এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

নারী নেতৃত্ব হারাম ? -১০



মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে প্রথম ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের ১৬ বছরের মাথায়- ৩৬ হিজরিতে । ৭ নভেম্বর ৬৫৬ খ্রিঃ । এই যুদ্ধের নাম ‘জঙ্গে জামাল’ বা ‘উটের যুদ্ধ’ ।
যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ইরাকের বসরায় । যুদ্ধের দুটি পক্ষের এক পক্ষে ছিলেন তৎকালীন আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) । তাঁর পক্ষে উল্লেখযোগ্য সাহাবা(রাঃ) গনের মধ্যে ছিলেন হাসান ইবনে আলী, আম্মার ইবনে ইয়াসির , মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর (ইনি আয়েশা রাঃ এর ভাই এবং হযরত আলীর পালিত পুত্র ছিলেন ), মুসলিম ইবনে আকিল, হারিস ইবনে রাবী, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ , আবু আইয়ুব আনসারি, আবু কাতাদা বিন রাবী, কায়স ইবনে সাদ , আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস , খুজায়মা ইবনে সাবিত ।
এই পক্ষে মোট সেনা ছিল বিশ হাজারের  কাছাকাছি ।

অপরপক্ষে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) । তাঁর সাথে উল্লেখযোগ্য সাহাবা(রাঃ) গনের মধ্যে ছিলেন তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ , যুবায়র ইবনুল আওয়াম , আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, কা’ব ইবনে সুর , মুহাম্মাদ ইবনে তালহা, ওয়ালিদ ইবনে উকবা, মারওয়ান ইবনে হাকাম (হযরত ওসমানের রাঃ চাচাতো ভাই ছিলেন এবং রাসুল সাঃ এর সময় হতে প্রথম দুই খলিফার শাসনকালে মদিনা হতে বহিস্কৃত ছিলেন )

এই পক্ষে মোট সৈন্য ছিল ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি ।

খারেজি বিদ্রোহীদের হাতে তৃতীয় খলিফাতুল মুসলেমিন, আমিরুল মু’মিনীন হযরত উসমান(রাঃ) শহীদ হওয়ার পর মুসলিমরা হযরত আলীর(রাঃ) হাতে বাইয়াত হন । চতুর্থ খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত আলী (রাঃ) । তিনি চেয়েছিলেন প্রথমে  নাজুক ও বিশৃংখল অবস্থা হতে খিলাফতকে সুসংহত করতে । এরপর হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে ।
কিন্তু হযরত আয়েশা(রাঃ) , তালহা (রাঃ), যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রাঃ) প্রমুখ সাহাবাগন দাবী করেন প্রথমে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে কিসাসের ব্যবস্থা করতে । তাঁরা এ নিয়ে হযরত আলীর (রাঃ) খেলাফত ও বাইয়াতকে চ্যালেঞ্জ করেন । এসময় হযরত আয়েশা(রাঃ) ছিলেন মক্কায় । তাঁরা মক্কা থেকে হযরত আলীর(রাঃ)  সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বসরার দিকে অগ্রসর হন । তাঁদের সাথে যোগ দেয় মারওয়ান ইবনুল হাকামের নেতৃত্বে উমাইয়াদের একটি গ্রুপ ও আরো অনেকে । [ আলী (রাঃ), তালহা (রাঃ), যুবায়ের(রাঃ) তিনজনই পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী ছিলেন ]
তাঁদের বাহিনীসহ অগ্রসর হবার সংবাদ পেয়ে হযরত আলী (রাঃ) – হাসান (রাঃ) এবং কুফার সাবেক গভর্নর আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে(রাঃ) কুফায় পাঠান সাহায্যের জন্য । কুফা থেকে অনেকে আলী (রাঃ)র সাথে যোগ দেয় । এছাড়া বনু বকর গোত্রও আলী(রাঃ) এর সাথে যোগ দেয় ।
হযরত আলী (রাঃ)- হযরত তালহা (রাঃ) এবং যুবায়ের (রাঃ) কে রাসুল (সাঃ) এর ভবিষ্যৎবাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে কনভিন্স করতে সক্ষম হন এবং তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন । পথে তাঁদের দুজনকেই হত্যা করে হযরত আয়েশা (রাঃ) বাহিনীর বিপথগামী সৈনিক । ( এক্ষেত্রে মারওয়ান এবং আমর ইবন জারমুজের নাম পাওয়া যায় ) 
বলা হয় যে সাবায়ীদের ষড়যন্ত্রের ফলে (সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে )  মীমাংসা না হয়ে এই বিবাদ পরদিন যুদ্ধে রুপ নেয় । এসময় হযরত আয়েশা (রাঃ) উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন । যুদ্ধে উভয়পক্ষের মোট ১২ হাজারের বেশি নিহত হন । এঁদের বিশাল অংশ ছিলেন সাহাবী । শেষে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর উটের পা কেটে ভুপাতিত করে আলী (রাঃ) এর বাহিনী । হযরত আয়েশা (রাঃ) পরাজিত হন এবং যুদ্ধ সমাপ্ত হয় । আয়েশা (রাঃ) কে আলী (রাঃ) তাঁর অন্যতম সেনাপতি , আয়েশা (রাঃ) এর ভাই মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরের (রাঃ) প্রহরায় মদিনায় পাঠিয়ে দেন ।


ইতিহাস থেকে এটা প্রমাণিত যে – উটের যুদ্ধে হযরত আয়েশা (রাঃ) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । আর সহজ কথায় এটা বলা যায় যে, আয়েশা (রাঃ) এর নৈতিক ও সশরীরে অংশগ্রহন ছাড়া ৩০ হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী খলিফা আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অগ্রসর হত না । আর তালহা (রাঃ) এবং যুবায়ের (রাঃ) চলে যাবার পরেও হযরত আয়েশা রয়ে যান এবং তাঁর উট ভূপাতিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলে ।

এই যুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা পাই যে , হযরত আয়েশা (রাঃ) এর পক্ষের অসংখ্য সাহাবী (রাঃ)  গন তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । তালহা (রাঃ) এবং যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধে অংশ না নিলেও আয়েশা (রাঃ) এর নেতৃত্বে বসরায় এসেছিলেন ।

অর্থাৎ অসংখ্য সাহাবী (রাঃ) একজন নারীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন । নারী নেতৃত্ব যদি প্রশ্নাতীতভাবে সর্বাবস্থায় (পুরুষের ওপরে) ‘হারাম’ হয়ে থাকে , তাহলে কি হযরত আয়েশা(রাঃ) এবং তালহা(রাঃ) ও যুবায়ের (রাঃ) সহ অন্যান্য সাহাবাগন হারাম কাজ করেছিলেন ? (নাউযুবিল্লাহ) ।

এখানে বলা হয় যে – এই ঘটনা নাকি নারী নেতৃত্বের উদাহরণ নয় , কারণ- পরবর্তীতে আয়েশা (রাঃ) অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং এ ঘটনার কথা ভেবে কাঁদতেন ।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি ঠিক এজন্য কাঁদতেন যে তিনি ‘নারী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন’ ? 
বরং তিনি কাঁদতেন এজন্য যে তিনি খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন , তার ফলে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী তালহা(রা), যুবায়র (রাঃ) সহ  প্রায় ১০ হাজার সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন । তিনি কাঁদলে তার কারণ এটা যে , তিনি উম্মাহর ঐক্যে ফাটল ধরানোতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন । শুধুমাত্র এজন্য নিশ্চয়ই নয় যে, তিনি একজন ‘নারী’ ছিলেন ।

(প্রসঙ্গ নারী নেতৃত্ব- ১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন