সরদার জয়েনউদ্দিনের একটা গল্প
ছোটবেলায় পড়েছিলাম । গল্পটা ছিল কিছুটা রম্য ধাঁচের । কিন্তু সেই রম্য
ধাঁচের গল্পটাই দিনে দিনে আমার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে ভয়ংকরভাবে ।
গল্পের নাম ‘টাকার মেশিন’ । এক কৌতুহলী কিশোরের গল্প । ছেলেটা শুনেছিল যে আমেরিকায় নাকি অনেক ধনী লোকেরা থাকে । তাদের অনেক টাকা । এত টাকা যে গুনে শেষ করা যায়না । কিন্তু কোনদিন সেরকম ধনী কাউকে দেখেনি বালক । হঠাত একদিন খবর পেল, বিদেশ থেকে একজন ধনী মানুষ এসেছেন সার্কিট হাউজে । শুনে পরি কি মরি করে দৌড় । তারপর প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনভাবে সে ঢুকে পড়ে ভেতরে । অনেকগুলো ঘরের কোনটাতে যে সেই ধনী লোকটা আছে তা তো জানা নেই । ভয়ে ভয়ে একটা ঘরের দরজায় উঁকি দেয় সে । ঘরটাতে একজন হাল্কাপাতলা মানুষ বসে ছিলেন । লোকটা দেখতে পেয়ে কিশোর ছেলেটাকে ডাক দেন ।
-‘বাবু, কাউকে খুঁজছো ?’
-‘হ্যা,আংকেল । শুনলাম আমেরিকা থেকে খুব ধনী একজন মানুষ এসেছেন । তাঁকে খুজছিলাম । বলতে পারেন, তিনি কোথায় আছেন ?’ ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় কিশোর।
মুচকি হেসে লোকটা বললেন, ‘এসো ভেতরে এসো । আমিই সেই লোক’ ।
কিশোর তো বিস্ময়ে হতবাক । সে বলে, ‘আপনি সেই লোক ? নাহ । আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছেন । বলুন না তিনি কোথায় আছেন ! আমি শুধু একবার তাঁকে দেখেই চলে যাবো । একদম ডিস্টার্ব করবো না’ ।
লোকটাও অবাক হয়ে বলেন- ‘কেন, তোমার বিশ্বাস হয় না আমিই সেই লোক?’
কিশোর বলে- ‘আপনি সেই লোক হলে দেখিতো আপনার হাত কয়টা ?’
‘আমার হাততো তোমার মতই দুইটি’ । হাত দুটি দেখান ধনী ভদ্রলোক ।
অবিশ্বাস বেড়ে যায় কিশোরের ।
আচ্ছা বলুনতো, আপনি কী খান ? প্রশ্ন করে সে ।
ধনী বলেন- আসলে বাপু আমার তো ডায়াবেটিস, তেমন কিছু খাইনা । এই ধরো সকালে ও রাতে দুই পিস রুটি, দুপুরে কিছু ফলমূল । এই ।
কিশোর অবিশ্বাস নিয়ে বলে, 'না না । আপনি তাহলে সেইলোক হতেই পারেন না । যার এত টাকা, তার শরীর হবে কয়েকটি হাতির সমান, তার নিশ্চয়ই কমছে কম দশটি হাত থাকবে, সেই দশহাত দিয়ে সারাদিন শুধু খাবে খাবে আর খাবে । কিন্তু আপনি তো কিছুই খান না । আমার চেয়েও কম খান !'
'আচ্ছা আপনি যদি সেই লোক হন, তাহলে সত্যি করে বলুন তো অত টাকা দিয়ে আপনি কী করেন ?'
ধনী লোক বলেন, আর বলোনা বাপু- খুব সংকটে আছি । শুনেছি আফ্রিকায় একটা তেলের খনি আবিস্কৃত হয়েছে । সেটা কিনতে চাইছি । কিন্তু কয়েকশত কোটি টাকা ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে ।
-সেই খনি কিনে কী করবেন ?
-বলো কী ? তেল উত্তোলন করে বিক্রি করবো । অনেক লাভ হবে ।
-সেই টাকা দিয়ে কী করবেন ?
-কেন, আরেকটি খনি কিনবো । তোমাদের দেশে নাকি কয়লার খনি আছে । সেগুলোও কিনতে পারি ।
-তাতে কী হবে ?
-কেন, আরো টাকা আসবে !
-আরো টাকা দিয়ে কী করবেন ?
-আরো ফ্যাক্টরি দিব ।
-আরো ফ্যাক্টরি দিয়ে কী হবে ?
-কেন, আরো টাকা আসবে !
-ওটা দিয়ে কী হবে ?
-আরো টাকা আসবে ।
-আরো টাকা দিয়ে কী হবে ?
-আরো টাকা আসবে...
কিছুক্ষণ ভেবে কিশোর বললো, আসলে আংকেল, আপনি তো মানুষ না ! আপনি তো আস্ত একটা ‘টাকার মেশিন !’
২।
সেইসময় গল্পটা আমার কাছে ছিল স্রেফ একটা মজার গল্প । আমাদের মত গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা কিশোরের পক্ষে টাকার মেশিন চেনাটা সহজ ছিলনা । আমরা চাহিবামাত্র কিছু পেতাম না, অপেক্ষা করতে হত বাবার বেতনের। আমাদের বাবাকে এখান সেখান থেকে টাকা জোগাড় করে বড় প্রয়োজন মেটাতে হত । তারপর বড় হতে হতে ধীরে ধীরে টাকার মেশিনের সাথে পরিচয় ঘটতে লাগলো আমার । তারাও আমাদের মত মানুষ, কিন্তু জীবনটা বন্দী টাকার খাঁচায় । বেশি বেশি টাকা উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য । ডাক্তারদের মধ্যেও এই সংখ্যাটা কম নয় । এদের কাউকে যদি জীবনের শেষ প্রান্তে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি সারাজীবন কী করেছেন ? হয়তো উত্তর হবে- ভালো উপার্জনের জন্য বেশি লেখাপড়া করেছেন, ভালো চাকরি-ব্যবসা করেছেন, টাকা কামিয়েছেন, সেই টাকা খেয়েছেন, হজম করেছেন, বিয়ে করেছেন, বউ-বাচ্চার জন্যে টাকা খরচ করেছেন । এইতো জীবন !
এই ধরণের মানুষের কথা চিন্তা করি আর সেই অবোধ কিশোরের মত আমিও নিজেকে প্রশ্ন করি- একজন মানুষের খাওয়ার জন্য কতটুকু খাবার প্রয়োজন ? একজন মানুষের থাকার জন্য কতটুকু জায়গা প্রয়োজন ? একজন মানুষের শরীর ঢাকার জন্য কতগুলো কাপড় প্রয়োজন ?
মন চায় টাকার পেছনে অন্ধের মত ছুটে চলা মানুষদের ধরে ধরে নকুলের গান শোনাই ।
কষ্ট করে দিনে রাইতে
কত টাকা করছো কামাই
অত টাকা কেমনে নিবা
কাফনের তো পকেট নাই...
বাড়ি গাড়ি আহামরি সোনাদানা ভরিভরি
টিভি ফ্রিজ চেন ঘড়ি
নেতাগিরি বাহাদুরি উমিদারি জমিদারি পড়ে রইবো
কিচ্ছা খতম হইবো...
কিচ্ছা খত...ম হই...বো ।
খোদার কাছে এই ফরিয়াদ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকার পেছনে যেন কখনো না ছুটি । সামান্য রিযিকের ব্যবস্থা হলে বাকি সময়টা যেন কাজ করতে পারি মানুষের কল্যাণে । মানুষকে যেন ডাকতে পারি হকের পথে। কখনো যেন না হই টাকার মেশিন ।
গল্পের নাম ‘টাকার মেশিন’ । এক কৌতুহলী কিশোরের গল্প । ছেলেটা শুনেছিল যে আমেরিকায় নাকি অনেক ধনী লোকেরা থাকে । তাদের অনেক টাকা । এত টাকা যে গুনে শেষ করা যায়না । কিন্তু কোনদিন সেরকম ধনী কাউকে দেখেনি বালক । হঠাত একদিন খবর পেল, বিদেশ থেকে একজন ধনী মানুষ এসেছেন সার্কিট হাউজে । শুনে পরি কি মরি করে দৌড় । তারপর প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনভাবে সে ঢুকে পড়ে ভেতরে । অনেকগুলো ঘরের কোনটাতে যে সেই ধনী লোকটা আছে তা তো জানা নেই । ভয়ে ভয়ে একটা ঘরের দরজায় উঁকি দেয় সে । ঘরটাতে একজন হাল্কাপাতলা মানুষ বসে ছিলেন । লোকটা দেখতে পেয়ে কিশোর ছেলেটাকে ডাক দেন ।
-‘বাবু, কাউকে খুঁজছো ?’
-‘হ্যা,আংকেল । শুনলাম আমেরিকা থেকে খুব ধনী একজন মানুষ এসেছেন । তাঁকে খুজছিলাম । বলতে পারেন, তিনি কোথায় আছেন ?’ ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় কিশোর।
মুচকি হেসে লোকটা বললেন, ‘এসো ভেতরে এসো । আমিই সেই লোক’ ।
কিশোর তো বিস্ময়ে হতবাক । সে বলে, ‘আপনি সেই লোক ? নাহ । আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছেন । বলুন না তিনি কোথায় আছেন ! আমি শুধু একবার তাঁকে দেখেই চলে যাবো । একদম ডিস্টার্ব করবো না’ ।
লোকটাও অবাক হয়ে বলেন- ‘কেন, তোমার বিশ্বাস হয় না আমিই সেই লোক?’
কিশোর বলে- ‘আপনি সেই লোক হলে দেখিতো আপনার হাত কয়টা ?’
‘আমার হাততো তোমার মতই দুইটি’ । হাত দুটি দেখান ধনী ভদ্রলোক ।
অবিশ্বাস বেড়ে যায় কিশোরের ।
আচ্ছা বলুনতো, আপনি কী খান ? প্রশ্ন করে সে ।
ধনী বলেন- আসলে বাপু আমার তো ডায়াবেটিস, তেমন কিছু খাইনা । এই ধরো সকালে ও রাতে দুই পিস রুটি, দুপুরে কিছু ফলমূল । এই ।
কিশোর অবিশ্বাস নিয়ে বলে, 'না না । আপনি তাহলে সেইলোক হতেই পারেন না । যার এত টাকা, তার শরীর হবে কয়েকটি হাতির সমান, তার নিশ্চয়ই কমছে কম দশটি হাত থাকবে, সেই দশহাত দিয়ে সারাদিন শুধু খাবে খাবে আর খাবে । কিন্তু আপনি তো কিছুই খান না । আমার চেয়েও কম খান !'
'আচ্ছা আপনি যদি সেই লোক হন, তাহলে সত্যি করে বলুন তো অত টাকা দিয়ে আপনি কী করেন ?'
ধনী লোক বলেন, আর বলোনা বাপু- খুব সংকটে আছি । শুনেছি আফ্রিকায় একটা তেলের খনি আবিস্কৃত হয়েছে । সেটা কিনতে চাইছি । কিন্তু কয়েকশত কোটি টাকা ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে ।
-সেই খনি কিনে কী করবেন ?
-বলো কী ? তেল উত্তোলন করে বিক্রি করবো । অনেক লাভ হবে ।
-সেই টাকা দিয়ে কী করবেন ?
-কেন, আরেকটি খনি কিনবো । তোমাদের দেশে নাকি কয়লার খনি আছে । সেগুলোও কিনতে পারি ।
-তাতে কী হবে ?
-কেন, আরো টাকা আসবে !
-আরো টাকা দিয়ে কী করবেন ?
-আরো ফ্যাক্টরি দিব ।
-আরো ফ্যাক্টরি দিয়ে কী হবে ?
-কেন, আরো টাকা আসবে !
-ওটা দিয়ে কী হবে ?
-আরো টাকা আসবে ।
-আরো টাকা দিয়ে কী হবে ?
-আরো টাকা আসবে...
কিছুক্ষণ ভেবে কিশোর বললো, আসলে আংকেল, আপনি তো মানুষ না ! আপনি তো আস্ত একটা ‘টাকার মেশিন !’
২।
সেইসময় গল্পটা আমার কাছে ছিল স্রেফ একটা মজার গল্প । আমাদের মত গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা কিশোরের পক্ষে টাকার মেশিন চেনাটা সহজ ছিলনা । আমরা চাহিবামাত্র কিছু পেতাম না, অপেক্ষা করতে হত বাবার বেতনের। আমাদের বাবাকে এখান সেখান থেকে টাকা জোগাড় করে বড় প্রয়োজন মেটাতে হত । তারপর বড় হতে হতে ধীরে ধীরে টাকার মেশিনের সাথে পরিচয় ঘটতে লাগলো আমার । তারাও আমাদের মত মানুষ, কিন্তু জীবনটা বন্দী টাকার খাঁচায় । বেশি বেশি টাকা উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য । ডাক্তারদের মধ্যেও এই সংখ্যাটা কম নয় । এদের কাউকে যদি জীবনের শেষ প্রান্তে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি সারাজীবন কী করেছেন ? হয়তো উত্তর হবে- ভালো উপার্জনের জন্য বেশি লেখাপড়া করেছেন, ভালো চাকরি-ব্যবসা করেছেন, টাকা কামিয়েছেন, সেই টাকা খেয়েছেন, হজম করেছেন, বিয়ে করেছেন, বউ-বাচ্চার জন্যে টাকা খরচ করেছেন । এইতো জীবন !
এই ধরণের মানুষের কথা চিন্তা করি আর সেই অবোধ কিশোরের মত আমিও নিজেকে প্রশ্ন করি- একজন মানুষের খাওয়ার জন্য কতটুকু খাবার প্রয়োজন ? একজন মানুষের থাকার জন্য কতটুকু জায়গা প্রয়োজন ? একজন মানুষের শরীর ঢাকার জন্য কতগুলো কাপড় প্রয়োজন ?
মন চায় টাকার পেছনে অন্ধের মত ছুটে চলা মানুষদের ধরে ধরে নকুলের গান শোনাই ।
কষ্ট করে দিনে রাইতে
কত টাকা করছো কামাই
অত টাকা কেমনে নিবা
কাফনের তো পকেট নাই...
বাড়ি গাড়ি আহামরি সোনাদানা ভরিভরি
টিভি ফ্রিজ চেন ঘড়ি
নেতাগিরি বাহাদুরি উমিদারি জমিদারি পড়ে রইবো
কিচ্ছা খতম হইবো...
কিচ্ছা খত...ম হই...বো ।
খোদার কাছে এই ফরিয়াদ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকার পেছনে যেন কখনো না ছুটি । সামান্য রিযিকের ব্যবস্থা হলে বাকি সময়টা যেন কাজ করতে পারি মানুষের কল্যাণে । মানুষকে যেন ডাকতে পারি হকের পথে। কখনো যেন না হই টাকার মেশিন ।
আদম সন্তানের যদি দুটি উপত্যকাপূর্ণ ধনসম্পদ থাকে তবুও সে তৃতীয়টার আকাঙ্ক্ষা করবে। আর মাটি ছাড়া লোভী আদম সন্তানের পেট ভরবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি তওবা করবে, আল্লাহ তা'আলা তার তওবা কবুল করবেন। (আল হাদীস)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন