবাইকে এখানে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন তিনি সবাইকে বললেন, 'কেউ একদম টেনশন করবে না । সব কিছুই স্বাভাবিক' । ফারহানার কিছুতেই মাথায় ধরছে না , এটা কীভাবে স্বাভাবিক হয় ?
ফারহানা মুনা আপুর হাতটা ওর কপাল থেকে সরিয়ে দেয় । ও যে রাগ করেছে মুনা আপুকে বোঝানো দরকার । ফারহানার কোন বোন নেই । এই মুনা আপুটা , কয়েক বিল্ডিং পরে বাসা । এত আদর করে । ফারহানাও অনেক জ্বালায় , তবু কিচ্ছু মনে করেনা মুনা আপু । আপুটা এত ভালো কেন আল্লাহ মালুম ।
মুনা আপু দুহাতে গলা জড়িয়ে ফারহানাকে কাছে টেনে নেন । এবার ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলে ফারহানা । আপু , এখন কী হবে ?
মুনা আপু কিছুক্ষণ চুপ থাকেন । ফারহানাকে কাঁদার সুযোগ দেন । বাপ মা'র একমাত্র মেয়ে ফারহানা । ছোট ভাই ছাড়া কেউ নেই । এইচএসসি প্রথম বর্ষে উঠেছে এবার । বাবা মার আদরে আদরে বেড়ে ওঠা ফারহানার জন্য এই পরিবেশ সত্যি অকল্পনীয় । কাঁদুক ও কিছুক্ষণ । তারপর চোখ খুলে বাস্তবতা মেনে নিতে শিখুক । মেয়েটা ঠিকমত নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারতো না । একমাস হলো নামাজ শিখে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে । অল্প কিছু ছোট ছোট সুরা মুখস্ত করলেও কুরআন পড়তে পারেনা ভালোমত । সামনে রমজান মাস । ভেবেছিল কুরআন জানা একজন বোনের কাছে নিয়মিত তালিম নিয়ে শিখে ফেলবে । কিন্তু আজ কুরআন তালিম নিতে এসে এই অবস্থায় পড়বে কেউ কল্পনাও করেনি ।
মুনা আপু বললেন , ফারহানা , একটা গল্প শুনবি ? তোকে একটা গল্প বলি ?
ফারহানা কোন জবাব দিলনা । শুধু একটু মাথা নাড়ালো । কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন । এই সময় স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেন একমাত্র মুনা আপু । এতবড় একটা বিপদে পড়েছে ওরা , মুনা আপুকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে ? এখন উনি গল্প বলবেন , ভাবা যায় ?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুনা আপু গল্প বলার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেনঃ শোন্ । গল্পটা একটা ছেলে আর তাঁর মা'র গল্প । ছেলেটার জন্ম অনেক অনেক দিন আগে । এখন থেকে প্রায় দেড়হাজার বছর আগে । মক্কায় । ছেলেটার নাম আম্মার ইবনে ইয়াসীর । বাবার নাম ইয়াসির ইবনে আমির আর তাঁর মায়ের নাম সুমাইয়া বিন্তে খুব্বাত । রাসুল (সাঃ) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন গোপনে অনেকেই মুসলিম হন । প্রথম দিকেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেন ইয়াসির ইবনে আমির, সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত এবং আম্মার ইবনে ইয়াসির । কিন্তু তাঁরা ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখতে পারেন নি ।
সুমাইয়া ছিলেন বনু মাখযুম গোত্রের আবু হুজাইফার দাসী । আবু জেহেলও ছিল ঐ গোত্রের । তাঁদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানতে পেরে বনু মাখযুমের নেতারা এসে বললো- তোমাদের ব্যাপারে যা শুনলাম তা কি সত্যি ?
ইয়াসির বললেন – আপনারা আমাদের ব্যাপারে কী শুনেছেন ?
‘আমরা শুনলাম , তোমরা নাকি মুহাম্মাদের সাথে যোগ দিয়েছো ?
ইয়াসির নিসংকোচে বললেন- ‘হ্যা , আমরা তাই করেছি’ ।
‘তোমরা কি জানোনা সে আমাদের দেবতাদের অপমান করে , আমাদের পূর্বপুরুষদের সমালোচনা করে ?’
‘হ্যা , আমরা জানি’ ।
‘এরপরেও তোমরা তাঁকে মেনে নিয়েছো ?’
‘হ্যা, আমরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের ওপর বিশ্বাস এনেছি’ ।
‘তোমরা কি লাত উজ্জা হোবলের ওপর বিশ্বাস ত্যাগ করেছো ?’
‘হ্যা , আমরা লাত উজ্জা হোবলকে বিশ্বাস করিনা’ । জবাব দেন ইয়াসির রাঃ ।
শুনে বনু মাখযুমের নেতারা বললো – ‘তোমরা যদি মুহাম্মাদের ধর্ম না ছাড়ো, তাহলে আমরা তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবো’ ।
ইয়াসির (রাঃ) এবং সুমাইয়া (রাঃ) বলেন- যাও তোমাদের যা ইচ্ছা করো । আমরা যা সত্য জেনেছি তার ওপর বিশ্বাস ত্যাগ করবো না ।
এই জবাব শুনে আবু জেহেলের লোকেরা ইয়াসির, সুমাইয়া ও তাঁদের ছেলে আম্মারকে বন্দি করে নিয়ে যায় । তাদেরকে মক্কার উত্তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে রাখা হয় । এছাড়াও নানাভাবে নির্যাতন করা হয় । কিন্তু তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস ত্যাগ করেন না ।
এক পর্যায়ে আবু জেহেলের বর্শার আঘাতে শহীদ হয়ে যান সুমাইয়া (রাঃ) । তিনিই লাভ করেন ইসলামের প্রথম শহীদ হবার সৌভাগ্য ।
সেসময় গুটিকয়েক মানুষ মুসলিম হয়েছিলেন । রাসুল (সাঃ) এর পক্ষেও সুযোগ ছিলনা ইয়াসির পরিবারকে কোন সাহায্য করার । ইয়াসির (রাঃ) ছিলেন ইয়েমেনের লোক, মক্কার কোন গোত্রের নন । সুমাইয়া ছিলেন দাসী । মক্কায় তাঁদের পক্ষে দাঁড়াবার কেউ ছিলনা । রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন, ‘ইয়াসির, ধৈর্যধারণ করো । আল্লাহর জান্নাত তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে’ ।
ফারহানার মুখটা নিজের দিকে তুলে ধরে মুনা আপু বললেন- এখন তুইই বল্ , তুই কোন অপরাধ করেছিস ? করিস নি । আমরা কেউ কোন অপরাধ করিনি । কুরআনের তালিম নেয়া যদি অপরাধ হয় তাহলে এটা সেই অপরাধ যা সুমাইয়া করেছিলেন । যে কারণে তাঁদেরকে মরুভূমিতে শুইয়ে রাখা হত । যেকারণে তাঁদেরকে হত্যা করেছে কাফেররা । তাঁরা কি কেউ ঈমানহারা হয়েছিলেন ?
ফারহানা আস্তে করে জবাব দিল - না । গল্প শুনতে শুনতে ফারহানা চোখের পানি মুছে ফেলেছে । মনে সাহস ফিরে পেতে শুরু করেছে ফারহানা ।
মুনা আপু প্রশ্ন করলেন - সুমাইয়া তো শহীদ হয়ে গেছেন । সুমাইয়া হতে না পারি, কিন্তু আমরা কি সুমাইয়ার বোন হতে পারি না ? আমাদের কি ধৈর্যহারা হলে চলবে ? তোর কি ইচ্ছা হয় না সেই প্রথম শহীদ সুমাইয়ার বোন হতে ?
****
আদালতে ঢুকে ফারহানা অবাক । এত মানুষ ? মানুষে গিজগিজ করছে আদালত প্রাঙ্গন । এরই মাঝে তাঁদেরকে একটা রুমে নেয়া হল । সিনেমা নাটকে যেমন দেখা যায় আসল আদালতগুলো সেরকম না । এখানে একটা বড় রুমে অনেক মানুষ থাকে । হৈ হুল্লোড় । সামনে এজলাস । এজলাসের নিচে উকিলরা কাগজপত্র নিয়ে কথা বলেন । জাজ শুনে তাঁর সামনে রাখা কাগজে রায় লিখে দেন ।
ফারহানা শুনলো তাদেরকে জামিন দেয়া হয়নি । বিচারক ওদেরকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছে । তার মানে এটা এস্টাবলিশ হয়ে গেলো যে কুরআনের তালিম নেয়াটা একটা অপরাধ ! ঠিক যেমন সুমাইয়ার অপরাধ ছিল ঈমান আনা ! ফারহানা ভাবছিলো, তাহলে আবু জেহেলটা কে ?
আজ আর ফারহানার মনে কোন কষ্ট নেই । প্রিজন ভ্যানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মুনা আপুর দিকে তাকিয়ে ফারহানা দেখলো, আপু হাসছেন । চোখাচোখি হতেই মুনা আপু বললেন – সুমাইয়ার বোন, কেমন আছো ?
ফারহানার বুকটা হঠাৎ অন্যরকম আনন্দে ভরে গেলো । সত্যিই কি আমরা সুমাইয়ার বোন হবার সৌভাগ্য পেয়েছি ? ক’জনের সেই সৌভাগ্য হয় ?
কাপড় চোপড়ের একটা ব্যাগ হাতে আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন শুকনো মুখে । ফারহানা আব্বার দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিল, আব্বা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন ।

***
উৎসর্গঃ সুমাইয়ার (রাঃ) বোনদের । যারা রাষ্ট্রের বর্বরতার শিকার হয়ে কুরআনের তালিম নেয়ার জঘন্য অপরাধে (!) কারাগারে রুদ্ধ ।
ক্ষুধা পেয়েছে বেশ । সেইযে সকালে নাস্তা করেছে ফারহানা এরপর আর কিছু পেটে যায়নি । শরীরটা ক্লান্ত লাগছে । দেয়ালে যে একটু হেলান দেবে সে রুচি হচ্ছেনা । থুথুর রেশ দেখা যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে ।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একঝলক দেখেছে ফারহানা, আব্বা হাতে একটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঘুরছেন । নিশ্চয়ই খাবারটা দেয়ার উপায় করতে পারেননি এখনো । অন্য দিন ফারহানা তার আব্বার ওপর খুব রাগ করে , সকাল দুপুর রাত আব্বা যেখানেই থাকুক ফোন করে খবর নেবে কী খেয়েছে । মনে হয় এই পৃথিবীতে ফারহানার জন্মই হয়েছে খাওয়ার জন্য । আর একবেলা ফারহানা ঠিকমত না খেলে যেন আব্বার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে ! কিন্তু আজ ক্ষুধায় ফারহানার পেট মোঁচড় দিচ্ছে । বাইরে আব্বাকে খাবারের প্যাকেট হাতে এক পলক দেখে হঠাৎ করে খুব কান্না পেতে লাগলো ফারহানার । ইচ্ছে হচ্ছিলো আব্বা বলে ঝাপিয়ে পড়ে । কিন্তু উপায় নেই । যে রুমে ওরা বসে আছে তার একপাশে গ্রিলের দরজায় তালা লাগানো । আর আব্বাও যে কোথায় আছে কে জানে ? সেই যে এক পলক দেখা গেল, এরপর আর দেখা যায়নি ।
থুথুর চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নোংরা দেয়ালেই হেলান দিল ফারহানা । কান্নার দমকে ওর নাক ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো ।
****
কপালে মুনা আপুর হাত অনুভব করলো ফারহানা । কিছুটা রাগও হচ্ছিল মুনা আপুর ওপর । কেন এমন হলো ? সব দোষ যেন মুনা আপুর । বিপদে পড়লে কারো ওপর দোষ চাপালে মনটা হালকা হয় । ফারহানা একবার ভাবলো, অকারণে মুনা আপুর ওপর রাগ ঝাড়বে । কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এই সময় রাগ করা যায়না ।
কী অদ্ভুত ! এরকম একটা বিপদে পড়েছে ওরা, অথচ মুনা আপুর কোন বিকার নেই । একদম শান্ত । এমনভাবে এখানে আসছিলেন যেন তিনি নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন । যখন সবাইকে এখানে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন তিনি সবাইকে বললেন, 'কেউ একদম টেনশন করবে না । সব কিছুই স্বাভাবিক' । ফারহানার কিছুতেই মাথায় ধরছে না , এটা কীভাবে স্বাভাবিক হয় ?
ফারহানা মুনা আপুর হাতটা ওর কপাল থেকে সরিয়ে দেয় । ও যে রাগ করেছে মুনা আপুকে বোঝানো দরকার । ফারহানার কোন বোন নেই । এই মুনা আপুটা , কয়েক বিল্ডিং পরে বাসা । এত আদর করে । ফারহানাও অনেক জ্বালায় , তবু কিচ্ছু মনে করেনা মুনা আপু । আপুটা এত ভালো কেন আল্লাহ মালুম ।
মুনা আপু দুহাতে গলা জড়িয়ে ফারহানাকে কাছে টেনে নেন । এবার ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলে ফারহানা । আপু , এখন কী হবে ?
মুনা আপু কিছুক্ষণ চুপ থাকেন । ফারহানাকে কাঁদার সুযোগ দেন । বাপ মা'র একমাত্র মেয়ে ফারহানা । ছোট ভাই ছাড়া কেউ নেই । এইচএসসি প্রথম বর্ষে উঠেছে এবার । বাবা মার আদরে আদরে বেড়ে ওঠা ফারহানার জন্য এই পরিবেশ সত্যি অকল্পনীয় । কাঁদুক ও কিছুক্ষণ । তারপর চোখ খুলে বাস্তবতা মেনে নিতে শিখুক । মেয়েটা ঠিকমত নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারতো না । একমাস হলো নামাজ শিখে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে । অল্প কিছু ছোট ছোট সুরা মুখস্ত করলেও কুরআন পড়তে পারেনা ভালোমত । সামনে রমজান মাস । ভেবেছিল কুরআন জানা একজন বোনের কাছে নিয়মিত তালিম নিয়ে শিখে ফেলবে । কিন্তু আজ কুরআন তালিম নিতে এসে এই অবস্থায় পড়বে কেউ কল্পনাও করেনি ।
মুনা আপু বললেন , ফারহানা , একটা গল্প শুনবি ? তোকে একটা গল্প বলি ?
ফারহানা কোন জবাব দিলনা । শুধু একটু মাথা নাড়ালো । কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন । এই সময় স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেন একমাত্র মুনা আপু । এতবড় একটা বিপদে পড়েছে ওরা , মুনা আপুকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে ? এখন উনি গল্প বলবেন , ভাবা যায় ?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুনা আপু গল্প বলার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেনঃ শোন্ । গল্পটা একটা ছেলে আর তাঁর মা'র গল্প । ছেলেটার জন্ম অনেক অনেক দিন আগে । এখন থেকে প্রায় দেড়হাজার বছর আগে । মক্কায় । ছেলেটার নাম আম্মার ইবনে ইয়াসীর । বাবার নাম ইয়াসির ইবনে আমির আর তাঁর মায়ের নাম সুমাইয়া বিন্তে খুব্বাত । রাসুল (সাঃ) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন গোপনে অনেকেই মুসলিম হন । প্রথম দিকেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেন ইয়াসির ইবনে আমির, সুমাইয়া বিনতে খুব্বাত এবং আম্মার ইবনে ইয়াসির । কিন্তু তাঁরা ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখতে পারেন নি ।
সুমাইয়া ছিলেন বনু মাখযুম গোত্রের আবু হুজাইফার দাসী । আবু জেহেলও ছিল ঐ গোত্রের । তাঁদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানতে পেরে বনু মাখযুমের নেতারা এসে বললো- তোমাদের ব্যাপারে যা শুনলাম তা কি সত্যি ?
ইয়াসির বললেন – আপনারা আমাদের ব্যাপারে কী শুনেছেন ?
‘আমরা শুনলাম , তোমরা নাকি মুহাম্মাদের সাথে যোগ দিয়েছো ?
ইয়াসির নিসংকোচে বললেন- ‘হ্যা , আমরা তাই করেছি’ ।
‘তোমরা কি জানোনা সে আমাদের দেবতাদের অপমান করে , আমাদের পূর্বপুরুষদের সমালোচনা করে ?’
‘হ্যা , আমরা জানি’ ।
‘এরপরেও তোমরা তাঁকে মেনে নিয়েছো ?’
‘হ্যা, আমরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের ওপর বিশ্বাস এনেছি’ ।
‘তোমরা কি লাত উজ্জা হোবলের ওপর বিশ্বাস ত্যাগ করেছো ?’
‘হ্যা , আমরা লাত উজ্জা হোবলকে বিশ্বাস করিনা’ । জবাব দেন ইয়াসির রাঃ ।
শুনে বনু মাখযুমের নেতারা বললো – ‘তোমরা যদি মুহাম্মাদের ধর্ম না ছাড়ো, তাহলে আমরা তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবো’ ।
ইয়াসির (রাঃ) এবং সুমাইয়া (রাঃ) বলেন- যাও তোমাদের যা ইচ্ছা করো । আমরা যা সত্য জেনেছি তার ওপর বিশ্বাস ত্যাগ করবো না ।
এই জবাব শুনে আবু জেহেলের লোকেরা ইয়াসির, সুমাইয়া ও তাঁদের ছেলে আম্মারকে বন্দি করে নিয়ে যায় । তাদেরকে মক্কার উত্তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে রাখা হয় । এছাড়াও নানাভাবে নির্যাতন করা হয় । কিন্তু তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস ত্যাগ করেন না ।
এক পর্যায়ে আবু জেহেলের বর্শার আঘাতে শহীদ হয়ে যান সুমাইয়া (রাঃ) । তিনিই লাভ করেন ইসলামের প্রথম শহীদ হবার সৌভাগ্য ।
সেসময় গুটিকয়েক মানুষ মুসলিম হয়েছিলেন । রাসুল (সাঃ) এর পক্ষেও সুযোগ ছিলনা ইয়াসির পরিবারকে কোন সাহায্য করার । ইয়াসির (রাঃ) ছিলেন ইয়েমেনের লোক, মক্কার কোন গোত্রের নন । সুমাইয়া ছিলেন দাসী । মক্কায় তাঁদের পক্ষে দাঁড়াবার কেউ ছিলনা । রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন, ‘ইয়াসির, ধৈর্যধারণ করো । আল্লাহর জান্নাত তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে’ ।
ফারহানার মুখটা নিজের দিকে তুলে ধরে মুনা আপু বললেন- এখন তুইই বল্ , তুই কোন অপরাধ করেছিস ? করিস নি । আমরা কেউ কোন অপরাধ করিনি । কুরআনের তালিম নেয়া যদি অপরাধ হয় তাহলে এটা সেই অপরাধ যা সুমাইয়া করেছিলেন । যে কারণে তাঁদেরকে মরুভূমিতে শুইয়ে রাখা হত । যেকারণে তাঁদেরকে হত্যা করেছে কাফেররা । তাঁরা কি কেউ ঈমানহারা হয়েছিলেন ?
ফারহানা আস্তে করে জবাব দিল - না । গল্প শুনতে শুনতে ফারহানা চোখের পানি মুছে ফেলেছে । মনে সাহস ফিরে পেতে শুরু করেছে ফারহানা ।
মুনা আপু প্রশ্ন করলেন - সুমাইয়া তো শহীদ হয়ে গেছেন । সুমাইয়া হতে না পারি, কিন্তু আমরা কি সুমাইয়ার বোন হতে পারি না ? আমাদের কি ধৈর্যহারা হলে চলবে ? তোর কি ইচ্ছা হয় না সেই প্রথম শহীদ সুমাইয়ার বোন হতে ?
****
আদালতে ঢুকে ফারহানা অবাক । এত মানুষ ? মানুষে গিজগিজ করছে আদালত প্রাঙ্গন । এরই মাঝে তাঁদেরকে একটা রুমে নেয়া হল । সিনেমা নাটকে যেমন দেখা যায় আসল আদালতগুলো সেরকম না । এখানে একটা বড় রুমে অনেক মানুষ থাকে । হৈ হুল্লোড় । সামনে এজলাস । এজলাসের নিচে উকিলরা কাগজপত্র নিয়ে কথা বলেন । জাজ শুনে তাঁর সামনে রাখা কাগজে রায় লিখে দেন ।
ফারহানা শুনলো তাদেরকে জামিন দেয়া হয়নি । বিচারক ওদেরকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছে । তার মানে এটা এস্টাবলিশ হয়ে গেলো যে কুরআনের তালিম নেয়াটা একটা অপরাধ ! ঠিক যেমন সুমাইয়ার অপরাধ ছিল ঈমান আনা ! ফারহানা ভাবছিলো, তাহলে আবু জেহেলটা কে ?
আজ আর ফারহানার মনে কোন কষ্ট নেই । প্রিজন ভ্যানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মুনা আপুর দিকে তাকিয়ে ফারহানা দেখলো, আপু হাসছেন । চোখাচোখি হতেই মুনা আপু বললেন – সুমাইয়ার বোন, কেমন আছো ?
ফারহানার বুকটা হঠাৎ অন্যরকম আনন্দে ভরে গেলো । সত্যিই কি আমরা সুমাইয়ার বোন হবার সৌভাগ্য পেয়েছি ? ক’জনের সেই সৌভাগ্য হয় ?
কাপড় চোপড়ের একটা ব্যাগ হাতে আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন শুকনো মুখে । ফারহানা আব্বার দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিল, আব্বা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন ।

***
উৎসর্গঃ সুমাইয়ার (রাঃ) বোনদের । যারা রাষ্ট্রের বর্বরতার শিকার হয়ে কুরআনের তালিম নেয়ার জঘন্য অপরাধে (!) কারাগারে রুদ্ধ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন