এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

পাঠকের বিশ্লেষণঃ কবিতা কী করে তার পাঠক হারালো ?

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কবিতা যে এখন একটা অজনপ্রিয় ধারায় পরিণত হয়েছে সেটা যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য হবেন । জীবনে একটা উপন্যাসও পড়েননি এমন লোক হয়তো সহজে খুঁজে পাওয়া যাবেনা । কিন্তু জীবনে একটাও কবিতার বই পড়েননি এমন মানুষ হাত বাড়ালেই মিলবে । কেন?  অথচ মানুষের সহজাত প্রবণতাই কবিতা । সাহিত্যের পথচলা শুরুই হয়েছে কবিতা দিয়ে । বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন যে চর্যাপদ খুঁজে পাওয়া গেছে, সেটাতো একটা কবিতার বই ! শিশুকে কোলে নিয়ে মায়েরা প্রথমে কী শোনায় ? উপন্যাস, গল্প নাকি ছড়া-কবিতা ?

বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেল পুরস্কারটি এসেছে কিসে ? গীতাঞ্জলী কি কোন উপন্যাসের নাম ? বাংলায় যে সাহিত্য বলে কিছু আছে সেটা বিশ্ববাসী জানে রবিঠাকুরের কল্যাণে । রবিঠাকুরের মত মেধাবী কবি বাংলা সাহিত্যে আর আসবেন কিনা বলা মুশকিল । অথচ রবিঠাকুর একজন স্বার্থক ঔপন্যাসিক ছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ রয়ে গেছে ।
প্রশ্ন হলো, কবিতা কী করে ক্রমে ক্রমে অজনপ্রিয় হলো ? এইযে কবিতার পাঠক কমে গেছে, এর দায় কি পাঠকের রুচির নাকি কবিদের ? এই প্রশ্নটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে ।

আমি এর দায় কবিদের ওপরই বর্তাবো ।

কবিদের প্রথম দায় হচ্ছে, তাঁরা কবিতাকে দিনে দিনে দুর্বোধ্য করে তুলেছেন । সাধারনের ভাষা থেকে তুলে এনে করেছেন পুরোহিতের ভাষা । বেছে বেছে অপ্রচলিত ও কঠিন শব্দ ব্যবহার করার একটা রেওয়াজ চালু করেছেন কেউ কেউ । অবস্থাটা এমন, নিজে কবি না হলে, কবিতা বোঝার সাধ্য কারো নেই । কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলীর অর্থ জানার জন্য- হয় বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী হতে হবে, অথবা অভিধান হাতে নিয়ে বসতে হবে । ফলে সাধারন ধারণাটা এমন দাঁড়িয়েছে, কবিতা মানেই অর্থহীন কথামালা । কিন্তু মানুষ তো ভাষাজ্ঞান অর্জনের জন্য কবিতা পড়ে না । অবসর সময়ে কিছু পড়ে যেন ভালো লাগে, যেন জীবনের কথা, আবেগের কথা, সমাজের কথা, পৃথিবীর কথা খুঁজে পাওয়া যায় সেজন্যই মানুষ কবিতা গল্প পড়ে । কবিতা যদি হয় অর্থহীন কিছু কঠিন শব্দের সমাহার, মস্তিষ্ককে সহজ করার চাইতে যদি আরো ব্যস্ত করে দেয় তাহলে মানুষ কবিতা পড়বে কেন ?

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায়, কবিতায় অশ্লীলতার প্রয়োগ । অনেকেই নারী অঙ্গের বর্ণনাকে কবিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে ফেলেছেন । কবিতা মানেই সেখানে কিছুটা অশ্লীল ইঙ্গিত থাকবে, নারীর শরীরের বর্ণনা থাকবে, কোন কিছুর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গেলেই তাকে নারীর সাথে তুলনা করতে হবে, এছাড়া যেন কবিতাই হবেনা ! একটা কবিতার বই সবার সামনে বসে নির্ভয়ে পড়তে পারা যায় না । কারণটা ঐ, কারো হাতে পড়লে নিশ্চিত তিনি খারাপ একটা ধারণা পাবেন । ‘বসে বসে এইসব পড়া হয় ?’  ফলাফল- ‘পাঠকের মৃত্যু’ ।

তৃতীয় কারণ বলা চলে, অতিমাত্রায় আমি তুমির ব্যবহার । কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে অতিমাত্রায় প্রেম এবং বিরহের ব্যবহার । এখানে অবস্থাটা এমন, যেন কবিরা এর বাইরে চিন্তা করতে জানেনই না ! জনমনে প্রচলিত হয়েছে যে, ‘ছ্যাকা না খেলে কবি হওয়া যায়না’ ! যদিও এটা একটা সত্য কথা যে, কৈশোরে নারী পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণের সূচনাপর্বেই সাধারণত মানুষ জীবনের প্রথম কবিতা লেখে । আর স্বাভাবিকভাবেই সেই কবিতার বিষয়বস্তু হয় 'তুমি' কিংবা 'তোমাকে চাই' ! সে কারণেই দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি, কেঁচোর চেয়ে গায়কের । কিন্তু সব কবিতায় সারা জীবন ইনিয়েবিনিয়ে সেই নারী পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ নিয়ে কথা বলাটাই কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু হওয়াতে কবিতার পাঠক কমেছে । আবেগ কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেলে আর কবিতা টানেনা প্রেমিককে । একটা জরিপ যদি করা হয়, বিবাহিত মানুষেরা কি কবিতা পড়েন ? এর উত্তরটা মোটামুটি নেতিবাচক হবার সম্ভাবনাই বেশি । 

চতুর্থ কারণ হিসেবে বলা যায়, পাঠ্যপুস্তকে কবিতার অন্তর্ভুক্তি এবং এই কবিতার ব্যাখা বিশ্লেষণের ‘ভার’ কিংবা ‘বোঝা’ কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপানো । মানুষ কবিতা পড়বে মনের আনন্দে, কিন্তু তা না করে পাঠ্যপুস্তকে এগুলোকে এমনভাবে যুক্ত করা হয়েছে, যেন সেগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে অতিরিক্ত ‘বোঝা’ মনে হয় । ‘এই বাক্যাংশ দ্বারা কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ?’  পরীক্ষায় এরকম প্রশ্নের উত্তর লিখতে লিখতে একজন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, যেন কবিতা মানেই একটা ক্যামোফ্লেজ ! যেটা বলা হচ্ছে, আসলে সেটা তার মূল অর্থ নয় ! মূল অর্থ অন্য কিছু, যেটা গাইড বই পড়ে মুখস্ত করতে হয় ! কবিতা মানেই তার একটা গূঢ় অর্থ থাকতে হবে !
এটা তার ভেতর কবিতার ব্যাপারে একটা নেতিবাচক প্রেরণা সৃষ্টি করে ।


ওয়েল । এবার আসি আরেকটি কারণ সম্পর্কে । কবি মানেই যেন উদাস ভাবুক কেউ । দুনিয়া সম্পর্কে উদাসীন অথবা লেখালেখি করাই তার কাজ ! হ্যা, ভাবুক হওয়াটা দোষের নয় বরং গভীরভাবে ভাবতে পারাটা খুব ভালো একটা গুণ । কবিদেরকে আমার ভালো লাগে এজন্য যে, আমার মনে হয়- কবিরা মানুষের জীবনকে খুব গভীর থেকে চেনেন । মানুষের জীবনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণত কবিদের ধারণা থাকে বেশ স্পষ্ট । তারা মানুষের আবেগ অনুভূতির গভীরে প্রবেশ করতে পারেন, মানুষের আত্মাকে জাগিয়ে তুলতে পারেন । আর অনুভূতির স্কেলে যদি মানুষকে বিচার করা হয় তবে কবিদের অবস্থান থাকবে একেবারে শীর্ষে । কারণ, কবিদের অনুভূতি হয় খুব প্রখর ! একজন কবি একই সাথে হয়ে থাকেন একজন দার্শনিক । চলমান জীবন ও সময়কে তাঁরা তীক্ষ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন । একটা পাকা ফলের হলদে বোঁটা দেখে কেউ হয়তো ভাবে, ‘ফলটা খাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে’ , কিংবা ‘যেকোন সময় এটি ছিঁড়ে পড়বে’ । আর কবি ভাবেন, মানুষের জীবনটাও তো এমনই । যতই বয়স বাড়ে, যতই পাক ধরে চুলে , ততই দুর্বল হয়, শিথিল হয় সম্পর্কের বোঁটা । তারপর একদিন চলে যেতে হয় বোঁটাছেড়া ফলের মত ।(সমস্যা হচ্ছে, কখনো কখনো কবিরা ছোটখাট ব্যাপারে অতিমাত্রায় সেন্সিটিভ হয় এবং সাধারণ কথাকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে জটিল বানিয়ে তোলে ।)

প্রশ্ন হচ্ছে, ইতিহাসে কোন কবি কি রাজনীতিক ছিলেন ?  একজন কবি কেন রাজনীতিক হবেন না? কেন একজন কবি অন্যকোন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা ব্যস্ততম দায়িত্ব পালন করবেন না ? একজন ডাক্তার কেন কবি হবেন না ? একজন ব্যাংকার কেন কবিতা লিখবেন না ? একজন সৈনিক, একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন ইঞ্জিনিয়ার কেন কবি হবেন না ? তারমানে কি এটাই যে, কবি হলে তার আর সমাজ রাষ্ট্রের কাজ করা যাবেনা ? কবিরা সমাজ রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব পালন করতে পারেন না?
কবি মানেই উদাসীন কেউ, এই বাস্তবতাটা যে ধারনা সৃষ্টি করে সেটা পরিশেষে কবিতার জন্য খারাপ হয় । এর অর্থ দাঁড়ায়, কবিতা লেখা কিংবা কবিতা পড়াটা অকর্মণ্য অলস উদাসীন লোকদের কাজ । স্বাভাবিক ব্যস্ত মানুষের জন্য কবিতা উপযুক্ত নয় !
অথচ ধারণাটা উল্টো হওয়াটাই উচিত ছিল । কবিতা পড়তে খুব অল্প সময় লাগে, কবিতাকে তাই বলা যেতে পারে ব্যস্ত মানুষের সাহিত্য ।  অন্তত আমি তাই মনে করি । একটা ব্যাপার বোঝানোর জন্য একটা উপন্যাসে হয়তো তিনশ পৃষ্ঠার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু একটা কবিতায় সেই ব্যাপারটা হয়তো বুঝিয়ে দেয়া যেতে পারে এক পৃষ্ঠাতেই !

তবে হ্যা, এই সবকিছুর পরিবর্তনের জন্য প্রথমে কবিদেরকে নেমে আসতে হবে সাধারণ মানুষের কাতারে । কথা বলতে হবে সাধারণ মানুষের ভাষায়, পুরোহিতের ভাষায় নয় ।
(এইসব কারণের পক্ষে আমি প্রথিতযশা কবিদের জীবন থেকে উদাহরণ দিতে পারতাম । কিন্তু ইচ্ছে করেই কারো নাম নিলাম না।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন