মাসুম যখন নানাবাড়ির গ্রামে
পৌঁছল , তখন সেখানে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গিয়েছে । নানাবাড়ির উঠানে বিশাল
জটলা । এলাকার বাচ্চা-কাচ্চা –কিশোরদের সংখ্যাই বেশি । ছোটমামা আছেন , আর
কয়েকজন অপরিচিত লোককে দেখা যাচ্ছে ।
একটা মাদী খাটাশ ধরা পড়েছিল ধানক্ষেত থেকে । ছেলেপেলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে । সেটাও সমস্যা ছিল না । মেরে ফেলার ঘণ্টাখানেক পরে ধানক্ষেতে তিনটি খাটাশের বাচ্চা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে । বাচ্চাগুলিকে কেউ মারেনি, ধরে নিয়ে আসে মৃত খাটাশটার কাছে । বাচ্চাগুলো ক্ষুধার্ত ছিল । মৃত মা খাটাশের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে বাচ্চা তিনটি । এতে এক করুণ দৃশ্য সৃষ্টি হয় । যারা খাটাশটাকে পিটিয়ে মেরে এতক্ষণ বাহাদুরি করছিল, তাদেরও খারাপ লাগে । আহা , বাচ্চাগুলোর এখন কী হবে ? বাচ্চাগুলো দেখতে বিড়ালের বাচ্চার কাছাকাছি । দেখে আদর করতে ইচ্ছে করে । লোকেরা ভেবে পায় না, খাটাশের বাচ্চা সুন্দর হবে কেন ?
খবর পেয়ে স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক এসেছেন দুজন । দৈনিক ঝিনাইদহ বার্তার আবিদুর রহমান, দৈনিক মেঘনার আব্দুল হক । তারা ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন । বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কী করা যায় ? সাংবাদিকদের সাথে পরামর্শ করে উপজেলা পশুসম্পদ কার্যালয়ে খবর দিয়েছিলেন মামা । উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা দুজন কর্মচারিকে নিয়ে চলে এসেছেন । সিদ্ধান্ত হয়েছে, খাটাশের মৃতদেহটাকে মাটিতে পুতে ফেলা হবে , আর বাচ্চাগুলোকে তিনি নিয়ে যাবেন । চিড়িয়াখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন তিনি ।
গ্রামের মানুষজন খাটাশটার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল । প্রায়ই এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে হাঁস, মুরগী, কবুতর ধরে নিয়ে যাচ্ছিল খাটাশ । মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও জঙ্গলের আশপাশ থেকে মুরগীর বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত । নানাবাড়ির পশ্চিম পাশে একটা জংলা বাশবাগান আছে । সবাই ভেবেছিল ওখানেই হয়তো আছে খাটাশটা । একদিন ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে অভিযানে নেমেছিল , কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজে জংলায় গর্ত পাওয়া গেলেও খাটাশটাকে পাওয়া যায়নি । জংলার পাশেই ধানক্ষেত । এতদিনে রহস্য উদ্ধার হলো । খাটাশটা একজায়গায় থাকতো না । কয়েক জায়গায় থাকতো । বাচ্চাদের জন্য হয়তো ধানক্ষেতের গর্তকেই নিরাপদ ভেবেছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য । সকালবেলা কামলারা ধান কাটতে নামলে গর্তটা একজনের চোখে পড়ে । সবাই মিলে কাস্তে, বস্তা হাতে গর্তটার চারপাশে ঘিরে ফেলে । খাটাশটা বিপদ টের পেয়ে হঠাৎ বের হয়ে দৌড় দেয় । প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু একজনের ছুড়ে মারা কাস্তে পায়ে লাগায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে । ধরে বস্তায় ঢুকানো হয় তাকে ।
খবর পেয়ে অনেকেই আসে । ‘তুই আমরার মুরগী খাইছিস’ , ‘হাঁস খাইছিস’ বলে পেটাতে থাকে । বস্তার ভেতরেই মৃত্যু হয় খাটাশটার ।
রিক্সা থেকে নেমে মাসুম জটলা ভেঙ্গে ভেতরে যায় । মামার সাথে কথা বলে । মাসুমের সাথে ওর আম্মাও এসেছে । আম্মা বাড়িতে ঢুকে গেছেন । মামা অবশ্য আগে থেকেই জানতেন । মাসুম ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলে নেয় । তারও খারাপ লাগে । যদিও খাটাশ জাতের ওপর ওর রাগও কম নয় ।
উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা সবার উদ্দেশে বক্তৃতা করা শুরু করলেন । তিনি বললেন, আপনারা যে খাটাশটা মেরে ফেলেছেন, এর নাম গন্ধগোকুল । এরা ছোট খাটাশ । এই প্রজাতির খাটাশ এখন বিলুপ্তির পথে । আগের মত এদেরকে দেখা যায় না । অল্প যে দুয়েকটা কোনমতে বেঁচে আছে সেগুলোও ঝুঁকির মুখে । মাঝে মাঝে মানুষজন এদের মেরে ফেলে । অথচ এরা নিরীহ প্রাণী । খাদ্যের অভাবে তারা মাঝে মাঝে হাঁস মুরগী চুরি করে ।
এরপরে যদি কখনো খাটাশ ধরেন , দয়া করে মেরে ফেলবেন না । আমাদের খবর দিলে আমরা নিয়ে যাব । অথবা আমাদের কার্যালয়ে পৌঁছে দেবেন ।
মাসুম যখন ছোট , ক্লাস ওয়ানে পড়ে তখন মামা তাকে একটা টিয়া পাখি উপহার দিয়েছিলেন । মাসুমরা শহরে থাকে । টিয়াপাখিটা ছিল মাসুমের সর্বক্ষণের সঙ্গী । স্কুলে যাবার আগে, স্কুল থেকে ফিরে টিয়াপাখিটাকে খাবার দিত, টিয়ার খাচা পরিষ্কার করতো, টিয়ার সাথে কথা বলতো । টিয়া পাখিটাকে মামা যখন দিয়েছিলেন, তখন সেটা কথা বলতে পারতো না । একবছর পরে দেখা গেল টিয়াটা মাসুমের সাথে কথা বলে । বাসায় কেউ আসলে বলে ওঠে ‘আসসালামু আলাইকুম’ । ছোট ছোট ছড়াও বলতে পারে ।
বাসায় কোন মেহমান এলে মাসুম টিয়ার ছড়া শোনাত । মাসুম এক লাইন বলে টিয়ার দিকে তাকালে টিয়া শুরু করত । অস্পষ্ট কথাগুলি মাসুম মেহমানকে বুঝিয়ে দিত । মেহমানরা মাসুমের টিয়ার খুব প্রশংসা করতেন ।
ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে নানাবাড়ি এসেছিল মাসুম । টিয়া ছাড়া কি সে থাকতে পারে ? টিয়ার খাঁচাটাও কোলে করে নিয়ে এসেছিল । টিয়ার কথা শুনে নানাবাড়ির সবাই তো মুগ্ধ । পাড়ার সব ছেলেমেয়ে টিয়ার ছড়া শুনতে এসেছিল । সবার মুখে মুখে মাসুমের টিয়ার প্রশংসা । মাসুম খুশিতে বাগবাগ ।
মাসুমের মনে পড়ে, নানী আঙ্গিনায় বসে গল্প বলা শুরু করেছিলেন । টুনটুনি ও রাজার গল্প । এক দেশে ছিল এক রাজা । রাজার নাম কাক্কাবোক্কা । রাজার অনেক ধন । রাজার কোষাগারে সোনার মোহরের স্তুপ । রাজা তাঁর মন্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই মোহর গুলো গুনতেন । একদিন দেখলেন, মোহরগুলো ময়লা হয়ে গেছে । ধুয়ে শুকোতে দিয়ে হবে ।
রাজার ছাদে উজ্জ্বল আলো দেখে এগিয়ে যায় টুনটুনি । মোহরগুলো বস্তায় ভরে নেয়ার সময় একটা মোহর ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়ে । টুনটুনি সেটি নিজের বাসায় নিয়ে যায় ।
টুনটুনি ছড়া কাটে-
রাজার পেয়াদা শুনতে পেয়ে রাজার কাছে নালিশ করে ।
রাজার হুকুমে টুনটুনির বাসা থেকে মোহরটা নিয়ে যায় পেয়াদারা । টুনটুনি তখন নতুন ছড়া বানায়-
বাচ্চারা সুলতানা বিবিয়ানা খেলছিল । টুনটুনি তাদেরকে নতুন ছড়াটি শিখিয়ে দেয়......
গুল্প শুনতে শুনতে নানীর কোলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মাসুম জানে না । টিয়ার খাঁচাটা কেউ একজন ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছিল । সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে টিয়া নেই । টিয়ার পালক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরের ভেতর । খাঁচার দরজাটা রাতে বন্ধ করা হয়নি । খাটাশে নিয়ে গেছে মাসুমের টিয়া । মাসুম সকালে কিছু খায়নি । সারাদিন কেদেছিল । মামা বারবার বলেছিলেন , বাবা এর চেয়ে সুন্দর টিয়া তোকে কিনে দেব । কাঁদিস না । কিন্তু কিছুতেই মাসুমের কান্না থামেনা ।
ঐ টিয়াটির কথা মনে পড়লে আজও মাসুমের কান্না আসে ।
মামা ঠিকই আরেকটি টিয়া কিনে দিয়েছিলেন । সেটিও কথা বলা শিখেছিল , কিন্তু আগেরটার মত হয় নি । মাসুম যখন ক্লাস সেভেনে, তখন টিয়াটি অসুখে মারা গিয়েছিল ।
আজ যে খাটাশটা মারা হয়েছে , হতে পারে এই সেই । কে জানে !
........................
নানী আজ আর বেঁচে নেই । মামাবাড়ির পেছনে পারিবারিক কবরস্থানে শুয়ে আছেন তিনি । অনেকদিন পর এবার মামাবাড়ি এলো মাসুম । আম্মা খুব জোড়াজুড়ি করছিলেন । মাসুমেরও ইচ্ছা হলো আত্মীয়দের বাড়িতে একবার ঘুরে আসতে । বিশেষ করে নানা নানীর কবরটা জিয়ারত করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল । মাসুম এখন একজন তরুণ ডাক্তার । ডাক্তার হওয়ার পর একবার যদি মামা খালাদের বাড়িতে না যাওয়া হয় – কে কী ভাববে ?
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে । মাগরিবের নামাজ পড়ে ল্যাপটপ খুলে বসেছে মাসুম । মোবাইলের বদৌলতে এখন গ্রামেও ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় । মাসুম খাটাশটার ছবি আপ্লোড করেছে । অনেকেই কমেন্ট করছে । কিরে তুই কই ? এইটা তুই মারছোস ? কেউ লিখেছে- তুই এত নিষ্ঠুর ? আহা । কেউ কেউ লিখেছে- খাটাশটা মারছে ভালোই হইছে !
মাসুম কমেন্টগুলোর উত্তর দিচ্ছিলো । আম্মা এসে বললেন , ড্রয়িং রুমে আয় । তোর মামার বন্ধু এসেছে , তোকে দেখতে চায় । চুলটুল একটু ভালো করে আঁচড়িয়ে আসবি ।
মাসুম একটা হাফ শার্ট পড়ে , আয়নায় একটু মুখটা দেখে চুল আঁচড়িয়ে নিলো । ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে আম্মা, মামা, মামী, মামার বন্ধু এবং একজন তরুণী বসে আছে । সবাই গল্প করছিলেন । মাসুম সালাম দিল । আম্মা এবং মামার মাঝখানে বসলো । সে একটু ইতস্তত করছিল । মামা তাকে টেনে বসালেন ।
মাসুমের হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন মামা । ‘আমার বন্ধুর সাথে যে মেয়েকে দেখছিস, ওর সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে । ভালো করে দেখে নে’ ।
মাসুমের বুকটা ধ্বক করে উঠলো । সে এরকম পরিস্থিতিতে পড়বে- কল্পনাও করেনি ।
মামার সাথে মাসুমের সম্পর্ক অনেক খোলামেলা । মামা অনেক দেরিতে বিয়ে করেছিলেন । ওদিকে মামার বন্ধু, যার মেয়ে এখন মাসুমের সামনে বসে আছে- তিনি অল্পবয়সেই বিয়ে করেছিলেন ।
মামা এবার একটু আনুষ্ঠানিকভাবেই বললেন , ‘মা রিয়া, এ হচ্ছে আমার ভাগ্নে মাসুম । ডাক্তারি পাশ করেছে’ ।
আর মাসুম, ও হচ্ছে রিয়া, আমার দোস্তের বড় মেয়ে । কেসি কলেজে অনার্স পড়ছে । কোন সাবজেক্ট যেন মা ?’
মাসুম ও রিয়া দুজনে চোখ তুলে একে অপরের দিকে তাকালো । চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের । কিছুক্ষণ কেউই চোখ নামালো না । রিয়া কী ভাবছিল কে জানে, কিন্তু মাসুমের মনে হলো , হৈমন্তী গল্পের নায়কের মত ‘পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’ ।
মাসুম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল , হারানো টিয়াপাখির স্মরণে সে তার বউকে টিয়া বলে ডাকবে । মাসুমের বুকের ভেতর যেন ঢাকঢোল বাজতে লাগলো - ‘টিয়া, আমার টিয়া !’
আম্মা মামার বন্ধুকে বললেন, ‘আমার মাসুমকে আমি যা বলবো ও তাই করবে । রিয়া মাকে আমার খুব ভালো লেগেছে । ভাইসাহেব, মাসুমকে আপনাদের পছন্দ হয়েছে কিনা, কবে কখন কীভাবে কী করা যায় আমার ভাইয়ের সাথে আলাপ করবেন’ ।
মাসুম তুই এখন যা ।
মাসুম ভেবেছিল , রিয়ার দিকে আর তাকাবে না । কিন্তু উঠতে উঠতে কেন যেন আরো একবার চোখাচোখি হয়েই গেল !
........................
খাটাশ / ১০-০৭-২০১৩
একটা মাদী খাটাশ ধরা পড়েছিল ধানক্ষেত থেকে । ছেলেপেলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে । সেটাও সমস্যা ছিল না । মেরে ফেলার ঘণ্টাখানেক পরে ধানক্ষেতে তিনটি খাটাশের বাচ্চা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে । বাচ্চাগুলিকে কেউ মারেনি, ধরে নিয়ে আসে মৃত খাটাশটার কাছে । বাচ্চাগুলো ক্ষুধার্ত ছিল । মৃত মা খাটাশের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে বাচ্চা তিনটি । এতে এক করুণ দৃশ্য সৃষ্টি হয় । যারা খাটাশটাকে পিটিয়ে মেরে এতক্ষণ বাহাদুরি করছিল, তাদেরও খারাপ লাগে । আহা , বাচ্চাগুলোর এখন কী হবে ? বাচ্চাগুলো দেখতে বিড়ালের বাচ্চার কাছাকাছি । দেখে আদর করতে ইচ্ছে করে । লোকেরা ভেবে পায় না, খাটাশের বাচ্চা সুন্দর হবে কেন ?
খবর পেয়ে স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক এসেছেন দুজন । দৈনিক ঝিনাইদহ বার্তার আবিদুর রহমান, দৈনিক মেঘনার আব্দুল হক । তারা ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন । বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কী করা যায় ? সাংবাদিকদের সাথে পরামর্শ করে উপজেলা পশুসম্পদ কার্যালয়ে খবর দিয়েছিলেন মামা । উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা দুজন কর্মচারিকে নিয়ে চলে এসেছেন । সিদ্ধান্ত হয়েছে, খাটাশের মৃতদেহটাকে মাটিতে পুতে ফেলা হবে , আর বাচ্চাগুলোকে তিনি নিয়ে যাবেন । চিড়িয়াখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন তিনি ।
গ্রামের মানুষজন খাটাশটার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল । প্রায়ই এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে হাঁস, মুরগী, কবুতর ধরে নিয়ে যাচ্ছিল খাটাশ । মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও জঙ্গলের আশপাশ থেকে মুরগীর বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত । নানাবাড়ির পশ্চিম পাশে একটা জংলা বাশবাগান আছে । সবাই ভেবেছিল ওখানেই হয়তো আছে খাটাশটা । একদিন ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে অভিযানে নেমেছিল , কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজে জংলায় গর্ত পাওয়া গেলেও খাটাশটাকে পাওয়া যায়নি । জংলার পাশেই ধানক্ষেত । এতদিনে রহস্য উদ্ধার হলো । খাটাশটা একজায়গায় থাকতো না । কয়েক জায়গায় থাকতো । বাচ্চাদের জন্য হয়তো ধানক্ষেতের গর্তকেই নিরাপদ ভেবেছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য । সকালবেলা কামলারা ধান কাটতে নামলে গর্তটা একজনের চোখে পড়ে । সবাই মিলে কাস্তে, বস্তা হাতে গর্তটার চারপাশে ঘিরে ফেলে । খাটাশটা বিপদ টের পেয়ে হঠাৎ বের হয়ে দৌড় দেয় । প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু একজনের ছুড়ে মারা কাস্তে পায়ে লাগায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে । ধরে বস্তায় ঢুকানো হয় তাকে ।
খবর পেয়ে অনেকেই আসে । ‘তুই আমরার মুরগী খাইছিস’ , ‘হাঁস খাইছিস’ বলে পেটাতে থাকে । বস্তার ভেতরেই মৃত্যু হয় খাটাশটার ।
রিক্সা থেকে নেমে মাসুম জটলা ভেঙ্গে ভেতরে যায় । মামার সাথে কথা বলে । মাসুমের সাথে ওর আম্মাও এসেছে । আম্মা বাড়িতে ঢুকে গেছেন । মামা অবশ্য আগে থেকেই জানতেন । মাসুম ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলে নেয় । তারও খারাপ লাগে । যদিও খাটাশ জাতের ওপর ওর রাগও কম নয় ।
উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা সবার উদ্দেশে বক্তৃতা করা শুরু করলেন । তিনি বললেন, আপনারা যে খাটাশটা মেরে ফেলেছেন, এর নাম গন্ধগোকুল । এরা ছোট খাটাশ । এই প্রজাতির খাটাশ এখন বিলুপ্তির পথে । আগের মত এদেরকে দেখা যায় না । অল্প যে দুয়েকটা কোনমতে বেঁচে আছে সেগুলোও ঝুঁকির মুখে । মাঝে মাঝে মানুষজন এদের মেরে ফেলে । অথচ এরা নিরীহ প্রাণী । খাদ্যের অভাবে তারা মাঝে মাঝে হাঁস মুরগী চুরি করে ।
এরপরে যদি কখনো খাটাশ ধরেন , দয়া করে মেরে ফেলবেন না । আমাদের খবর দিলে আমরা নিয়ে যাব । অথবা আমাদের কার্যালয়ে পৌঁছে দেবেন ।
মাসুম যখন ছোট , ক্লাস ওয়ানে পড়ে তখন মামা তাকে একটা টিয়া পাখি উপহার দিয়েছিলেন । মাসুমরা শহরে থাকে । টিয়াপাখিটা ছিল মাসুমের সর্বক্ষণের সঙ্গী । স্কুলে যাবার আগে, স্কুল থেকে ফিরে টিয়াপাখিটাকে খাবার দিত, টিয়ার খাচা পরিষ্কার করতো, টিয়ার সাথে কথা বলতো । টিয়া পাখিটাকে মামা যখন দিয়েছিলেন, তখন সেটা কথা বলতে পারতো না । একবছর পরে দেখা গেল টিয়াটা মাসুমের সাথে কথা বলে । বাসায় কেউ আসলে বলে ওঠে ‘আসসালামু আলাইকুম’ । ছোট ছোট ছড়াও বলতে পারে ।
আতা গাছে তোতা পাখি ,
ডালিম গাছে মৌ ।
এত ডাকি তবু কথা
কয়না কেন বৌ ?
মৌমাছি মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াওনা একবার ভাই
ঐ ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় যে নাই !
বাসায় কোন মেহমান এলে মাসুম টিয়ার ছড়া শোনাত । মাসুম এক লাইন বলে টিয়ার দিকে তাকালে টিয়া শুরু করত । অস্পষ্ট কথাগুলি মাসুম মেহমানকে বুঝিয়ে দিত । মেহমানরা মাসুমের টিয়ার খুব প্রশংসা করতেন ।
ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে নানাবাড়ি এসেছিল মাসুম । টিয়া ছাড়া কি সে থাকতে পারে ? টিয়ার খাঁচাটাও কোলে করে নিয়ে এসেছিল । টিয়ার কথা শুনে নানাবাড়ির সবাই তো মুগ্ধ । পাড়ার সব ছেলেমেয়ে টিয়ার ছড়া শুনতে এসেছিল । সবার মুখে মুখে মাসুমের টিয়ার প্রশংসা । মাসুম খুশিতে বাগবাগ ।
মাসুমের মনে পড়ে, নানী আঙ্গিনায় বসে গল্প বলা শুরু করেছিলেন । টুনটুনি ও রাজার গল্প । এক দেশে ছিল এক রাজা । রাজার নাম কাক্কাবোক্কা । রাজার অনেক ধন । রাজার কোষাগারে সোনার মোহরের স্তুপ । রাজা তাঁর মন্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই মোহর গুলো গুনতেন । একদিন দেখলেন, মোহরগুলো ময়লা হয়ে গেছে । ধুয়ে শুকোতে দিয়ে হবে ।
রাজার ছাদে উজ্জ্বল আলো দেখে এগিয়ে যায় টুনটুনি । মোহরগুলো বস্তায় ভরে নেয়ার সময় একটা মোহর ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়ে । টুনটুনি সেটি নিজের বাসায় নিয়ে যায় ।
টুনটুনি ছড়া কাটে-
রাজার ঘরে যে ধন আছে ,
টুনির ঘরেও সে ধন আছে ।
রাজার ঘরে যে ধন আছে,
টুনির ঘরেও সে ধন আছে ।
রাজার পেয়াদা শুনতে পেয়ে রাজার কাছে নালিশ করে ।
রাজার হুকুমে টুনটুনির বাসা থেকে মোহরটা নিয়ে যায় পেয়াদারা । টুনটুনি তখন নতুন ছড়া বানায়-
রাজা বড় ধনে কাতর,
টুনির ধন নিল ঘরের ভিতর ।
রাজা বড় ধনে কাতর,
টুনির ধন নিলো ঘরের ভিতর...
বাচ্চারা সুলতানা বিবিয়ানা খেলছিল । টুনটুনি তাদেরকে নতুন ছড়াটি শিখিয়ে দেয়......
গুল্প শুনতে শুনতে নানীর কোলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মাসুম জানে না । টিয়ার খাঁচাটা কেউ একজন ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছিল । সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে টিয়া নেই । টিয়ার পালক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরের ভেতর । খাঁচার দরজাটা রাতে বন্ধ করা হয়নি । খাটাশে নিয়ে গেছে মাসুমের টিয়া । মাসুম সকালে কিছু খায়নি । সারাদিন কেদেছিল । মামা বারবার বলেছিলেন , বাবা এর চেয়ে সুন্দর টিয়া তোকে কিনে দেব । কাঁদিস না । কিন্তু কিছুতেই মাসুমের কান্না থামেনা ।
ঐ টিয়াটির কথা মনে পড়লে আজও মাসুমের কান্না আসে ।
মামা ঠিকই আরেকটি টিয়া কিনে দিয়েছিলেন । সেটিও কথা বলা শিখেছিল , কিন্তু আগেরটার মত হয় নি । মাসুম যখন ক্লাস সেভেনে, তখন টিয়াটি অসুখে মারা গিয়েছিল ।
আজ যে খাটাশটা মারা হয়েছে , হতে পারে এই সেই । কে জানে !
........................
নানী আজ আর বেঁচে নেই । মামাবাড়ির পেছনে পারিবারিক কবরস্থানে শুয়ে আছেন তিনি । অনেকদিন পর এবার মামাবাড়ি এলো মাসুম । আম্মা খুব জোড়াজুড়ি করছিলেন । মাসুমেরও ইচ্ছা হলো আত্মীয়দের বাড়িতে একবার ঘুরে আসতে । বিশেষ করে নানা নানীর কবরটা জিয়ারত করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল । মাসুম এখন একজন তরুণ ডাক্তার । ডাক্তার হওয়ার পর একবার যদি মামা খালাদের বাড়িতে না যাওয়া হয় – কে কী ভাববে ?
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে । মাগরিবের নামাজ পড়ে ল্যাপটপ খুলে বসেছে মাসুম । মোবাইলের বদৌলতে এখন গ্রামেও ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় । মাসুম খাটাশটার ছবি আপ্লোড করেছে । অনেকেই কমেন্ট করছে । কিরে তুই কই ? এইটা তুই মারছোস ? কেউ লিখেছে- তুই এত নিষ্ঠুর ? আহা । কেউ কেউ লিখেছে- খাটাশটা মারছে ভালোই হইছে !
মাসুম কমেন্টগুলোর উত্তর দিচ্ছিলো । আম্মা এসে বললেন , ড্রয়িং রুমে আয় । তোর মামার বন্ধু এসেছে , তোকে দেখতে চায় । চুলটুল একটু ভালো করে আঁচড়িয়ে আসবি ।
মাসুম একটা হাফ শার্ট পড়ে , আয়নায় একটু মুখটা দেখে চুল আঁচড়িয়ে নিলো । ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে আম্মা, মামা, মামী, মামার বন্ধু এবং একজন তরুণী বসে আছে । সবাই গল্প করছিলেন । মাসুম সালাম দিল । আম্মা এবং মামার মাঝখানে বসলো । সে একটু ইতস্তত করছিল । মামা তাকে টেনে বসালেন ।
মাসুমের হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন মামা । ‘আমার বন্ধুর সাথে যে মেয়েকে দেখছিস, ওর সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে । ভালো করে দেখে নে’ ।
মাসুমের বুকটা ধ্বক করে উঠলো । সে এরকম পরিস্থিতিতে পড়বে- কল্পনাও করেনি ।
মামার সাথে মাসুমের সম্পর্ক অনেক খোলামেলা । মামা অনেক দেরিতে বিয়ে করেছিলেন । ওদিকে মামার বন্ধু, যার মেয়ে এখন মাসুমের সামনে বসে আছে- তিনি অল্পবয়সেই বিয়ে করেছিলেন ।
মামা এবার একটু আনুষ্ঠানিকভাবেই বললেন , ‘মা রিয়া, এ হচ্ছে আমার ভাগ্নে মাসুম । ডাক্তারি পাশ করেছে’ ।
আর মাসুম, ও হচ্ছে রিয়া, আমার দোস্তের বড় মেয়ে । কেসি কলেজে অনার্স পড়ছে । কোন সাবজেক্ট যেন মা ?’
মাসুম ও রিয়া দুজনে চোখ তুলে একে অপরের দিকে তাকালো । চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের । কিছুক্ষণ কেউই চোখ নামালো না । রিয়া কী ভাবছিল কে জানে, কিন্তু মাসুমের মনে হলো , হৈমন্তী গল্পের নায়কের মত ‘পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’ ।
মাসুম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল , হারানো টিয়াপাখির স্মরণে সে তার বউকে টিয়া বলে ডাকবে । মাসুমের বুকের ভেতর যেন ঢাকঢোল বাজতে লাগলো - ‘টিয়া, আমার টিয়া !’
আম্মা মামার বন্ধুকে বললেন, ‘আমার মাসুমকে আমি যা বলবো ও তাই করবে । রিয়া মাকে আমার খুব ভালো লেগেছে । ভাইসাহেব, মাসুমকে আপনাদের পছন্দ হয়েছে কিনা, কবে কখন কীভাবে কী করা যায় আমার ভাইয়ের সাথে আলাপ করবেন’ ।
মাসুম তুই এখন যা ।
মাসুম ভেবেছিল , রিয়ার দিকে আর তাকাবে না । কিন্তু উঠতে উঠতে কেন যেন আরো একবার চোখাচোখি হয়েই গেল !
........................
খাটাশ / ১০-০৭-২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন