যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধূয়া
সবই শুনে শুনে যেতে হবে...
যদি আসি আসি করে দেরি করে সে
দিন গুনে গুনে যেতে হবে...
বিছানায় বসে গুনগুনিয়ে গাইছিলো রতন । সামনেই ‘একজন’ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছে মনোযোগ দিয়ে । রতন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে । হঠাৎ করে সাজগোজে মগ্ন ‘একজনের’ খেয়াল হলো ব্যাপারটা । আয়নার দিক থেকে না মুখ ঘুরিয়েই বললো- এইভাবে তাকায় না থেকে এইবার একটু পলক ফেলা যায়না রাজামশায়?
রতন নিচুস্বরে জবাব দিলো-
-'আমার কী দোষ ? কবিই তো বলেছেন- তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, সেকি মোর অপরাধ ? আর তাছাড়া রাণীর সাজগোজ দেখাটাও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার !'
-বসে বসে গান গাওয়া হচ্ছে কেন সেটা তো আমরা বুঝি ! এহ, শখ কত ! মুখে বলার তো সাহস নাই । গান গেয়ে ইঙ্গিত দেয় !
যেভাবে সে সাজাবে , সাজবো যে সেভাবে, সুখ দুঃখ সবই মেনে নিতে হবে !
ওয়ার্ড রোব থেকে নীল শাড়িটা বের করতে করতে বিদ্রুপাত্মক সুরে পরের কয়েকটি কলি গায় অবনী ।
নীল শাড়ি রতনের পছন্দের । বিশেষ বিশেষ দিনে নীল শাড়ি পড়াটা এই দম্পতির নিয়ম । অবনীরও পছন্দ, কিন্তু সেটা সে মুখ ফুটে কখনো বলে না । রতনকে বলে, 'দেখো- আমি কিন্তু শুধু তোমার কথা চিন্তা করেই নীল শাড়ি পড়েছি !' এটা একধরণের ছলনা কিনা কে জানে ! কিন্তু অবনীর মনে হয়, ভালোবাসার প্রয়োজনে কিছুটা ছলনা করাই যায় !
আজকের দিনটায় একটু মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে দুজনের ভেতরেই । কিছুটা আনন্দ । কিছুটা বিষাদ । কালই ঢাকা ছাড়তে হবে অবনীকে । রতন এবং অবনী দুজনেই ডাক্তার । এবার অবনীর বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ হয়েছে । আগামীকালই জয়েন করতে হবে । পোস্টিং দিয়েছে গ্রামে । অবশ্য নিজেরই গ্রাম । নিজের বাড়িতে থেকেই অফিস করতে পারবে । এদিকে রতন পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং করছে ঢাকা মেডিকেলে । ট্রেনিং গ্যাপ দেয়া যাবেনা । সুতরাং বলতে গেলে আপাতত বিচ্ছেদ । রতন মাঝে মাঝে ছুটি পেলেই চলে যাবে । কিন্তু... প্রতিদিনতো আর দেখা হবে না । সকাল বিকাল ঝগড়া করা হবেনা । ঝগড়া করতে না পারাটাও যে মন খারাপের কারণ হতে পারে, এর আগে কখনো মনে হয়নি রতনের ।
প্ল্যান করেছে আজ বিকালটা ওরা রিক্সায় করে ঘুরবে । যান্ত্রিক শহর হলেও ঢাকার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে অবনীর । অথচ বিয়ের আগে সে একপ্রকার শর্ত দিয়ে বসেছিল, আর যেখানেই হোক, ঢাকায় থাকা চলবে না । ধুলোবালি জ্যাম যান্ত্রিকতার শহরে থাকতে কোনভাবেই ইচ্ছুক ছিলনা অবনী । বিয়ের পর কিছুদিন গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে ছিল । তারপর রতন ঢাকায় নিয়ে আসে । বলেছিল, ‘কিছুদিন থাকো । যদি ভালো না লাগে তখন নাহয় অন্য ব্যবস্থা করবো’ । কিন্তু সেইযে ঢাকায় এলো, এরপর কীভাবে কীভাবে যে কয়েকটা বছর চলে গেল । ঢাকা শহরটা এখন আর খারাপ লাগে না । বরং গ্রামে গেলেই কেমন যেন খালি খালি লাগে । সবখানেই একটা নাই নাই ভাব । কেমন যেন হাহাকার ।
কিন্তু এখন যেতে হচ্ছে । প্রথমে ভেবেছিল জয়েন করবে না । কেমন লাগবে কে জানে ! কিন্তু রতন সাহস দেয়, ‘আপাতত জয়েন করে দেখো । ভালো না লাগলে পরে দেখা যাবে!’
অবনীও ভেবেছে, নিজের উপজেলা , নিজের গ্রাম । হয়তো খারাপ লাগবে না । যদিও ভাইবোনেরা কেউ বাড়িতে নেই । লেখাপড়া , চাকরির প্রয়োজনে সবাই বিভিন্ন জায়গায় । বাবা মা তো আছেন । বাবা মায়ের সাথে থাকা হবে এটাই বা কম কিসে ? এখন যদি একটু সেবাযত্ন করতে পারে সেটাতো সৌভাগ্যের ব্যাপার । ক’টা মেয়ের ভাগ্য হয় শেষ বয়সে বাবা মায়ের সেবা করার ? আর তাছাড়া নিজের গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দিতে পারবে । এইসব ভেবে অবশেষে জয়েন করার সিদ্ধান্তই নিয়েছে অবনী ।
আজ বিকেলটা একসাথে ঘুরে ফিরে রাতের বাসে রওনা দেবে গ্রামের উদ্দেশ্যে । সাথে লাগেজপত্র থাকবে না বেশি । কিছু কাপড় চোপড় , এই ।
আধাঘন্টা পরে ওরা বাসা থেকে বের হলো । একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো । রিক্সাওয়ালা বয়স্ক মানুষ । অবশ্য বয়স্ক মানুষ দেখেই তার রিক্সায় উঠেছে ওরা । বয়স্ক একজন মানুষ রিক্সা চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই নিরুপায় হয়েই । কেমন চুপচাপ ধরণের লোকটা । হয়তো ছেলেপুলে নেই । অথবা থাকলেও বৃদ্ধ বাবার ভরনপোষণ দেয় না ।
অবনীকে দেখে কয়েকটা চ্যাংড়া রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিল- আপা কই যাইবেন ? এইটা এদের একটা বদভ্যাস । অথবা বলা যেতে পারে বাঙ্গাল চরিত্র । যদি দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বা রিক্সা খুঁজছে, এরা যেচে এসে সাধবে- আপা কই যাইবেন ? অথচ পুরুষ মানুষ যদি জিজ্ঞেস করে, যাইবা ? এরা ঘেট হয়ে বসে থাকবে । যামুনা ।
একদিন তো এক রিক্সাওয়ালাকে হাতে নাতে লজ্জা দিয়েছিল রতন । ব্যাটা ধানমন্ডি যাবেই না । একটু পর অবনী গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে- যাবেন ? এইবার তো রিক্সাওয়ালা রাজী ! অবনী রিক্সায় উঠে বসলে আড়াল থেকে রতনও এসে সেই রিক্সায় উঠে পড়ে । বলে- মামা চলেন !
সেদিন বেচারা রিক্সাওয়ালার মুখটা হয়েছিল দেখার মত!
বয়স্ক রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কই যামু ?
রতন বললো, চাচা চলেন আপনের যেইখানে ইচ্ছা !
এটাও একধরণের খেলা । একসাথে বের হলে মাঝে মাঝেই ওরা এই খেলা খেলে । কোথায় যাবে কিছু মনস্থির না করেই রিক্সায় উঠে পড়ে । তারপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেয় রিক্সাওয়ালার ওপর । বেচারি রিকশাওয়ালা পড়ে মহা ফ্যাসাদে । ‘কোথায় যাবো ?’ এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা আসলে সহজ কাজ না । আসলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াই সহজ কাজ না । বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় রিক্সাওয়ালা হার মেনে যায় । আজকের রিক্সাওয়ালাও হার মানলো । অবশ্য এই লোকের হার মানারই কথা । জীবনযুদ্ধে হারতে হারতেই তো এতদূর চলে এসেছেন ।
রিক্সাওয়ালা চাচা বললেন, বাবা কইয়া দেন কই যামু ।
রতন সহজ সমাধান দেয় , যান চাচা। সামনের দিকে যান । যেদিকে দেখবেন রাস্তা খালি, জ্যাম নাই- সেইদিকে যাইবেন ।
রিক্সায় উঠে হঠাৎ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে দু’জনই । সাময়িক বিচ্ছেদ, এটুকুও মানতে চায়না মন । মনে তোলপাড়, কত কথার তুফান ছুটছে । অথচ মুখে আসছে না কিছুই ।
রতন পড়েছে সাদার ওপর নীল স্ট্রাইপের শার্ট । রিকশার বাম পাশের সিটে বসেছে সে, ডান পাশে অবনী । অবনীর কোলের ওপর ওর লাল ভ্যানিটি ব্যাগ ।
-‘কী হলো ? কিছু বলছো না যে ?’ অধৈর্য হয়ে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রতন । এটা রতনের কথা শুরু করার স্টাইল । বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় রতন নীরবতা ভাঙ্গে এই কথার মাধ্যমে ।
অবনী বলে ,
-কী বলবো ? আমার কিছু বলার নাই ।
-আরে কী তাজ্জব ! কিছু বলার নাই মানে ? কেমন লাগছে অন্তত সেটা বলো ।
-বলার কী আছে ? আমার কেমন লাগছে সেটা তোমার অজানা না ।
এই এক সমস্যা । মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা । মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা । এখন অবনীর মন খারাপ । আকাশ বাতাস কুয়াশাচ্ছন্ন । বেশি কথা বলা যাবে না । তিস্তা হয়ে যেতে পারে । রাস্তার মাঝখানে রিক্সায় বসে একটা মেয়ে কাঁদছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না ।
স্রষ্টা যে এঁদের মনে কেন এত আবেগ দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন । সেই এসএসসির পর থেকেই তো রতন বাড়ির বাইরে । প্রতিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একমনে হেঁটে চলে যেত । কারণ, ফিরে তাকালেই দেখা যেত, আঁচলে মুখ ঢেকে মা কাঁদছেন । গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোটবোনটা কাঁদছে । সত্যি বলতে- রতনের বুকটাও যে গুমরে উঠতো না তা নয় । একবার তো ভুলে পেছন ফিরে তাকিয়ে সেও কেঁদে ফেলেছিল । সেবার আর যাওয়া হয়নি । বাসের টিকেট ক্যান্সেল করে পরে আরেকদিন যেতে হয়েছিল ।
এই মুহূর্তে রাস্তাটা বেশ ফাঁকা । মাঝে মাঝে দুএকটা প্রাইভেট কার হুসহাস করে চলে যাচ্ছে । পকেট থেকে মোবাইল বের করে রতন । হেডফোনের একটা এয়ারপিস জুড়ে দেয় অবনীর বাম কানে , নিজের ডান কানে আরেকটা ।
তারপর প্লে করে ওর খুব পছন্দের একটা গান । এই গানটা শুনলে অবনীরও মন ভালো হয়ে যায় ।
'যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ, একদিন, গলেও যায় । তবুও তুমি আমার । যদি নায়াগ্রা জলপ্রপাত, একদিন, সাহারার কাছে চলেও যায়... যদি প্রশান্ত মহাসাগরের, একফোঁটা, জল আর নাও থাকে । যদি গঙ্গা ভলগা হোয়াংহো, নিজেদের শুকিয়েও রাখে...যদি ভিসুভিয়াস ফুজিয়ামা, একদিন, জ্বলতে জ্বলতে জ্বলেও যায়...তবুও তুমি আমার । যদি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে একদিন তৃতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধে , যদি নিভেও যায় কোনদিন, যতটুকু আলো আছে, ওই সূর্য আর চাঁদে...'
তন্ময় হয়ে গান শুনছিল দুজনেই । হঠাৎ আর্তচিৎকার করে উঠলো অবনী । একটা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিয়েছে ছিনতাই কারী । কিছু বুঝে ওঠার আগেই রতন দেখলো অবনী রিক্সা থেকে পড়ে যাচ্ছে । একটা হাত ধরার চেষ্টা করে রতন, কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা । অবনীর মাথাটা গিয়ে ঠেকলো পিচঢালা রাস্তায় । আর ঠিক তখনি পেছন হতে বেপরোয়া আরেকটি কারের ধাক্কা লাগলো অবনীর শরীরে । কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে পড়লো রতনের সাদা শার্টে ।
[উৎসর্গঃ ডাঃ সানজানা জেরিন । চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র এই আপু কিছুদিন আগেই এমনি এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এখনো স্বাভাবিক হয়নি তাঁর জীবন । যদিও আমার সাথে কখনো পরিচয় হয়নি, তবুও তাঁর এই দূর্ঘটনার কথা আমি ভুলতে পারিনা ।]
সবই শুনে শুনে যেতে হবে...
যদি আসি আসি করে দেরি করে সে
দিন গুনে গুনে যেতে হবে...
বিছানায় বসে গুনগুনিয়ে গাইছিলো রতন । সামনেই ‘একজন’ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছে মনোযোগ দিয়ে । রতন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে । হঠাৎ করে সাজগোজে মগ্ন ‘একজনের’ খেয়াল হলো ব্যাপারটা । আয়নার দিক থেকে না মুখ ঘুরিয়েই বললো- এইভাবে তাকায় না থেকে এইবার একটু পলক ফেলা যায়না রাজামশায়?
রতন নিচুস্বরে জবাব দিলো-
-'আমার কী দোষ ? কবিই তো বলেছেন- তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, সেকি মোর অপরাধ ? আর তাছাড়া রাণীর সাজগোজ দেখাটাও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার !'
-বসে বসে গান গাওয়া হচ্ছে কেন সেটা তো আমরা বুঝি ! এহ, শখ কত ! মুখে বলার তো সাহস নাই । গান গেয়ে ইঙ্গিত দেয় !
যেভাবে সে সাজাবে , সাজবো যে সেভাবে, সুখ দুঃখ সবই মেনে নিতে হবে !
ওয়ার্ড রোব থেকে নীল শাড়িটা বের করতে করতে বিদ্রুপাত্মক সুরে পরের কয়েকটি কলি গায় অবনী ।
নীল শাড়ি রতনের পছন্দের । বিশেষ বিশেষ দিনে নীল শাড়ি পড়াটা এই দম্পতির নিয়ম । অবনীরও পছন্দ, কিন্তু সেটা সে মুখ ফুটে কখনো বলে না । রতনকে বলে, 'দেখো- আমি কিন্তু শুধু তোমার কথা চিন্তা করেই নীল শাড়ি পড়েছি !' এটা একধরণের ছলনা কিনা কে জানে ! কিন্তু অবনীর মনে হয়, ভালোবাসার প্রয়োজনে কিছুটা ছলনা করাই যায় !
আজকের দিনটায় একটু মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে দুজনের ভেতরেই । কিছুটা আনন্দ । কিছুটা বিষাদ । কালই ঢাকা ছাড়তে হবে অবনীকে । রতন এবং অবনী দুজনেই ডাক্তার । এবার অবনীর বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ হয়েছে । আগামীকালই জয়েন করতে হবে । পোস্টিং দিয়েছে গ্রামে । অবশ্য নিজেরই গ্রাম । নিজের বাড়িতে থেকেই অফিস করতে পারবে । এদিকে রতন পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং করছে ঢাকা মেডিকেলে । ট্রেনিং গ্যাপ দেয়া যাবেনা । সুতরাং বলতে গেলে আপাতত বিচ্ছেদ । রতন মাঝে মাঝে ছুটি পেলেই চলে যাবে । কিন্তু... প্রতিদিনতো আর দেখা হবে না । সকাল বিকাল ঝগড়া করা হবেনা । ঝগড়া করতে না পারাটাও যে মন খারাপের কারণ হতে পারে, এর আগে কখনো মনে হয়নি রতনের ।
প্ল্যান করেছে আজ বিকালটা ওরা রিক্সায় করে ঘুরবে । যান্ত্রিক শহর হলেও ঢাকার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে অবনীর । অথচ বিয়ের আগে সে একপ্রকার শর্ত দিয়ে বসেছিল, আর যেখানেই হোক, ঢাকায় থাকা চলবে না । ধুলোবালি জ্যাম যান্ত্রিকতার শহরে থাকতে কোনভাবেই ইচ্ছুক ছিলনা অবনী । বিয়ের পর কিছুদিন গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে ছিল । তারপর রতন ঢাকায় নিয়ে আসে । বলেছিল, ‘কিছুদিন থাকো । যদি ভালো না লাগে তখন নাহয় অন্য ব্যবস্থা করবো’ । কিন্তু সেইযে ঢাকায় এলো, এরপর কীভাবে কীভাবে যে কয়েকটা বছর চলে গেল । ঢাকা শহরটা এখন আর খারাপ লাগে না । বরং গ্রামে গেলেই কেমন যেন খালি খালি লাগে । সবখানেই একটা নাই নাই ভাব । কেমন যেন হাহাকার ।
কিন্তু এখন যেতে হচ্ছে । প্রথমে ভেবেছিল জয়েন করবে না । কেমন লাগবে কে জানে ! কিন্তু রতন সাহস দেয়, ‘আপাতত জয়েন করে দেখো । ভালো না লাগলে পরে দেখা যাবে!’
অবনীও ভেবেছে, নিজের উপজেলা , নিজের গ্রাম । হয়তো খারাপ লাগবে না । যদিও ভাইবোনেরা কেউ বাড়িতে নেই । লেখাপড়া , চাকরির প্রয়োজনে সবাই বিভিন্ন জায়গায় । বাবা মা তো আছেন । বাবা মায়ের সাথে থাকা হবে এটাই বা কম কিসে ? এখন যদি একটু সেবাযত্ন করতে পারে সেটাতো সৌভাগ্যের ব্যাপার । ক’টা মেয়ের ভাগ্য হয় শেষ বয়সে বাবা মায়ের সেবা করার ? আর তাছাড়া নিজের গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দিতে পারবে । এইসব ভেবে অবশেষে জয়েন করার সিদ্ধান্তই নিয়েছে অবনী ।
আজ বিকেলটা একসাথে ঘুরে ফিরে রাতের বাসে রওনা দেবে গ্রামের উদ্দেশ্যে । সাথে লাগেজপত্র থাকবে না বেশি । কিছু কাপড় চোপড় , এই ।
আধাঘন্টা পরে ওরা বাসা থেকে বের হলো । একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো । রিক্সাওয়ালা বয়স্ক মানুষ । অবশ্য বয়স্ক মানুষ দেখেই তার রিক্সায় উঠেছে ওরা । বয়স্ক একজন মানুষ রিক্সা চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই নিরুপায় হয়েই । কেমন চুপচাপ ধরণের লোকটা । হয়তো ছেলেপুলে নেই । অথবা থাকলেও বৃদ্ধ বাবার ভরনপোষণ দেয় না ।
অবনীকে দেখে কয়েকটা চ্যাংড়া রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিল- আপা কই যাইবেন ? এইটা এদের একটা বদভ্যাস । অথবা বলা যেতে পারে বাঙ্গাল চরিত্র । যদি দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বা রিক্সা খুঁজছে, এরা যেচে এসে সাধবে- আপা কই যাইবেন ? অথচ পুরুষ মানুষ যদি জিজ্ঞেস করে, যাইবা ? এরা ঘেট হয়ে বসে থাকবে । যামুনা ।
একদিন তো এক রিক্সাওয়ালাকে হাতে নাতে লজ্জা দিয়েছিল রতন । ব্যাটা ধানমন্ডি যাবেই না । একটু পর অবনী গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে- যাবেন ? এইবার তো রিক্সাওয়ালা রাজী ! অবনী রিক্সায় উঠে বসলে আড়াল থেকে রতনও এসে সেই রিক্সায় উঠে পড়ে । বলে- মামা চলেন !
সেদিন বেচারা রিক্সাওয়ালার মুখটা হয়েছিল দেখার মত!
বয়স্ক রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কই যামু ?
রতন বললো, চাচা চলেন আপনের যেইখানে ইচ্ছা !
এটাও একধরণের খেলা । একসাথে বের হলে মাঝে মাঝেই ওরা এই খেলা খেলে । কোথায় যাবে কিছু মনস্থির না করেই রিক্সায় উঠে পড়ে । তারপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেয় রিক্সাওয়ালার ওপর । বেচারি রিকশাওয়ালা পড়ে মহা ফ্যাসাদে । ‘কোথায় যাবো ?’ এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা আসলে সহজ কাজ না । আসলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াই সহজ কাজ না । বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় রিক্সাওয়ালা হার মেনে যায় । আজকের রিক্সাওয়ালাও হার মানলো । অবশ্য এই লোকের হার মানারই কথা । জীবনযুদ্ধে হারতে হারতেই তো এতদূর চলে এসেছেন ।
রিক্সাওয়ালা চাচা বললেন, বাবা কইয়া দেন কই যামু ।
রতন সহজ সমাধান দেয় , যান চাচা। সামনের দিকে যান । যেদিকে দেখবেন রাস্তা খালি, জ্যাম নাই- সেইদিকে যাইবেন ।
রিক্সায় উঠে হঠাৎ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে দু’জনই । সাময়িক বিচ্ছেদ, এটুকুও মানতে চায়না মন । মনে তোলপাড়, কত কথার তুফান ছুটছে । অথচ মুখে আসছে না কিছুই ।
রতন পড়েছে সাদার ওপর নীল স্ট্রাইপের শার্ট । রিকশার বাম পাশের সিটে বসেছে সে, ডান পাশে অবনী । অবনীর কোলের ওপর ওর লাল ভ্যানিটি ব্যাগ ।
-‘কী হলো ? কিছু বলছো না যে ?’ অধৈর্য হয়ে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রতন । এটা রতনের কথা শুরু করার স্টাইল । বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় রতন নীরবতা ভাঙ্গে এই কথার মাধ্যমে ।
অবনী বলে ,
-কী বলবো ? আমার কিছু বলার নাই ।
-আরে কী তাজ্জব ! কিছু বলার নাই মানে ? কেমন লাগছে অন্তত সেটা বলো ।
-বলার কী আছে ? আমার কেমন লাগছে সেটা তোমার অজানা না ।
এই এক সমস্যা । মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা । মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা । এখন অবনীর মন খারাপ । আকাশ বাতাস কুয়াশাচ্ছন্ন । বেশি কথা বলা যাবে না । তিস্তা হয়ে যেতে পারে । রাস্তার মাঝখানে রিক্সায় বসে একটা মেয়ে কাঁদছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না ।
স্রষ্টা যে এঁদের মনে কেন এত আবেগ দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন । সেই এসএসসির পর থেকেই তো রতন বাড়ির বাইরে । প্রতিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একমনে হেঁটে চলে যেত । কারণ, ফিরে তাকালেই দেখা যেত, আঁচলে মুখ ঢেকে মা কাঁদছেন । গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোটবোনটা কাঁদছে । সত্যি বলতে- রতনের বুকটাও যে গুমরে উঠতো না তা নয় । একবার তো ভুলে পেছন ফিরে তাকিয়ে সেও কেঁদে ফেলেছিল । সেবার আর যাওয়া হয়নি । বাসের টিকেট ক্যান্সেল করে পরে আরেকদিন যেতে হয়েছিল ।
এই মুহূর্তে রাস্তাটা বেশ ফাঁকা । মাঝে মাঝে দুএকটা প্রাইভেট কার হুসহাস করে চলে যাচ্ছে । পকেট থেকে মোবাইল বের করে রতন । হেডফোনের একটা এয়ারপিস জুড়ে দেয় অবনীর বাম কানে , নিজের ডান কানে আরেকটা ।
তারপর প্লে করে ওর খুব পছন্দের একটা গান । এই গানটা শুনলে অবনীরও মন ভালো হয়ে যায় ।
'যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ, একদিন, গলেও যায় । তবুও তুমি আমার । যদি নায়াগ্রা জলপ্রপাত, একদিন, সাহারার কাছে চলেও যায়... যদি প্রশান্ত মহাসাগরের, একফোঁটা, জল আর নাও থাকে । যদি গঙ্গা ভলগা হোয়াংহো, নিজেদের শুকিয়েও রাখে...যদি ভিসুভিয়াস ফুজিয়ামা, একদিন, জ্বলতে জ্বলতে জ্বলেও যায়...তবুও তুমি আমার । যদি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে একদিন তৃতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধে , যদি নিভেও যায় কোনদিন, যতটুকু আলো আছে, ওই সূর্য আর চাঁদে...'
তন্ময় হয়ে গান শুনছিল দুজনেই । হঠাৎ আর্তচিৎকার করে উঠলো অবনী । একটা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিয়েছে ছিনতাই কারী । কিছু বুঝে ওঠার আগেই রতন দেখলো অবনী রিক্সা থেকে পড়ে যাচ্ছে । একটা হাত ধরার চেষ্টা করে রতন, কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা । অবনীর মাথাটা গিয়ে ঠেকলো পিচঢালা রাস্তায় । আর ঠিক তখনি পেছন হতে বেপরোয়া আরেকটি কারের ধাক্কা লাগলো অবনীর শরীরে । কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে পড়লো রতনের সাদা শার্টে ।
[উৎসর্গঃ ডাঃ সানজানা জেরিন । চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র এই আপু কিছুদিন আগেই এমনি এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এখনো স্বাভাবিক হয়নি তাঁর জীবন । যদিও আমার সাথে কখনো পরিচয় হয়নি, তবুও তাঁর এই দূর্ঘটনার কথা আমি ভুলতে পারিনা ।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন