প্রসঙ্গ নারী নেতৃত্ব, পর্ব-১২: নারী নেতৃত্ব সম্পর্কিত হাদীসের
পর্যালোচনা
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে ইরানে একবার
(৬২৯ থেকে ৬৩২ সালের
দিকে) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণে
ইরানের রাজা নিহত হলে তাঁর মেয়েকে সিংহাসনে বসিয়েছিল ইরানের পরিষদ । সে সংবাদ রাসুল (সাঃ) এর কাছে পৌঁছলে তিনি যে মন্তব্য
করেছিলেন , সেটিই নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে
শক্ত দলীল হিসেবে তুলে ধরা হয়ে থাকে । যদিও তাতে বলা নেই যে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ।
বুখারী শরীফে হাদীসটি সংকলিত হয়েছে ।
‘‘উসমান ইবনে হাইয়সাম (রঃ) ......... আবু বাকরা (রাঃ) হতে
বর্ণিত । তিনি বলেন, একটি কথা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা জঙ্গে জামাল (উষ্ট্রের
যুদ্ধ) এর সময় আমাকে বড়ই উপকৃত করেছেন । (সে কথাটি হল) নবী (সাঃ) এর নিকট যখন
এ সংবাদটি পৌঁছল যে, পারস্যের লোকেরা কিসরার কন্যাকে তাদের
শাসক নিযুক্ত করেছে , তখন তিনি বললেনঃ সে জাতি কখনোই সফলকাম
হবেনা, যারা তাদের শাসনভার কোন রমনীর হাতে অর্পণ করে’’
।
(সহীহ বুখারী, ১০ম খন্ড, ফিতনা অধ্যায় , হাদীস নং- ৬৬১৮, ইসলামিক
ফাউন্ডেশন প্রকাশিত)
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, এই হাদীসের রা’বী আবু বাকরা
(রাঃ) – খলিফা আবু বকর (রাঃ) নন । অন্য একজন ।
এখন আমাদের এই হাদীসটি সম্পর্কে মোটামুটিভাবে
বিস্তারিত বিশ্লেষণে যেতে হবে ।
১। (ক) রাবী’র দুর্বলতাঃ হাদিসটি রাবীর কারণে দুর্বল । হযরত আবু বাকরার (রাঃ) ব্যাপারে অভিযোগ আছে যে – তিনি (হযরত ওমর রাঃ এর খেলাফতকালে এক মামলায় ) মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার অপরাধে আদালতে
শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ।
(সূত্র-“দ্য ফরগটন কুইন্স অব ইসলাম”- ফাতেমা মার্নিসি)
আর ফাতেমা মার্নিসির এই অভিযোগ বা তথ্যের
সত্যতার বিরুদ্ধে কেউ কোন বক্তব্য বা প্রমাণ দিয়েছেন বলে আমি এখনো পাইনি ।
তাঁর ব্যাপারে ইতিহাস গ্রন্হ ‘তারিখ আল তাবারী’ থেকে আরো জানা
যায়-
উটের যুদ্ধে আলী (রাঃ) বিজয়ী হয়ে বসরায় গেলে আবু
বাকরা (রাঃ) তাঁকে এ হাদিস শোনান
। এসময় তিনি ইরাকের বসরা শহরে বাস করতেন । তিনি উটের যুদ্ধে আলী (রাঃ) এর পক্ষে যোগ দেননি ।
হাদিসটি তিনি বলেছেন আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর । এর আগে এমনকি যুদ্ধের
সময়েও বলেছেন বলে জানা যায় না । সেজন্য সংশয়বাদী আর কট্টর চিন্তাধারার
কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন যে , জামাল যুদ্ধে
আয়েশা (রাঃ) যদি জিতে যেতেন তাহলে
এ হাদিস তিনি প্রকাশ করতেন কিনা !
(খ) বর্ণনার
দুর্বলতাঃ যেসকল গ্রন্থে
এই হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে সবখানেই
মাত্র এই একজন সাহাবীরই বর্ণনায় । এটা জানা কথা যে, একাধিক বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী এবং বর্ণনার ধারাবাহিকতা হাদীসের
ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । আর হাদীসটি তিনি একবারই বর্ণনা করেছেন
রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের
প্রায় ২৫ বছর পরে জঙ্গে জামালের মত মুসলিম উম্মাহর একটি বিশেষ ঘোলাটে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে
। আর ঈমাম মালেক (রঃ) এর একটি নীতি ছিল যে- কারো ব্যাপারে একবারও মিথ্যা বলার নজীর থাকলে তিনি তাঁর কাছ থেকে হাদীস
নিতেন না ।
২। এই হাদীসকে দুর্বল বলেছেন
গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদীস গবেষক শায়খ নাসিরউদ্দিন আলবানী । । বুখারী শরীফে আছে মানেই
যে তা নিঃসন্দেহে সহীহ তা বলার এখন আর সুযোগ নেই । হাদীস গবেষকগন নানা বিষয় বিবেচনা করে
বুখারী হতেও বেশ কিছু হাদীসের দুর্বলতা চিহ্নিত করেছেন । মালয়েশিয়ার IIUM বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, আফগান স্কলার Mohammad Hashim Kamali রচিত A textbook of
Hadith Studies বইয়ের তথ্য অনুযায়ী- যখন
ইমাম বুখারী(রহঃ)
হাদীস সংগ্রহের কাজ শেষ করেন , তখনই
সেই সময়ের ইসলামী পণ্ডিতগন ( আহমাদ ইবনে হাম্বল রঃ সহ)
বুখারী রহঃ নির্বাচিত সহীহ হাদীসের কয়েকটিকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত
করেন । এছাড়া বিভিন্ন সময়ে হাদীস বিশারদগন বুখারী শরীফের ৮০ জন রাবী
এবং ৮৯ টি হাদীসের দুর্বলতা চিহ্নিত করেছেন, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন । আর মানবরচিত কোন গ্রন্থই ভুলের উর্ধ্বে
নয়, এটা উল্লেখ করেছেন বুখারী(রঃ) নিজেও
।
এখন আমরা যদি হাদীসটির এই দুর্বলতা উপেক্ষা
করে ধরে নেই যে হাদীসটি সহিহ, তাহলে যেসব প্রশ্ন
আসে-
৩। রাসুল (সাঃ) এর সময়ে বর্তমান ছিল এমন সব
বিষয়েই তো কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট করে হালাল হারামের বর্ননা দেয়া হয়েছে । মদ খাওয়া হারাম, জুয়া খেলা হারাম ইত্যাদি । আর এই হাদীসে স্পষ্ট
যে , রাসুল (সাঃ)
যখন এই উক্তি করেন তখন একজন নারী শাসক সম্পর্কেই উক্তিটি করেছিলেন
। এমন একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় যদি ‘হারাম’ হয়- তাহলে রাসুল (সাঃ) স্পষ্ট
‘হারাম’ না বলে কেন অস্পষ্ট ভাষায়
‘উন্নতি করতে পারবে না’ বললেন ? রাসুল (সাঃ) যেসময় বললেন
যে ‘ঐ জাতি উন্নতি করতে পারবে না’ , সেসময়েই তো এও বলতে পারতেন যে ‘এটি হারাম’
। তাহলে কি আমরা মনে করবো
যে, সুযোগ থাকা সত্বেও রাসুল (সাঃ) উম্মতকে একটি হারাম সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা
দিয়ে যাননি ? (নাউযুবিল্লাহ) । এটা কি সম্ভব ? এখানে আমাদের বক্তব্যটি ভালোভাবে খেয়াল করুন যে-
রাসুল (সাঃ) কী
বলেছেন সেটা নিয়ে আমাদের কোন সংশয় নেই, আমাদের সংশয় হচ্ছে
‘রাসুল (সাঃ) আদতেই
তা বলেছিলেন কিনা ?’ যদি আসলেই তিনি এটি বলে থাকেনই- যেখানে তিনি
‘সুযোগ থাকার পরও’
স্পষ্ট করে হারাম ঘোষণা করে যাননি, সেখানে আমরা কেন বনী ইসরাইলের মত নিজেরা ‘হারাম’
বানাচ্ছি ?
৪। পরবর্তী প্রশ্ন জাগে
যে- এই বক্তব্য কি সবসময়ের জন্য সমানভাবে
প্রযোজ্য ? রাসুল (সাঃ) কি এটি সাধারণভাবে সবসময়ের জন্য, সবার জন্য বলেছিলেন
নাকি অব্জেক্টিভলি ঐ সময়কার পারস্য সাম্রাজ্যের ব্যাপারে বলেছিলেন ?
যেহেতু কিসরার ঘটনা শুনে রাসুল (সাঃ) এই উক্তিটি করেছিলেন
, সেজন্য প্রথমেই
এটা মনে করা স্বাভাবিক ও উচিৎ যে- এখানে ‘সে জাতি’ বলতে
পারসিয়ান দের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ঐ জাতির পতন আসছে । এবং পরবর্তীতে পারস্যের
ব্যাপারে রাসুলের(সাঃ) এই বানী
বাস্তবের সাথে মিলে যায় ।
পাকিস্তানে ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন ফাতিমা জিন্নাহকে
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করা হয় তখন পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মুনায়েম খান এই হাদিসটি উল্লেখ করে
একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরিকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি এই ধরনের
বিবৃতি দিতে রাজি হননি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে- হাদিসের অনেক উক্তি ‘সমকালীন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে’ উচ্চারিত হয়েছে, সে পরিপ্রেক্ষিত না জেনে স্বার্থসিদ্ধির
জন্য হাদিসকে ব্যবহার করা অপরাধ।
এখানে আরো একটি তথ্য উল্লেখ করে রাখতে
চাই যে- মা’আরেফুল কুরআন
এর রচয়িতা আল্লামা মুফতি মুহাম্মাদ শফীও ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী
করায় সমর্থন দিয়েছিলেন । (দেখুন অধ্যাপক গোলাম আযম এর ‘ইসলামী
ঐক্য ইসলামী আন্দোলন’ বইয়ে । ঐ বৈঠকে জনাব গোলাম
আযম নিজেই উপস্থিত ছিলেন)
৫। এছাড়া (কুরআনে বর্নিত সাবা’র রানী বিলকিসের
ঘটনা সহ) আমরা আগের পর্বগুলোয় যেসমস্ত ইতিহাস তুলে ধরেছি এবং
বর্তমান সময়ে জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া সহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন
রাষ্ট্রে দেখতে পাই - নারী শাসক থাকার পরেও তারা উন্নতি করছে
। (খেয়াল রাখুন
যে- সেসময়ের পারস্য কিন্তু ইসলামী সাম্রাজ্যভুক্ত ছিলনা,
সেকারণে জার্মানী- অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ অপ্রাসঙ্গিক
নয় ।)
এমনটা ভাবার কি সুযোগ আছে যে- রাসুল (সাঃ) এমন কথা বলেছিলেন যা বাস্তবের সাথে মিলে না
? (নাউযুবিল্লাহ) । যেহেতু রাবী’র ব্যাপারে এমনিতেই সন্দেহ প্রকাশের কারণ আছে এবং অনেক হাদীস
বিশারদ সে সন্দেহ প্রকাশও করেছেন ।
তাই এটা মনে করাই যুক্তিসঙ্গত যে , রাসুল (সাঃ) ‘উন্নতি করতে পারবে না’ বলতে পারস্যের কথা ইঙ্গিত করেছেন আর
সেটা একটা বিশেষ ইঙ্গিত ছিল পারস্যের পরাজয় ও পতনের । সবসময়ের জন্য কোন সার্বজনীন কথা নয় । আত্মিক বা পরকালীন উন্নতির কথা তৎকালীন
পারস্যের ব্যাপারে আসার সুযোগ নেই , কারণ পরকালীন সফলতার প্রথম শর্ত হলো ‘ঈমান’,
যা তাদের ছিলনা ।
শেষকথা হচ্ছে, এমন একটি সন্দেহযুক্ত হাদীস -
সন্দেহ আছে তা সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য কিনা তা নিয়েও
, এমনকি যেখানে ‘সুযোগ থাকার পরও’ স্পষ্টত ‘হারাম’ ঘোষণা করা হয়নি – তারই ভিত্তিতে কোনকিছুকে নির্বিশেষে (অপছন্দনীয়/অপ্রয়োজনীয়/অবিজ্ঞতাসুলভ না বলে ) সরাসরি ‘হারাম’ বলার সুযোগ
আছে কি ?
- চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন