এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৩

নারী নেতৃত্ব হারাম ? -০৯



বাংলাদেশের খালেদা জিয়া , শেখ হাসিনা ; পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, ফাতিমা জিন্নাই শুধু নন- মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নারী নেতৃত্বের লিস্টে আরো আছেন  আজারবাইজানের লালা সেবকেত (Lala Shovkat)  , সেনেগালের মেমি মাদিয়র  (Mame Madior Boye) , তুরস্কের তানসু সিলার (Tansu Çiller) , কসভোর ককুসা জাসারি (Kaqusha Jashari) , ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতি সুকর্নপুত্রী ( Megawati Sukarnoputri)

ইতিহাসে আরো অনেক মুসলিম নারীর নেতৃত্ব ও শাসনের কথা পাওয়া যায় । এর একটা বিবরণ দিয়েছেন ‘নারীবাদী’ হিসেবে পরিচিত মরক্কোর ‘Mohammed V’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা , খ্যাতিমান  মুসলিম  লেখিকা  ‘ফাতেমা মার্নিসি’ তিনি ‘নারী’ বিষয়ক গবেষক এবং ইসলামে মুসলিম নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়েই তাঁর বেশিরভাগ গবেষণা । মরক্কো ও আরব নারীদের নিয়ে অনেক ফিল্ডওয়ার্ক ও গবেষণা করেছেন । তাঁর বই ‘দ্য ফরগট কুইন্স্ অব্ ইসলাম-এ এরকম ১৭ জন নারীর উল্লেখ করেছেন যারা বিভিন্ন সময়ে খেলাফতের অধীনে এবং কখনো কখনো স্বাধীনভাবে শাসক হিসেবে ছিলেন । রাষ্ট্রের মূল নেতা হিসেবে কাজ করেছেন । তাঁদের নামাংকিত মুদ্রা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে । তাঁদের অনেকের নামে মসজিদে খুতবা দেয়া হত বলেও জানা যায় । সেমময়ের আলেমগন এর বিরুদ্ধে জোরালো কোন প্রতিবাদ-আন্দোলন করেছেন বলে জানা যায় না ।

এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে দিল্লীর সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়ার কথা বলা যায় । তাঁকে বলা হয় মানুষের ইতিহাসের একমাত্র অবিবাহিতা সম্রাজ্ঞী ১২৩৬ সালে ছেলেদের হাতে না দিয়ে মেয়ে হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন রাজিয়ার বাবা ভারতবর্ষের তৎকালীন সম্রাট ইলতুৎমিস
তখনকার খলীফার সমর্থনও পেয়েছিলেন সুলতানা রাজিয়া তাঁর রাজত্বকালে চালু করা মুদ্রায় খোদাই করা আছে-সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা মালিকা ইলতুৎমিস, যিনি আমিরুল মুমেনিনের সম্মান বাড়ান -মুদ্রা সংরক্ষিত আছে কলকাতার যাদুঘরে একই সময়ে ১২৫০ সালে মিশরের রাণী সাজারাত আল্- দু-এর নামেও মুদ্রা ছিল, মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি শুধু তা- নয়, মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা পড়াতেন সেসময়ের আলেমগণ রাজিয়ার সময়ের আলেমরা নারী-নেতৃত্বের প্রতিবাদ করেননি (“দ্য ফরগট্ন কুইন্স্ অব্ ইসলামফাতেমা মার্নিসি, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)

ইলতুতমিশের যোগ্য ছেলে মারা যায় আর অন্য দুই ছেলেকে তিনি অযোগ্য মনে করতেন , যদিও সুলতানা রাজিয়ার হত্যার পর তারাও শাসক হয়েছিল ।   তবে ইতিহাস বলে যে – রাজিয়ার চরিত্রে ‘পুরুষসুলভ’ যোগ্যতা ছিল আর তিনি অনেক সময় ‘পুরুষের পোষাক’ পড়ে সেনাবাহিনী ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন । ১২৩৬ হতে ১২৪০ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ।

ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ের নারী শাসকদের মোটামুটিভাবে একটা লিস্ট করলে দাঁড়ায় -
সুলতানা রাজিয়া১২৩৬ সাল, দিল্লী ।
তুরকান খাতুনইরানের তুরকান অঞ্চলের রাণী ছিলেন । ১২৫৭ থেকে ১২৮২ পর্যন্ত একটানা ২৬ বছর মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা দেয়া হত
পাদিশা খাতুনতুরকান খাতুনের মেয়ে । তাঁর নামাংকি মুদ্রা পাওয়া যায়
আব খাতুনইরাণের সিরাজ অঞ্চল ১২৫৩ থেকে ১২৮৭ একটানা ২৫ বছর খোৎবা এবং নামাংকিত মুদ্রা পাওয়া যায়
ইরাণের লুরিস্থান অঞ্চলের ১৩৩৯ সালের মুসলিম রাণী (নাম নিয়ে মতভেদ আছে । সঠিক নাম জানা যায় না )
রাণী তিন্দু ১৪২২ থেকে ১৪১৯ পর্যন্ত, বছর (জায়গা সম্বন্ধে মতভেদ আছে)
,৮,৯ মালদ্বীপের সুলতানারা খাদীজা, মরিয়ম, ফাতিমা ১৩৪৭ থেকে ১৩৮৮একটানা ৪১ বছর ইবনে বতুতা সেখানকার সরকারি কাজী ছিলেন
১০,১১ ইয়েমেনের সুলায়হি বংশের দুই রাণী আসমা আরোয়া, প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করেছেন আসমার নামে খুতবা হত
বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পলো লেখা থেকে এসময়ের একটা বিবরণ পাওয়া যায় -১৫৯১ হইতে ১৯২৫, প্রায় তিনশ তিরিশ বছরে পুরুষ রাজারা দেশের রাস্তাঘাট দালানকোঠা মসজিদ-গম্বুজে যাহা উন্নতি করিয়াছিলেন, সম্রাজ্ঞী আসমা আরোয়া তাহা হইতে অনেক বেশি ন্নতি করিয়াছিলেন
১২ ১২৫০ সালে মিশরের রাণী সাজারাত আল্ দু তাঁর নামে মুদ্রাও ছিল, মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি মসজিদে তাঁর নামে খুতবা পড়ানো হত
১৩ সুলতানা ফাতিমা, মধ্য এশিয়ায় কাসেমী খেলাফতের শেষ সার্বভৌম সুলতানা, শাসন করেছেন ১৬৭৯ থেকে ১৬৮১
১৪১৭ ইন্দোনেশিয়ায় ১৬৪১ থেকে ১৬৯৯ পর্যন্ত ৫৮ বছর ধরে একটানা শাসন করেছেন সুলতানা শাফিয়া, সুলতানা নূর নাকিয়া, সুলতানা জাকিয়া, সুলতানা কামালাত শাহ
এই লিস্টটা নেয়া হয়েছে ফাতেমা মার্নিসির বই ‘ফরগটেন কুইন্স অব ইসলাম’ থেকে । 

এদের নেতৃত্ব এটা প্রমাণ করেনা যে – নারী নেতৃত্ব ‘হারাম নয়’ । কিন্তু এই তথ্যটি আমাদের সামনে তুলে ধরছে যে- এদের নেতৃত্বের সময়ের আলেমগণ এদের বিরুদ্ধে সেসময় কোন জোরালো ফতোয়া দেননি যে – ‘এরা নারী, সুতরাং এদের নেতৃত্ব হারাম’ । আলেমগণ এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা হাতে নেননি । বরং মেনেই নিয়েছিলেন , তাঁদের অধীনে কাজও করেছেন ।

এ পর্যন্ত পর্বগুলোতে আমরা দেখিয়েছি যে যুগে যুগে মুসলিম সমাজেও নারী নেতৃত্ব, নারী শাসক এসেছিল আর আলেমগণ তা মেনে নিয়েছিলেন । আমরা বর্তমান থেকে অতীতের দিকে এগিয়ে এসেছি । এই পরিক্রমায় আমরা আগামী পর্বে দেখতে পাবো – রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রখ্যাত সাহাবীরাও (রাঃ) কীভাবে নারীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন ।
চলবে......
(প্রসঙ্গ নারী নেতৃত্ব- ০৯) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন