এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধূয়া...

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধূয়া
সবই শুনে শুনে যেতে হবে...
যদি আসি আসি করে দেরি করে সে
দিন গুনে গুনে যেতে হবে...

বিছানায় বসে গুনগুনিয়ে গাইছিলো রতন । সামনেই ‘একজন’ আয়নার সামনে  দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছে মনোযোগ দিয়ে । রতন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে । হঠাৎ করে সাজগোজে মগ্ন ‘একজনের’ খেয়াল হলো ব্যাপারটা । আয়নার দিক থেকে না মুখ ঘুরিয়েই বললো- এইভাবে তাকায় না থেকে এইবার একটু পলক ফেলা যায়না রাজামশায়?
রতন নিচুস্বরে জবাব দিলো-
-'আমার কী দোষ ? কবিই তো বলেছেন- তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, সেকি মোর অপরাধ ? আর তাছাড়া রাণীর সাজগোজ দেখাটাও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার !'
-বসে বসে গান গাওয়া হচ্ছে কেন সেটা তো আমরা বুঝি ! এহ, শখ কত ! মুখে বলার তো সাহস নাই । গান গেয়ে ইঙ্গিত দেয় !
যেভাবে সে সাজাবে , সাজবো যে সেভাবে, সুখ দুঃখ সবই মেনে নিতে হবে !
ওয়ার্ড রোব থেকে নীল শাড়িটা বের করতে করতে বিদ্রুপাত্মক সুরে পরের কয়েকটি কলি গায় অবনী ।

নীল শাড়ি রতনের পছন্দের । বিশেষ বিশেষ দিনে নীল শাড়ি পড়াটা এই দম্পতির নিয়ম । অবনীরও পছন্দ, কিন্তু সেটা সে মুখ ফুটে কখনো বলে না । রতনকে বলে, 'দেখো- আমি কিন্তু শুধু তোমার কথা চিন্তা করেই নীল শাড়ি পড়েছি !' এটা একধরণের ছলনা কিনা কে জানে ! কিন্তু অবনীর মনে হয়, ভালোবাসার প্রয়োজনে কিছুটা ছলনা করাই যায় !

আজকের দিনটায় একটু মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে দুজনের ভেতরেই । কিছুটা আনন্দ । কিছুটা বিষাদ । কালই ঢাকা ছাড়তে হবে অবনীকে । রতন এবং অবনী দুজনেই ডাক্তার । এবার অবনীর বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ হয়েছে । আগামীকালই জয়েন করতে হবে । পোস্টিং দিয়েছে গ্রামে । অবশ্য নিজেরই গ্রাম । নিজের বাড়িতে থেকেই অফিস করতে পারবে । এদিকে রতন পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং করছে ঢাকা মেডিকেলে । ট্রেনিং গ্যাপ দেয়া যাবেনা । সুতরাং বলতে গেলে আপাতত বিচ্ছেদ ।  রতন মাঝে মাঝে ছুটি পেলেই চলে যাবে । কিন্তু... প্রতিদিনতো আর দেখা হবে না । সকাল বিকাল ঝগড়া করা হবেনা । ঝগড়া করতে না পারাটাও যে মন খারাপের কারণ হতে পারে, এর আগে কখনো মনে হয়নি রতনের ।

প্ল্যান করেছে আজ বিকালটা ওরা রিক্সায় করে ঘুরবে । যান্ত্রিক শহর হলেও ঢাকার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে অবনীর । অথচ বিয়ের আগে সে একপ্রকার শর্ত দিয়ে বসেছিল, আর যেখানেই হোক, ঢাকায় থাকা চলবে না । ধুলোবালি জ্যাম যান্ত্রিকতার শহরে থাকতে কোনভাবেই ইচ্ছুক ছিলনা অবনী । বিয়ের পর কিছুদিন গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে ছিল । তারপর রতন ঢাকায় নিয়ে আসে । বলেছিল, ‘কিছুদিন থাকো । যদি ভালো না লাগে তখন নাহয় অন্য ব্যবস্থা করবো’ । কিন্তু সেইযে ঢাকায় এলো, এরপর কীভাবে কীভাবে যে কয়েকটা বছর চলে গেল । ঢাকা শহরটা এখন আর খারাপ লাগে না । বরং গ্রামে গেলেই কেমন যেন খালি খালি লাগে । সবখানেই একটা নাই নাই ভাব । কেমন যেন হাহাকার ।

কিন্তু এখন যেতে হচ্ছে । প্রথমে ভেবেছিল জয়েন করবে না । কেমন লাগবে কে জানে ! কিন্তু রতন সাহস দেয়, ‘আপাতত জয়েন করে দেখো । ভালো না লাগলে পরে দেখা যাবে!’
অবনীও ভেবেছে, নিজের উপজেলা , নিজের গ্রাম । হয়তো খারাপ লাগবে না ।  যদিও ভাইবোনেরা কেউ বাড়িতে নেই । লেখাপড়া , চাকরির প্রয়োজনে সবাই বিভিন্ন জায়গায় । বাবা মা তো আছেন । বাবা মায়ের সাথে থাকা হবে এটাই বা কম কিসে ? এখন যদি একটু সেবাযত্ন করতে পারে সেটাতো সৌভাগ্যের ব্যাপার । ক’টা মেয়ের ভাগ্য হয় শেষ বয়সে বাবা মায়ের সেবা করার ? আর তাছাড়া নিজের গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দিতে পারবে । এইসব ভেবে অবশেষে জয়েন করার সিদ্ধান্তই নিয়েছে অবনী ।
আজ বিকেলটা একসাথে ঘুরে ফিরে রাতের বাসে রওনা দেবে গ্রামের উদ্দেশ্যে । সাথে লাগেজপত্র থাকবে না বেশি । কিছু কাপড় চোপড় , এই ।

আধাঘন্টা পরে ওরা  বাসা থেকে বের হলো । একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো । রিক্সাওয়ালা বয়স্ক মানুষ । অবশ্য বয়স্ক মানুষ দেখেই তার রিক্সায় উঠেছে ওরা । বয়স্ক একজন মানুষ রিক্সা চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই নিরুপায় হয়েই । কেমন চুপচাপ ধরণের লোকটা । হয়তো ছেলেপুলে নেই । অথবা থাকলেও বৃদ্ধ বাবার ভরনপোষণ দেয় না ।

অবনীকে দেখে কয়েকটা চ্যাংড়া রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিল- আপা কই যাইবেন ? এইটা এদের একটা বদভ্যাস । অথবা বলা যেতে পারে বাঙ্গাল চরিত্র । যদি দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বা রিক্সা খুঁজছে, এরা যেচে এসে সাধবে- আপা কই যাইবেন ? অথচ পুরুষ মানুষ যদি জিজ্ঞেস করে, যাইবা ? এরা ঘেট হয়ে বসে থাকবে । যামুনা ।

একদিন তো এক রিক্সাওয়ালাকে হাতে নাতে লজ্জা দিয়েছিল রতন । ব্যাটা ধানমন্ডি যাবেই না । একটু পর অবনী গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে- যাবেন ? এইবার তো রিক্সাওয়ালা রাজী ! অবনী রিক্সায় উঠে বসলে আড়াল থেকে রতনও এসে সেই রিক্সায় উঠে পড়ে । বলে- মামা চলেন !
সেদিন বেচারা রিক্সাওয়ালার মুখটা হয়েছিল দেখার মত!

বয়স্ক রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কই যামু ?
রতন বললো, চাচা চলেন আপনের যেইখানে ইচ্ছা !

এটাও একধরণের খেলা । একসাথে বের হলে মাঝে মাঝেই ওরা এই খেলা খেলে । কোথায় যাবে কিছু মনস্থির না করেই রিক্সায় উঠে পড়ে । তারপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেয় রিক্সাওয়ালার ওপর । বেচারি রিকশাওয়ালা পড়ে মহা ফ্যাসাদে । ‘কোথায় যাবো ?’ এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা আসলে সহজ কাজ না । আসলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াই সহজ কাজ না ।  বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় রিক্সাওয়ালা হার মেনে যায় । আজকের রিক্সাওয়ালাও হার মানলো । অবশ্য এই লোকের হার মানারই কথা । জীবনযুদ্ধে হারতে হারতেই তো এতদূর চলে এসেছেন ।
রিক্সাওয়ালা চাচা বললেন, বাবা কইয়া দেন কই যামু ।
রতন সহজ সমাধান দেয় , যান চাচা। সামনের দিকে যান । যেদিকে দেখবেন রাস্তা খালি, জ্যাম নাই- সেইদিকে যাইবেন ।

রিক্সায় উঠে হঠাৎ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে দু’জনই । সাময়িক বিচ্ছেদ, এটুকুও মানতে চায়না মন । মনে তোলপাড়, কত কথার তুফান ছুটছে । অথচ মুখে আসছে না কিছুই ।
রতন পড়েছে সাদার ওপর নীল স্ট্রাইপের শার্ট । রিকশার বাম পাশের সিটে বসেছে সে, ডান পাশে অবনী । অবনীর কোলের ওপর ওর লাল ভ্যানিটি ব্যাগ ।
-‘কী হলো ? কিছু বলছো না যে ?’ অধৈর্য হয়ে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রতন । এটা রতনের কথা শুরু করার স্টাইল । বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় রতন নীরবতা ভাঙ্গে এই কথার মাধ্যমে ।
অবনী বলে ,
-কী বলবো ? আমার কিছু বলার নাই ।
-আরে কী তাজ্জব ! কিছু বলার নাই মানে ? কেমন লাগছে অন্তত সেটা বলো ।
-বলার কী আছে ? আমার কেমন লাগছে সেটা তোমার অজানা না ।

এই এক সমস্যা । মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা । মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা । এখন অবনীর মন খারাপ । আকাশ বাতাস কুয়াশাচ্ছন্ন । বেশি কথা বলা যাবে না । তিস্তা হয়ে যেতে পারে । রাস্তার মাঝখানে রিক্সায় বসে একটা মেয়ে কাঁদছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না ।
স্রষ্টা যে এঁদের মনে কেন এত আবেগ দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন । সেই এসএসসির পর থেকেই তো রতন বাড়ির বাইরে । প্রতিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একমনে হেঁটে চলে যেত । কারণ, ফিরে তাকালেই দেখা যেত, আঁচলে মুখ ঢেকে মা কাঁদছেন । গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোটবোনটা কাঁদছে । সত্যি বলতে- রতনের বুকটাও যে গুমরে উঠতো না তা নয় । একবার তো ভুলে পেছন ফিরে তাকিয়ে সেও কেঁদে ফেলেছিল । সেবার আর যাওয়া হয়নি । বাসের টিকেট ক্যান্সেল করে পরে আরেকদিন যেতে হয়েছিল ।

এই মুহূর্তে রাস্তাটা বেশ ফাঁকা । মাঝে মাঝে দুএকটা প্রাইভেট কার হুসহাস করে চলে যাচ্ছে । পকেট থেকে মোবাইল বের করে রতন । হেডফোনের একটা এয়ারপিস জুড়ে দেয় অবনীর বাম কানে , নিজের ডান কানে আরেকটা ।
তারপর প্লে করে ওর খুব পছন্দের একটা গান । এই গানটা শুনলে অবনীরও মন ভালো হয়ে যায় ।

'যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ, একদিন, গলেও যায় । তবুও তুমি আমার । যদি নায়াগ্রা জলপ্রপাত,  একদিন, সাহারার কাছে চলেও যায়... যদি প্রশান্ত মহাসাগরের, একফোঁটা, জল আর নাও থাকে । যদি গঙ্গা ভলগা হোয়াংহো, নিজেদের শুকিয়েও রাখে...যদি ভিসুভিয়াস ফুজিয়ামা, একদিন, জ্বলতে জ্বলতে জ্বলেও যায়...তবুও তুমি আমার । যদি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে একদিন তৃতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধে , যদি নিভেও যায় কোনদিন, যতটুকু আলো আছে, ওই সূর্য আর চাঁদে...'

তন্ময় হয়ে গান শুনছিল দুজনেই । হঠাৎ আর্তচিৎকার করে উঠলো অবনী । একটা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিয়েছে ছিনতাই কারী ।  কিছু বুঝে ওঠার আগেই রতন দেখলো অবনী রিক্সা থেকে পড়ে যাচ্ছে । একটা হাত ধরার চেষ্টা করে রতন, কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা । অবনীর মাথাটা গিয়ে ঠেকলো পিচঢালা রাস্তায় । আর ঠিক তখনি পেছন হতে বেপরোয়া আরেকটি কারের ধাক্কা লাগলো অবনীর শরীরে । কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে পড়লো রতনের সাদা শার্টে ।

[উৎসর্গঃ ডাঃ সানজানা জেরিন । চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র এই আপু কিছুদিন আগেই এমনি এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।  এখনো স্বাভাবিক হয়নি তাঁর জীবন । যদিও আমার সাথে কখনো পরিচয় হয়নি, তবুও তাঁর এই দূর্ঘটনার কথা আমি ভুলতে পারিনা ।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন