সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির দিকে প্যাডেল চালালো অপু । যতই বাড়ির কাছাকাছি হতে লাগলো, ততই তার চোখ ঝাপসা হতে লাগলো । বাড়ি থেকে আধা কিলো উত্তরে রাস্তার পাশে বিল । চারধারে উঁচু করে বাধানো । একপাশে একটা বাঁশের সাঁকো আছে । পশ্চিমের রাস্তায় উঠতে হলে সাঁকোটা পার হতে হয় ।
চোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু গালের ওপর এসে পড়েছে । অপু সাইকেল থেকে নেমে পড়লো । সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বাঁশের সাকোর একপাশে স্ট্যান্ড করিয়ে রাখলো । পা ঝুলিয়ে বসলো সাঁকোর ওপর । এখন সুর্য পাটে নেমে গেছে । পাখিগুলো যার যার নীড়ে ফিরে যাচ্ছে । মা পাখি বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে ।
শুন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অপু । এই গ্রাম, এই সাঁকো । কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে ।
অপু তাদের গ্রামের স্কুলে পড়তো । বাড়িতে মা ওকে পড়াতেন । প্রথম থেকেই অপু ভালো রেজাল্ট করতে লাগলো । ক্লাস ফাইভে বৃত্তিও পেল । অপু হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলো । যেদিন বৃত্তির রেজাল্ট হলো, সে তখন স্কুলে । বিকালে ফিরে এসে দেখে আঙ্গিনায় একটা লাল টুকটুকে সাইকেল । মা এসে অপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন , আর বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন ।
সাইকেলটা হাতে ধরিয়ে মা বলেছিলেন, ‘বাবা সোনা, এই সাইকেলটা তোর জন্য কিনেছি । তোর পছন্দ হয়েছে ?’ অপু সাইকেলটা খুঁটে খুঁটে দেখেছিল । সাইকেলের নাম ‘হিরো’ ।
একবছর ধরে টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন মা । সকালে অপুর বৃত্তির রেজাল্ট শুনেই সাইকেল কেনার ব্যবস্থা করেন ।
সাইকেল পেয়ে অপুর খুশি আর ধরে না । সাইকেল চালানো সে আগেই শিখেছিল ইলিয়াস চাচার কাছে । চাচার একটা ফোনিক্স সাইকেল আছে । ইলিয়াস চাচা অপুকে খুব আদর করেন । অপু যখন ছোট্ট ছিল তখন থেকেই ইলিয়াস চাচা বিকেলে সাইকেলে করে অপুকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন । ধানক্ষেত, বিল, নদী , নদীর ওপর বেইলি ব্রিজ এইসব দেখিয়ে আনতেন । অপু কান্নাকাটি করলে তার একমাত্র অষুধ ছিল ইলিয়াস চাচার সাইকেল । সাইকেলে চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনলেই অপু শান্ত হয়ে যেত ।
একবছর অপু ইলিয়াস চাচার কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল । ‘চাচা আমি সাইকেল চালাবো’ । চাচা বলেন, বাবা আরেকটু বড় হও । অপুর জেদাজেদিতে ইলিয়াস চাচা তাকে সাইকেল চালানো শেখাতে বাধ্য হন । চাচা পেছনে ক্যারিয়ার ধরে রাখেন , অপু ‘হাফ প্যাডেল’ মারে । চাচা মাঝে মাঝে হাত ছেড়ে দেন , অপুর সাইকেল কাত হয়ে গেলে আবার ধরে ফেলেন । ধীরে ধীরে অপু শিখে ফেলে । কিন্তু ইলিয়াস চাচার সাইকেল অনেক বড় । হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে হয় অপুকে ।
সাইকেলের ত্রিভুজাকৃতি ফ্রেমের ভেতর প্যাডেল চালাত অপু । হ্যান্ডেলের নিচ দিয়ে সামনে তাকাতে হত ।
মায়ের দেয়া ছোট সাইকেল অপুর হাতে যেন পুরো পৃথিবী । এখন সে সাইকেলের সিটে বসে চালাবে । সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাবে । স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে যাবে । ওদের কয়েকটা ধানী জমি ছিল বেশ দূরে । সেগুলোও দেখতে যেতে পারবে ।
বিকেলে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ঢোকার আগে অপু বাঁশের সাঁকোটার ওপর এসে বসতো । সাঁকোটা খুব সরু । দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতেও কষ্ট হয় । অপুর মাথায় খেয়াল চাপে একদিন সাইকেলে চড়েই সাঁকোটা পার হতে হবে ।
স্কুল থেকে ফিরে সাঁকো পার হবার প্র্যাকটিস করতে শুরু করলো অপু । প্রথমে সে মাঠের সরু আইল ধরে চালানো শুরু করলো । বেশ কিছুদিন চালিয়ে যখন মোটামুটি সাহস হয়ে গেল , একদিন বিকেলবেলা সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়ালো সাঁকোর কাছে । আশেপাশে কেউ নেই দেখে দু-তিনশ গজ দূর থেকে সাইকেলে উঠে গতি বাড়িয়ে নিলো । নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাইকেল তুলে দিল সাঁকোর ওপর । সাঁকো দুলতে লাগলো । সাইকেল লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো । তিনভাগের দুইভাগ পার হয়েছে এমন সময় সামনের চাকাটা স্লিপ করে গেল । টাল সামলাতে পারেনি অপু । সাইকেল সহ পড়ে গিয়েছিল খালের পানিতে ।
.......................................
অপু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল । জ্ঞান ফিরলে দেখে সে হাসপাতালে । তার হাতে পায়ে বেশ কয়েকটা ব্যান্ডেজ । কান্না ভেজা চোখে মা বসে আছেন মাথার কাছে । ওকে চোখ খুলতে দেখেই মা কেঁদে উঠলেন । আমার বাবা, আমার সোনা । বাবা আমার, এখন কেমন লাগছে বাবা ? ব্যথা করছে ? সব দোষ আমার, আমি কেন তোকে সাইকেল কিনে দিলাম ?’
অপু জিজ্ঞেস করলো, ‘মা, আমার সাইকেল কোথায় ? সাইকেলটা ঠিক আছে তো ?’
ইলিয়াস চাচা এসে ঢুকলেন রুমে । বললেন, তোর সাইকেলের রিং বাঁকা হয়ে গেছে । চিন্তা করিস না , আমি ঠিক করে দেবো ।
অপু যখন সাঁকো থেকে পড়ে যায় , ইলিয়াস চাচা তখন মূল রাস্তা ধরে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন । হঠাৎ সাঁকোর দিক থেকে শব্দ শুনে তিনি এগিয়ে এসে দেখেন অপু পড়ে গেছে । তিনি তাড়াতাড়ি খালের পানিতে লাফ দিয়ে অপুকে উদ্ধার করেন ।
সেবার অপুর বাম হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল । প্রায় দুইমাস তাকে ঘরে বসে থাকতে হয়েছিল ।
সাঁকোর ওপর বসে মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো অপুর । মা কেন এভাবে চলে গেল ?
অপু ক্লাস এইটেও বৃত্তি পেয়েছিল । প্রাইমারিতে সাধারণ গ্রেডে পেলেও জুনিয়র বৃত্তিতে ট্যালেন্টপুল পেয়েছিল । ভালোয় ভালোয় এসএসসি পরীক্ষাও দিল । এসএসসি পরীক্ষার শেষদিকে মায়ের শরীরটা কেমন শুকনো শুকনো হয়ে যেতে লাগলো । মা প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে যাবার আগে নিজ হাতে অপুকে দুধভাত খাইয়ে দিতেন । অপু জিজ্ঞেস করে – তোমাকে এমন শুকনো লাগছে কেন মা ? মা বলেন, ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না বাবা । আমি ভালো আছি । তুই ভালো করে পরীক্ষা দে । এ প্লাস পেতে হবে কিন্তু ।
অপু বলেছিল, তোমার দোয়া থাকলে এ প্লাস আমি পাবোই মা ।
কে জানতো, জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে ! শুন্য হয়ে যাবে । মায়ের শরীর আরো খারাপ হতে লাগলো । একদিন বাবাসহ মাকে নিয়ে উপজেলা হাসপাতালে গেল অপুরা । ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন । সেগুলো করানোর পর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন বড় হাসপাতালে নেয়ার । এখানে কিছু করার নেই ।
মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেল অপু ও বাবা । সেখানে আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা হল । ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন । বাবার মুখ শুকিয়ে গেল । অপু জিজ্ঞেস করে – বাবা, কী হয়েছে মার ?
বাবা বলেন, কিছু হয়নি বাবা । সামান্য অসুখ । কদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে ।
বাবার চোখ ছলছল করে । অপুর কাছে তিনি আড়াল করেন ।
মাকে নিয়ে ঢাকায় গেল ওরা । বাবা তাঁর মুদি দোকান বিক্রি করে দিলেন । ধানী জমি বিক্রি করে দিলেন । চিকিৎসা চলতে লাগলো । কিন্তু মায়ের অবস্থা আরো খারাপের দিকেই যেতে লাগলো । মাথার চুল পড়ে গেল । সুন্দর গোলগাল মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে চুপসে গেছে ।
অপু সবসময় মায়ের কাছে বসে থাকে । মায়ের কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয় । খাবার খাইয়ে দেয় । কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে । মা বলেন, কিচ্ছু লাগবে না বাপ । তুইই আমার সব । তুই কাছে থাকলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না । অপুর মন খারাপ দেখে সবসময় বলেন, বাবা দেখিস, আমি কিছুদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবো । তোকে ছাড়া কি আমি থাকতে পারি ?
অপুর মন মানে না । মাঝে মাঝে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে । নামাজ পড়ে দোয়া করে । চোখ মুছে মায়ের কাছে ফিরে আসে ।
মা কথা রাখেন নি । অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল । বাবা আর গোপন করেন নি । অপুকে বলে দিয়েছেন, তোর মায়ের ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে বাপ । ও বাঁচবে কিনা জানিনা ।
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হবার দিন মায়ের কাছে বসে ছিল অপু । ইলিয়াস চাচা স্কুলে টেলিফোন করে রেজাল্ট জেনে এসেছেন । অপু এ প্লাস পেয়েছে । সেবছর চতুর্থ বিষয়ের পয়েন্ট যোগ হয়নি । রেজাল্ট শুনে মার শুকনো চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো । মা বললেন , বাবা আমি বোধহয় আর থাকতে পারবো নারে । তুই ভালো করে লেখাপড়া করিস । আমি সবসময় তোকে দোয়া করবো । শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হবি । আশা ছিল তোকে ডাক্তার বানাবো । তুই ডাক্তার হবি । আমার কথা ভেবে রোগীদের চিকিৎসা করবি ।
রানু খালাকে ডেকে নিলেন মা । খালার মেয়ে মিলিকে আদর করলেন । খালাকে বললেন, রানু- মনে আশা ছিল তোর মেয়েটাকে আমার বাড়ির বৌ বানাবো । আমার অপুর জন্য ওকে নিয়ে আসব । আমি বোধহয় থাকবো নারে । তুই ওর সাথে মিলির বিয়ে দিস ।
অপু অঝোরে কাঁদছিল । মা তাকে ডেকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন । বললেন , বাবা , কষ্ট নিস না । আমি তোর সাথেই থাকবো । তোর জন্য আমি মিলিকে পছন্দ করে দিয়ে গেলাম ।
অপুর মুখে কথা ছিল না । ও শুধু মা মা করেছিল । আসরের আজানের সময় মা ওকে একা রেখে চিরবিদায় নিলেন ।
...................................................
অপু শহরে গিয়ে সরকারি কলেজে ভর্তি হল । বই কেনার জন্য সাইকেলটা বিক্রি করে দিল । এইচএসসিতেও ভালো রেজাল্ট করলো । একটা কোচিং এ ফ্রিতে ভর্তি হলো । কোচিং এর বড় ভাইরা তাকে খুব স্নেহ করতেন । সে কোচিং এর পরীক্ষায় ভালো করতে লাগলো ।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিল । চান্স পেল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ।
আজ মায়ের স্বপ্ন পুরণ হয়েছে । অপু ডাক্তার হয়েছে । কিন্তু মা নেই । মায়ের দেয়া সাইকেলটা নেই । খুব বিপদে পড়েই ওটা বিক্রি করেছিল অপু । তাছাড়া মা নেই, সাইকেল রেখে কী লাভ ? এমন ধারণাও করেছিল তখন । কিন্তু সাইকেলটা বিক্রি করার পর সেই রাতে অঝোরে কেঁদেছিল সে ।
কয়েকদিন থেকে বাবা ফোন করছেন বাড়িতে আসার জন্য । খালাও ফোন করেছিলেন । অপু ধারণা করছে, হয়তো তার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করছেন বাবা । খালার বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হত না অপুর । গত সাত-আট বছরে দুবার কি তিনবার গিয়েছে । মিলি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে । দেখতে নাকি খুব সুন্দর হয়েছে । অপু খুব একটা খোজখবর নেয়নি কখনো । বাবা মাঝে মাঝে নিজে যেঁচে মিলির কথা বলতেন । অপুর লজ্জা করতো । বাবা সম্ভবত অপুকে মায়ের শেষ ইচ্ছার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেন । ইলিয়াস চাচা জানিয়েছে, দুই পরিবারের মধ্যে সব কথাবার্তা-প্রস্তুতি সম্পন্ন । এবার অপু বাড়িতে এলেই বিয়েটা ঘরোয়াভাবে সেরে ফেলবে । কোন ধুমধাম হবে না ।
বাড়িতে আসার আগে মায়ের দেয়া সেই সাইকেলটার কথা স্মরণ করে একটা সাইকেল কিনেছে অপু। সাইকেলটা বাসের ওপর উঠিয়ে নিয়ে এসেছে । বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে সাইকেলে চড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল সে । সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে শুধু মায়ের কথা মনে পড়ছিল । পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিল । চোখটা ভিজে যাচ্ছিল । চিন্তাভাবনাগুলো কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল ।
আকাশে বক উড়ে যাচ্ছে । দূর আকাশে কয়েকটি চিল উড়ছে । জীবনানন্দের কবিতা মাথায় এলো-
‘‘হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; ......’’
সাঁকোর নিচ দিয়ে প্যাক প্যাক করতে করতে কয়েকটি রাজহাঁস সাতার কেটে গেল । অপুর মাথায় এলো- উইড়া যায়রে হংস পক্ষী পইড়া রয়রে মায়া ...
সাঁকোর গোড়ায়, যেখানে সাইকেল রেখেছে অপু, সেদিক থেকে টুং করে শব্দ হলো । সাঁকোটাও যেন একটু কেঁপে উঠলো । ঝাপসা চোখে সেদিকে তাকালো অপু । অবাক হয়ে দেখলো- সাঁকোর ওপর উঠে হেঁটে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে আসছে মিলি । গোধুলীর লাল আলো তার মুখে এসে পড়েছে ।
...........................
উড়ে যায় হংসপক্ষী / ০৯-০৭-২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন