এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১১

জনগন ও একজন ডাক্তার- ৫ঃ ডাক্তার বাইরে প্রাকটিস করেন কেন ?

ডাক্তার বাইরে প্রাকটিস করেন কেন ? প্রশ্নটা এভাবেই আসে । শিক্ষা এবং চিকিত্‍সা মানুষের মৌলিক অধিকার । কোন মানুষই যেন শিক্ষা এবং চিকিত্‍সা থেকে বঞ্চিত না হয় সেরকমটাই হওয়া উচিত্‍ । চাই সে ধনী হোক কিংবা কপর্দকহীন হোক । শিক্ষা এবং চিকিত্‍সার বেসরকারিকরণ আমি সমর্থন করিনা । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার ? জনগনের ভাবগতিক দেখে মনে হয় এটার দায়িত্ব 'ডাক্তারের' !

এত এত ক্লিনিক , ডায়াগনোস্টিক সেন্টার গড়ে উঠছে । সেগুলোতে অতিরিক্ত খরচ ও নানা অনিয়মের কথা বলার সময় অনেকেরই গলা চড়ে যায় , যদিও রোগীরও অভাব হয়না । সমস্যাটা হলো . এজন্য ডাক্তারকেই দায়ী করা হয় ।
জনগনের মৌলিক অধিকার চিকিত্‍সা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের । ডাক্তারের নয় ।
এজন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেটা সরকারকেই নিতে হবে । যারা সরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়েছেন তাদের নির্ধারিত সময়ে দায়িত্ব ফাঁকি দেয়াটা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয় । কিন্তু এর বাইরে প্র্যাকটিস করতে ডাক্তারদের বাধ্য করছে সরকারই ! চার বছরে বিবিএ কোর্স করে কিংবা ইন্জিনিয়ারিং এর বন্ধুরা যখন চল্লিশ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি শুরু করে তখন ছয় বছরে এমবিবিএস কোর্স শেষ করা একজন ডাক্তার বেকার ! স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারও চাইবে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা আয় করতে । বিবিএ করা বন্ধু তার অফিসে সময় দেয় ৮ ঘন্টা । একই পরিমাণ উপার্জন করতে সদ্য ডাক্তারকে দৈনিক ১৬ ঘন্টা ডিউটি দিতে হবে ক্লিনিকে ।
এভাবেই একজন নবীন ডাক্তারের মনে প্রথমেই একটা 'জেদী' এবং পুঁজিবাদী চেতনার বীজ বপিত হয় । ইন্টার্নশীপ শেষ করার পরেই যখন একজন ডাক্তার নিজের অবস্থান , নিজের এতদিনের কষ্টগুলোর কথা অন্য বন্ধুদের অবস্থার সাথে তুলনা করেন তখন তাঁর মনে একটা কঠোরতা তৈরি হয় । 'সেবা'র বিষয়টা তাঁর কাছে
একটা প্রহসনের মত মনে হয় তখন । কারণ , সেবার কথাটা শুধুমাত্র 'ডাক্তার' শব্দটার সাথেই উচ্চারিত হয় । ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ এর ব্যাপারে 'সেবা'র কথাটা কি শোনা যায় ?


সবাই সেবার ব্রত নিয়ে ডাক্তার হয় এটাই জনগনের ধারণা এবং বিশ্বাস । অথবা ভাবটা এমন যে ডাক্তার হলেই তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সেবার মনোভাব রাখতেই হবে । ব্লগে একজনের কমেন্ট দেখলাম এরকম 'সেবার জন্য ডাক্তার হয়েছেন , এখন আবার ফি চান কেন ?' মামা নয় , এ যেন খালার বাড়ির আব্দার ! স্বভাবতই প্রশ্ন করতেই পারি , যারা বিবিএ করেছেন তারা কি সেবার ব্রত নিয়ে করেছেন ? যারা ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এ পড়েন তারা কি সেবার ব্রত নিয়ে পড়েন ? অবশ্যই না ।

ডাক্তার সেবা দিতে বাধ্য ! গরীবদের ফ্রি চিকিত্‍সা করাতে বাধ্য ! বাংলাদেশের কোন দোকানে গরীবদের বিনামুল্যে দুইটাকার তেল দেয়া হয় ? চিনি দেয়া হয় ?
গরীব বলে কাকে বিনামুল্যে চাল ডাল দেয়া হয় ?
ডাক্তাররা সেবার মনোভাব রাখবেননা কিংবা মানুষকে সেবা দেবেননা আমি এমনটা বলছিনা । তবে ডাক্তার সেবা দিতে বাধ্য , জনগনের এমন ধারনার অসাড়তার কথা বলছি । খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিত্‍সা মানুষের মৌলিক অধিকার । এগুলো নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার , কোন নির্দিষ্ট পেশার মানুষের নয় । ডাক্তারি প্রথমত একটা পেশা , এরপর যোগ হতে পারে জনকল্যানের ব্রত । বিস্তারিত পরে লিখব , আজ এটুকুই বলছি যে এখন পর্যন্ত ডাক্তাররাই সবচেয়ে বেশি জনকল্যান করেন ।

বিদেশে তো বটেই , বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়োগ দেয়া হয় তিন চার লাখ টাকা বা তারও বেশি বেতনে । শর্ত থাকে তাঁরা বাইরে প্র্যাকটিস করবেন না । ,
ঐ একই মানের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সরকারি হাসপাতালে বেতন পান ত্রিশহাজার টাকা । তাহলে তিনি বাইরে প্রাকটিস করতে বাধ্য হবেন না কেন ?

এইবার সেই মোক্ষম যুক্তির অবতারণা করবেন অনেকেই । আপনারা জনগনের টাকায় পড়াশোনা করেন ! এই যুক্তিটি শোনার জন্যই আমি যেন মুখিয়ে ছিলাম !
তো ভাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কার টাকায় পড়াশোনা করেন ? বুয়েট চুয়েটের ছাত্ররা ? তাদের বেলায় তো আপনাকে 'জনগনের পক্ষে' খুঁজে পাইনা ! বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কী বলবেন ? তারা কার টাকায় পড়াশোনা করে ?

আরেকটি বিষয় খোলাসা করা দরকার । স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট দেয়া হয় তা কিন্তু শুধু মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য খরচ করা হয়না ! এর প্রায় পুরোটাই জনগনের জন্যই ব্যয় হয় । কয়েকটি বেসিক সাবজেক্ট ছাড়া বাকি সকল সাবজেক্টের টিচারগনকে হাসপাতালে ডিউটি করতে হয় । জনগনের সেবার জন্যই তো নাকি !
বাজেটের সিংহভাগ ,বাঘভাগ কিংবা গন্ডারভাগই ব্যয় হয় হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে । মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য নয় ।

আরেকটি বিষয় লিখেই আজকের পর্বের ইতি টানবো । সেদিন হাসপাতালের করিডোরে একজনকে আক্ষেপ করতে দেখলাম । তার রোগী নাকি হাসপাতালে বেড পাচ্ছেনা । ডাক্তাররা বড্ড বজ্জাত ! জনগনের ধারণা , রোগী বেড না পেলে সেটাও ডাক্তারের দোষ ! আরে ভাই ডাক্তারের কাজ চিকিত্‍সা দেয়া , সিট ম্যানেজমেন্ট না । আর সরকারি হাসপাতালে এমনিতেই সিট সংকট । চমেক হাসপাতালে ১২00 বেড , প্রতিদিন চিকিত্‍সা নেয় গড়ে ২০০০ রোগী । এখানে ডাক্তার কী করবে ? এই সাধারণ বিষয়গুলো যদি কেউ না বোঝে ,সেটা আসলেই কষ্টের নয় কি ?


 শনিবার, আগস্ট 27, 2011

বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১১

বিপ্লবী কুম্ভকর্ণ


এই রাত ভোর হবে
আবৃত্তি করে অনেকেই । এরপর হাই তোলে
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা ঢাকতেও ভুলে যায়
কখন ঘুমিয়ে পড়ে -
জানতেও পারেনা কেউ ।

সুবহে সাদিকের আভাস পেয়ে
ডেকে ওঠে ভোরের পাখিরা
এরপর ভোর হয় ; দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে পটে
মহান বিপ্লবী কবি তখন স্বপ্নে বিভোর
পা ছোড়েন তিনি শুন্যে
মুষ্ঠিবদ্ধ করেন হাত
তাঁর কন্ঠে আচমকা শোনা যায়
কালজয়ী কাব্য-
'এইরাত ভোর হবে' ।
হবেই হবে ।



বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১১

জনগন ও একজন ডাক্তার -৪ ঃ 'ডাক্তাররা রোগীকে আইসিইউ তে পাঠায় টাকার জন্য !'

মাসুদ সাহেব আজকের মত দুঃখ আর কখনো পান নাই । তিনি ভাবছেন , এখন থেকে তিনিও স্বার্থপর হয়ে যাবেন । কারো কাছে ফি কম নিবেন না । রাত বিরাতে নিজের সুখ দুঃখ ভুলে কারো চিকিত্‍সা করারও প্রয়োজনবোধ তিনি করছেন না । এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ যাদের নেই , তাদের জন্য অযথা কষ্ট করবেন কেন তিনি ? মাসুদ সাহেব গরীব পরিবারের সন্তান । অনেক কষ্টের মাঝে পড়ালেখা করেছেন । ডাক্তার হয়েছেন । সম্পূর্ণ বিনামুল্যে চিকিত্‍সাসেবা দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় । তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি যথাসম্ভব কম খরচে মানুষের চিকিত্‍সা করবেন ।
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় মাসুদ সাহেবের এক বন্ধু তাঁর এই ইচ্ছার কথা শুনে যা বলেছিলেন তার বাস্তব প্রমাণ হাতে হাতে পেয়ে আজ সেকথা মনে পড়লো তাঁর । তাঁর বন্ধু বলেছিলেন একটা প্রবাদের কথা ।
জনগন যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন ডাক্তারকে 'বাবা' ডাকে । যেকোন মুল্যে সুস্থ হতে চায় । এরপর সুস্থ হয়ে গেলে প্রথম এক মাস খুব কৃতজ্ঞ থাকে । পথেঘাটে দেখা হলে ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়ে । দ্বিতীয় মাসে দেখা হলে শ্রদ্ধার সাথে সালাম দেয় । তৃতীয় মাসে দেখা হলে কোনমতে শ্রদ্ধাভক্তি বিহীন সালাম দিয়ে চলে যায় । ছয় মাসের পর দেখা হলে মুখরক্ষার খাতিরে সালাম দেয় । আর ডাক্তার চোখের আড়াল হলেই বলে 'শালা ডাক্তার । আমার কাছে ২০০ টাকা ফি নিছিলো !'
কাশেম সাহেব যেদিন রাত তিনটায় ডাঃ মাসুদকে ডেকে ঢোক গিলতে গিলতে কোনমতে তার ছেলের অসুস্থতার কথা বলছিলেন সেই রাতের কথাও মনে পড়লো । একটা জরুরী কাজ সেরে এসে তিনি ঘন্টাখানেক আগে ঘুমিয়েছিলেন মাত্র । এরই মধ্যে কাশেম সাহেব এসে ডাক দিয়েছেন । ডাঃ মাসুদ তাড়াতাড়ি উঠে ব্যাগটা নিয়ে গেলেন কাশেম সাহেবের বাসায় । ছেলেটাকে দেখে ওষুধপত্র দিলেন । এরপরেও কয়েকবার তিনি নিজে গিয়ে ছেলেটার খোঁজখবর নিয়েছেন । ফিও নিয়েছেন যথেষ্ট কম । সে মাস পাঁচেক আগের কথা । একটু আগে চায়ের দোকানে চা খেতে বসে শুনলেন কাশেম সাহেবের কথা । কাশেম সাহেব তাঁর নামে কটুক্তি করে বলেছেন , 'ডাঃ মাসুদ চিকিত্‍সার নামে মানুষ ঠকাচ্ছেন !
তিনি আমার কাছে এতটাকা বিল নিয়েছিলেন !'
আপনি যতকিছুই করেন না কেন , জনগন শেষমেষ মনে রাখবে আপনার ফি-র অংকটা । তা যত কমই হোকনা কেন ! মাসুদ সাহেব আজ সিদ্ধান্ত নিলেন , খুব গরীব হলে একেবারে বিনামুল্যে চিকিত্‍সা দেবেন আর বাকিদের ক্ষেত্রে যথাযোগ্য পরিমানেই ফি নিবেন । নো মার্সি ।

অকৃতজ্ঞতার আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি । খুব কষ্ট পাই এধরনের কথায় । আমার এক বন্ধু একদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলো , তাকে নাকি কে একজন বলেছে 'ডাক্তাররা রোগীকে আইসিইউ তে পাঠায় টাকার জন্য !'
শুনে তো আমার ঙঞ অবস্থা । এ কীরকম অজ্ঞতা আর অকৃতজ্ঞতা ? আইসিইউ (Intensive care unit) একটি বিশেষায়িত চিকিত্‍সাব্যবস্থা । মুমূর্ষু রোগীদের এখানে নিবিড় পরিচর্যা ও তত্বাবধানে রাখা হয় । দেহের প্রধান প্রধান অংশগুলি (Vital organ) যখন প্রায় অক্ষম হয়ে পড়ে তখন সেগুলোকে কৃত্রিম সহায়তা (Artificial support) দিয়ে সক্রিয় রাখা হয় । এর মাধ্যমে অনেকেই বলতে গেলে 'জীবন ফিরে পান' । ডাক্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে রোগীর কষ্টলাঘব এবং যথাসম্ভব দ্রুত রোগ নিরাময় । স্বভাবতই এখানে খরচ কিছুটা বেশি হয় । এই অতিরিক্ত খরচটা কিন্তু ডাক্তারের পকেটে যায়না । ডাক্তার তার নির্দিষ্ট বেতন-ফি টাই পান । এখন কেউ যদি বলে অতিরিক্ত টাকার জন্য 'ডাক্তার' রোগীকে আইসিইউ তে পাঠান , এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা আর কী হতে পারে ? আর ডাক্তার কি জোর করে আপনাকে চিকিত্‍সা দেয় ? আপনি তো ডাক্তারের কাছে না গেলেও পারেন নাকি ?


 বুধবার, আগস্ট 10, 2011

মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০১১

এই বর্ষায়

বৃষ্টির সাথেই যেন মিশে যায় বারবার
হৃদয়ের আকুলতা
এই বর্ষায় ।

ভেজা খড়ের চালার সোঁদা গন্ধ
আহ্বান করে হয়তোবা জীবনের প্রারম্ভিকতাকেই
আর চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলি
মনে হয় যেন সৃষ্টির আদিম তরল !

হুহু বাতাস বাতায়ন পথে আসে
মনটাকে নিয়ে যায় ভেজা আকাশের দিঘীতে
সেখানে উথাল পাথাল প্রেম
সৃষ্টি আর স্রষ্টার ।

বৃষ্টির সাথেই যেন মিশে যায় বারবার
গহন অন্তর
এই বর্ষায় ।

নিরন্তর টুপটাপ শব্দ
আর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ডাক
জানিয়ে যায় কী এক অবর্ণন আমন্ত্রণ ।
সে আবেগকে প্রশ্রয় দেয় সময়ও
সময়ের প্রয়োজনে
তবুও থমকে থাকি , সময়ের অপেক্ষায় !

বৃষ্টিভেজা ঘাসফুলগুলি মুচকি হাসে
'তুমি কৃষক ,
নিষ্ক্রীয় কেন লাঙ্গল তোমার ?
কর্ষণ করো ভেজা মাটি ; বপন করো বীজ
বর্ষাই তো প্রকৃত সময় !'

অতঃপর
বৃষ্টির সাথেই নিয়ত মিশে যায়
প্রণোদিত অতৃপ্ত হৃদয়
এই বর্ষায় ।


 মঙ্গলবার, আগস্ট 9, 2011

রবিবার, ৭ আগস্ট, ২০১১

জনগন ও একজন ডাক্তার -৩ঃ নাপিত আর ডাক্তার একই তো নয়

নাপিত আর ডাক্তার একই তো নয়
কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশান !
বুঝতেই পারছেন ,খুবই জনপ্রিয় একটি গানের দুটি লাইনের প্যারোডি । পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গায়ক নচিকেতার 'সামাজিক গঠনমুলক' হিসেবে খ্যাত গানগুলির একটি হলো 'ও ডাক্তার' গানটি । বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় । শুনতেও খারাপ লাগেনা বটে ! আমাদের মহান জনগনের কাছে এই গানটি একটি মোক্ষম অস্ত্র । যতজনের সাথে মিশেছি তার একটা বৃহত্‍ অংশ উপদেশ দিতে ভোলেননি 'ডাক্তারি পড়ছো , ভালো । এখনতো ডাক্তার আর কসাইর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই । তুমি যেন ওরকম না হও ।' কেউ কেউ আবার গানটি হেড়ে গলায় গেয়ে শোনানোর চেষ্টা করে । তারা হয়তো এতেই আনন্দ পায় । হায়রে জনগন ! কেযে কিসে আনন্দ পায় বোঝা মুশকিল । মুচকি হেসে বলি , 'ঠিক আছে । ভবিষ্যতে কখনো জ্বর হলে আমাকে আর ফোন করিয়েন না । কসাইকেই করিয়েন ।' তখন আবার মুখটা মলিন করে বলেন , 'না আমি আসলে ওটা বোঝাতে চাইনি !' যাকগে , উনারা যে কী বোঝেন আর কীইবা বোঝাতে চান সেটা বোঝার চেষ্টা করে মাথায় অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর কোন যৌক্তিকতা আমি এইমুহূর্তে দেখছি না ।
যাহোক , গোড়ার কথায় ফিরে যাই ।
কসাই এবং নাপিতরা অনেক আগে থেকেই ধারালো বস্তু ব্যবহার করে । আসলে তাদের কাজটাই এমন যে ধারালো উপকরণই প্রধানত দরকার ।
একসময় , চিকিত্‍সা ছিল শাস্ত্রের পর্যায়ে । চিকিত্‍সাবিদ্যা তখনো বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি । তখনকার দিনগুলোতে এই কসাই আর নাপিতরা ছিল জনগনের জন্য 'বিশিষ্ট সার্জন' । জনগন যেসব সমস্যাকে মনে করত 'কেটে ফেলার মত' সেগুলোর জন্য নাপিতের দোকানে যেত । যেমন , ফোড়া হলে নাপিত সেটা ছিদ্র করে পুজ বের করে দিত ইত্যাদি । এরপর আবিস্কৃত হলো মানবদেহের বিভিন্ন কার্যকলাপের গতিপ্রকৃতি । আবিস্কৃত হলো রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া । Artery , vein এর গতিপথ । তখনো পর্যন্ত সেই 'নাপিতীয়' চিকিত্‍সাতেই জনগন অভ্যস্ত ছিলো । এতে করে অনেকেই হয়তো সাময়িকভাবে সুস্থ হতো । কিন্তু পরবর্তীতে Secondary এবং opportunistic infection হয়ে Septicaemia র মত ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে লাগলো । শেষমেষ ডাক্তাররাই ভরসা ।
এক অঞ্চলে একজন নাপিত খুব দক্ষ , নিষ্কম্প হাতে কাটাকুটির কাজ করতো । যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছিল সে । লোকজন ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঐ নাপিতের কাছেই যাওয়া অব্যাহত রাখলো । ভালোর চেয়ে খারাপই হচ্ছিল বেশি । একদিন ডাক্তার নাপিতকে বললেন , তুমিতো অনেক ভালো কাজ কর । তুমি মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে মানবদেহ নিয়ে কিছু কিছু শিখে যেও । আমিতো অনেক পড়াশোনা করেছি । জানাশোনা থাকলে তুমি আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারবে । নাপিত আনন্দিত হয়ে তাই করতে লাগলো । সে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে এসে শিক্ষা নিতে লাগলো । ডাক্তার তাকে রক্তনালী (Artery) ও স্নায়ুর (Nerve) গতিপথ সম্পর্কে জানালেন । 'দেখ , এদিক দিয়ে গেছে এই রক্তনালী আর এই স্নায়ু । সাবধানে কাজ করিও । এই স্নায়ু কাটা গেলে এই হাতটা অকেজো (Paralysed) হয়ে যাবে ।' এসব জানার আগে নাপিতের হাত কাঁপত না । জানার পর থেকে নাপিত কোন কিছু ঠিকমত কাটতে পারলো না । তার হাত কাঁপতে লাগলো । এখানে কাটবো , যদি নার্ভ কেটে যায় ! এরপর থেকে রোগী আসলে নাপিত ডাক্তারের কাছেই পাঠিয়ে দিত । এভাবেই অবসান হলো কসাই ও নাপিতীয় চিকিত্‍সাব্যবস্থার ।
,
নাপিতরা এখনো আছে । থাকা দরকারও । মাস দুয়েকের অনুশীলনে শেখা বিদ্যায় কাচি খচখচ করে অনেক নাপিত জীবনরক্ষাকারী ডাক্তারের চেয়েও বেশি বিল পেয়ে যায় ।(উদাহরণ হিসেবে হাবিবস এর কথা বলা যায় , সেখানে হাজার টাকার বিনিময়ে চুল কাটানো হয় !) কেউ প্রশ্ন করেনা , চুল কেটে এত টাকা দিব কেন ? শুধু বছরের পর বছর পড়াশোনা আর দিনরাত খেটে চিকিত্‍সা করা ডাক্তারের বেলায়ই যতসব । নাপিত তার কাচি দিয়ে চুল কাটে , আর ডাক্তারের কাচি আপনার জীবন বাঁচায় । একজন সন্ত্রাসী কিংবা কসাইর ছুরি মানুষের জীবন নাশ করে অন্যদিকে ডাক্তারও ছুরি ব্যবহার করে কিন্তু সেটা জীবন রক্ষা করে । জনগনের চোখ আজো নাপিত আর ডাক্তারের মধ্যেকার পার্থক্য বুঝতে শেখেনি । দুর্ভাগ্যই বটে ।
দুঃখের সাথে তাই বলতে হয়
'নাপিত আর ডাক্তার একই তো নয় ,
কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশান !!!'

নচিকেতা কি গানটি আরেকবার নতুন করে গাইবেন ?


 রবিবার, আগস্ট 7, 2011

শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১১

জনগন ও একজন ডাক্তার -২ : দ্বৈত মনোভাব

আগের পোস্টে কথা বলছিলাম ডাক্তারের ফি নিয়ে । সেখানেই আরেকটি বিষয় উঠে এসেছিল যে ডাক্তাররা রোগী দেখায় খুব কম সময় দেন । এখানেই জনগনের বাস্তববিমুখতা ও দ্বৈত মনোভাব প্রকাশ পায় । বাস্তবতা হচ্ছে , সরকারিভাবে চিকিত্‍সাসেবা এতই অপ্রতুল যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠলেও রোগীর ঠাই দেয়া যাচ্ছে না । ডাক্তারদের চেম্বারেও সিরিয়াল নিয়ে টানাটানি । (এই সুযোগে ডাক্তার যেমন তেমন ডাক্তারের পিএস এর ভাবটা উঠে যায় আসমানে !) এখন ডাক্তার যদি প্রতিজন রোগীর জন্য আধাঘন্টা করে সময় দেন (যদিও তা অবাস্তব ও অপ্রয়োজনীয়) তাহলে অনেক পেশেন্ট চিকিত্‍সা না পেয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হবে । ডাক্তার তো আর সারাদিন রাত রোগী দেখবেন না । তারও তো একটা ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু আছে নাকি ? যাহোক পেশেন্ট নিজে চান ডাক্তার তাকে অনেকক্ষণ সময় দিন । আবার যখন ডাক্তার প্রয়োজনবশত একজন পেশেন্টকে বেশি সময় দেন তখন অপেক্ষায় থাকা অন্য পেশেন্ট ও এটেনড্যান্টরা অধৈর্য হয়ে ওঠেন । তারা ক্ষেপে যান । 'কি ভুয়া ডাক্তারের কাছে আসলাম , এতক্ষণ সময় লাগে একজন রোগী দেখতে !' বুঝুন ঠেলা । কীরকম দ্বৈত মনোভাব । ওনারা যে কী চান নিজেরাই বোঝেন না ।
আর প্রকৃত বাস্তবতাটা হলো ১৫-২০ বছর ধরে একটা বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে তারপর একজন ডাক্তার একটা বিষয়ের ওপর স্পেশালিস্ট হন । এসময়ের মধ্যে তাকে একইরকম হাজার হাজার পেশেন্ট নিয়ে কাজ করতে হয়েছে । এমবিবিএস কমপ্লিট করতে কমপক্ষে ৬.৫ বছর , এফসিপিএস শেষ করতে কমপক্ষে ৬ বছর , এমডি করতে কমপক্ষে ৬ বছর । এত সময় ব্যয় করেছে তো এজন্যই যেন অল্প সময়ে ট্রিটমেন্ট দিতে পারেন । এভাবে এত পড়াশোনা , এত পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট করার পরও যদি একজন ডাক্তার অল্প সময়ে পেশেন্ট ম্যানেজ করতে না পারেন তাহলে ঐ ডাক্তারের ক্লিনিক্যাল আই এবং শিক্ষাব্যবস্থার গলদ নিয়েই প্রশ্ন তুলতে হবে । Clinical eye হলো একজন ডাক্তারের সন্ধানী চোখ । অনেক প্র্যাকটিসের ফলে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তার সাথে জ্ঞান মিলিয়ে তৈরি করে ক্লিনিক্যাল আই । এতে একজন ডাক্তার রোগীর Appearance , attitude থেকেই অনেকাংশে ডায়াগনোসিস এর কাছাকাছি পৌঁছে যান । যার ক্লিনিকাল আই যত বেশি প্রখর , তিনি ততোবেশি দক্ষ চিকিত্‍সক বলে গন্য হবেন । তার ডায়াগনোসিস হবে তত দ্রুত ও নির্ভুল । পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্রের এ বিষয়ে ব্যাপক খ্যাতি ছিল । আমাদের স্কুলের বাংলা স্যার বলতেন 'ডাক্তার হলে বিধান চন্দ্রের মত হবি '। তিনি নাকি একজন রোগীকে একনজর দেখেই ডায়াগনোসিস করে ফেলতে পারতেন । ওনার ভাগ্য ভালো যে তাঁকে এই সময়ে বাংলাদেশে প্র্যাকটিস করতে হচ্ছে না । তিনি যদি এই সময় রোগীকে একনজর দেখেই প্রেসক্রিপশন লিখে দিতেন , তাহলে আমাদের উপরোল্লিখিত জনগন কীযে বলতো আল্লাহ মালুম !


 শুক্রবার, আগস্ট 5, 2011

বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০১১

জনগন ও একজন ডাক্তার- ১ঃ ডাক্তারের ফি

ফ্যাক্টরি অচল । কয়েকদিন থেকে মেশিন চলছে না । বিকল মেশিন কোনভাবেই সারাতে পারছে না ফ্যাক্টরির লোকেরা । উত্‍পাদন বন্ধ । বড় বড় অর্ডার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে । এভাবে চলতে থাকলে দেউলিয়া হয়ে যাবে কোম্পানি । ব্যাংকের লোন পরিশোধ করা যাবে না । শ্রমিকরা বিক্ষোভ করবে । বাধ্য হয়ে ফ্যাক্টরির ম্যানেজার একজন বিশেষজ্ঞ ইন্জিনিয়ার ডাকলেন । বিশেষজ্ঞ ভালোভাবে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলেন একটি গুরুত্বপুর্ণ জায়গায় একটি পেরেক খুলে গেছে । তিনি কর্মচারীদের দেখিয়ে দিলেন এবং সেখানে পেরেকটি মেরে দিতে বললেন । যথাস্থানে পেরেকটি লাগানোর পরই আবারও মেশিন চালু হলো ।পরদিন বিল পাঠানো হলো ১ লাখ টাকা । মালিক বেঁকে বসলেন । মাত্র একটা পেরেক ঠুকানোর জন্য এক লাখ টাকা ! তিনি বিল ফেরত পাঠালেন ।পরদিন বিশেষজ্ঞ নতুন করে বিল পাঠালেন । পেরেক ঠুকানো বাবদ ১ টাকা । আর পেরেক কোথায় লাগাতে হবে সেটা খুঁজে বের করা বাবদ ৯৯৯৯৯ টাকা ! এবার ফ্যাক্টরি মালিক কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না ।পোস্টের শিরোনামের সাথে গল্পটি মিলিয়ে বুদ্ধিমান পাঠক এতক্ষণে হয়তো আসল কথাটি বুঝে ফেলেছেন । ঠিকই ধরেছেন , আজকের বিষয় ডাক্তারের ফি । ডাক্তারের ফি নিয়ে অনেককেই উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় । এদের মধ্যে 'বুঝদার' লোকের সংখ্যাও কম নয় । নিজে কোটি টাকার মালিক , ব্যবসায় আসল দামের দ্বিগুন মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করে মার্সিডিজ বেন্জে ঘোরেন । ডাক্তারের ফি টা দেয়ার বেলায়ই কেবল তার পকেটে টান পড়ে ! এইতো সেদিন রেস্টুরেন্টে বসে একজন ডাক্তারদের চৌদ্দ দুগুনে আঠাশ গোষ্ঠীর কুষ্ঠি উদ্ধার করলেন । এই পোস্টের কমেন্টেও হয়তো অনেকেই কাজটা করবেন । 'ওনাদের' মহা ক্ষোভ । 'ওমুক কার্ডিওলজিস্ট এর কাছে গেলাম , পালস আর ব্লাড প্রেসার মেপে ইসিজিটা দেখে ১০ মিনিটের মধ্যে কিনা কি লিখে ছেড়ে দিলো । বিল নিলো ৫০০ টাকা । ডাহা জোচ্চুরি !' ওনাদের এটুকু বলা প্রয়োজন মনে করছি - মামা কি দরকার ছিলো কার্ডিওলজিস্টের কাছে যাবার ? মুদি দোকানে গেলেই পারতেন ! দোকানদার আপনাকে দশঘন্টা ধরে চেকআপ করে লজেন্স দিতো , মজা করে সেটাই খেতেন !এই বেকুবের দলকে আবার দেখবেন মেন্জ ক্লাবের শার্ট আর ক্যাটস আইর ক্যাপ মহানন্দে কিনছে । শৈল্পিক থেকে পান্জাবি । মহিলারা কে ক্রাফট থেকে ওয়ান টু থ্রিপিছ কিনছে । যেটার উত্‍পাদন খরচ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা । সেটাই বিনা প্রশ্নে কিনছেন ওনারা ১৫০০ টাকায় । শোরুম থেকে বের হয়ে আফসোস করেন । ইস্ নতুন ক্যাটালগে একটা চরম ডিজাইন আসছে । আর কিছু টাকা থাকলে ওটাও নিতাম !'ওনাদের' জন্য আর বেশি কিছু বলতে চাই না । শুধু এটুকু বলবো , যে ছেলেটা আজকে কার্ডিওলজিস্ট হয়েছে সে এমনি এমনি হয়নি । আপনি যখন বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মেরেছেন তখন সে হাসপাতালে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে । আপনি যখন মুভি দেখে সময় কাটিয়েছেন , তখন তার সময় কেটেছে বইয়ের পাতায় আর অপারেশন থিয়েটারে । এমনি করেই সে জীবনের অনেক স্বাদ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে কমপক্ষে ৪০ বছর নষ্ট করেছে । এমবিবিএস করার পরও এমডি , এফসিপিএস ইত্যাদি ডিগ্রি নিয়েছে । এখনো দিনেরাতে সেবা দিয়ে যাচ্ছে মানুষকে।



বুধবার, আগস্ট 3, 2011