সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললো হেলাল মিয়া । আজ হাসপাতালে যেতেই হবে । বেশ
কিছুদিন ধরেই শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছিলো । আজকাল খুব দুর্বল লাগে তার ।
দু’একটা খেপ দিলেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। তবু কোনমতে চালিয়ে নিচ্ছিল এতদিন ।
কিন্তু আজ আর কোনভাবেই রিকশা নিয়ে বের হওয়া সম্ভব না । এই শরীরে রিকশা নিয়ে
বেরুলে আর ঘরে ফেরা হবে কিনা সন্দেহ । কোথায় মাথা ঘুরে পড়ে থাকবে কে জানে !
-‘কইগো হেনার মা, দেহ দেহি রফিক্যা আছে নি বাড়িত । আমারে এট্টু ডাহা মেডিকেলত দিয়া আসবার ক-তো । আইজকা যাইতেই অইবো, এইবাভে আর থাহন যায়না’ ।
মেঝেতে চট বিছিয়ে মেয়েকে পাশে বসিয়ে সরিষার তেল মাখা গরম ভাত খায় হেলাল মিয়া । প্লেটের ওপর কাঁচামরিচ ও আলুভর্তা । আলুভর্তাটা ভালোই বানায় হেনার মা । খেতে খেতে মেয়েকে আদর করে হেলাল । এরইমধ্যে রফিক মিয়ার কন্ঠ শোনা যায় ।
-‘হেলাল বাই, রেডি অইছো নি? তাড়াতাড়ি খাইয়া লও । দেরি অইয়া যাইতাছে’।
এই বস্তির অনেকেই রিকশা চালায় । রফিক মিয়াও তাদের একজন । হেলাল মিয়ার পাশের ঘরেই থাকে ।
ঢাকা মেডিকেলের আউটডোর বিভাগের সামনে এসে নামে হেলাল মিয়া । রফিক তার রিকশা নিয়ে চলে যায় অন্য দিকে । হেলাল মিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ‘বহিঃবিভাগ’ গেটের দিকে ।
জীবনে কোনদিন এই হাসপাতালে আসেনি হেলাল মিয়া । সে বুঝতে পারেনা কী করবে । আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনছে । ‘এইহানেও টিকিট লাগে?’ ভাবতে ভাবতে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে । ‘বাই, টিহিট কত?’ সামনের জনকে জিজ্ঞেস করে হেলাল । ‘দশ টেহা’ । ঝাঁঝালো জবাব পায় সে । এই প্রশ্নের উত্তরে এত ঝাঁঝ দেখানোর কী আছে ভেবে পায়না হেলাল ।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঝিম ঝিম করে হেলালের । যখন সে কাউন্টারের সামনে এসে পৌঁছে, ততক্ষণে আধা ঘন্টার বেশি পার হয়ে গেছে । সময়টা হয়তো আরও বেশিই হবে, কিন্তু হেলাল মিয়ার হাতে যেহেতু কোন ঘড়ি নেই, তাই আন্দাজ করা আর ছাড়া কোন উপায় নেই তার ।
-‘টেহা বাইর করো মিয়া । সমুস্যাডা কী?’
বেশ ধমকের স্বরেই জানতে চায় কাউন্টারে বসা লোকটি । মিনমিন করে হেলাল জানায়- তার ‘শইল্যে ব্যথা’, ‘মাথা গুরে’, ‘বুক দরফর করে’ । একটা ছোট্ট কাগজে নাম ও নম্বর লিখে হেলালের হাতে দেয় লোকটি । বলে- ‘যাও, মেডিসিন আউটডোরে চইল্যা যাও’ ।
-‘ঐ মিয়া, এত সুমায় লাগে ক্যা?’ তাড়া দেয় হেলালের পেছনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক লোকটিও ।
হেলাল মিয়া দুএকজনকে জিজ্ঞেস করে মেডিসিন আউটডোর চিনে নেয় । সেখানেও লাইনে দাঁড়াতে হয় তাকে । প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর সে ডাক্তারের সামনে গিয়ে পৌঁছে । এর মধ্যে গেটে দাঁড়ানো লোকটি তাকে দু’তিনবার ধমকায়। ডাক্তার সাহেব অবশ্য ভালো করেই দেখেন হেলালকে । তিনি কিছু ঔষধ লিখে দেন । আর বুকের এক্সরে, রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করাতে বলেন । ডাক্তারের রুম হতে বেরুতে বেরুতে হেলালের কানে আসে শ্লেষমাখা কন্ঠ- ‘ঐ মিয়া কী হইছে তুমার? এত সুমায় লাগাইলা ক্যান? আর হেই ডাক্তারে কিছু জানে নি? অতক্ষণ লাগে একজন রুগি দেইখতে?’
সেই কাগজ নিয়ে হেলালকে যেতে হয় অন্য একটি রুমে । সেখানে তার নাম এবং স্লিপ নম্বর লিখে নতুন কয়েকটি কাগজ ধরিয়ে দেয় একজন নার্স । তারপর ঐসব কাগজ নিয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে অলিগলি পেরিয়ে ‘নিউ বিল্ডিং’ এ পৌঁছায় হেলাল । সেখানে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ‘টাকা জমা’ দেয় সে । টাকা জমার স্লিপ নিয়ে সে একে একে এক্সরে বিভাগে গিয়ে ‘বুকের ছবি’ ওঠায়, রক্তের নমুনা দেয় অন্য আরেকটি রুমে, সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য একটি রুমে গিয়ে প্রস্রাবের নমুনা দেয় । প্রতিবারই তাকে গড়ে আধাঘন্টা থেকে একঘন্টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । দারোয়ান ও টেকনিশিয়ানদের ধমক শুনতে হয় । সবখান থেকেই একদিন পরে এসে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে বলা হয় হেলালকে ।
হেলাল খেয়াল করে, রিপোর্ট সংগ্রহের লাইনটাও অত ছোট না ।
‘যুহর কি হইয়া আইলো নাকি?’ আকাশের দিকে তাকায় হেলাল । কিন্তু তার চোখ কংক্রিটের ছাদে বাধা পেয়ে ফিরে আসে ।
দুর্বল শরীর নিয়ে গেটে ফিরে আসে হেলাল মিয়া । রফিককে বলা আছে, যোহরের সময় সে গেটে থাকবে । হেলালকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে ।
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে হেলালের । ডাক্তারের সামনে কয়েক মিনিট ছাড়া আর কোথাও বসার সুযোগ হয়নি তার । এখন মনে হয় ‘মাথাটাও ঘুরছে’।
কোনরকমে গেটে পৌঁছে ফুটপাতের ওপর দাঁড়ায় হেলাল । তার চোখ খুঁজে ফেরে রফিক মিয়াকে । ‘ঐ তো , ঐতো রফিক আইছে’। মনে মনে খুশি হয় হেলাল মিয়া । কিন্তু রফিকের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই হঠাৎ চোখ অন্ধকার হয়ে আসে তার। জ্ঞান হারানোর আগে একবার রফিকের কন্ঠ কানে আসে- হেলাল বাই, কী অইছে হেলাল বাই? এমুন করতাছ ক্যান? হেলাল বাই, এমুন করতাছ ক্যান?
-‘কইগো হেনার মা, দেহ দেহি রফিক্যা আছে নি বাড়িত । আমারে এট্টু ডাহা মেডিকেলত দিয়া আসবার ক-তো । আইজকা যাইতেই অইবো, এইবাভে আর থাহন যায়না’ ।
মেঝেতে চট বিছিয়ে মেয়েকে পাশে বসিয়ে সরিষার তেল মাখা গরম ভাত খায় হেলাল মিয়া । প্লেটের ওপর কাঁচামরিচ ও আলুভর্তা । আলুভর্তাটা ভালোই বানায় হেনার মা । খেতে খেতে মেয়েকে আদর করে হেলাল । এরইমধ্যে রফিক মিয়ার কন্ঠ শোনা যায় ।
-‘হেলাল বাই, রেডি অইছো নি? তাড়াতাড়ি খাইয়া লও । দেরি অইয়া যাইতাছে’।
এই বস্তির অনেকেই রিকশা চালায় । রফিক মিয়াও তাদের একজন । হেলাল মিয়ার পাশের ঘরেই থাকে ।
ঢাকা মেডিকেলের আউটডোর বিভাগের সামনে এসে নামে হেলাল মিয়া । রফিক তার রিকশা নিয়ে চলে যায় অন্য দিকে । হেলাল মিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ‘বহিঃবিভাগ’ গেটের দিকে ।
জীবনে কোনদিন এই হাসপাতালে আসেনি হেলাল মিয়া । সে বুঝতে পারেনা কী করবে । আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনছে । ‘এইহানেও টিকিট লাগে?’ ভাবতে ভাবতে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে । ‘বাই, টিহিট কত?’ সামনের জনকে জিজ্ঞেস করে হেলাল । ‘দশ টেহা’ । ঝাঁঝালো জবাব পায় সে । এই প্রশ্নের উত্তরে এত ঝাঁঝ দেখানোর কী আছে ভেবে পায়না হেলাল ।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঝিম ঝিম করে হেলালের । যখন সে কাউন্টারের সামনে এসে পৌঁছে, ততক্ষণে আধা ঘন্টার বেশি পার হয়ে গেছে । সময়টা হয়তো আরও বেশিই হবে, কিন্তু হেলাল মিয়ার হাতে যেহেতু কোন ঘড়ি নেই, তাই আন্দাজ করা আর ছাড়া কোন উপায় নেই তার ।
-‘টেহা বাইর করো মিয়া । সমুস্যাডা কী?’
বেশ ধমকের স্বরেই জানতে চায় কাউন্টারে বসা লোকটি । মিনমিন করে হেলাল জানায়- তার ‘শইল্যে ব্যথা’, ‘মাথা গুরে’, ‘বুক দরফর করে’ । একটা ছোট্ট কাগজে নাম ও নম্বর লিখে হেলালের হাতে দেয় লোকটি । বলে- ‘যাও, মেডিসিন আউটডোরে চইল্যা যাও’ ।
-‘ঐ মিয়া, এত সুমায় লাগে ক্যা?’ তাড়া দেয় হেলালের পেছনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক লোকটিও ।
হেলাল মিয়া দুএকজনকে জিজ্ঞেস করে মেডিসিন আউটডোর চিনে নেয় । সেখানেও লাইনে দাঁড়াতে হয় তাকে । প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর সে ডাক্তারের সামনে গিয়ে পৌঁছে । এর মধ্যে গেটে দাঁড়ানো লোকটি তাকে দু’তিনবার ধমকায়। ডাক্তার সাহেব অবশ্য ভালো করেই দেখেন হেলালকে । তিনি কিছু ঔষধ লিখে দেন । আর বুকের এক্সরে, রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করাতে বলেন । ডাক্তারের রুম হতে বেরুতে বেরুতে হেলালের কানে আসে শ্লেষমাখা কন্ঠ- ‘ঐ মিয়া কী হইছে তুমার? এত সুমায় লাগাইলা ক্যান? আর হেই ডাক্তারে কিছু জানে নি? অতক্ষণ লাগে একজন রুগি দেইখতে?’
সেই কাগজ নিয়ে হেলালকে যেতে হয় অন্য একটি রুমে । সেখানে তার নাম এবং স্লিপ নম্বর লিখে নতুন কয়েকটি কাগজ ধরিয়ে দেয় একজন নার্স । তারপর ঐসব কাগজ নিয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে অলিগলি পেরিয়ে ‘নিউ বিল্ডিং’ এ পৌঁছায় হেলাল । সেখানে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ‘টাকা জমা’ দেয় সে । টাকা জমার স্লিপ নিয়ে সে একে একে এক্সরে বিভাগে গিয়ে ‘বুকের ছবি’ ওঠায়, রক্তের নমুনা দেয় অন্য আরেকটি রুমে, সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য একটি রুমে গিয়ে প্রস্রাবের নমুনা দেয় । প্রতিবারই তাকে গড়ে আধাঘন্টা থেকে একঘন্টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । দারোয়ান ও টেকনিশিয়ানদের ধমক শুনতে হয় । সবখান থেকেই একদিন পরে এসে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে বলা হয় হেলালকে ।
হেলাল খেয়াল করে, রিপোর্ট সংগ্রহের লাইনটাও অত ছোট না ।
‘যুহর কি হইয়া আইলো নাকি?’ আকাশের দিকে তাকায় হেলাল । কিন্তু তার চোখ কংক্রিটের ছাদে বাধা পেয়ে ফিরে আসে ।
দুর্বল শরীর নিয়ে গেটে ফিরে আসে হেলাল মিয়া । রফিককে বলা আছে, যোহরের সময় সে গেটে থাকবে । হেলালকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে ।
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে হেলালের । ডাক্তারের সামনে কয়েক মিনিট ছাড়া আর কোথাও বসার সুযোগ হয়নি তার । এখন মনে হয় ‘মাথাটাও ঘুরছে’।
কোনরকমে গেটে পৌঁছে ফুটপাতের ওপর দাঁড়ায় হেলাল । তার চোখ খুঁজে ফেরে রফিক মিয়াকে । ‘ঐ তো , ঐতো রফিক আইছে’। মনে মনে খুশি হয় হেলাল মিয়া । কিন্তু রফিকের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই হঠাৎ চোখ অন্ধকার হয়ে আসে তার। জ্ঞান হারানোর আগে একবার রফিকের কন্ঠ কানে আসে- হেলাল বাই, কী অইছে হেলাল বাই? এমুন করতাছ ক্যান? হেলাল বাই, এমুন করতাছ ক্যান?