এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

একটি শিরোনামহীন গল্প

কাঁপা কাঁপা হাতে কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে প্রায় এক ঘন্টা ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে শানু । যেন নিজের মৃত্যুদন্ডের আদেশে স্বাক্ষর করেছে সে নিজেই । মৃত্যু !  মৃত্যুর কথাও কি তার মনে আসেনি ? এসেছিল । গত কয়েকটা দিন , কয়েকটা রাত তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের সাথে । বারবার মনে হয়েছে, মরে গেলেই হয়তো ভালো হবে ! কতবার মনে হয়েছে , নীল ওড়নাটা কাজে লাগাবে । খুব কি কঠিন কাজটা ? সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ফ্যানটার সুইচ অফ করতে হবে । তারপর একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে ওড়নাটা ফ্যানের সিলিং এর সাথে বেঁধে নিলেই কাজ শেষ । শুধু ঝুলানো প্রান্তটা গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে লাথি মেরে চেয়ারটা সরানোই বাকি থাকবে । সব শেষ হয়ে যাবে মুহূর্তেই ।
শেষ হবে কি ? পরক্ষণেই সে প্রশ্নটাও এসেছে মনে । শেষ যদি হত , কতইনা ভালো হত !  কিন্তু তা তো হবেনা । মৃত্যুই যে সবকিছুর শেষ নয় এতটুকু বিশ্বাস আছে শানুর । আত্মহত্যা করা মহাপাপ , নিশ্চিতভাবে অনন্তকাল দোযখে কষ্ট পেতে হবে । কারনটাও জানা আছে শানুর । আত্মহত্যা করা মানে সৃষ্টিকর্তার ওপর থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে যাওয়া । যার আরেক অর্থ দাঁড়ায় সৃষ্টিকর্তাকেই অস্বীকার করা । শেষমেষ আর ওড়নাটাকে ওভাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি শানু । পৃথিবীতে ক'টা দিনই বা জীবন । অনন্তকাল কষ্টভোগের চেয়ে পৃথিবীতে ক'টা দিন কষ্ট করাই ভালো । কে জানে , এই হয়তো ওর ভাগ্যে ছিল । আর তাছাড়া নিজেকে শেষ করে দিয়ে ও নিজে হয়তো আপাতত মুক্তি পেত , কিন্তু বাবা মা ? তাঁরা কী নিয়ে বেঁচে থাকবেন ? ওর চেয়ে কী তাঁদের কষ্ট কম হচ্ছে ? নিশ্চয়ই তাঁদের অন্তর পুড়ে যাচ্ছে । হয়তো তাঁদেরও ইচ্ছে করছে মেঘনায় ঝাপিয়ে পড়ে এ দুনিয়া ছেড়ে যাবার । হয়তো শানুর কথা ভেবেই পারেননি , নিজে যেমন পারেনি শানু ।
আচ্ছা ওরা কি পারতো না , রাতের আঁধারে সবাই মিলে দূরে কোথাও চলে যেতে ? ওই সন্ত্রাসীরা  কি এতটাই ক্ষমতাশালী যে সবখান থেকেই খুঁজে বের করতে পারতো ? অথবা সবাই না হোক , শানু একাই কি কোথাও চলে যেতে পারতো না ?
পরক্ষণেই মনে হলো , একা হয়তো পালিয়ে বাঁচতে পারতো কিন্তু বাবা মা লাশ হয়ে যেতেন ক'দিনেই । আর পালিয়ে বাঁচতে যে পারতো তারই বা নিশ্চয়তা কী ? কাকে বিশ্বাস করা যায় এই নষ্ট সমাজে ? হয়তো ওকে শিকার হতে হত অন্য কোন হায়েনার । হয়তো ওর স্থান হত কোন এক নষ্টপল্লীতে । কে জানে ? তবুও সে অনিশ্চয়তাকে বেছে নেয়াই হয়তো ভালো ছিল । এখন আর সেকথা ভেবে লাভ কী ? কাবিন নামায় স্বাক্ষর তো করেই ফেলেছে শানু ।

আয়নার পর্দাটা ফ্যানের বাতাসে উড়ছে । নিজের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে আয়নায় । নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে উঠছে শানু । ধক করে উঠছে বুক । এই সুন্দর মুখটাই কাল হলো ওর জীবনে ? একটু সুন্দর হবার জন্যে , মেয়েরা কতকিছুই না করে ! নিজের সৌন্দর্যের জন্য মনে মনে একটু ভালোলাগা , একটু অহংকার কি ওরও ছিলনা ? অন্যদের মুখে ওর সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে গর্ব হতনা শানুর ? অথচ আজ ! আজ মনে হচ্ছে নিগ্রো হওয়াই ভালো ছিল !  দূর গাঁয়ের কোন পাতাকুড়ানি মেয়ে হওয়াই ভালো ছিল । হায় ,  এই যদি ছিল ভাগ্যে , এরচেয়ে হয়তো ক্যান্সার হয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল ! এখন তো মনের ক্যান্সারে ধুঁকে ধুঁকে কাটাতে হবে বাকি জীবনটা ।

নিজের ওপর খুব রাগ হয় শানুর । রাগ হয় বাবা মার ওপরও । কী দরকার ছিল শালিস করতে একজন সন্ত্রাসীর কাছে যাবার ? কী দরকার ছিল ওকে সাথে নেবার ? শানু যদি সেদিন জেলগেটে না যেত , আজ হয়তো এমন হতনা ।

***
ঘটনা শানু জানতে পারে অনেক দেরিতে । যখন সব শেষ হয়ে গেছে ।  রাস্তার ধারে ওদের তিনবিঘা জমি নিয়ে বহুদিন ধরেই ঝামেলা চলছিল মোজাফফর সাহেবের সাথে । মোজাফফর সাহেব জাল দলিল দেখিয়ে জমি দখল করতে চেয়েছিল । দখল করার জন্য মোজাফফর সাহেব যোগাযোগ করে বিপু বাহিনীর সাথে । এই জেলা শহরে সবকিছু চলে বিপু ও তার বাবার কথায় । বিপুর বাবা এই জেলা শহরের পৌরসভা মেয়র ।  বিপু নিজে ফাঁসির আসামী । বহুবছর ধরে জেলবন্দি ।

প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা হত্যার দায় প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির আদেশ হয়েছিল তার । সরকার পরিবর্তন হওয়ায় নিজদলের প্রাক্তন নেতা, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ক্ষমা করিয়ে নিয়েছে । নিজে বন্দী থাকলে কী হবে , এই শহরের আন্ডারগ্রাউন্ড চলে বিপুর নির্দেশে । জেলখানা থেকেই সে পরিচালনা করে তার সন্ত্রাসী বাহিনী । পুলিশবাহিনীও ওদের কাছে অসহায় ।
উপায় না দেখে জমি বাঁচাতে বিপুর শরনাপন্ন হয়েছিল শানুর পরিবার । জেলখানায় দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল বিপুর সাথে । বাবা মায়ের সাথে গিয়েছিল শানুও । কিছুক্ষণ কথা বলেই বিপু শানুর বাবাকে বলে দেয় , ‘যান আপনার জমিতে কেউ হাত দিতে পারবেনা । দায়িত্ব আমি নিলাম’  । সেদিন বিপু  বারবার তাকাচ্ছিল শানুর দিকে । ওর অস্বস্তি লাগছিল । তবু খুশি মনেই বাড়ি ফিরেছিল ওরা ।
সেদিন কে জানতো , জেলবন্দী ফাঁসির আসামি এভাবে বিয়ে করতে চাইবে ? দু’দিন পরে শানুর বাবার কাছে খবর আসে মেয়রের কাছ থেকে । বিপুর বাবা মেয়র সাহেব বলেন , ‘মোক্তার , বিপুর সাথে বিয়ে দিতে হবে তোমার মেয়ে শানুর ! নাহলে শানুর বা তোমার পরিবারের কী হবে সে ব্যাপারে আমি কোন দায়দায়িত্ব নিতে পারবো না’ ।

সেই জবাব আজকে দিতে হলো শানুকে কাবিন নামায় সাইন করে ! নিজের চেয়ে বিশ বছরের বড় জেলখানায় বন্দী একজন সন্ত্রাসী আজ থেকে ওর স্বামী ! যে ফাঁসির দড়ি চেপে বসার কথা ছিল বিপুর গলায় , আজ অদৃশ্য সে  ফাঁসির দড়ি যেন চেপে বসেছে শানুর গলায় ! মেয়ে হয়ে জন্মানোই কি ওর অপরাধ ছিল ? এ থেকে কবে মুক্তি মিলবে ? মৃত্যুর আগে আদৌ কি কোনদিন মুক্তি মিলবে ? যদি ছাড়াছাড়ি হয় , সেটাকে কি মুক্তি বলা যাবে ?  শানুর ভাবনা বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করে ।
পূনর্জন্মে বিশ্বাস থাকলে শানু হয়তো ভাবতে পারতো , আগের জন্মে নিশ্চয় বড় কোন পাপ করেছিল সে ! নইলে এমন হবে কেন ? জীবনটা হঠাৎ করেই পানসে ধূসর হয়ে গেল কেন ? মুক্ত স্বাধীন পছন্দের কাউকে হৃদয়ের রাজা বানাবার স্বপ্নতো শানুরও ছিল ! এভাবে কেন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল সব ? স্বপ্নেও তো কখনো সে এমন কোন নায়কের কথা কল্পনা করেনি !

কাজী চলে যাবার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে । কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয়ই চাউর হয়ে যাবে খবরটা । কেউ জানবেনা কোন্‌ পরিস্থিতিতে, কতটা অসহায়ত্বের মুখে কাবিন নামায় সাইন করতে হয়েছে শানুকে । সবাই ছিঃছিঃ করবে । একটা লম্পট খুনি সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেছে ঐ মেয়েটা ! ছিঃছিঃ । মাথা খারাপ নাকি ?

সবকিছু এলোমেলো লাগছে শানুর । আশেপাশে কে কে আছে সে ব্যাপারে কোন ধারণা নেই ওর । চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে । অস্পষ্ট কিছু একটা কানে এলো ,  কে যেন ডাকছে । শানু শানু , এই শানু । কী হলো ? এই ওকে ধর , পড়ে যাচ্ছে তো ।
জ্ঞান হারাবার আগে শেষ মুহূর্তে কাঁধে কোন একজনের হাতের ছোঁয়া অনুভব করে শানু ।

***
ফুটনোটঃ আচছা , বিশ বছর বয়সের একটা মেয়ে কি  জেলখানায় বন্দী  দ্বিগুন বয়সের একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে সানন্দে বিয়ে করবে ? লক্ষীপুরের মেয়র খুনি তাহেরের ছেলে খুনি সন্ত্রাসী বিপ্লব জেলগেটে বিয়ে করেছে শুনে প্রশ্নটা আমার মনে জেগেছিল । ভেবেছিলাম , নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘাপলা আছে । দু’দিন আগে একটা মাধ্যমে জানলাম সেই ঘাপলাটা । মাধ্যম নিশ্চিত করে বলতে পারেনি , তবে এরকমটাই হওয়া স্বাভাবিক । আসলে মেয়ের পরিবার বাধ্য হয়েছে এই বিয়েতে । এছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিলনা । ওই বিয়ে হয়তো কাগজপত্রে ঠিক আছে , কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি হয়েছে আরেকটি জঘন্য অপরাধ । একটা অণুগল্পে ঘটনাটা তুলে রাখা ছাড়া এই মুহূর্তে ঐ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ঘৃণা জানানোর কিংবা ঐ হতভাগী ও তার পরিবারকে স্বান্তনা দেবার জন্য আমার আর কীইবা উপায় আছে ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন