মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে প্রথম
ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের ১৬ বছরের মাথায়- ৩৬
হিজরিতে । ৭ নভেম্বর ৬৫৬ খ্রিঃ । এই যুদ্ধের নাম ‘জঙ্গে জামাল’ বা ‘উটের যুদ্ধ’ ।
যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ইরাকের বসরায় ।
যুদ্ধের দুটি পক্ষের এক পক্ষে ছিলেন তৎকালীন আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী ইবনে আবি
তালিব (রাঃ) । তাঁর পক্ষে উল্লেখযোগ্য সাহাবা(রাঃ) গনের মধ্যে ছিলেন হাসান ইবনে আলী, আম্মার ইবনে ইয়াসির , মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর
(ইনি আয়েশা রাঃ এর ভাই এবং হযরত আলীর পালিত পুত্র ছিলেন ), মুসলিম ইবনে আকিল,
হারিস ইবনে রাবী, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ , আবু আইয়ুব আনসারি, আবু কাতাদা বিন রাবী,
কায়স ইবনে সাদ , আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস , খুজায়মা ইবনে সাবিত ।
এই পক্ষে মোট সেনা ছিল বিশ হাজারের কাছাকাছি ।
এই পক্ষে মোট সেনা ছিল বিশ হাজারের কাছাকাছি ।
অপরপক্ষে ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)
। তাঁর সাথে উল্লেখযোগ্য সাহাবা(রাঃ) গনের মধ্যে ছিলেন তালহা
ইবনে উবায়দুল্লাহ , যুবায়র ইবনুল আওয়াম , আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, কা’ব ইবনে সুর
, মুহাম্মাদ ইবনে তালহা, ওয়ালিদ ইবনে উকবা, মারওয়ান ইবনে হাকাম (হযরত ওসমানের রাঃ
চাচাতো ভাই ছিলেন এবং রাসুল সাঃ এর সময় হতে প্রথম দুই খলিফার শাসনকালে মদিনা হতে
বহিস্কৃত ছিলেন ) ।
এই পক্ষে মোট সৈন্য ছিল ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি ।
খারেজি বিদ্রোহীদের হাতে তৃতীয় খলিফাতুল
মুসলেমিন, আমিরুল মু’মিনীন হযরত উসমান(রাঃ) শহীদ হওয়ার পর মুসলিমরা হযরত আলীর(রাঃ)
হাতে বাইয়াত হন । চতুর্থ খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত আলী (রাঃ) । তিনি
চেয়েছিলেন প্রথমে নাজুক ও বিশৃংখল অবস্থা
হতে খিলাফতকে সুসংহত করতে । এরপর হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে ।
কিন্তু হযরত আয়েশা(রাঃ) , তালহা (রাঃ), যুবায়র
ইবনুল আওয়াম (রাঃ) প্রমুখ সাহাবাগন দাবী করেন প্রথমে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে
কিসাসের ব্যবস্থা করতে । তাঁরা এ নিয়ে হযরত আলীর (রাঃ) খেলাফত ও বাইয়াতকে
চ্যালেঞ্জ করেন । এসময় হযরত আয়েশা(রাঃ) ছিলেন মক্কায় । তাঁরা মক্কা থেকে হযরত
আলীর(রাঃ) সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বসরার
দিকে অগ্রসর হন । তাঁদের সাথে যোগ দেয় মারওয়ান ইবনুল হাকামের নেতৃত্বে উমাইয়াদের
একটি গ্রুপ ও আরো অনেকে । [ আলী (রাঃ), তালহা (রাঃ), যুবায়ের(রাঃ) তিনজনই
পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী ছিলেন ]
তাঁদের বাহিনীসহ অগ্রসর হবার সংবাদ পেয়ে হযরত আলী
(রাঃ) – হাসান (রাঃ) এবং কুফার সাবেক গভর্নর আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে(রাঃ) কুফায়
পাঠান সাহায্যের জন্য । কুফা থেকে অনেকে আলী (রাঃ)র সাথে যোগ দেয় । এছাড়া বনু বকর
গোত্রও আলী(রাঃ) এর সাথে যোগ দেয় ।
হযরত আলী (রাঃ)- হযরত তালহা (রাঃ) এবং যুবায়ের
(রাঃ) কে রাসুল (সাঃ) এর ভবিষ্যৎবাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে কনভিন্স করতে সক্ষম হন এবং
তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন । পথে তাঁদের দুজনকেই হত্যা করে হযরত আয়েশা (রাঃ)
বাহিনীর বিপথগামী সৈনিক । ( এক্ষেত্রে মারওয়ান এবং আমর ইবন জারমুজের নাম পাওয়া যায়
)
বলা হয় যে সাবায়ীদের ষড়যন্ত্রের ফলে (সত্যতা নিয়ে
সন্দেহ আছে ) মীমাংসা না হয়ে এই বিবাদ
পরদিন যুদ্ধে রুপ নেয় । এসময় হযরত আয়েশা
(রাঃ) উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন । যুদ্ধে উভয়পক্ষের মোট ১২ হাজারের বেশি
নিহত হন । এঁদের বিশাল অংশ ছিলেন সাহাবী । শেষে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর উটের পা কেটে
ভুপাতিত করে আলী (রাঃ) এর বাহিনী । হযরত আয়েশা (রাঃ) পরাজিত হন এবং যুদ্ধ সমাপ্ত
হয় । আয়েশা (রাঃ) কে আলী (রাঃ) তাঁর অন্যতম সেনাপতি , আয়েশা (রাঃ) এর ভাই
মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরের (রাঃ) প্রহরায় মদিনায় পাঠিয়ে দেন ।
ইতিহাস থেকে এটা প্রমাণিত যে – উটের
যুদ্ধে হযরত আয়েশা (রাঃ) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । আর সহজ কথায় এটা বলা যায় যে, আয়েশা
(রাঃ) এর নৈতিক ও সশরীরে অংশগ্রহন ছাড়া ৩০ হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী খলিফা আলী
(রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অগ্রসর হত না । আর তালহা (রাঃ) এবং যুবায়ের (রাঃ)
চলে যাবার পরেও হযরত আয়েশা রয়ে যান এবং তাঁর উট ভূপাতিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলে
।
এই যুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা পাই যে
, হযরত আয়েশা (রাঃ) এর পক্ষের অসংখ্য সাহাবী (রাঃ) গন তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । তালহা
(রাঃ) এবং যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধে অংশ না নিলেও আয়েশা (রাঃ) এর নেতৃত্বে বসরায়
এসেছিলেন ।
অর্থাৎ অসংখ্য সাহাবী (রাঃ) একজন
নারীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন । নারী নেতৃত্ব যদি প্রশ্নাতীতভাবে সর্বাবস্থায়
(পুরুষের ওপরে) ‘হারাম’ হয়ে থাকে , তাহলে কি হযরত আয়েশা(রাঃ) এবং তালহা(রাঃ) ও
যুবায়ের (রাঃ) সহ অন্যান্য সাহাবাগন হারাম কাজ করেছিলেন ? (নাউযুবিল্লাহ) ।
এখানে বলা হয় যে – এই ঘটনা নাকি নারী
নেতৃত্বের উদাহরণ নয় , কারণ- পরবর্তীতে আয়েশা (রাঃ) অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং
এ ঘটনার কথা ভেবে কাঁদতেন ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি ঠিক
এজন্য কাঁদতেন যে তিনি ‘নারী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন’ ?
বরং তিনি কাঁদতেন এজন্য যে তিনি
খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন , তার ফলে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী
তালহা(রা), যুবায়র (রাঃ) সহ প্রায় ১০
হাজার সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন । তিনি কাঁদলে তার কারণ এটা যে , তিনি উম্মাহর ঐক্যে
ফাটল ধরানোতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন । শুধুমাত্র এজন্য নিশ্চয়ই নয় যে, তিনি একজন
‘নারী’ ছিলেন ।
(প্রসঙ্গ নারী নেতৃত্ব- ১০)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন