বাংলাদেশের খালেদা
জিয়া , শেখ হাসিনা ; পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, ফাতিমা জিন্নাই শুধু নন- মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ
দেশের নারী
নেতৃত্বের লিস্টে
আরো আছেন
আজারবাইজানের লালা সেবকেত (Lala Shovkat) , সেনেগালের মেমি মাদিয়র (Mame Madior Boye) , তুরস্কের তানসু সিলার (Tansu
Çiller) , কসভোর ককুসা জাসারি (Kaqusha
Jashari) , ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতি সুকর্নপুত্রী ( Megawati Sukarnoputri) ।
ইতিহাসে আরো অনেক
মুসলিম নারীর নেতৃত্ব ও শাসনের কথা পাওয়া যায় । এর একটা বিবরণ দিয়েছেন ‘নারীবাদী’
হিসেবে পরিচিত মরক্কোর ‘Mohammed V’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা , খ্যাতিমান মুসলিম
লেখিকা ‘ফাতেমা মার্নিসি’ । তিনি ‘নারী’ বিষয়ক গবেষক এবং ইসলামে মুসলিম
নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়েই তাঁর বেশিরভাগ গবেষণা । মরক্কো ও আরব নারীদের নিয়ে অনেক ফিল্ডওয়ার্ক ও
গবেষণা করেছেন । তাঁর বই ‘দ্য ফরগটন কুইন্স্ অব্ ইসলাম”-এ এরকম ১৭ জন নারীর
উল্লেখ করেছেন যারা বিভিন্ন সময়ে খেলাফতের অধীনে এবং কখনো কখনো স্বাধীনভাবে শাসক
হিসেবে ছিলেন । রাষ্ট্রের মূল নেতা হিসেবে কাজ করেছেন । তাঁদের নামাংকিত মুদ্রা
জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে । তাঁদের অনেকের নামে মসজিদে খুতবা দেয়া হত বলেও জানা যায় ।
সেমময়ের আলেমগন এর বিরুদ্ধে জোরালো কোন প্রতিবাদ-আন্দোলন করেছেন বলে জানা যায় না ।
এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে দিল্লীর
সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়ার কথা বলা যায় । তাঁকে বলা হয়
মানুষের ইতিহাসের একমাত্র অবিবাহিতা সম্রাজ্ঞী । ১২৩৬ সালে
ছেলেদের হাতে না দিয়ে মেয়ের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন রাজিয়ার বাবা
ভারতবর্ষের তৎকালীন সম্রাট ইলতুৎমিস ।
তখনকার খলীফার সমর্থনও পেয়েছিলেন সুলতানা রাজিয়া । তাঁর রাজত্বকালে চালু করা মুদ্রায় খোদাই করা আছে-“সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা মালিকা ইলতুৎমিস, যিনি আমিরুল মু’মেনিনের সম্মান বাড়ান।” এ-মুদ্রা সংরক্ষিত আছে কলকাতার যাদুঘরে । একই সময়ে ১২৫০ সালে মিশরের রাণী সাজারাত আল্- দু’র-এর নামেও মুদ্রা ছিল, মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা পড়াতেন
সেসময়ের আলেমগণ । রাজিয়ার সময়ের
আলেমরা নারী-নেতৃত্বের প্রতিবাদ করেননি। (“দ্য ফরগট্ন কুইন্স্ অব্ ইসলাম” – ফাতেমা মার্নিসি, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)।
ইলতুতমিশের যোগ্য
ছেলে মারা যায় আর অন্য দুই ছেলেকে তিনি অযোগ্য মনে করতেন , যদিও সুলতানা রাজিয়ার
হত্যার পর তারাও শাসক হয়েছিল । তবে
ইতিহাস বলে যে – রাজিয়ার চরিত্রে ‘পুরুষসুলভ’ যোগ্যতা ছিল আর তিনি অনেক সময়
‘পুরুষের পোষাক’ পড়ে সেনাবাহিনী ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন । ১২৩৬ হতে ১২৪০ পর্যন্ত
তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ।
ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ের নারী শাসকদের মোটামুটিভাবে একটা লিস্ট
করলে দাঁড়ায় -
১। সুলতানা রাজিয়াঃ ১২৩৬ সাল, দিল্লী ।
২। তুরকান খাতুনঃ ইরানের তুরকান অঞ্চলের রাণী ছিলেন । ১২৫৭ থেকে ১২৮২ পর্যন্ত একটানা ২৬ বছর। মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা দেয়া
হত ।
৩। পাদিশা খাতুনঃ তুরকান খাতুনের মেয়ে । তাঁর নামাংকিত মুদ্রা পাওয়া যায় ।
৪। আবশ খাতুনঃ ইরাণের সিরাজ অঞ্চল । ১২৫৩ থেকে ১২৮৭ । একটানা ২৫ বছর । খোৎবা এবং নামাংকিত মুদ্রা পাওয়া যায় ।
৫। ইরাণের লুরিস্থান অঞ্চলের ১৩৩৯ সালের মুসলিম রাণী (নাম নিয়ে মতভেদ আছে । সঠিক নাম জানা যায় না )
৬। রাণী তিন্দুঃ ১৪২২ থেকে ১৪১৯ পর্যন্ত, ৯ বছর। (জায়গা সম্বন্ধে মতভেদ আছে)।
৭,৮,৯ । মালদ্বীপের সুলতানারাঃ খাদীজা, মরিয়ম, ও ফাতিমা । ১৩৪৭ থেকে ১৩৮৮ । একটানা ৪১ বছর। ইবনে বতুতা সেখানকার সরকারি কাজী ছিলেন।
১০,১১ । ইয়েমেনের সুলায়হি বংশের দুই রাণী আসমা ও আরোয়া, প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করেছেন । আসমার নামে খুতবা হত ।
বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পলো’র লেখা থেকে এসময়ের একটা বিবরণ পাওয়া যায়
-“১৫৯১ হইতে ১৯২৫, প্রায় তিনশ’ তিরিশ বছরে পুরুষ রাজারা দেশের রাস্তাঘাট দালানকোঠা মসজিদ-গম্বুজে যাহা উন্নতি করিয়াছিলেন, সম্রাজ্ঞী আসমা ও আরোয়া তাহা হইতে অনেক বেশি উন্নতি করিয়াছিলেন।”
১২ । ১২৫০ সালে মিশরের রাণী সাজারাত আল্ দু’র। তাঁর নামে মুদ্রাও ছিল, মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি । মসজিদে তাঁর নামে খুতবা পড়ানো হত ।
১৩। সুলতানা ফাতিমা, মধ্য এশিয়ায় কাসেমী খেলাফতের শেষ সার্বভৌম সুলতানা, শাসন করেছেন ১৬৭৯ থেকে ১৬৮১ ।
১৪ −১৭। ইন্দোনেশিয়ায় ১৬৪১ থেকে ১৬৯৯ পর্যন্ত ৫৮ বছর ধরে একটানা শাসন করেছেন সুলতানা শাফিয়া, সুলতানা নূর নাকিয়া, সুলতানা জাকিয়া, ও সুলতানা কামালাত শাহ ।
এই লিস্টটা নেয়া
হয়েছে ফাতেমা মার্নিসির বই ‘ফরগটেন কুইন্স অব ইসলাম’ থেকে ।
এদের নেতৃত্ব এটা
প্রমাণ করেনা যে – নারী নেতৃত্ব ‘হারাম নয়’ । কিন্তু এই তথ্যটি আমাদের সামনে তুলে
ধরছে যে- এদের নেতৃত্বের সময়ের আলেমগণ এদের বিরুদ্ধে সেসময় কোন জোরালো ফতোয়া দেননি
যে – ‘এরা নারী, সুতরাং এদের নেতৃত্ব হারাম’ । আলেমগণ এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের
ঝান্ডা হাতে নেননি । বরং মেনেই নিয়েছিলেন , তাঁদের অধীনে কাজও করেছেন ।
এ পর্যন্ত পর্বগুলোতে আমরা দেখিয়েছি যে যুগে যুগে মুসলিম সমাজেও নারী নেতৃত্ব, নারী শাসক এসেছিল আর আলেমগণ তা মেনে নিয়েছিলেন । আমরা বর্তমান থেকে অতীতের দিকে এগিয়ে এসেছি । এই পরিক্রমায় আমরা আগামী পর্বে দেখতে পাবো – রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রখ্যাত সাহাবীরাও (রাঃ) কীভাবে নারীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন ।
এ পর্যন্ত পর্বগুলোতে আমরা দেখিয়েছি যে যুগে যুগে মুসলিম সমাজেও নারী নেতৃত্ব, নারী শাসক এসেছিল আর আলেমগণ তা মেনে নিয়েছিলেন । আমরা বর্তমান থেকে অতীতের দিকে এগিয়ে এসেছি । এই পরিক্রমায় আমরা আগামী পর্বে দেখতে পাবো – রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রখ্যাত সাহাবীরাও (রাঃ) কীভাবে নারীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন ।
চলবে......
(প্রসঙ্গ নারী
নেতৃত্ব- ০৯)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন