এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৩

অমানুষ

শামীমের সামনে কেউ সিগারেট ধরাতে এখন আর সাহস করে না । অথচ দু’মাস আগেও এরকম ছিল না । শামীম বাসায় এলে স্কুলের মাঠে বন্ধুরা বসে আড্ডা দিত । বন্ধুরা একেকজন একেকরকম । স্কুলে সবাই একসাথে পড়েছে, স্কুলের কত কথা কত স্মৃতি । একসাথে কতকিছু করেছে । এখন কেউ ব্যবসা শুরু করেছে , কেউ চাকরি করছে, কেউ কেউ এখনো ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে । একমাত্র শামীমই মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিল । ডাক্তার হিসেবে বন্ধুমহলে শামীমের একটা আলাদা অবস্থান আছে । সবাই শামীমকে ভালোবাসে । শামীম একটু চুপচাপ ধরণের ছেলে হওয়ায় সবাই মনে মনে ওকে একটু সমীহ করে ।

শামীম নাকি ডাক্তারি পাশ করে হাসপাতালে ইন্টার্ণশিপ করছিল । কী নাকি ঝামেলা হয়েছে , একমাস থেকে সে বাসায় ।
কাউকে সিগারেট ধরাতে দেখলে শামীমের চোখ কেমন যেন লাল হয়ে ওঠে । রেগে গিয়ে বলে, ওই বেটা, সিগারেট ফেল । নাইলে চান্দি ফাডাই দিমু ।
বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন স্মোকার । তবে রফিক ও আসগর একটু বেশি । চেইন স্মোকার হয়ে গেছে । প্রতি ঘন্টায় একটা করে সিগারেট না ফুঁকলে ওদের চলে না ।
একটু আগে আসগর ভুলে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিল । শামীম রেগে গেল । ঐ তুই পাইছস কি ? আবার আমার সামনে সিগারেট ধরাইছস । ক্যান, মনে থাকে না ক্যান ?
আসগর মন খারাপ করে উঠে গিয়েছিল । এখন অবশ্য আবার ফিরে এসেছে ।

কদিন আগেও শামীম এরকম ছিল না । শামীমের মত ভদ্র ছেলে ব্যাচে কমই ছিল । চুপচাপ, কথাবার্তা কম বলে । বেশিরভাগ সময় শুধু শোনে । তবে কথা কম বললেও সে সবসময় গ্রুপের বিভিন্ন পরিকল্পনায় অংশ নিত ঠিকই । সেজন্যে তাকে একেবারে আঁতেল ও বলা যেত না ।

শামীমরা বসেছে স্কুলের বারান্দায় । ডেমরার এই স্কুলটি ইদানিং বেশ নাম করছে । রেজাল্ট আগের চেয়ে অনেক ভালো করছে । শামীম, রফিক, আসগর, হেলাল, বকর , রন্টু সবার বাসা স্কুলের এক কিলোর ভেতরেই । ওরা সবাই এই স্কুলের ছাত্র ছিল । একই ব্যাচের ।
শামীম জিজ্ঞেস করলো - রন্টু , জামশেদ স্যারের খবর কিরে ?
আসগর জানালো - জামশেদ স্যার রিটায়ার করেছেন । এখন খুবই অসুস্থ । হাঁটাচলা করতে পারেন না ।

জামশেদ স্যার খুব বদরাগী ছিলেন । ক্লাসে খুব মারধোর করতেন । সপ্তাহে একদিন সবাইকে জামশেদ স্যারের পিটুনি খেতে হত । কিন্তু অবাক করার ব্যাপার ছিল- কেন যেন কেউ স্যারের ক্লাস মিস করত না । ক্লাসের বাইরে স্যার খুব ভালো । একদিন শামীম আর রফিক কী একটা কাজে শাহবাগে গেছে । হঠাৎ দেখে জামশেদ স্যার । তারা চেষ্টা করছিল কীভাবে স্যারের চোখ এড়িয়ে চলে যাওয়া যায় । কিন্তু ততক্ষণে স্যার ওদের দেখে ফেলেছেন । জামশেদ স্যার ওদের ডেকে বললেন, কিরে আমাকে দেখে পালাচ্ছিস কেন ? আমাকে ভয় লাগে তাইনা ? কী খাবি বল । আয় তোদের ফুচকা খাওয়াই ।
স্যার ওদের দুজনকে ফুচকা খাওয়ালেন । তারপর দুটো মাচো আইসক্রিম কিনে দিলেন ।

আরেকদিনের কথা কোনদিন ভোলা যাবে না । রন্টু মাথা ন্যাড়া করেছিল । সেজন্য সে একটা ক্যাপ মাথায় দিয়ে স্কুলে এসেছিল । স্যার দেখে বললেন - কিরে রন্টু , মাথায় ক্যাপ কেন ? ক্যাপ খোল । আমার সামনে ক্যাপ মাথায় দিয়ে বসে আছিস বেয়াদব ।
ক্লাসে কয়েকজন ছেলে মাথায় টুপি পড়ে আসত । ওদের একজনের দিকে আঙ্গুল তুলে রন্টু বলেছিল – স্যার , ওদেরও তো মাথায় টুপি আছে । ওদেরকে তো খুলতে বলেন না । তাহলে আমাকে বলছেন কেন ?
স্যারের কী হল কে জানে, স্যার বেত হাতে এগিয়ে এসে রন্টুকে পেটাতে লাগলেন । রন্টুটাও শক্ত হয়ে থাকলো । তেমন একটা আহা উহু পর্যন্ত করলো না । স্যার কিছুক্ষণ পিটিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন । পুরো ক্লাস তো থ ।
খানিক বাদে রন্টু স্যারের কাছে গিয়ে ক্যাপটা খুলে টেবিলে রাখল । হঠাৎ স্যারের পায়ে হাত দিয়ে কেঁদে ফেললো । স্যার আপনাকে অনেক ভালোবাসি স্যার । বেয়াদবি করে থাকলে মাফ করে দিবেন স্যার ।
জামশেদ স্যারও হু হু করে কেঁদে উঠলেন । জামশেদ স্যারের মত মানুষ এভাবে কেঁদে ফেলবে শামীমরা কোনদিন ভাবেনি । জামশেদ স্যারের নতুন নাম হলো ‘নারিকেল স্যার’ । নারিকেলের খোলসটা শক্ত , কিন্তু ভেতরে সুস্বাদু পানি ।

শামীম বললো- স্যারের বাসার ঠিকানা কেউ জানিস ? স্যারকে দেখতে যাবো ।

পরদিন স্যারের বাসায় গিয়ে স্যারকে দেখে আসলো শামীমরা । স্যার ওদের দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন । সবার খোজখবর নিলেন । অতীতের অনেক স্মৃতিচারণ করলেন । স্যার অনেকটা নিঃসঙ্গ মানুষ । শামীমদের পেয়ে যেন ছাড়তেই চাচ্ছিলেন না । ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল ।

রন্টু শামীমকে ছাড়লো না । বললো – দোস্ত চলনা একটু বসি কোথাও । তোর সাথে একটু আলাপ করি ।
বন্ধুদের গ্রুপের ভেতরেও শামীমের সাথে রন্টুর সম্পর্কটা একটু বেশি গভীর । নিজের অনেক কথা তারা দুজনে শেয়ার করে । মনের কথা ।
শামীমের আচরণ নিয়ে রন্টু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল । শামীম একমাসের মত বাসায় বসে আছে । প্রথমে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন বড় ধরণের কারণ আছে ।
ওরা দুজনে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে একটা দেয়ালের ওপর বসলো । এই দিকটাতে অনেকেই প্লট কিনে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে ।
শামীম বুঝতে পারছিল রন্টু কী জানতে চায় । কিছু কিছু সময় কেউ কিছু না বললেও সবকিছু স্পষ্ট টের পাওয়া যায় ।

.................................

শামীম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে নতুন একটা পরিবেশ পেয়েছিল । অনেক বড় হোস্টেল । একসাথে কত ছেলে থাকে । হোস্টেলের ভেতরেই মসজিদ, ক্যান্টিন , রিডিং রুম , লাইব্রেরি , কমন রুম । হোস্টেলের সামনে ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট, ভলিবলও খেলা যায় । শর্টপিচ ক্রিকেটও খেলা যায় । ক্রিকেট অবশ্য হোস্টেলের করিডোরেই খেলত ওরা । বল তিনতলা থেকে নিচে পড়লেই আউট । সবসময় একটা আনন্দমুখর পরিবেশ । হোস্টেলের ছাদটা শামীমের খুব প্রিয় জায়গা ছিল । বিকেলে এবং রাতে একবার করে ছাদে ওঠাটা তার রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল । পুর্ণিমা রাতগুলো যেন শামীমের হৃদয়টা শুন্য করে দিয়ে যেত । ঘণ্টার পর ঘন্টা ছাদে শুয়ে কাটিয়ে দিত শামীম আকাশের দিকে তাকিয়ে । হোস্টেলের পাশের কিছু গাছে হুতুমপেঁচা এসে বসতো । হুতুমপেঁচার ডাকে গা ছমছম করে উঠতো । কিন্তু হুতুমপেঁচা না ডাকলে ভালোও লাগত না ।

সবকিছুই ভালো, শুধু একটা বিষয় শামীমের খারাপ লাগত । ছাত্রদের মধ্যে কত বিভেদ । রাজনীতির কারণে হোস্টেলের এত সুন্দর পরিবেশ মাঝে মাঝে বিষাক্ত হয়ে ওঠে । ছাত্ররা মারামারি করে । একদল আরেকদলের ওপর অত্যাচার করে । বই-পুস্তক কাপড়-চোপড় পুড়িয়ে দেয় । সরকারদলীয় সংগঠনের ছেলেরাই বেশি অত্যাচার করে । বিরোধী দলের ছেলেরা মার খায় ।

অনেক সংগঠন আছে । কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, কেউ ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলে, কেউ সমাজতন্ত্রের কথা বলে, কেউ বলে রাজনীতির দরকার নাই- নামাজ রোজা করবো, সরকারের কথামত চলবো । ব্যস । দুনিয়া আখেরাত উভয় জায়গাতেই সুবিধা ।
শামীম সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে । কথা ও কাজে মিল দেখে । সালভাদর আলেন্দে পাঠাগার থেকে বই নিয়ে কম্যুনিস্টদের তত্ব পড়ে । আবার ইসলামপন্থিদের পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়ে । নিজের মত করে দুইটার ভেতর পার্থক্য করার চেষ্টা করে । কোনটা সঠিক বোঝার চেষ্টা করে । বই নিয়ে সহপাঠি, সিনিয়র দুএকজনের সাথে মাঝে মাঝে আলোচনা হয় ।

শামীম দেখে – যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে তাদের কোন সাহিত্য নাই । এরা সুবিধাবাদী । সরকারের পক্ষে কথা বলে সুবিধা নেয়াই উদ্দেশ্য । চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, লবিং করে পাস করা এসবই তাদের কাজ । আবার সরকার পরিবর্তন হলে এদের চেতনা উলটে যায় ।
সেই তুলনায় কম্যুনিস্ট এবং ইসলামপন্থিদের চিন্তাধারা অনেক উন্নত । তাদের একটা সুনির্দিস্ট আদর্শ আছে । আচার ব্যবহারের দিক থেকেও তারা উন্নত ।

মুসলিম হিসেবে এমনিতেই ইসলামকে পুর্নাংগ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে জানতো শামীম । কিন্তু ইসলামের অর্থনৈতিক সমাধান, রাজনৈতিক কাঠামো , সামাজিক শৃংখলার বিধান এইসব বিষয় নিয়ে খুব একটা ধারণা ছিল না । বই পড়ে পড়ে সেসব বিষয় সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়তে লাগলো । কার্ল মার্ক্সের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার চেয়ে ইসলামের সমাধান তার কাছে মনে হলো বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ । একজন মুসলিম হিসেবে গর্ব করার মত মানসিকতা তৈরি হল ধীরে ধীরে । স্থায়ী শান্তির জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ থাকলো না । স্বাভাবিকভাবেই মনে মনে ইসলামপন্থী সংগঠনের প্রতি সমর্থন তৈরি হলো তার ।

রাজনৈতিক ভাবে সে ততটা সক্রিয় হয় নাই । মাঝে মাঝ দুয়েকটা মিছিলে – র্যা লিতে গেছে । পেছনে থেকেছে । এতটুকু সমর্থন না দিলে ঈমান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হত তার ।

পাঁচ বছরের ক্যাম্পাস লাইফে কখনো কারো সাথে ঝগড়া ঝাটি তো দূরে থাক, কটু কথাও বলে নি শামীম । সিনিয়র জুনিয়র সবার কাছে সে ছিল একজন শ্রদ্ধার পাত্র । নিরীহ, ভদ্র, শান্তশিষ্ট ছাত্র হিসেবে সবাই তাকে ভালবাসত ।

একসময় পাস করে ইন্টার্ণশিপ শুরু করে শামীম । এদিকে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ও সরকারী বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের ইসলামপন্থি সংগঠনটি । তারা ক্যাম্পাস ছাড়া হয় । ডাক্তার হিসেবে শামীম হাসপাতালে দায়িত্ব পালন চালিয়ে যেতে থাকে । হোস্টেলে সে আর থাকে না । তিন-চারজন ডাক্তার মিলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে । ব্যাচেলর ডাক্তার ।

সেদিন ইভেনিং শিফটে ডিউটি ছিল শামীমের । ডিউটি শেষ করে মোবাইলটা অন করেছে । ডিউটিতে এত চাপ থাকে –রোগীর ভিড় । মোবাইল খোলা রাখলে ঝামেলা হয়ে যায় । মোবাইলটা অন করেছে ফেসবুকে একটু ঢুঁ মারবে । এরই মাঝে এক বন্ধু কল দিল । কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো শামীম । লবিতে নেমেছে , এমন সময় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা , দুইজন শামীমেরই ব্যাচমেট শামীমকে ধরে ফেললো । সোহেল এবং মফিজ । মোবাইলটা কেড়ে নিল । তাকে টেনে নিয়ে গেল ক্যাম্পাসের একটা অন্ধকার কোণে ।

রাজাকার, মৌলবাদী , ছাগল এগুলো সহ অনেক অকথ্য অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো । লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো । একজন এসে দাড়ি ধরে বললো – ‘শালা ছাগলের মত দাড়ি রাখছে, পুরাই ছাগু’ ।
ইট দিয়ে মুখেও মারলো তারা, লাঠি দিয়ে গুতা দিল । নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল- দাড়িওয়ালা ছাগু পিটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করছিল ওরা ।

শামীম দাতে দাঁত চেপে সহ্য করার চেষ্টা করেছিলো । সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা । মাথা ঘুরছে । দুপুরে বাসায় খেয়ে এসেছিল হাসপাতালের ওয়ার্ডে । আট ঘণ্টা কিছু খায় নি । একের পর এক রোগী এসেছিল সেদিন । ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে করতে নাস্তা করারও সুযোগ হয়নি । ক্ষুধায় এমনিতেই শরীর নেতিয়ে আসছিল ।

জুনিয়র ব্যাচের একজন হিন্দু ছাত্র, সেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে এলো জ্বলন্ত সিগারেট হাতে । দুজন মিলে জাপ্টে ধরে রাখলো শামীমকে দেয়ালের সাথে । সিগারেটের আগুন এগিয়ে আসতে লাগলো শামীমের চোখের সামনে । শামীম চোখ বন্ধ করলো । ধীরে ধীরে গালের ওপর চেপে বসলো আগুন । শামীমের সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে উঠলো

কথা বলতে বলতে শামীমের গলা ভারী হয়ে আসে । রন্টুর চোখে পানি । এতক্ষণ সে বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছিল প্রিয় বন্ধুর ওপর অত্যাচারের কাহিনী । আকাশে চাঁদ উঠেছে । চাঁদের আলো এসে পড়েছে শামীমের মুখে । অস্পষ্ট আলোতেও শামীমের মুখের কালচে দাগটা স্পষ্ট দেখতে পেল রন্টু । আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে দুজনেই চুপচাপ বসে রইলো ।

একটু পরে শামীম নীরবতা ভেঙ্গে ধরা গলায় বলতে লাগলো- দোস্ত, এখন কারো মুখে সিগারেট দেখলে সেই দৃশ্যটা চোখে ভাসে । সহ্য করতে পারিনা । মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে । একদিন আমি ওদের গালেও সিগারেটের ছ্যাকা দেব । বুঝিয়ে দেব, কেমন লাগে ।

........................

একবছর পর ।
শামীম আবার হাসপাতালে কাজে যোগ দিয়েছে । রোগীদের সেবা করে যাচ্ছে পরম মমতায় । সরকার পরিবর্তন হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৈনিকরা এখন চেতনা ভুলে গেছে । অনেকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে ।

শামীম নাইট ডিউটিতে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঢুকেছে , একজন জুনিয়র খবর দিল- ভাইয়া, বিজয় কুমারকে পাওয়া গেছে । ঐযে আপনাকে মেরে সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছিল । সে গোপনে ক্যাম্পাসে ঢুকেছে লিয়াজো করার জন্য । যেখানে আপনাকে মেরেছিল, সেখানেই ওকে নিয়ে গেছে জুনিয়ররা ।
শামীম যন্ত্রচালিতের মত সেদিকে এগিয়ে চললো । তার মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণাটা ফিরে এলো । মুখের কালো দাগটা এখনো আছে । নিজের অজান্তে হাতটা চলে গেল সেখানে । ব্যাগের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল, সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা ঠিকমত আছে কিনা । শামীম তার ব্যাগে সবসময় একটা লাইটার আর এক প্যাকেট সিগারেট রাখে । একদিন এটা কাজে লাগাবে । হয়তো আজই সেই দিন ।

শামীম গিয়ে দেখে সেই সন্ত্রাসীটাকে জুনিয়ররা ঘিরে রেখেছে । চড় থাপ্পড় মারছে । সে সবার পায়ে পড়ে মাফ চাচ্ছে ।
শামীমকে দেখে সে কেঁদে উঠলো । শামীম ভাই, আমারে মাফ কৈরা দেন ।
একজন বললো , তখন মনে আছিলো না ? শামীম ভাইর মত মানুষকে তুই সিগারেটের ছ্যাকা দিছিলি । এই ছিল তোদের মুক্তিযুদ্ধ ? দশজনে মিলে একজনরে ধইরা আইনা খুব মুক্তিযুদ্ধ করছিলি না ? তোরা মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করেছিস ।
মুক্তিযুদ্ধ হইছিল অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে । আর তোরা মুক্তিযুদ্ধের নাম বেইচ্যা জুলুম অত্যাচার করছিস ।
শামীমের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে । চোখ লাল হয়ে উঠছে । লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়েছে । এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী বিজয় কুমারের মুখের দিকে । ঠিক যেভাবে সে একদিন সিগারেটের আগুন এগিয়ে এনেছিল শামীমের মুখের দিকে । দৃশ্যটা শামীম এখনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ।

জ্বলন্ত সিগারেট বিজয় কুমারের মুখের সামনে নিয়ে থেমে গেল শামীম । এক মুহুর্ত চিন্তা করলো সে । তারপর সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল ।
মুখটা বিকৃত করে উচ্চারণ করলো – কুত্তার বাচ্চা কুত্তা ।

শামীম উঠে দাঁড়ালো । এ কাজ সে করতে পারবে না । তার মনে হলো- এই শয়তানটার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার , এর মুখে সিগারেটের ছ্যাকা দেয়াই দরকার । কিন্তু শামীমের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় । এই শয়তানটা সেই কাজটা করেছিল । আসলে এদের মত অমানুষ শয়তান ছাড়া আর কেউ এমন কাজ করতে পারে না ।

....................................
অমানুষ / ১৩-০৭-২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন