এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

নারী নেতৃত্ব হারাম ? - ০৫



বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নারী নেতৃত্ব চলে আসছে । এর দায় কার ? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াত প্রথমে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য বিএনপিকে সমর্থন দেয় । কিন্তু তখন বিএনপিকে অথবা আওয়ামী লীগকে – যেকোন একটি দলকে সমর্থন দিতেই হত । আর দুদলেরই প্রধান ছিলেন নারী । যেহেতু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ইসলামী রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিসমিল্লাহ সংযোজন করেন- স্বাভাবিকভাবেই সমর্থন বিএনপিকে দেওয়াটাই ছিল যুক্তিযুক্ত ।
পরবর্তীতে ২০০০ সালে আবার বিএনপির সাথে জোট বাঁধে জামায়াত । তবে এবার একা নয়- আরো কয়েকটি ইসলামী দল সাথে ছিল ।
যাহোক- নারী নেতৃত্ব প্রসঙ্গ আসলে জামায়াতকেই বেশি দায়ী করা হয় । কিন্তু আসলে দায় কার কতটুকু ? অন্যান্য যারা প্রথমে দূরে ছিলেন, পরে নারী নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন তাদের দায় কতটুকু ? আর সামগ্রিকভাবে আলেম-ওলামাদের দায় কতটুকু ? যদি সকল ইসলামী দল ও আলেম ঐক্যবদ্ধ হয়ে ডাক দেন তাহলে এখনো বাংলার মুসলমান সবকিছুকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে । কিন্তু তা কি তাঁরা কখনো পেরেছেন ?

এই প্রসঙ্গে আসুন আমরা দেখি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির সংক্ষিপ্ত খতিয়ান-

‘স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এসময় ইসলামী রাজনীতি বলতে কিছু ছিল না । আর পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার ধাক্কায় এ অঞ্চলের ইসলাম্পন্থিরা হয়ে পড়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ।  

'৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পট পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে ১৯৭৭ সালের শুরুতে জিয়াউর রহমান সংবিধানে  সংশোধনী আনেন। বিসমিল্লাহ'র সংযোজন করা হয় এবং  'আল্লাহ্‌'র উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থাই হবে সংবিধানের মূল ভিত্তি’ কথাটি যোগ করা হয় ।  

জিয়াউর রহমান ইসলামী রাজনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ইসলামী দলগুলোর জন্য কিছুটা অনুকূল পরিবেশ তৈরী হয়। এই অঞ্চলে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর মাওলানা আবদুর রহীম আগের মতো পুরাতন দলের নামে কাজ করতে রাজী ছিলেন না তিনি আগের দলগুলোর সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত ইসলামী দল গঠনের উদ্যোগ নেন ১৯৭৬ সালে জামায়াতসহ তৎকালীন কয়েকটি ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী, পিডিপি, বিডিপি, আইডিপি ও ইমারত পার্টিসহ মোট সাতটি দল নিয়ে 'ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ' (IDL) নামে একটি নতুন দল গঠন করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর রাজনৈতিক  দূর্দিন কেটে গেলে জামায়াত ১৯৮০ সনে আইডিএল ভেঙ্গে বেরিয়ে যায় এবং জামায়াতে ইসলামী নামেই কাজ শুরু করে এসময় জামায়াতের আমীর ছিলেন গোলাম আযম, তিনি বিদেশে থাকায় আব্বাস আলী খান ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন ।

মাওলানা আবদুর রহীম এরকম চাননি তিনি জামায়াতে না গিয়ে প্রথমে আইডিএল নামে এবং পরে ১৯৮৪ সালের ৩০ শে নভেম্বর আইডিএলকে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন নাম দিয়ে নতুন গতিতে রাজনীতি শুরু করেন।

১৯৮১ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে প্রবীণ আলেম মওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর  দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উঠে আসেন তিনি ১৯৮১ সনের ২৯ নভেম্বর ঢাকায়  'খেলাফত আন্দোলন' নামে একটি সংগঠনের কার্যক্রম ঘোষণা করেন।  কয়েক বছরের মাথায় তাঁকে কেন্দ্র করেই দেশের ছোট বড় এগারটি সংগঠন ও কতিপয় বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে 'খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ' নামে একটি বৃহত্তর মোর্চা গড়ে উঠে। হাফেজ্জী হুজুরের বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, মাওলানা আব্দুর রহীমের ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, মেজর (অব.) এম এ জলীলের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন প্রভৃতি সংগঠন এ মোর্চায় ছিল ।
কিন্তু খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে গঠিত 'সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ' তাদের ঐক্য বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৮৫ সনে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের জীবদ্দশায় তারই শিষ্য শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক হাফেজ্জীর নেতৃত্বাধীন দল থেকে বের হয়ে নিজ নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) নামে আরেকটি দল গঠন করেন। এ দলটিই ১৯৮৯-এর ১২ অক্টোবর যুব শিবিরের সাথে একাকার হয়ে খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে।

১৯৮৭ সালে তদানিন্তন সময়ের কয়েকজন ইসলামী রাজনীতিক অনুভব করলেন ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - চরমোনাই'র পীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক, ঐক্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুর রহীম, জামায়াতের মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবান আলী, আওলাদে রাসূল মাওলানা আবদুল আহাদ মাদানী, তৎকালীন যুব শিবিরের সভাপতি অধ্যাপক আহম্মদ আব্দুল কাদের প্রমূখ। সিদ্ধান্ত হলো ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ, সকলের উপস্থিতিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হবে এবং এই ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। কিন্তু তার আগেই ঐক্যবদ্ধ ইসলামী আন্দোলনের উদ্যোক্তা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী দেশ ছেড়ে মক্কায় চলে যান অভিযোগ আছে যে , জামায়াতের চাপে তিনি এথেকে সরে দাঁড়ান, যদিও আসল কারণ এখনো অজানা  নির্ধারিত দিনে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন পীর সাহেব চরমোনাই। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটলো কিন্তু কিছুদিন পর এরও একই পরিণতি ঘটে। অনৈক্য ও ভাঙ্গন

১৯৮৭ সনের ১ অক্টোবর মাওলানা আব্দুর রহীম ইন্তেকাল করেন এরপর '৯১এর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবান আলীর নেতৃত্বে একটি অংশ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনে থেকে যায়, আর হাফেজ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ এ ঐক্য থেকে বের হয়ে যায়। অন্য দিকে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) এবং ইসলামী যুব শিবিরও এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ১৯৮৯-এর ১২ অক্টোবর খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) ও যুব শিবিরের এক যৌথ বৈঠকে খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন চরমোনাইর পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন একটি একক দলে পরিণত হয়।

২০০১ এর নির্বাচনে অনেক ওলামা ও ইসলামী দল নারী নেতৃত্বের অধীনে জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নেয়তখন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন জামায়াত-বিএনপি'র সাথে না হলেও এরশাদের সাথে ঠিকই নির্বাচনী জোট বাঁধে – যদিও জাতীয় পার্টিতে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ গুরুত্বপুর্ণ পদে ছিলেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাও করেন  

হাফেজ্জী হুযুরের জামাতা মুফতী ফজলুল হক আমিনী হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর (১৯৮৭) খেলাফত আন্দোলন ত্যাগ করে অন্যান্য কয়েকটি ইসলামী দলের সাথে মিলে একটি ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেন। কিন্তু শীঘ্রই এই ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়।


১৯৯৬ এর নির্বাচনে ইসলাম বিদ্বেষী আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর ইসলামের উপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন, ইসলাম ও ওলামা বিদ্বেষী আচরণ ইসলামী দলগুলোকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার পরিবেশ তৈরী করে দেয়। কিন্তু ২০০১ সনে মহিলা নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির অধীনে চারদলীয় জোটে থাকা না থাকাকে কেন্দ্র করে ইসলামী ঐক্যজোটে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। শাইখুল হাদীস ও আমিনীর নেতৃত্বে খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী মোর্চা প্রভৃতি দল বিএনপি ও জামায়াতের সাথে চার দলীয় জোটভূক্ত হয়ে নির্বানে অংশ নেয়। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন জোট বাঁধে এক কালের স্বৈরশাসক এরশাদের সাথে।

নির্বাচনের পর ইসলামী ঐক্যজোটে আবার ভাঙ্গন ধরে মুফতী ফজলুল হক আমিনী শাইখুল হাদীস আজীজুল হকের পরিবর্তে নিজেকে ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে শাইখুল হাদীস খেলাফত মজলিস নিয়ে ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর থেকে এই দলটি একাই নিজেদেরকে ইসলামী ঐক্যজোট বলে দাবী করতে থাকে। এদিকে ঐক্যজোট আমিনী অংশের নতুন মহাসচিব নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মুফতী ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীকে জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে ভেঙ্গে যায় নেজামে ইসলাম পার্টি। নতুন নেজামে ইসলাম পার্টি ঘোষণা করে মুফতী ইজহারুল ইসলামও নিজেকে ঐক্যজোটের নেতা বলে দাবী করেন। মিসবাহুর রহমান নামে এক হকার নেতাকে মহাসচিব নিযুক্ত করার কয়েকদিন যেতে না যেতে তিনিও  বিদ্রোহ করেন মুফতী ইজহারের সাথে। ইজহারের জোট ভেঙে তিনি তার দলের নাম দেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট। অন্যদিকে নেতৃত্বের কোন্দলে পড়ে ভেঙে যায় খেলাফত মজলিস। ২০০৫ সনের ২২ মে শাইখুল হাদীসের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে আহমদ আব্দুল কাদির তার পুরাতন যুব শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আরেকটি খেলাফত মজলিসের জন্ম দেয়।

এমতাবস্থায় মুফতী আমিনী চারদলীয় জোটে ইসলামী ঐক্যজোটের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই নব গঠিত খেলাফত মজলিসের নামই ব্যবহার করতে থাকেন। এরই মধ্যে মুফতী ইজহার ফুলের তোড়া দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বরণ করে নেন। আর ২০০৬ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর শাইখুল হাদীস নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস পাঁচ দফা চুক্তির ভিত্তিতে চির শত্রু আওয়ামীলীগের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেয়’’  

আমার ধারণা –অবস্থা দেখে আপনার মাথা ঘোরা শুরু হয়েছে । এই হলো বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের অবস্থা । অনৈক্য, ভাঙ্গন নিত্যসঙ্গী । জামায়াতকে বাদ দিয়েও যদি অন্য আলেমগন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে পারতেন- তাহলেও বলতে পারতাম যে জামায়াত একাই দোষী । কিন্তু না, জামায়াত একা নয়- অন্য দল ও আলেমরাও সমান দোষে দোষী । জামায়াত কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছে । সে তুলনায় অন্যদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ । পরবর্তীতে জামায়াত আরো বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল ঐক্যের যার কিছু বর্ণনা  গোলাম আযমের বইয়ে পাওয়া যায় ।

যাহোক, এখন যদি ঐক্যের প্রশ্ন ওঠে তাহলে অন্যান্য ছোট দলগুলোকেই জামায়াতের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবার বিকল্প নেই । সহজ কারণ- বড়র নেতৃত্ব অবশ্যম্ভাবী । যাহোক, নারী নেতৃত্ব চান না- একথা প্রমাণ করার জন্য আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে নারী নেতৃত্বের বিকল্প প্ল্যাটফর্ম জনগনের সামনে নিয়ে আসতে হবে । অন্যথায় ‘নারী নেতৃত্ব মানি না’ বলার নৈতিক অধিকার কারো নেই, বরং সেকথা চরম বালখিল্যতা কিংবা মোনাফেকি ছাড়া আর কিছুই নয় । 

(প্রসঙ্গ নারী নেতৃত্বঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ- ০৫) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন