এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০১৪

শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করা কি বউয়ের দায়িত্ব ?

- কিরে মনু, শুনলাম তোর নাকি বিয়া ?
- হ ভাই, কী করুম কন ? বাপ -মা'র বয়স হইছে, দেখভাল করার জন্যে একজন মানুষ তো দরকার । কী কন ?
- হ, তা অবশ্য ঠিকই কইছস । তয় বেবাকরে ঠিকমতন দাওয়াত টাওয়াত দেস কিন্তু কইলাম !

মনু এবং মনুর সমর্থন করার মত লোক বাঙালি সমাজে অহরহই মিলবে । নিজের বাপ - মায়ের 'খেদমতে'র দায় বউয়ের ওপর চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে কে না চায় ? যৌথ পরিবার থেকে যদি কেউ বিচ্ছিন্ন হতে চায় , সেটাকেও বাঙালি সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না । আর এ ব্যাপারে আড়ালে আবডালেও বউকেই দোষ দেয়া হয় ।
......

কিন্তু ইসলাম একক পরিবারের ধারণাকেই প্রাধান্য দেয় । মাওলানা আশরাফ আলী থানভী তাঁর 'কোরআন হাদিসের আলোকে পারিবারিক জীবন' বইয়ে লিখেছেন, ছেলে মেয়েদের বিয়ের পর তাদেরকে পৃথক করে দিতে হবে । তারা আলাদা পরিবার গড়ে আলাদাভাবে পারিবারিক জীবন শুরু করবে ।
তাঁর মতে- পিতামাতার সেবা, খেদমত ও দেখাশুনা করার দায়িত্ব সন্তানের ; স্ত্রীর নয় । ছেলের বউ যদি শ্বশুর শ্বাশুড়ী নিয়ে এক পরিবারে থাকাকে পছন্দ করে তাহলে সেটা হতে পারে , কিন্তু যখনই বোঝা যাবে যে ছেলের বউ পৃথক হওয়াকে পছন্দ করছে , তখন সে ব্যবস্থাই গ্রহণ করা দরকার ।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর মতে, স্ত্রীর জন্য আলাদা ঘর ও তাঁর খোরপোষের ব্যবস্থা করা স্বামীর ওপর স্ত্রীর হক এবং এ হকের দাবি পূরণ করা ওয়াজিব । এ ক্ষেত্রে পিতা মাতা স্ত্রীকে আলাদা করে রাখতে আপত্তি করলেও বা মত না দিলেও তা করা উচিৎ, ওয়াজিব আদায়ের জন্য ।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী তাঁর 'মু'মিনের পারিবারিক জীবন' বইয়ে এ ব্যাপারে আরো যোগ করেছেন- স্ত্রী গ্রহণের উদ্দেশ্য হলো পারিবারিক শান্তি লাভ । পিতামাতার খেদমত করা, পারিবারিক কাজ-কর্ম করা এসব এর উদ্দেশ্য নয় । স্বামী স্ত্রীর প্রধান সম্পর্ক হবে পবিত্র দাম্পত্য জীবন যাপন , যাতে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায় । অবশ্য স্ত্রী যদি সমঝদার ও বিনয়ী হয় তবে তাঁর শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর খেদমত করতে আপত্তি থাকার কথা নয় । তা ছাড়া সাংসারিক কাজকর্ম করা- এটাও অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব হিসেবে পালন করতে পারে । এটাও পারিবারিক শান্তির কারণ হতে পারে , কেননা প্রত্যেক স্বামীর পক্ষে কাজের লোক রেখে পাক-শাক করানো ও পারিবারিক অন্যান্য কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয় । কিন্তু এসব কাজ যদি পারিবারিক শান্তির ব্যাঘাত সৃষ্টি করে তাহলে স্ত্রীকে আলাদাভাবে রাখারই ব্যবস্থা করতে হবে স্বামীকে ।
......
......
বিশেষ কারণে পারিবারিক জীবনে ইসলামের বিধিবিধান নিয়ে পড়তে গিয়ে বেশ আশ্চর্য হচ্ছি ।
ইসলাম নারীকে চরম অবমাননাকর অবস্থা থেকে শুধু উদ্ধারই করেনি, এত বেশি অধিকার দিয়েছে যে, মাঝে মাঝে পুরুষ হিসেবে নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয় । ইসলাম নারীকে সন্তানের দেখাশোনা করা ছাড়া প্রায় আর সব কিছু থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে । এমনকি ঘরের কাজকর্ম করতেও বউকে বাধ্য করা যাবে না ! পারলে বেতন দিয়ে অন্য লোক রেখে করান , নাহলে নিজেই করুন । আপনার বাপ-মায়ের সেবা বউ করলে সেটা তাঁর মহানুভবতা, না করলে দোষ দেয়ার সুযোগ নাই ।
নারীরা যদি তাঁদের অধিকার নিয়ে সচেতন হয় , তাহলে তো বেচারা পুরুষ প্রজাতির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হবে । এই জন্যেই বোধহয় একসময় পর্দা এবং শিক্ষাকে বিপরীত হিসেবে তুলে ধরে, পর্দার নামে নারীদের শিক্ষাবিমুখ করার চেষ্টা হয়েছিল । সম্ভবত এখনো ছেলেরা মনে করেন , এসব ব্যাপারে মেয়েরা যত কম জানে ততই মঙ্গল !

ফুটনোটঃ এইটা জেনে ভাইয়ারা সচেতন হোন । কিন্তু আপারা (যদি কেউ দেখে থাকেন) আজকেই রান্নাবান্না বন্ধ করে দিয়েন না । অধিকার থাকলেই তা সাথে সাথে আদায় করতে হয়না । আর তাছাড়া যুগ যুগ ধরে যে আচার-বিশ্বাস সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়েছে তা একদিনে পরিবর্তন করতে পারবেন না । এতে বিশৃংখলা হবে । শ্বশুর শাশুড়ীর সেবা করা আপনার দায়িত্ব নয়, কিন্তু করতে পারলে নিশ্চয়ই ভালো । পরিবারে শান্তি রক্ষা করে ধীরে ধীরে আপনাদের অধিকার আদায় করবেন । আর শ্বশুর শাশুড়ীর সেবা করার দায়িত্ব না চাপালেও নিজের বাবা মায়ের সেবা করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি কিন্তু নারী পুরুষ কাউকেই দেয়া হয়নি , সেটাও খেয়াল রাখতে হবে ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার পর বিভিন্ন জনের প্রশ্নের জবাবে আরো যা বলেছিলাম -
১। মেয়েদেরকে ইসলাম কী অধিকার/সুযোগ দিয়াছেন তাহা না বলিলে তো উহারা মরিচীকার পেছনে ছুটিবে । যেমনটা হইয়াছে পর্দার ক্ষেত্রে । আপনারা যদি আগেই বলিতেন যে পর্দা করিয়া বাহিরের প্রায় সকল কাজই উহারা করিতে পারিবে , তাহা হইলে হয়তো উহারা আর পর্দা 'ছাড়িয়া' বাহির হইতো না । কিন্তু পর্দা করাইয়া ঘরে আটকাইয়া দেওয়ায় উহারা শেষে পর্দাকেই ছুড়িয়া ফেলিয়াছে , শয়তান ইহার সুযোগ লইয়াছে ।
যাহারা ভালো মনের অধিকারী , তাহারা এমনিতেই পিতা-মাতার সেবা করিবে । কিন্তু ইহা যে ফরয ওয়াজিব নহে তাহা জানা থাকা দরকার । না হইলে ছেলে/শ্বশুর/শাশূড়ির পক্ষ হইতে বউয়ের ওপর জুলুম করিবার সম্ভাবনা থাকে । অনেক ক্ষেত্রে ঘটিয়াছেও তাহাই । ফলে বিবাহের উদ্দেশ্যই এক পর্যায়ে ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে । 


২।
অনেক সিঙ্গেল ফ্যামিলিকে দেখেছি যাদের প্রতি বাবা-মা খুবই সন্তুষ্ট । আবার অনেক যৌথ ফ্যামিলির বাবা মা ছেলে-বউয়ের ওপর সন্তুষ্ট না । এবং বাস্তবে এই অসন্তুষ্টি থেকেই পরবর্তীতে যৌথ ফ্যামিলি ভেঙ্গে যায় । সম্পর্ক খারাপ হয়ে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেলে পরে সেটাকে আর আগের জায়গায় নেয়া যায় না । বাবা-মা কে সন্তুষ্ট করার জন্য একসাথে থাকাটা জরুরী না । দেয়ার আর সো মেনি ফ্যাক্টরস টু স্যাটিসফাই প্যারেন্টস । আধুনিক যুগে চাইলেও আর পরিবারগুলো একত্রে থাকতে পারবে না । পাশ্চাত্যের প্রভাবের অভিযোগটা সত্য হবে না , কারণ পাশ্চাত্যের পরিবারগুলোর ভাঙ্গন মহামারী আকার ধারণের আগেই আলেমরা এই ব্যাপারে কথা বলে গেছেন । 

৩।
বউ যদি স্বামীর অধীন হয়, স্বামী যদি তার পিতা-মাতার অধীন হয়, তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল?

মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর মতে, স্ত্রীর জন্য আলাদা ঘর ও তাঁর খোরপোষের ব্যবস্থা করা স্বামীর ওপর স্ত্রীর হক এবং এ হকের দাবি পূরণ করা ওয়াজিব । এ ক্ষেত্রে পিতা মাতা স্ত্রীকে আলাদা করে রাখতে আপত্তি করলেও বা মত না দিলেও তা করা উচিৎ, ওয়াজিব আদায়ের জন্য । 


৪। 
দায়িত্ব না / ফরজ-অয়াজিব না মানে কি 'করা যাবে না' ? বউ যদি এতটুকু মানবিক হয়, তাহলে সামান্য অনুরোধেই সব করবে । ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি বউকে 'বাধ্য করতে' পারবেন না । বিষয়টা আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে একটু জটিল , কিন্তু অতটা জটিল না । আমি তো দেখি অনেকেই বাবা মাকে শহরে নিয়ে এসে নিজের সাথে রাখছেন । খুব ইজি । কিন্তু সব ভাইবোন একত্রে সংসার চালানোটা (পুরনো যৌথ পরিবার) আসলেই প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার । 

৫।
বাবা মায়ের সেবা করা সন্তানের ওপর ফরয । সন্তানের বউয়ের ওপর তো নয় । আর বউ শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা করতে বাধ্য নয় মানে এই না যে সব ধরণের সম্পর্ক ছেদ করবে । বউ তার স্বামীরও সেবা করবে, সন্তানেরও সেবা করবে, নিজের বাবা মায়ের সেবা করবে , আবার স্বামীর বাবা মায়ের সেবা করবে - এতকিছু তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে । এই ক্ষেত্রেই অনেক সময় জুলুম করা হয় । সে হয়তো বাধ্য হয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির সেবা করছে কিন্তু তার মন পড়ে থাকে নিজের বাবা মায়ের কাছে । হয়তো তার নিজের বাবা মা অসুস্থ, তাঁদের সেবা করার সুযোগ তাঁকে দেয়া হচ্ছে না । 

৬।
সবাই মনে প্রানে বিশ্বাস করে বসে আছে - শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা বউয়ের এক নম্বর দায়িত্ব ! একটু কম হলেই বউয়ের নামে গীবত চোগলখুরী শুরু হয়ে যায় । আর নিজের বাপ মা অল্প সেবাতেই অনেক খুশি হয়, কিন্তু শ্বশুর শাশুড়িকে সেবা করে সন্তুষ্ট করা নাইন্টি পার্সেন্ট ক্ষেত্রে সম্ভব না । তারা বউয়ের কোন একটা ভুল বের করবেই । 

1 টি মন্তব্য: