এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৩

ক্রাশ

মেয়েরা সুন্দর হলে ‘রুপবতী’ বলা যায় ,কিন্তু ছেলেরা সুন্দর হলে ‘রুপবান’ বলা যায় না । বলতে হয় ‘হ্যান্ডসাম’ ।
সে হিসেবে ভাইয়াকে বেশ ‘হ্যান্ডসাম’ না বলে উপায় নেই । মেয়েরা ফর্সা হলে বলা হয় ‘দুধে আলতা বরণ’ , কিন্তু ভাইয়া পুরুষ মানুষ বলে সেটা বলা যাচ্ছে না । আচ্ছা, ‘দুধে পানি’ বলা যায় কি ?

ভাইয়াকে নিয়ে বেশ আলোচনা চলতো আমাদের ভেতর । ভাইয়াটা কেমন চুপচাপ । খুব একটা কথা বলতে দেখা যায়না তাঁকে । মেয়েরা সালাম দিলে মাথা উপর নিচে দুলিয়ে অস্ফূট স্বরে সালামের উত্তর দিতেন । সরাসরি মুখের দিকে তাকাতেন না । ভাইয়ার কোন রিলেশন আছে কিনা জানার জন্য সবার ভেতরেই একটা গোপন আগ্রহ ছিল । আমি সেটা টের পেতাম । কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলতো না । বলেও লাভ নাই । আমার ঘটনাটা কীভাবে কীভাবে জানি হোস্টেলের সবাই জেনে গিয়েছিল । ভাইয়া যা বলেছিলেন , সেটাও । এরপর থেকে আর কেউ ওপথে পা বাড়ানোর সাহস করেনি । জানে, ওতে লাভ হবে না ।

আমার ইন্টার্ণশিপ শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে । বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য বিভিন্ন পাত্রের বায়োডাটা সংগ্রহ করছেন । দুটি বায়োডাটা ইতোমধ্যে আমার হস্তগত হয়েছে । একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার । বিকেলটা আমার কাটে ছাদে বসে । ছাদে একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার রাখা হয়েছে । নতুন কেনা আর এফ এল চেয়ার । নান্টু ঘটকের কথা শুনে কেনা হয়েছে কিনা কে জানে !

বিকেলে এক কাপ কফি নিয়ে আমি ছাদে এসে বসি । চুপচাপ চিন্তা করি । আমার চোখের সামনে সুর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যায় । মনটা হঠাৎ তখন কেন যেন বিষাদে ভরে ওঠে ।

সেই দিনগুলোর কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে । নতুন এসেছি ক্যাম্পাসে । ক্লাসের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস । একটা ক্লাসও মিস দেই না । বিকেল বেলা দুতিন জনে মিলে ঘুরতে বের হই । ক্যাম্পাসের ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করি । পড়াশোনার চাপ নেই তেমন ।

সেদিন ছিল জুলাই মাসের ১০ তারিখ । বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে । যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় । বিকেলে ঘুরতে বের হওয়াটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে । যুথীও আমার মত উড়নচন্ডি । আমি ডাকলেই ও রাজী । বললেই হলো- ‘চল, বাইরে কোথাও ফুচকা খেয়ে আসি’ ।

সেদিন গোলপাহাড় মোড়ে ফুচকা খেয়ে ফিরছি । হঠাৎ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । আমি রিক্সা নিতে চাইলাম, যুথী রাজী হল না । একটু ভিজলে কী হয় ? প্রবর্তক মোড়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছি , দেখি রাস্তার পাশে টং দোকানে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খাচ্ছে একজন । আমার চোখ আটকে গেল । উদাসভাবে চা খাচ্ছিলেন তিনি । যুথীকে বললাম- ‘উনার পরিচয় বের করতে হবে’ ।
যুথী মোবাইল বের করে দূর থেকে ছবি তুলে ফেললো । রুমে এসে আমার রুমমেট তানিয়া আপুকে ছবিটা দেখালাম । তানিয়া আপু চোখ বড় বড় করে বললেন- এই ছবি কোথায় পেলি তুই ? এ যে আমাদের আউয়াল ! খবরদার, ওর দিকে হাত বাড়াবি না ।

জানলাম , উনি আমাদের সিনিয়র ব্যাচের ছাত্র । আমার ভেতরটা ওলট পালট হয়ে যেতে লাগলো । আমিও দেখতে কম সুন্দরী নই । স্কুলে- কলেজে কত ছেলে আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছে, কাউকে পাত্তা দেইনি । দেয়ার দরকারও মনে করিনি । কিন্তু এবার তো বোধহয় আমাকেই লাইন ধরতে হবে !

কী আর করা । পরদিন থেকে কারণে অকারণে সিনিয়র ব্যাচের রুটিন অনুযায়ী ক্লাসরুমের আশেপাশে ঘোরাফেরা করা শুরু করলাম । ভাইয়া বের হন, আমি করিডোরের এক প্রান্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি । সুযোগ পেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ।
মাঝে মাঝে ছাত্রাবাসে যাওয়ার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি । কিছু বলার সাহস হয়না । উনি কোনদিনও আমার দিকে তাকাননা । কখনো যদি আমার দিকে চোখ পড়ে, সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেন । আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে । সাহস আরো কমে যায় । আমাকে কি তার পছন্দ না ? সবাই আমার দিকে তাকায়, উনি তাকাননা কেন ?

.............................................

আজ যুথী এসেছে বাসায় । ছাদের ওপর দুজনেই বসেছি কফির মগ হাতে । যুথীর বিয়ে হয়ে গেছে ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই । যুথীকে দেখে সেই দিনটির কথা বেশি করে মনে পড়তে লাগলো ।

প্রায় ছয়মাস কেটে গিয়েছিল । আমি তখনো কিছুই বলতে পারিনি । যুথী আমার ওপর বিরক্ত । আমি সারাদিন আউয়াল ভাইয়া আউয়াল ভাইয়া করে ওর কান ঝালাপালা করি ।
যুথী যে সেদিন এইকাজ করবে আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি । জানুয়ারি মাস । বিকেল বেলা হাঁটতে বের হয়েছি । যুথী বললো , ‘মুন্নি দ্যাখ দ্যাখ’ ।
তাকিয়ে দেখি পশ্চিম দিক থেকে আউয়াল ভাইয়া আসছেন । আমি যুথীকে বললাম, ‘চল অন্যদিকে যাই’ ।
যুথী আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো । কাছাকাছি এসে পড়লে আমাকে টেনে ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । ওর সাহস দেখে আমি অবাক । এদিকে তো আমার হার্টবিট এক’শ পার হয়ে গেছে ।
‘ভাইয়া , আমার বান্ধবী আপনাকে কিছু বলতে চায়’ ।
‘আমাকে... কেন ? আমি কী করেছি ?’ মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন ভাইয়া ।
আমি কী বলবো ? আমি তো এই পরিস্থিতির জন্য রেডি ছিলাম না । আমার মাথা ঘুরছিল । কপাল ঘামতে লাগলো । মাথার ভেতরটা শুন্য হয়ে যেতে লাগলো । শুধু বললাম ‘যুথী , আমাকে ধর । আমি পড়ে যাচ্ছি’ ।
যুথীকে সেদিন ভাইয়া বলেছিলেন- মুসলিম হিসেবে উনি ইসলামের বিধান মেনে চলেন । ‘বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা, প্রেম ইসলামে নিষেধ আছে’ ।
আমি আর কখনো তাঁকে বিরক্ত করিনি ।

‘কিরে, এত গম্ভীর হয়ে আছিস কেন তুই ?’ যুথী বিরক্ত হয়ে আমার চুল ধরে টান দিল । উঃ । কেন জানিনা আমার চোখ ছলছল করতে লাগলো । হাত দিয়ে চোখটা কচলে নিলাম । যুথীর চোখের দিকে তাকালাম । দেখি, ও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । গলার স্বরটা স্বাভাবিক করে নিলাম ।
‘যুথী, আউয়াল ভাইয়ার কথা কি তোর মনে আছে ? তার কোন খবর জানিস ?’

-ক্রাশ / ০১-০৭-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন