সুর্য এখনো ওঠেনি । ঠান্ডা বাতাস বইছে । রাস্তায় নামতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল আব্দুল লতিফ বিএসসি সাহেবের ।
সকালবেলা আব্দুল লতিফ সাহেব আধাঘন্টা হাঁটাহাঁটি করেন । মসজিদে ফজরের নামাজ শেষ করে হাঁটতে বের হন । আশেপাশে আধাঘন্টার মত হাঁটেন । কখনো কখনো এক দেড় ঘন্টাও লেগে যায় । এলাকার লোকজনের সাথে দেখা হয় , নানান বিষয়ে কথা হয় । লোকেরা তাঁর সাথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করে । দেশের অতীত ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হয় । রাজনীতি নিয়ে কথা হয় ।
বয়স প্রায় ষাটের কোঠায় । কিন্তু শরীর এখনো শক্তপোক্ত । ছেলেবেলা থেকেই কঠিন পরিশ্রম করে বড় হয়েছেন । এখনো পরিশ্রম করেন । জীবনে কাজ করতে হবে । ভালো কাজের মাধ্যমে জীবন শেষ করাই সার্থকতা । সবাইকে মরতে হবে । কেউ অল্প বয়সে, কেউ বেশি । দুনিয়ায় সবাই সমান পরিবেশ , সমান সুযোগ-সুবিধা পায় না । প্রেসিডেন্ট হওয়াকে কেউ সফলতা মনে করতে পারে । কিন্তু প্রেসিডেন্ট কয়জন হবে ? তাহলে বাকিরা কি ব্যর্থ ?
যতটুকু সময় পাওয়া যাবে, যতটুকু সুযোগ পাওয়া যাবে, ভালো কাজ করে যেতে হবে । ওতেই সফলতা ।
আব্দুল লতিফ সাহেব জেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্কুল- পাইলট হাইস্কুলের হেডমাস্টার । তিনি তাঁর মেধা দিয়ে আরো অনেক ওপরে যেতে পারতেন । কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে , ছোট ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে গ্রামেই রয়ে গেছেন ।
হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে পুরণো দিনগুলির কথা ভাবেন ।
বাবা ছিলেন কৃষক । বাবা বলতেন , আমার ছেলেদের আমি লেখাপড়া শেখাবো । আমার মত কৃষক বানাবো না । সেসময় কাছেপিঠে কোন স্কুল ছিল না । সবচেয়ে কাছের স্কুলটি ছিল বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে । ছোট্ট লতিফকে একদিন বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । স্কুলের কাছে এক গেরস্ত বাড়িতে লজিং এর ব্যবস্থা করে দিলেন । সেখানে তিন বেলা খেতে দেয় । রাতে থাকার জন্য একটা চৌকি । গেরস্ত বাড়ির টুকটাক কাজ করে দিতে হয় । বাবা প্রতি সপ্তাহে এসে দেখে যান । চিড়া মুড়ি দিয়ে যান । মাসে একবার কি দুবার গরুর গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে যান ।
প্রাইমারিতে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলেন আব্দুল লতিফ । সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলেন । ছোট্ট আব্দুল লতিফকে নিয়ে বাবা সেদিন এলাকার সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া চেয়েছিলেন , ছেলে যেন অনেক বড় কিছু হয় । সেকথা মনে পড়লে আজও নিজের অজান্তে চোখ ভিজে আসে ।
হাইস্কুলে যেতেন উল্টোদিকে দশ কিলোমিটার দূরে । হেঁটে হেঁটেই যেতে হত , হেঁটেই আসতে হত । ফযরের কিছু পরপরই পান্তাভাত খেয়ে হাটা দিতেন । এলাকার আরো দুএকজন পড়াশোনা করত, কিন্তু বছর খানেক যেতে না যেতেই আর কেউ থাকলো না । তখন একা একাই এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হত ।
আই.এ পাস করার পর পরই বাবা মারা গেলেন । বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হল । সব পরীক্ষাতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলেন , বেশ কিছু সাবজেক্টে লেটার মার্কস ছিল । আশা ছিল ভার্সিটিতে ভর্তি হবেন, কিন্তু তা আর হলো না । জেলা শহরের ডিগ্রি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হলেন । অল্প ফি তে স্কুলের ছেলেদের পড়াতে লাগলেন, গণিত , ইংরেজী , পদার্থ, রসায়ন । জমিজমা যা ছিল ধান পাট আবাদ করতে শুরু করলেন ।
বিএসসি পাস করে হাইস্কুলে মাস্টারি শুরু করলেন বিএসসি শিক্ষক হিসেবে । কীভাবে কীভাবে যে জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল – মনে হয় এই সেদিন স্কুল পাস করলেন । সময় এত দ্রুত যায় । এখন তিনিই সেই স্কুলের হেডমাস্টার । ভাবলে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ।
ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালেন হেডমাস্টার সাহেব । দুখু আরেকটা অচেনা কুকুরের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে । এই এক বদ-স্বভাব তার । অচেনা কুকুরকে তার এরিয়ার ভেতর সে সহ্য করেনা । কুকুরদের একটা স্বভাবই হলো ঝগড়া করা, নিজেদের ভেতর কামড়াকামড়ি করা । এই কাজ না করলে তাদের যেন কিছু হজমই হয় না । এটাকে ডগ হ্যাবিট বা বাংলায় কুত্তা স্বভাব বলা যায় ।
আব্দুল লতিফ সাহেব পাত্তা না দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলেন ।
দুখু আব্দুল লতিফ সাহেবের পোষা কুকুর । সবসময় আশেপাশে থাকে । রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয় । কুকুরটা বেশ বুদ্ধিমান । একবার তো হাতে নাতে চোর ধরিয়ে দিয়েছিল । চোরকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে । কিন্তু পালাতে দেয় নি ।
বাড়িতে পশ্চিম দিকের ঘরটা গোলাঘর । দক্ষিণের ঘরে আব্দুল লতিফ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী থাকেন । ঐ ঘরের আলমারিতে গয়না পাতি ছিল । সেদিন তাঁরা সবাই গেছেন এক আত্মীয়ের বিয়েতে । বাড়ি সম্পুর্ণ ফাঁকা । রাতের বেলা চোর এসে সিঁদ কেটে ঢুকেছে । দুখু কোথায় ছিল কে জানে , আশেপাশের কয়েক বাড়ির কুকুর মিলে তারা চোরের ওপর হামলে পড়েছিল । বেচারা চোর পালাতেও পারেনি ।
দুখু নামটা আব্দুল লতিফ সাহেবের দেয়া । বছর সাতেক আগের কথা । তখন পাকা রাস্তা দিয়ে বাস ট্রাক চলাচল করা শুরু হয়েছে । লতিফ সাহেব মোটরসাইকেলে করে স্কুলে যান । একদিন সকালবেলা তিনি স্কুলে যাচ্ছেন । তাঁর চোখের সামনেই ঘটে গেল ঘটনাটা । একটা ট্রাক বেশ স্পিডে চলছিল । হঠাৎ রাস্তার পাশে দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা কুকুর কীভাবে কীভাবে জানি চাপা পড়ে গেল । ঘটনাস্থলেই মারা গেল কুকুরটা । দেখা গেল রাস্তার পাশে একটা কুকুরের বাচ্চা – কালো সাদা ডোরাকাটা শরীর । বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ঐ কুকুরটিরই হবে । মা মরা বাচ্চাটাকে দেখে খুব মায়া হলো আব্দুল লতিফ সাহেবের । তিনি একটা ব্যাগে করে বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন । নাম রেখে দিলেন – দুখু ।
দুখু তখন থেকে সবসময়- যতক্ষণ আব্দুল লতিফ সাহেব বাড়িতে থাকেন আশেপাশে ঘুরঘুর করে । সকালবেলা যখন হেডমাস্টার সাহেব হাঁটতে বের হন , তখনো সে পিছে পিছে হাঁটতে থাকে ।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছেন হেডমাস্টার সাহেব । এর মধ্যে বেশ কয়েকবার মোবাইলে কথা বললেন । উপজেলা শহরে আজ একটা বিক্ষোভ মিছিল হবে । গোটা উপজেলার মানুষজনকে খবর দিতে হবে । সরকার মুসলমানদের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছে । সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপুর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস – এই কথাটা একজন মুসলমানের ঈমানের মৌলিক কথা । সংবিধানের একটা মূলনীতি হিসাবে এই কথাটি ছিল । কিন্তু সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে এই কথাটুকুও তুলে দিয়েছে । এর প্রতিবাদ করা ঈমানদারদের দায়িত্ব । পথে অনেকের দেখা হলো । অনেকের সাথে এই বিষয়ে আলোচনাও করলেন তিনি । বিকালের প্রতিবাদ মিছিলে যাওয়ার জন্য বললেন সবাইকে ।
আব্দুল লতিফ সাহেব পাইলট স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র । কোন রাজনৈতিক দলের নেতা না হলেও তাঁর প্রভাব অনেক । বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি জনগনকে নিয়ে রুখে দাঁড়ান । একবছর ধরে এই অঞ্চলে টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছেন তিনি । কোন সমাবেশে তিনি যখন কথা বলেন – জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে । টিপাইমুখ বাঁধ যে বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কার মত আরেকটা মরণফাঁদ , তিনি জনগনকে এটা ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন । হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন ।
এবার ঈমান নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে । জনগনকে নিয়ে আবার নামতে হবে । সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে – বাংলাদেশের মানুষ ঈমানদার । ঈমান নিয়ে টানাটানি তারা সহ্য করবে না ।
আব্দুল লতিফ সাহেব ফিরতি পথ ধরলেন । আজ অনেকক্ষণ হাঁটা হয়েছে ।
.............................. ......
বারবার গোঁফে হাত দিচ্ছেন রোস্তম খান । তিনি সরকারি দলের উপজেলা সভাপতি । বোঝা যাচ্ছে, তিনি বেশ টেনশনে আছেন । আগামী সংসদ নির্বাচনে তাঁর এই আসন থেকে প্রার্থী হবার কথা । সেজন্য সব দিকে তাঁকে কড়া নজর রাখতে হচ্ছে । বিশেষ করে সরকার বিরোধী যেকোন ব্যাপার । মৌলবাদীরা অপপ্রচার করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছে । ভারত একটা বড় দেশ । তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্য করেছে । তারা তাদের স্বার্থে , চিরশত্রু পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বার্থে যুদ্ধে এসেছে সেটা ঠিক । কিন্তু আমাদের সাহায্য তো হয়েছে । এখন তারা কিছু প্রতিদান তো পেতেই পারে । যুদ্ধের পরপর তারা অনেক কিছু লুট করে নিয়ে গেছে । সেটাতো তারা করতেই পারে । এখন তারা উজানে একটা বাঁধ দিচ্ছে- তো দিক না । এই নিয়ে এত চিল্লাফাল্লা করার দরকার টা কি ? বিরোধীদল ষড়যন্ত্র করছে ।
সামনে ট্রানজিট ইস্যু আসছে । ভারত একটু আমাদের দেশের ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করতে চায় – এটা এমন খারাপ কি ? বিরোধীদল এসব ইস্যুকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাজে লাগাচ্ছে । আর ঐ হেডমাস্টার আব্দুল লতিফ, না বুঝে আন্দোলন করছে । জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে । আর জনগন পেয়েছেটা কি তাঁর মধ্যে ? হেডমাস্টার ডাকলেই দেখি সব পিপড়ার মত চলে আসে । শ্লোগান দেয় ।
এবারের ইস্যুটা তো আরো মারাত্মক । সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে । আল্লাহর ওপর আস্থা- এই সাম্প্রদায়িক মূলনীতি তুলে দিয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি সংযোজন করা হয়েছে । ঠিকই তো আছে । কিন্তু হেডমাস্টার নাকি আবার আজকে মিছিল সমাবেশ করবে । উনি নাকি বলেছেন- এটা মুসলমানের ঈমান নিয়ে খেলা । আরে বাবা- এতে ঈমানের কী হলো ? ঈমান থাকবে মনের ভিতর । সব বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র ।
আরো একটা খবর কানে এসেছে রোস্তম খানের । বিরোধীদল নাকি হেডমাস্টারকে দলে নেয়ার চেষ্টা করছে । হেডমাস্টারকে এবার নমিনেশন দিয়ে আসনটা তারা দখল করতে চায় । আর এই হেডমাস্টার দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে । উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় হেডমাস্টার বিরোধীদলের প্রার্থীকে সমর্থন দিল । অনেক কারচুপি করেও দলীয় প্রার্থীকে জেতানো গেল না ।
রোস্তম খানের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো । তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন । গতকাল রাতেই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি । পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে হবে । হেডমাস্টারকে আর বাড়তে দেয়া যায় না । এভাবে চলতে থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতির কবর হয়ে যাবে এখানে । একজনকে খবর দিয়েছেন । জুম্মন গুন্ডা । এতক্ষণে সে চলে আসার কথা । তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হবে । আর বিষয়টা যেন কাকপক্ষীও না জানে । কাজ শেষ করেই সে চলে যাবে । অর্ধেক টাকা এখন পাবে । বাকি অর্ধেক কাজ সমাধা হলে ।
ড্রয়ার খুলে টাকার প্যাকেটটা দেখে নিলেন রোস্তম খান । বেশি কথা বলার দরকার পড়বে না । জুম্মন গুন্ডা পেশাদার । দলের নিজস্ব লোকও বলা যায় । তাকে দিয়ে এর আগেও দলের অনেক নেতাই কাজ করেছে । কাজ সে ভালোই করে ।
দরজায় নক হলো । রোস্তম খান দরজা খুলে জুম্মন গুন্ডাকে ভেতরে নিয়ে এলেন । এই বাসায় কেউ নাই । তাকে বোঝানো শুরু করলেন- আজ বিকেলে ওরা একটা মিছিল করবে । রাতে হেডমাস্টার তাঁর বাড়িতে থাকবে । খোঁজখবর নেয়া আছে । জানালা খোলাই থাকে । জানালা বরাবর তাঁর খাট । খাটে ঘুমন্ত অবস্থায় মাথা বরাবর দুইটা গুলি করতে হবে । বন্দুকের আওয়াজ যেন বেশি না হয় । ঠিক ঐসময় একটা ট্রাক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে বলে । দৌড়ে এসে ট্রাকে উঠলেই শেষ । সোজা ঢাকায় নিয়ে যাবে । ট্রাকের ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে । ওদের কিছু বলতে হবে না । যা বলার আমিই বলে দিয়েছি । বাকি টাকা ট্রাকের ড্রাইভারের কাছে পেয়ে যাবে ।
জুম্মন গুন্ডা টাকার প্যাকেট নিয়ে চলে গেল ।
...........................
গভীর রাত । ডিম লাইটের নীলচে আলোয় হেডমাস্টার আব্দুল লতিফ বিএসসির মুখটা দেখা যাচ্ছে । জানালার দিকে মুখ । পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ডান কাত করে শুয়েছেন তিনি । রাতের দ্বিতীয় প্রহরের ঘুম খুব গাঢ় হয় । দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে । ওই দিকটাতে বাঁশঝাড়, বেশ কিছু আম কাঠাল ও নিম গাছ আছে । সব সময় বেশ ঠান্ডা থাকে । বাতাস পাওয়া যায় ভালোই ।
আজ বেশ ধকল গেছে হেডমাস্টার সাহেবের । বিকেলে গিয়ে দেখেন স্কুল মাঠ লোকে লোকারণ্য । স্কুল মাঠ থেকেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু হবে । মাইকের ব্যবস্থাও করেছে লোকজন । তিনি বক্তৃতা করলেন । এই বাংলাদেশ , ঈমানদার মুসলমানদের বাংলাদেশ । তিতুমীর শরীয়তুল্লার বাংলাদেশ । শাহ মখদুম খান জাহানের বাংলাদেশ । এখানে নব্বই ভাগ মানুষ ঈমানদার । এদেশের সংবিধানে ঈমানের কথা থাকতে হবে । দেশের সংবিধান থেকে ঈমানের কথা তুলে দেয়া হয়েছে । এই অন্যায় মানা যায় না । অবিলম্বে সংবিধানে ঈমানের কথা , সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের বিশ্বাসের কথা পুনর্বহাল করতে হবে । হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই আমরা মিলেমিশে থাকব । সবাই যার যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করবে । কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন সংবিধানে থাকতে হবে ।
সমবেত মানুষজন গর্জে উঠেছিল । সাগরের ঢেউয়ের মত মিছিল শুরু হয়েছিল । প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার মিছিলের সাথে হাঁটতে হয়েছে । পুলিশ এসেছিল বাধা দিতে । এটা একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে ওদের । জনগনের আন্দোলনে বাধা দেয় । পুলিশ বাধা দিতে এসেছে শুনে যুবকদের অনেকেই মারমুখি হয়ে উঠেছিল । অনেক কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে । হেডমাস্টার সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে- বাংলাদেশের মানুষের ঈমানে হাত দিয়ে কেউ টিকে থাকতে পারবে না ।
রাত সোয়া দুইটা । পা টিপে টিপে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো জুম্মন গুন্ডা । চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো । কেউ কোথাও নেই । পকেট থেকে রিভলবার বের করে চেক করলো । সব ঠিক আছে । ঠিক দুইটা বিশ মিনিটে ট্রাক এসে রাস্তায় দাঁড়ালো । সময় হয়ে গেছে ।
জানালার নিচে দাঁড়িয়ে শিক ধরে মাথাটা উঁচু করলো । হ্যা , হেডমাস্টারের মাথাটা দেখা যাচ্ছে । রিভলবার তাক করে নিশানা ঠিক করে নিল । ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসলো জুম্মন ।
সাথে সাথেই মুখ দিয়ে আহ শব্দ বের হয়ে এলো তার । হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল জুম্মন । ট্রিগারে চাপ দেয়ার সময়ই নিচ থেকে পায়ে কামড় দিয়েছে একটা কুকুর । গায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা । গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছে ।
দ্বিতীয় গুলিটা করলো কুকুরটাকে । এটা আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না । গুলি লাগলো কুকুরের পেটে । নাছোড়বান্দা কুকুরটা তবু কামড়ে আছে । গুলি খেয়ে দুর্বল হয়ে গেল কুকুরটা । হাত দিয়ে কোনমতে ছুটিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে দৌড় লাগালো জুম্মন । কিন্তু ট্রাকের কাছে পৌঁছার আগেই আরো পাঁচ ছয়টি কুকুর কোত্থেকে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবার । দুতিনজন লোককেও দেখা গেল লাঠি হাতে বের হয়ে এসেছে । ছুটে আসছে তারা । অবস্থা বেগতিক দেখে ট্রাক ছেড়ে দিল ড্রাইভার । মাটিতে পড়ে গিয়ে কুকুরের কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে জুম্মন ।
.............................. ......
ঝনঝন শব্দে আয়না ভেঙ্গে পড়ায় লাফ দিয়ে উঠলেন হেডমাস্টার সাহেব । বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে । আশেপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন জেগে উঠেছে । হইচই হচ্ছে । তিনি লাইট জ্বালিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকালেন । ঐদিক থেকেই এসেছে গুলিটা ।
জানালার নিচে সাদাকালো চেহারাটা দেখেই চিনতে পারলেন তিনি । দুখুর নিথর শরীর পড়ে আছে । রক্তে লাল হয়ে উঠেছে তার দেহ । শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন আব্দুল লতিফ বিএসসি সাহেব ।
.............................. .........
দুখু / ১৮-০৭-২০১৩
সকালবেলা আব্দুল লতিফ সাহেব আধাঘন্টা হাঁটাহাঁটি করেন । মসজিদে ফজরের নামাজ শেষ করে হাঁটতে বের হন । আশেপাশে আধাঘন্টার মত হাঁটেন । কখনো কখনো এক দেড় ঘন্টাও লেগে যায় । এলাকার লোকজনের সাথে দেখা হয় , নানান বিষয়ে কথা হয় । লোকেরা তাঁর সাথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করে । দেশের অতীত ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হয় । রাজনীতি নিয়ে কথা হয় ।
বয়স প্রায় ষাটের কোঠায় । কিন্তু শরীর এখনো শক্তপোক্ত । ছেলেবেলা থেকেই কঠিন পরিশ্রম করে বড় হয়েছেন । এখনো পরিশ্রম করেন । জীবনে কাজ করতে হবে । ভালো কাজের মাধ্যমে জীবন শেষ করাই সার্থকতা । সবাইকে মরতে হবে । কেউ অল্প বয়সে, কেউ বেশি । দুনিয়ায় সবাই সমান পরিবেশ , সমান সুযোগ-সুবিধা পায় না । প্রেসিডেন্ট হওয়াকে কেউ সফলতা মনে করতে পারে । কিন্তু প্রেসিডেন্ট কয়জন হবে ? তাহলে বাকিরা কি ব্যর্থ ?
যতটুকু সময় পাওয়া যাবে, যতটুকু সুযোগ পাওয়া যাবে, ভালো কাজ করে যেতে হবে । ওতেই সফলতা ।
আব্দুল লতিফ সাহেব জেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্কুল- পাইলট হাইস্কুলের হেডমাস্টার । তিনি তাঁর মেধা দিয়ে আরো অনেক ওপরে যেতে পারতেন । কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে , ছোট ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে গ্রামেই রয়ে গেছেন ।
হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে পুরণো দিনগুলির কথা ভাবেন ।
বাবা ছিলেন কৃষক । বাবা বলতেন , আমার ছেলেদের আমি লেখাপড়া শেখাবো । আমার মত কৃষক বানাবো না । সেসময় কাছেপিঠে কোন স্কুল ছিল না । সবচেয়ে কাছের স্কুলটি ছিল বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে । ছোট্ট লতিফকে একদিন বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । স্কুলের কাছে এক গেরস্ত বাড়িতে লজিং এর ব্যবস্থা করে দিলেন । সেখানে তিন বেলা খেতে দেয় । রাতে থাকার জন্য একটা চৌকি । গেরস্ত বাড়ির টুকটাক কাজ করে দিতে হয় । বাবা প্রতি সপ্তাহে এসে দেখে যান । চিড়া মুড়ি দিয়ে যান । মাসে একবার কি দুবার গরুর গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে যান ।
প্রাইমারিতে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলেন আব্দুল লতিফ । সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলেন । ছোট্ট আব্দুল লতিফকে নিয়ে বাবা সেদিন এলাকার সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া চেয়েছিলেন , ছেলে যেন অনেক বড় কিছু হয় । সেকথা মনে পড়লে আজও নিজের অজান্তে চোখ ভিজে আসে ।
হাইস্কুলে যেতেন উল্টোদিকে দশ কিলোমিটার দূরে । হেঁটে হেঁটেই যেতে হত , হেঁটেই আসতে হত । ফযরের কিছু পরপরই পান্তাভাত খেয়ে হাটা দিতেন । এলাকার আরো দুএকজন পড়াশোনা করত, কিন্তু বছর খানেক যেতে না যেতেই আর কেউ থাকলো না । তখন একা একাই এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হত ।
আই.এ পাস করার পর পরই বাবা মারা গেলেন । বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হল । সব পরীক্ষাতে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলেন , বেশ কিছু সাবজেক্টে লেটার মার্কস ছিল । আশা ছিল ভার্সিটিতে ভর্তি হবেন, কিন্তু তা আর হলো না । জেলা শহরের ডিগ্রি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হলেন । অল্প ফি তে স্কুলের ছেলেদের পড়াতে লাগলেন, গণিত , ইংরেজী , পদার্থ, রসায়ন । জমিজমা যা ছিল ধান পাট আবাদ করতে শুরু করলেন ।
বিএসসি পাস করে হাইস্কুলে মাস্টারি শুরু করলেন বিএসসি শিক্ষক হিসেবে । কীভাবে কীভাবে যে জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল – মনে হয় এই সেদিন স্কুল পাস করলেন । সময় এত দ্রুত যায় । এখন তিনিই সেই স্কুলের হেডমাস্টার । ভাবলে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ।
ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালেন হেডমাস্টার সাহেব । দুখু আরেকটা অচেনা কুকুরের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে । এই এক বদ-স্বভাব তার । অচেনা কুকুরকে তার এরিয়ার ভেতর সে সহ্য করেনা । কুকুরদের একটা স্বভাবই হলো ঝগড়া করা, নিজেদের ভেতর কামড়াকামড়ি করা । এই কাজ না করলে তাদের যেন কিছু হজমই হয় না । এটাকে ডগ হ্যাবিট বা বাংলায় কুত্তা স্বভাব বলা যায় ।
আব্দুল লতিফ সাহেব পাত্তা না দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলেন ।
দুখু আব্দুল লতিফ সাহেবের পোষা কুকুর । সবসময় আশেপাশে থাকে । রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয় । কুকুরটা বেশ বুদ্ধিমান । একবার তো হাতে নাতে চোর ধরিয়ে দিয়েছিল । চোরকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে । কিন্তু পালাতে দেয় নি ।
বাড়িতে পশ্চিম দিকের ঘরটা গোলাঘর । দক্ষিণের ঘরে আব্দুল লতিফ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী থাকেন । ঐ ঘরের আলমারিতে গয়না পাতি ছিল । সেদিন তাঁরা সবাই গেছেন এক আত্মীয়ের বিয়েতে । বাড়ি সম্পুর্ণ ফাঁকা । রাতের বেলা চোর এসে সিঁদ কেটে ঢুকেছে । দুখু কোথায় ছিল কে জানে , আশেপাশের কয়েক বাড়ির কুকুর মিলে তারা চোরের ওপর হামলে পড়েছিল । বেচারা চোর পালাতেও পারেনি ।
দুখু নামটা আব্দুল লতিফ সাহেবের দেয়া । বছর সাতেক আগের কথা । তখন পাকা রাস্তা দিয়ে বাস ট্রাক চলাচল করা শুরু হয়েছে । লতিফ সাহেব মোটরসাইকেলে করে স্কুলে যান । একদিন সকালবেলা তিনি স্কুলে যাচ্ছেন । তাঁর চোখের সামনেই ঘটে গেল ঘটনাটা । একটা ট্রাক বেশ স্পিডে চলছিল । হঠাৎ রাস্তার পাশে দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা কুকুর কীভাবে কীভাবে জানি চাপা পড়ে গেল । ঘটনাস্থলেই মারা গেল কুকুরটা । দেখা গেল রাস্তার পাশে একটা কুকুরের বাচ্চা – কালো সাদা ডোরাকাটা শরীর । বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ঐ কুকুরটিরই হবে । মা মরা বাচ্চাটাকে দেখে খুব মায়া হলো আব্দুল লতিফ সাহেবের । তিনি একটা ব্যাগে করে বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন । নাম রেখে দিলেন – দুখু ।
দুখু তখন থেকে সবসময়- যতক্ষণ আব্দুল লতিফ সাহেব বাড়িতে থাকেন আশেপাশে ঘুরঘুর করে । সকালবেলা যখন হেডমাস্টার সাহেব হাঁটতে বের হন , তখনো সে পিছে পিছে হাঁটতে থাকে ।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছেন হেডমাস্টার সাহেব । এর মধ্যে বেশ কয়েকবার মোবাইলে কথা বললেন । উপজেলা শহরে আজ একটা বিক্ষোভ মিছিল হবে । গোটা উপজেলার মানুষজনকে খবর দিতে হবে । সরকার মুসলমানদের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করেছে । সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপুর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস – এই কথাটা একজন মুসলমানের ঈমানের মৌলিক কথা । সংবিধানের একটা মূলনীতি হিসাবে এই কথাটি ছিল । কিন্তু সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে এই কথাটুকুও তুলে দিয়েছে । এর প্রতিবাদ করা ঈমানদারদের দায়িত্ব । পথে অনেকের দেখা হলো । অনেকের সাথে এই বিষয়ে আলোচনাও করলেন তিনি । বিকালের প্রতিবাদ মিছিলে যাওয়ার জন্য বললেন সবাইকে ।
আব্দুল লতিফ সাহেব পাইলট স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র । কোন রাজনৈতিক দলের নেতা না হলেও তাঁর প্রভাব অনেক । বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি জনগনকে নিয়ে রুখে দাঁড়ান । একবছর ধরে এই অঞ্চলে টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছেন তিনি । কোন সমাবেশে তিনি যখন কথা বলেন – জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে । টিপাইমুখ বাঁধ যে বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কার মত আরেকটা মরণফাঁদ , তিনি জনগনকে এটা ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন । হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন ।
এবার ঈমান নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে । জনগনকে নিয়ে আবার নামতে হবে । সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে – বাংলাদেশের মানুষ ঈমানদার । ঈমান নিয়ে টানাটানি তারা সহ্য করবে না ।
আব্দুল লতিফ সাহেব ফিরতি পথ ধরলেন । আজ অনেকক্ষণ হাঁটা হয়েছে ।
..............................
বারবার গোঁফে হাত দিচ্ছেন রোস্তম খান । তিনি সরকারি দলের উপজেলা সভাপতি । বোঝা যাচ্ছে, তিনি বেশ টেনশনে আছেন । আগামী সংসদ নির্বাচনে তাঁর এই আসন থেকে প্রার্থী হবার কথা । সেজন্য সব দিকে তাঁকে কড়া নজর রাখতে হচ্ছে । বিশেষ করে সরকার বিরোধী যেকোন ব্যাপার । মৌলবাদীরা অপপ্রচার করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছে । ভারত একটা বড় দেশ । তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্য করেছে । তারা তাদের স্বার্থে , চিরশত্রু পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বার্থে যুদ্ধে এসেছে সেটা ঠিক । কিন্তু আমাদের সাহায্য তো হয়েছে । এখন তারা কিছু প্রতিদান তো পেতেই পারে । যুদ্ধের পরপর তারা অনেক কিছু লুট করে নিয়ে গেছে । সেটাতো তারা করতেই পারে । এখন তারা উজানে একটা বাঁধ দিচ্ছে- তো দিক না । এই নিয়ে এত চিল্লাফাল্লা করার দরকার টা কি ? বিরোধীদল ষড়যন্ত্র করছে ।
সামনে ট্রানজিট ইস্যু আসছে । ভারত একটু আমাদের দেশের ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করতে চায় – এটা এমন খারাপ কি ? বিরোধীদল এসব ইস্যুকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাজে লাগাচ্ছে । আর ঐ হেডমাস্টার আব্দুল লতিফ, না বুঝে আন্দোলন করছে । জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে । আর জনগন পেয়েছেটা কি তাঁর মধ্যে ? হেডমাস্টার ডাকলেই দেখি সব পিপড়ার মত চলে আসে । শ্লোগান দেয় ।
এবারের ইস্যুটা তো আরো মারাত্মক । সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে । আল্লাহর ওপর আস্থা- এই সাম্প্রদায়িক মূলনীতি তুলে দিয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি সংযোজন করা হয়েছে । ঠিকই তো আছে । কিন্তু হেডমাস্টার নাকি আবার আজকে মিছিল সমাবেশ করবে । উনি নাকি বলেছেন- এটা মুসলমানের ঈমান নিয়ে খেলা । আরে বাবা- এতে ঈমানের কী হলো ? ঈমান থাকবে মনের ভিতর । সব বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র ।
আরো একটা খবর কানে এসেছে রোস্তম খানের । বিরোধীদল নাকি হেডমাস্টারকে দলে নেয়ার চেষ্টা করছে । হেডমাস্টারকে এবার নমিনেশন দিয়ে আসনটা তারা দখল করতে চায় । আর এই হেডমাস্টার দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে । উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় হেডমাস্টার বিরোধীদলের প্রার্থীকে সমর্থন দিল । অনেক কারচুপি করেও দলীয় প্রার্থীকে জেতানো গেল না ।
রোস্তম খানের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো । তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন । গতকাল রাতেই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি । পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে হবে । হেডমাস্টারকে আর বাড়তে দেয়া যায় না । এভাবে চলতে থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতির কবর হয়ে যাবে এখানে । একজনকে খবর দিয়েছেন । জুম্মন গুন্ডা । এতক্ষণে সে চলে আসার কথা । তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হবে । আর বিষয়টা যেন কাকপক্ষীও না জানে । কাজ শেষ করেই সে চলে যাবে । অর্ধেক টাকা এখন পাবে । বাকি অর্ধেক কাজ সমাধা হলে ।
ড্রয়ার খুলে টাকার প্যাকেটটা দেখে নিলেন রোস্তম খান । বেশি কথা বলার দরকার পড়বে না । জুম্মন গুন্ডা পেশাদার । দলের নিজস্ব লোকও বলা যায় । তাকে দিয়ে এর আগেও দলের অনেক নেতাই কাজ করেছে । কাজ সে ভালোই করে ।
দরজায় নক হলো । রোস্তম খান দরজা খুলে জুম্মন গুন্ডাকে ভেতরে নিয়ে এলেন । এই বাসায় কেউ নাই । তাকে বোঝানো শুরু করলেন- আজ বিকেলে ওরা একটা মিছিল করবে । রাতে হেডমাস্টার তাঁর বাড়িতে থাকবে । খোঁজখবর নেয়া আছে । জানালা খোলাই থাকে । জানালা বরাবর তাঁর খাট । খাটে ঘুমন্ত অবস্থায় মাথা বরাবর দুইটা গুলি করতে হবে । বন্দুকের আওয়াজ যেন বেশি না হয় । ঠিক ঐসময় একটা ট্রাক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে বলে । দৌড়ে এসে ট্রাকে উঠলেই শেষ । সোজা ঢাকায় নিয়ে যাবে । ট্রাকের ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে । ওদের কিছু বলতে হবে না । যা বলার আমিই বলে দিয়েছি । বাকি টাকা ট্রাকের ড্রাইভারের কাছে পেয়ে যাবে ।
জুম্মন গুন্ডা টাকার প্যাকেট নিয়ে চলে গেল ।
...........................
গভীর রাত । ডিম লাইটের নীলচে আলোয় হেডমাস্টার আব্দুল লতিফ বিএসসির মুখটা দেখা যাচ্ছে । জানালার দিকে মুখ । পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ডান কাত করে শুয়েছেন তিনি । রাতের দ্বিতীয় প্রহরের ঘুম খুব গাঢ় হয় । দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে । ওই দিকটাতে বাঁশঝাড়, বেশ কিছু আম কাঠাল ও নিম গাছ আছে । সব সময় বেশ ঠান্ডা থাকে । বাতাস পাওয়া যায় ভালোই ।
আজ বেশ ধকল গেছে হেডমাস্টার সাহেবের । বিকেলে গিয়ে দেখেন স্কুল মাঠ লোকে লোকারণ্য । স্কুল মাঠ থেকেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু হবে । মাইকের ব্যবস্থাও করেছে লোকজন । তিনি বক্তৃতা করলেন । এই বাংলাদেশ , ঈমানদার মুসলমানদের বাংলাদেশ । তিতুমীর শরীয়তুল্লার বাংলাদেশ । শাহ মখদুম খান জাহানের বাংলাদেশ । এখানে নব্বই ভাগ মানুষ ঈমানদার । এদেশের সংবিধানে ঈমানের কথা থাকতে হবে । দেশের সংবিধান থেকে ঈমানের কথা তুলে দেয়া হয়েছে । এই অন্যায় মানা যায় না । অবিলম্বে সংবিধানে ঈমানের কথা , সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের বিশ্বাসের কথা পুনর্বহাল করতে হবে । হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই আমরা মিলেমিশে থাকব । সবাই যার যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করবে । কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন সংবিধানে থাকতে হবে ।
সমবেত মানুষজন গর্জে উঠেছিল । সাগরের ঢেউয়ের মত মিছিল শুরু হয়েছিল । প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার মিছিলের সাথে হাঁটতে হয়েছে । পুলিশ এসেছিল বাধা দিতে । এটা একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে ওদের । জনগনের আন্দোলনে বাধা দেয় । পুলিশ বাধা দিতে এসেছে শুনে যুবকদের অনেকেই মারমুখি হয়ে উঠেছিল । অনেক কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে । হেডমাস্টার সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে- বাংলাদেশের মানুষের ঈমানে হাত দিয়ে কেউ টিকে থাকতে পারবে না ।
রাত সোয়া দুইটা । পা টিপে টিপে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো জুম্মন গুন্ডা । চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো । কেউ কোথাও নেই । পকেট থেকে রিভলবার বের করে চেক করলো । সব ঠিক আছে । ঠিক দুইটা বিশ মিনিটে ট্রাক এসে রাস্তায় দাঁড়ালো । সময় হয়ে গেছে ।
জানালার নিচে দাঁড়িয়ে শিক ধরে মাথাটা উঁচু করলো । হ্যা , হেডমাস্টারের মাথাটা দেখা যাচ্ছে । রিভলবার তাক করে নিশানা ঠিক করে নিল । ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসলো জুম্মন ।
সাথে সাথেই মুখ দিয়ে আহ শব্দ বের হয়ে এলো তার । হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল জুম্মন । ট্রিগারে চাপ দেয়ার সময়ই নিচ থেকে পায়ে কামড় দিয়েছে একটা কুকুর । গায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা । গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছে ।
দ্বিতীয় গুলিটা করলো কুকুরটাকে । এটা আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না । গুলি লাগলো কুকুরের পেটে । নাছোড়বান্দা কুকুরটা তবু কামড়ে আছে । গুলি খেয়ে দুর্বল হয়ে গেল কুকুরটা । হাত দিয়ে কোনমতে ছুটিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে দৌড় লাগালো জুম্মন । কিন্তু ট্রাকের কাছে পৌঁছার আগেই আরো পাঁচ ছয়টি কুকুর কোত্থেকে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবার । দুতিনজন লোককেও দেখা গেল লাঠি হাতে বের হয়ে এসেছে । ছুটে আসছে তারা । অবস্থা বেগতিক দেখে ট্রাক ছেড়ে দিল ড্রাইভার । মাটিতে পড়ে গিয়ে কুকুরের কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে জুম্মন ।
..............................
ঝনঝন শব্দে আয়না ভেঙ্গে পড়ায় লাফ দিয়ে উঠলেন হেডমাস্টার সাহেব । বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে । আশেপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন জেগে উঠেছে । হইচই হচ্ছে । তিনি লাইট জ্বালিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকালেন । ঐদিক থেকেই এসেছে গুলিটা ।
জানালার নিচে সাদাকালো চেহারাটা দেখেই চিনতে পারলেন তিনি । দুখুর নিথর শরীর পড়ে আছে । রক্তে লাল হয়ে উঠেছে তার দেহ । শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন আব্দুল লতিফ বিএসসি সাহেব ।
..............................
দুখু / ১৮-০৭-২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন