এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ছিন্নমুকুল

এতটুকু একটা বাচ্চা, এতটুকু শরীর । কতটুকুই বা বুকের খাঁচা ? ঠিকমত আঙুল বসানোর উপায় নেই । তবু বৃদ্ধাঙ্গুলি দুটি বুকের মাঝখানে দুইপাশে রেখে চাপ দেয়া শুরু করলো নোমান ।

রাত প্রায় তিনটা । ঘুমঘুম চোখে ডক্টরস রুমে বসে ছিল নোমান । দরজার পর্দাটা উড়ছিল ফ্যানের বাতাসে । মাঝে মাঝে শিশুর কান্না ভেসে আসছিল ।

নোমান একজন ডাক্তার । ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করার পরে একবছর ইন্টার্ণশিপ ট্রেনিং নিতে হয় । নোমান এখন ইন্টার্নশিপ করছে । গতকালই জয়েন করেছে হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে । পেডিয়াট্রিকস ওয়ার্ড । এই ওয়ার্ডে এসে অনেকটাই মন খারাপ হয়ে গেছে নোমানের । ছোট ছোট বাচ্চাগুলি কতরকম কষ্টে ভুগছে , দেখতে ভালো লাগে না । ফুটফুটে পরীর বাচ্চার মত একটা শিশু, অথচ তার হার্ট ঠিকমত কাজ করছে না । কেউ কেউ ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ।

এতদিন মেডিসিন ওয়ার্ডে কাজ করেছে নোমান । কিন্তু তখন এতটা খারাপ লাগেনি । বড় মানুষেরা তাদের ব্যথার কথা বলতে পারে, শিশুরা পারেনা । তাদের কষ্ট থেকে যায় অব্যক্ত । এক কান্নার আওয়াজে কতটুকু বোঝানো যায় ? আর এই ব্যাপারটাই বেশি করে কষ্ট দেয় নোমানকে । শিশুর মা ছুটে আসে,  কেউ বলে ভাইয়া আমার বাবুটাকে একটু দেখেন – খুব কান্নাকাটি করছে । কেউ বলে, বাবা আমার নাতিডারে একটু দেইখা যাও । আমার ভালা ঠেকতাছে না । বুকটা ধ্বক করে ওঠে নোমানের । ইচ্ছে করে কোন এক জাদুর কাঠি বুলিয়ে সব বাচ্চার সব কষ্ট নিমেষেই দূর করে দেয় । ইচ্ছে হয় ; রুপকথার মত যদি বিপদ আপদে ঘেরা কোন এক অচিন পাহাড়ের চূড়ায়ও এমন কোন ওষুধ পাওয়া যেত, যা দিয়ে এইসব শিশুর কষ্ট দূর করা যায়- সব ছেড়েছুড়ে তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তো নোমান । কিন্তু সেরকম কিছু তো নেই । চিকিৎসাবিজ্ঞান সত্যি অনেকদূর এগিয়েছে । তবুও রয়ে গেছে অনেক সীমাবদ্ধতা । আর আমাদের দেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি গরীব দেশে সেই সীমাবদ্ধতার কোন সীমা নেই ।

মাঝে মাঝে স্রষ্টার প্রতি অভিযোগ করতে ইচ্ছা হয় । খোদা যত কষ্ট দাও বড়দের । এই শিশুদের কষ্টে না রাখলেই কি নয় ?
কিন্তু তা করা যায়না । কারণ, স্রষ্টার জ্ঞান অসীম, স্রষ্টা নিজেই অসীম । তাঁকে প্রশ্ন করা চলে না । তাঁর ইচ্ছা তিনিই ভালো জানেন । মানুষকে যতটুকু জানানো হয়েছে এর বেশি জানতে পারবে না । বরং যতটুকু সামর্থ আছে তা দিয়ে মানুষকে ভালোর জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে ।

একটা অবুঝ শিশুর জন্য বাবা মায়ের কতটা ভালোবাসা থাকে এই দু’দিনেই বুঝতে পেরেছে নোমান । সবাই যখন বারবার এটাসেটা জিজ্ঞেস করতে আসে, হয়তো কিছু কিছু কথা অপ্রাসংগিক – তবু সে বিরক্ত হয়না । বিরক্তি যে আসেনা তা নয় , কিন্তু যখনই ভাবে- ঐ শিশুটি হয়তো সারা পৃথিবীর কয়েকশত কোটি শিশুর একজন, হয়তো ওর কিছু হয়ে গেলে পৃথিবীর কিছু আসে যায়না – কিন্তু ঐ তরুণী মা’টির বুক শূন্য হয়ে যায় । তাঁর তো ঐ একটিই নাড়ী ছেড়া ধন ।

মায়েদের স্বার্থপরতা নিয়েও ভেবেছে নোমান । এখানে ডাক্তারের কাছে সব শিশুই তো রোগী, ডাক্তার রোগের গুরুত্ব ও জটিলতা অনুযায়ী গুরুত্ব দেবেন এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু প্রতিটি মায়ের কাছে মনে হয়, তাঁর শিশুটিই সবচেয়ে কষ্টে আছে । তাঁর বাচ্চাটাকেই আগে দেখতে হবে । শুধু ডাক্তারের কাছেই যে দাবি করে তা নয়, এ নিয়ে নিজেরা নিজেদের ভেতর ঝগড়াও বাঁধায় তারা মাঝে মাঝে ।
নোমান এসব দেখে আর ভাবে , আহারে ভালোবাসা ! ভালোবাসা মানুষকে এরকম  স্বার্থপর বানায় !

একটা তরুণী মায়ের প্রথম সন্তানের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকে এখন সেটা বোঝার চেষ্টা করে নোমান । নিজে সে কিছুটা কাঠখোট্টা বলেই মনে করে নিজেকে । বড়বোন যখন ভাগ্নে ভাগ্নিদের জন্য খেটে মরে, প্রায়ই সে বলে – এত আহ্লাদের কী আছে আপা । বাচ্চাগুলাকে নিজের মত করে বড় হতে দাও ।
আপা বলেন, এখন তো বুঝবি না । নিজের হলে বুঝবি ।
নিজের কবে কী হবে সে তো অনেক পরের কথা , তবে এখানে এসে কিছুটা বুঝতে পারছে সে ।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগের সাথেই লাগোয়া  স্পেশালাইজড নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট । সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতক  শিশুদের স্থান হয় এখানে । পুরো হাসপাতালের মধ্যে এইটা একটা ভয়ংকর জায়গা মনে হয় নোমানের । একজন বয়স্ক মানুষ মারা গেলে তবু হয়তো মেনে নেয়া যায়, কিন্তু একটা শিশুর মৃত্যু মেনে নেয়া যেন আরো কঠিন । অথচ প্রতিদিনই কত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে ।

কার্ডিওলজির সিসিইউ কে দ্বিতীয় ভয়ংকর জায়গা মনে হয় ওর । মৃত্যু কীভাবে যে আসে যায়, ওখানে সেটা খুব ভালো করে বোঝা যায় । জ্বলজ্যান্ত মানুষ নিজের হাতের ওপর কীভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সেই অভিজ্ঞতা নোমানের হয়েছিল সিসিইউ তে । হার্ট ফেইলুরের একজন রোগীকে সিপিআর (কার্ডিও রেসপিরেটরি রিসাসিটেশন) দিয়েছিল নোমান । বড় বড় চোখে নোমানের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল সে । তারপর সেভাবেই চলে যায় পরপারে । চোখ দুটো বুজে দিয়ে একজন পরাজিত মানুষের মত ফিরে এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়েছিল নোমানকে ।

মেডিসিন ওয়ার্ডের একটা কিশোরের কথাও খুব মনে পড়ে । একদিন আগে সে বলেছিল- স্যার আমি বাচুম না, আমারে বাচান ।
কী আশ্চর্য, পরদিন সকালে গিয়ে নোমান দেখে ঐ বেডে অন্য রোগী । রাতেই মারা গিয়েছিল ছেলেটি ।
হাসপাতালে প্রতিদিনই চোখের সামনে দিয়ে কত লাশ পার হয়ে যায়, তবু কারো কারো মৃত্যু ভোলা যায় না ।

নিওনেটাল আইসিইউ তে প্রতি রাতে কয়েকটি শিশু মারা যায় । এখানে আজই প্রথম নাইট ডিউটি পড়েছে নোমানের । আজ যে কী হবে ভেবে হাত জমে যাচ্ছে ওর । কীকরে এই ফুলের মত ফেরেশতাগুলোর ডেথ সার্টিফিকেট লিখবে সে ?

এলোমেলোভাবে এসব কিছুই ভাবছিলো নোমান । এরই মাঝে ওয়ার্ড বয় এসে ডাক দিলো । স্যার, চার নম্বর বেবিটা নিঃশ্বাস নিতেছে না ।
চার নম্বর বেডে একটা মেয়েশিশু ভর্তি । প্রিম্যাচিউর বেবি উইথ ভেরি লো বার্থ ওয়েট । বারবার এপনিক (নিঃশ্বাস আটকে যাওয়া) হয়ে যাচ্ছে । কতক্ষণ টিকবে বলা মুশকিল ।

দৌড়ে গেল নোমান । এতটুকু একটা বাচ্চা, এতটুকু শরীর । কতটুকুই বা বুকের খাঁচা ? ঠিকমত আঙুল বসানোর উপায় নেই । তবু বৃদ্ধাঙ্গুলি দুটি বুকের মাঝখানে দুইপাশে রেখে চাপ দেয়া শুরু করলো নোমান । একজন নার্সকে লাগিয়ে দিল আম্বু ব্যাগ টিপতে । এই মুহূর্তে কেন জানি মনে পড়ে গেল ওর সেই ছোটবোনটির কথা যার কথা এখন আর মনে পড়ে না ।

নোমানের বয়স যখন চার কী পাঁচ তখন ওর একটি বোন হয়েছিল । এক সপ্তাহের মাথায় সেই বোনটি মারা যায় । সেই পিচ্চির মুখটা কেমন ছিল ? মনে পড়ে না নোমানের ।  মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে, যার চোখ তাকে আর, মনে পড়ে না । শুধু মনে পড়ে মা খুব কেঁদেছিলেন সেদিন । পিচ্চিটাকে বাড়ির পেছনের গোরস্তানে একটা ছোট্ট কবরে রাখা হয়েছিল । সবার পেছনে পেছনে গুটিগুটি পায়ে নোমানও গিয়েছিল । এখন আর সে কবরটাকেও আলাদা করে চেনা যায় না । ভাইবোনেরাও কেউ ওর কথা স্মরণ করেনা । মা নিশ্চয়ই ওকে ভোলেননি , কিন্তু মা-ও আর কখনো ওর প্রসংগ তোলেননা ।

সে যেন চলে গেছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্নমুকুল’ এর মত-

সব-চেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে,
সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিলো
সে গিয়েছে সবার আগে সরে
ছোট্ট যে জন ছিলো রে সব চেয়ে
সে দিয়েছে সকল শূন্য করে।

নোমানের হঠাৎ মনে হতে লাগলো, আচ্ছা ওর মুখটা কি এই বেবিটার মত ছিল ?
এখানে অন্য সময় সব বাচ্চাকে একই রকম লাগে । সেজন্য কারো চেহারার দিকে ঠিক আলাদা করে খেয়াল করা হয়না । সিপিআর দিতে দিতে নতুন করে বেবিটার মুখের দিকে তাকালো নোমান । নীল হয়ে আছে ছোট্ট মুখটা । একটু দূরেই বেবিটার মা দাঁড়িয়ে আছে মুখে আঁচল দিয়ে । হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় । এই মুহূর্তে তাঁর অনুভূতি কেমন, পৃথিবীর কেউ হয়তো তা বুঝতে পারবে না ।

বেবিটার অতটুকু বুকে চাপ দিতে দিতে নোমানের মনে হতে লাগলো, যেন সে ওর সেই নাম না জানা , মুখ না চেনা , হারিয়ে যাওয়া বোনটিকেই বাঁচানোর জন্য  সংগ্রাম করছে ।

[ফুটনোটঃ সত্যিই আমার একটি ছোট বোন জন্মের কয়েকদিনের মাথায় মারা গিয়েছিল । ওর কোন নাম ছিলনা । তখন ছোট ছিলাম । এখন আর সত্যি সত্যি শত চেষ্টা করেও আমি ওর মুখের ছবিটা মনের পটে  আঁকতে পারিনা ।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন