এই এক সমস্যা আমার। পথে নামলেই পথের প্রেমে পড়ে যাই। মনে হয়ঃ পথে পথে কাটিয়ে দিইনা কেন জীবনের বাকিটা সময়? . এইযে পথ- দুধারে নানান গাছের সারি দেবদারু - অশ্বথ - বাশঝাঁড় - কাশবন, তাকিয়ে থাকলেই চোখে নেশা ধরে আসে; যেন অপরুপ সৌন্দর্যের পানে- মুগ্ধ প্রেমিকের চেয়ে থাকা.... . এই এক সমস্যা আমার।
হয়তো একদিন এ শহর ছেড়ে পথে নেমে গেলে হয়তো হারিয়ে যাবো অচিন পথের বাঁকে- হয়তোবা আর কভু হবে নাকো ফেরা পুরনো কামরায়।
দেখো কীরকম নিশ্চুপ হয়ে গেছি আমি অমাবশ্যার মত ভয়ানক নৈঃশব্দ গ্রাস করে রেখেছে আমাকে। কতদিন আমি কোন কবিতা লিখিনা, মনে পড়ে? কতদিন গলা ছেড়ে গাইনি একটাও ভাটিয়ালি গান! . দেখো, কীরকম নিরাবেগ হয়ে গেছি আমি যেন হিম বরফের মত শীতল হয়ে আছে আমার হৃদয়। কতদিন দেখনি আমার প্রাণখোলা হাসি? মনে পড়ে? . আর কীরকম উদাসীন হয়ে গেছি আজকাল! যেন গৈরিক সন্ন্যাসীর মত ভয়ানক বৈরাগ আচ্ছন্ন করেছে আমাকে। শোনো, মানবিক উষ্ণতা ছাড়া এ বরফ আর গলবে না। তীব্র কোলাহল ছাড়া ঘুঁচবেনা নৈঃশব্দ। আর সম্ভবতঃ ভয়ানক প্রেম ছাড়া ফিরবেনা- পুরনো আবেগ!
ইদানিং অনেক ডাক্তারকে দেখি ফেসবুকে রোগীর ছবি পোস্ট করেন । এটা করা
কোনভাবেই ঠিক নয় । মেডিকেল ইথিক্স অনুযায়ী রোগীর সকল তথ্য গোপন রাখা
ডাক্তারের অবশ্য কর্তব্য, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া । যেমন ইনফেকশাস ডিজিজ বা
পুলিশ কেস সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয় । একাডেমিক আলোচনা ও
গবেষণার প্রয়োজনে রোগীর অনুমতি সাপেক্ষে তাঁর তথ্য ব্যবহার করা যায় । এসব
ক্ষেত্র ছাড়া নিজের খেয়ালখুশিমত কারো ছবি, বা রোগ সম্পর্কিত অন্য কোন তথ্য
সামাজিক মিডিয়া তো দূরের কথা, রোগীর নিকটাত্মীয় নন অথবা রোগী চান না এমন কারো কাছে প্রকাশ করার সুযোগ নেই । এটা মেডিকেল এথিক্সের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ।
ডাক্তারের কাছে রোগীর অবস্থা জানার জন্য অনেকেই আসেন । দেখা যায়-
হাসপাতালে রোগী দেখতে এলে সবাই একবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগীর অবস্থা
জানতে চান। কিন্তু রোগীর স্বজনদের বুঝতে হবে- সবকিছু জানার অধিকার আপনার
নেই । অনেক সময়ই ডাক্তাররা আপনাদের সাথে কথা বলতে চান না । অনেক সময় বিরক্ত
হন । কারণ, এখানে ডাক্তারের ওপর অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় চাপের বাইরে নীতির
প্রশ্নও জড়িত আছে ।
ডাক্তারদেরও সচেতন থাকতে হবে । রোগীর কোন তথ্য
কেউ জানতে চাইলে অবশ্যই রোগীর সাথে তাঁর সম্পর্ক যাচাই করে নিতে হবে ।
সম্ভব হলে রোগীর অনুমতি নিতে হবে । কাকে কতটুকু বলা যাবে তা ভেবে নিয়ে তাকে
ততটুকুই বলতে হবে । তার বেশি কখনোই নয় ।
রোগী হয়তো চিকিৎসায়
শারীরিক সুস্থতা লাভ করবেন, কিন্তু রোগীর অনুমতি ছাড়া কোন কোন তথ্য অন্য
কারো হস্তগত হলে পরবর্তীতে রোগীর সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে ।
মেডিকেল ইথিক্স তা কখনোই হতে দিতে পারে না ।
জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় উগ্রবাদ উত্থানের কারণ কী? মোটাদাগে দুটি কারণকে
তুলে আনা যায়। একটা হচ্ছে- হতাশা । প্রতিশোধস্পৃহা । আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে
সঠিক শিক্ষার অভাব ।
দীর্ঘদিন নির্যাতন নিপীড়ন শোষণ বঞ্চনার শিকার
হলে যেকোন জনগোষ্ঠীই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । যখন বঞ্চনার জায়গা থেকে উত্তরণের
স্বাভাবিক কোন পন্থা থাকে না, নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা কাজে আসে না, তখন
মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে । শুধু মানুষ নয়, যেকোন প্রাণীই সহিংস হয়ে ওঠে । মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণতা । এ উপমহাদেশ থেকে শুরু করে সারা
বিশ্বের সকল উগ্রবাদীদের উত্থানের পেছনে এই কারণটিই প্রধান । এমনকি
ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বিরোধী সহিংস আন্দোলনসহ বিশ্বের প্রায় সকল সহিংস
আন্দোলন-সংগ্রাম বা যুদ্ধের পেছনের কারণ এটিই । ইসলামকে পুঁজি করে যে
উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে, যার ঢেউ এসে পড়েছে আমাদের দেশেও, তারও
প্রধান কারণ এটি । আমরা দেখি, আইএস আল কায়েদা এইসব গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের হতাশা থেকে, ক্ষোভ থেকে । প্রতিশোধস্পৃহা থেকে
। ইরাক যুদ্ধ, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ- এইসব ঘটনার পরেই
ক্ষুদ্র উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো ফুলে ফেপে উঠেছে । আরো বেশি মানুষকে তাদের দলে
ভিড়াতে পেরেছে । আরো বেশি শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছে । সিরিয়া, ইরাক,
আফগানিস্তান, লিবিয়া, এইসব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তরুন যুবকেরাই আইএস আল
কায়েদার মূল শক্তি । পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জীবন সম্পর্কে
হতাশ, রেডিকালি চেঞ্জড কিছু যুবক তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ।
আইএস সহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম তরুনদের মাঝে একটা ধারণা ছড়িয়ে
দিচ্ছে- দেখো, সারাবিশ্বে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে । আর ইহুদী খ্রিস্টান
অমুসলিমরাই হচ্ছে নির্যাতনকারী । অতএব তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে ।
তাদেরকে খুন করতে হবে ! আর বিশ্বের মুসলিমদের দুরবস্থায় হতাশ তরুনরা আবেগে
জড়িয়ে পড়ছে উগ্রবাদী সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে । যোগ দিচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ
মানুষ হত্যার মত জঘন্য কাজে ।
মুসলিমরা অবশ্যই নির্যাতিত হচ্ছে, এই
বাস্তবতা কারো অস্বীকার করার সুযোগ নেই । কিন্তু তাই বলে অন্য কোন নিরীহ
মানুষকে হত্যা তো দূরের কথা, সামান্য ক্ষতি করার অনুমতিও ইসলাম দেয় না ।
কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা একজন নিরীহ মানুষ হত্যাকে পৃথিবীর সকল মানুষকে
হত্যার সমান বলে ঘোষণা করেছেন । নিরীহ মানুষ হত্যার ব্যাপারে উগ্র
গোষ্ঠীগুলো মুসলিম যুবকদের ধারণা দেয় যে- ইহুদি খ্রিস্টানরাও তো নিরীহ
মুসলিমদের হত্যা করছে ! অতএব তোমরা করলে দোষ কী? সঠিক ইসলামী শিক্ষা না
পাওয়া আবেগি মুসলিম তরুনেরা এইসব কথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে
ধ্বংসের পথে ।
তাদেরকে isolated ভাবে কুরআনের এমন কিছু কিছু আয়াত
থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়, যেখানে ‘ক্বিতাল’এর কথা বলা হয়েছে । কিন্তু কখন,
কোন্ প্রেক্ষাপটে, কেন সেইসব আয়াত নাযিল হয়েছিল তা বলা হয়না । তারা
নিজেরাও জানার সুযোগ পায় না, চেষ্টা করে না । আগে থেকে ইসলামের শিক্ষা না
থাকার ফলে তাদের ধারণা হয়ঃ ঠিকই তো ! এগুলো তো কুরআনেরই কথা !
অথচ
Context ছাড়া কুরআনের কোন Text থেকে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই । যদি
তাই হতো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা শুধু বই আকারে কুরআন নাযিল করতেন, রাসুল
পাঠাতেন না । সমগ্র কুরআন একসাথে নাযিল করতেন, ২৩ বছর সময় দিতেন না ।
‘উগ্রবাদের কারণ ও প্রতিকার- ১ (চলবে)
কারা বেশি করে জড়াচ্ছে উগ্রপন্থায়? যারা জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছে
ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে । ফলে হঠাৎ করে যখন তারা জীবনে কোন একটা বড় ধাক্কা
খায়, যখন কোনভাবে তার মনে হয়- কী করছি আমি এসব? আমি তো অনেক পাপ করেছি, হায়
হায় আমার কী হবে ! আমার তো দুনিয়া আখেরাত সব বরবাদ হয়ে গেলো ! ঠিক এসময়ই
তারা সন্ধান পায়, অথবা তাদেরকে খুঁজে নেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী । তাদেরকে বলা
হয়- আল্লাহর কাছে মাফ পেতে চাও? তাহলে এই নাও অস্ত্র! খুন করে ফেলো
ওকে-তাকে । ওরা ইসলামের শত্রু ! ওদেরকে মেরে নিজেও মরে যাও , শহীদ হয়ে যাও ।
শহীদ(?) হবার এই সহজ রাস্তা পেয়ে আবেগি তরুন নেমে পড়ে মানুষ হত্যায় ।
এমনিতেই সে ছিল জীবন সম্পর্কে হতাশ, ক্ষুব্ধ । এমনিতেই সে ছিল জীবন
সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ । তারপর যখন উগ্রবাদীরা তার সামনে আত্মাহুতি দেয়ার একটা
'মহান' (?) কারণ দাঁড় করায়, অস্থিরহৃদয় যুবক তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে । কারণ-
সারাটা জীবন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মেনে চলার চেয়ে হঠাৎ
আবেগে জীবন দেয়াটা অনেক সহজ ।
উল্টোদিকে যারা ছোটবেলা থেকেই
ইসলামের শিক্ষা পেয়ে, ধর্মীয় আচার আচরণের মধ্যে বড় হয়- তাদের ভেতর একটা
তৃপ্তি থাকে- আমি ধর্মের পথেই আছি । ফলে তাদেরকে র্যাডিকালাইজড করা সম্ভব
হয় না ।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে- ধর্মীয় শিক্ষা নেবার জায়গাটা । এটা
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তরুনদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে । ধর্ম নিয়ে, জীবন
নিয়ে । এইসব প্রশ্নের জবাব সে কোথায় পাবে? প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়ার
জায়গাটা হাতের কাছে থাকতে হবে । ধর্মীয় বই পুস্তক, ধর্মীয় নেতা, আলেম
ওলামাদের গতিবিধি, মাহফিল মজলিশ মক্তব মাদ্রাসা ওয়াজ নসিহত বক্তৃতা সীমিত
হয়ে পড়লে সেই জায়গাটা দখল করে নেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী । ফলে মানুষের বিপথগামী
হবার সুযোগ সম্ভাবনাও বেড়ে যায় ।
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা
যতটুকু বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে তার পেছনে এইসব কার্যকারণ জড়িত আছে । বিগত
বছরগুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দিনকে দিন সীমিত হয়েছে । অনেক মক্তব
মাদ্রাসা, ধর্মীয় জলসা মাহফিল মজলিশ টিভি পত্র পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে । আর
এর সুযোগটা নিতে পেরেছে উগ্রবাদীরা । ফলে তরুণ- যুবকদের একটা অংশকে
বিপথগামী করার সুযোগ পেয়েছে উগ্রবাদিরা । ধর্মের শিক্ষার পথ বন্ধ করা নয়-
বরং সহজলভ্য করতে হবে । যাতে তরুন মনের প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে পায়
পিতামাতার কাছে, শুভাকাঙ্খি কারো কাছে । পরিচিত কারো কাছে । আর যারা
ইসলামের যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানে, শেখে, বোঝে, তাদেরকে বিপথে নেয়া কারো জন্য
সহজ হয় না । তাদেরকে র্যাডিকালাইজড করা যায় না ।
‘উগ্রবাদের কারণ ও প্রতিকার- ২ (চলবে)
কথা ছিল শ্রীমঙ্গলে নামবার । কিন্তু ট্রেনেই আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ হয়ে গেল । স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, মাধবপুর এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সবচেয়ে কাছাকাছি হবে ভানুগাছ স্টেশন । অতএব আমরা এখন ভানুগাছেই নামবো ! সারারাত ঘুমাইনি । গল্পগুজব করেই কেটে গেল কয়েকটা ঘন্টা । শ্রীমঙ্গল আসার আগেই চেয়ার ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছি ট্রেনের দরজায় । হুহু বাতাস এসে লাগছিল শরীরে । দুপাশে গাছ আর গাছ । যেন বনের ভেতর দিয়ে চলছে ট্রেন । একটা অসাধারণ ভ্রমণের রোমাঞ্চ শুরু হলো সেখান থেকেই । তারপর যেই কথা সেই কাজ । রাত তিনটায়, বলা চলে ‘ভররাত্রে’ই আমাদের ভানুগাছ স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে চলে গেল উপবন এক্সপ্রেস । আমরা নেমে পড়লাম ‘পথে’ । বাকি দিনগুলো আমরা যেভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি তাকে কোন ভ্রমণ না বলে ‘পথে পথে ঘুরে বেড়ানো’ বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত । হুম । সিলেটের পথে পথে ।
চা বাগানের ভোর
সিলেট মানে চা বাগান । অতএব শুরুটা অবশ্যই হতে হবে চা বাগান দিয়েই। কাছাকাছি রয়েছে ন্যাশনাল টি এস্টেট এর চা বাগান । চা বাগানের ভেতর লেক । মাধবপুর লেক । কিন্তু এই রাত তিনটায় তো আর সেখানে যাওয়া যায় না! অতএব ভানুগাছ স্টেশনে হাত মুখ ধুয়ে গরম পরোটা ডিম ডাল আর চা খেয়ে পেটকে বশে আনলাম । ফযরের আজান হলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে একটা সিএনজি ভাড়া করলাম আমরা । তখন ভোর ছয়টা। সিএনজি ছুটছে গ্রামের পথ ধরে । দুপাশে মাঠ, ধানক্ষেত, পুকুর, দীঘি । ভোরের শীতল স্নিগ্ধ হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছিলো শরীর। ছোট একটা নদীও দেখলাম একেবেঁকে চলে গেছে । অনেক অনেক দিন পর এমন দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল আমাদের । অফিসিয়ালি চা বাগানে ঢোকার সময় সকাল আটটার পর হতে । অতএব এই ভোরবেলায় গার্ডকে অনুরোধ করে আমাদের ঢুকতে হলো ভেতরে । চা বাগান, ভেতরের লেক দুটোই অনেক সুন্দর । লেকটা অনেকটা বান্দরবানের বগা লেকের মত লাগলো ।
উল্লুকের অভয়ারণ্যে !
ঘন্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে গাড়ির মুখ ঘোরাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দিকে । পথে চা নাস্তা খেয়ে নিলাম । স্থানীয়দের সাথে আলাপ করলাম। লাউয়াছড়ায় যখন পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে আটটা। অফিসিয়ালি টিকেট নিয়ে ঢোকার সময় নয়টার পর হতে। দেখলাম আরো অনেকেই ঢুকে পড়ছে টিকেট ছাড়াই । কারণ, কাউন্টারে কেউ নেই । আমরাও কালবিলম্ব না করে ঢুকে গেলাম লাউয়াছড়ার বনে । পরে টিকেট নেয়া যাবে । অবশ্যই- পায়ে হেঁটে ! পথের দুপাশে গাছ । মাঝখানে ইট বিছানো রাস্তা । ততক্ষণে আকাশে সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে । বনের ভেতর যেন আলো আধারির খেলা । হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম গিয়ে রেললাইনে । লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন । কথিত আছে, জুলভার্নের বিখ্যাত সিনেমা Round the world in 80 days এর এক অংশের শুটিং হয়েছিল এখানে ।
এই বনের সৃষ্টি বৃটিশদের হাতে, সেই ১৯২৫ সালে । পরে এই বনকে জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য ঘোষণা করে সরকার। বানর, আর উল্লুকের দেখা মিললেও অন্য কোন প্রাণির অবশ্য দেখা পাওয়া গেলনা । তবে এখানে নাকি দুএকটি হরিণ, অজগর আর অনেক রকম সাপ আছে । কয়েকদিন আগেই নাকি এক অজগর সাপ একটা সম্পূর্ণ হরিণ গলাধঃকরণ করেছিল ! ভেতরে আছে জরাজীর্ণ কয়েকটি অফিস ঘর । টিলার ওপরে একটি দোকান। একটি বাংলো । একটি মসজিদও আছে । ঘন্টা দুয়েক ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে আরো অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলাম মসজিদের বারান্দায় । লাউয়াছড়ায় একটি ডরমিটরি আছে যেটা নাকি গবেষকদের বা স্টুডেন্টদের থাকার জন্য । কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হলাম । বিদ্যুৎ সংযোগ নেই । অতএব, রাতে থাকা সম্ভব নয় ।
গন্তব্য মাধবকুন্ড!
আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে । ছোটবেলায় মাত্র দুটো ঝর্ণার কথা জানতাম । চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড আর মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড । সীতাকুন্ড দেখা হয়ে গেছে সাত বছর আগেই । এবার লক্ষ্য মাধবকুন্ড । এতক্ষণে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে । বন থেকে বেরিয়ে আবার সিএনজিতে উঠলাম আমরা । এবার ‘লোকাল’ যাত্রী হিসেবে । বিকজ, সিএনজি রিজার্ভ নিতে গেলেই আকাশচুম্বি দাম চেয়ে বসে । সিএনজিওয়ালাদের ধারণা, পর্যটক মানেই একেকটা টাকার গাছ ! চাইলেই কেল্লা ফতেহ ! সিএনজি চললো । আমরা এলাম সমশেরনগর । সেখান থেকে কুলাউড়া । তারপর জুড়ী পার হয়ে কাঠালতলী হয়ে মাধবকুন্ড । বিকেল হয়ে গেছে এতক্ষণে । সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত মাধবকুন্ডের শীতল পানিতে শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকলাম ।
মনে হলো মাধবকুণ্ডকে বেশ যত্ন করে ‘পর্যটন কেন্দ্র’ হিসেবে সাজানো হয়েছে । বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলি অবহেলায় পড়ে আছে । সেই তুলনায় মাধবকুন্ড যথেষ্টই সমাদর পেয়েছে বলতে হয়। আফসোস হলো, যেখানটায় ঝর্নার পানি পড়ছে, সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ । পানিতে ডুবে কয়েকজনের মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে । ওখানে নাকি পানির গভীরতা অনেক । সন্ধ্যা যখন হয় হয় তখন আমরা মাধবকুন্ডের মায়া ত্যাগ করে চলে এলাম কাঠালতলী । মাধবকুন্ড হতে কাঠালতলী বাজার, মাত্র ৭-১০ মিনিটের রাস্তা । সিএনজি ভাড়া লাগলো আড়াইশ টাকা ! মাধবকুন্ডের এই এলাকায় সিএনজিচালকরা একটা বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে ।
হাওরে ভাসাই ভেলা
কুলাউড়া পার হয়ে জুড়ী উপজেলায় ঢুকতেই চোখে এসেছিলো দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি । যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি । এ আবার কোন্ সমূদ্র? সিলেটে তো সাগর আছে বলে জানতাম না ! জানা গেলো, এটাই হাকালুকি হাওর । অতএব আমাদের পরিকল্পনায় যোগ হলো হাওর দর্শন । সিলেটে এসে হাওর না দেখে ফিরে যাবো? তা অয় না মিয়া । বড়লেখায় এক হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন নামলাম হাওরের পথে । বড়লেখা হতে সিএনজি ভাড়া করে যেতে হলো ঘন্টাখানেকের পথ । সেখানে নৌকা ভাড়া করে হাওরের ঘোলাজলে ভাসতে লাগলাম আমরা ।
জাফলং কতদূর?
পরবর্তী গন্তব্য জাফলং । দুপুরের পরপর সিএনজি নিয়ে জাফলং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম । কিন্তু কোথায় জাফলং? কতদূর ? জানা নেই । এবার আমাদের রাস্তা চেনানোর দায়িত্বভার চাপালাম গুগল ম্যাপের কাঁধে । দাসের হাট হয়ে বিয়ানীবাজার । সেখান থেকে দুবাগ, তারপর শাহবাগ । তারপর সুরমা ব্রীজ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম কানাইঘাট । ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায় । কানাইঘাটে খাওয়া দাওয়া করে শুরু হলো আরেক যাত্রা । পার্বতীপুর, দুর্গাপুর হয়ে গেলাম দরবস্ত বাজার । সেখান থেকে জৈন্তাপুর । জৈন্তাপুরে শুরু হলো সিলেটের চিরাচরিত ভর বর্ষণের রাত । এরইমধ্যে এলো জাফলং এর উদ্দেশ্যে রাতের সবশেষ বাস । উঠে পড়লাম আমরা । বাস চললো জাফলং এর উদ্দেশ্যে । রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ । বাইরে প্রবল বৃষ্টি, জানালা দিয়ে গায়ে লাগছে বৃষ্টির ছাট । গাড়ি দুলছে রোলার কোস্টারের মত । ভেতরে আমরা, যেন এগিয়ে যাচ্ছি অজানার উদ্দেশ্যে । অজান্তেই মনে এলো পুরনো সেই গান - এই পথ যদি না শেষ হয়... তবে কেমন হত... তুমি বলতো !! হঠাৎ মনে হলো- জীবনটা আসলে একেবারে মন্দ নয় !!
জাফলং এ ভোর
এই বৃষ্টির মাঝে একটা হোটেল খুঁজে বের করলাম । মামার বাজার । বিদ্যুৎ নেই । বেশ ঠান্ডাও পড়েছে । এরমধ্যে রাত কাটিয়ে সকালে উঠেই পায়ে হেঁটে চলে গেলাম জাফলং এ । পাথর উত্তোলনের মহাযজ্ঞ চলছে সেখানে । সামনে এগিয়ে একটা নৌকা নিলাম । ওপারে গিয়ে ঘন্টাখানেক পরে ফিরে এলাম এপারে । ফ্রেশ মাছ ভাজা হচ্ছিল তীরের এক ছাপড়া হোটেলে । গরম ভাত, টাটকা মাছ ভাজা আর কাঁচামরিচ । ভোজনটা হলো অমৃত সমান । পরবর্তী গন্তব্য সারিঘাট- লালাখাল ।
লালাখালে এক মধ্যাহ্ন !
সারি নদীর ঘাটে নেমে আমরা চললাম লালাখালে । বাহন – অটোরিক্সা । প্রবল বর্ষণে লালাখালের পানির স্বচ্ছতা অনেকাংশে কমে গেছে । লালাখাল আমাদের খুব একটা মুগ্ধ করতে পারলো না । এর আরেকটা কারণ হতে পারে- রাঙামাটি আর কাপ্তাইয়ের লেকে ঘুরে ঘুরে আমাদের নজরটা হয়ে উঠেছে নাকউঁচা । অতএব সময়ের বড় অংশটা কাটলো নাজিমগড় রিসোর্টে । ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল । আমাদের যেতে হবে আরো বহুদূর । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নেমেছে । আর বসে থাকা যায় না ।
গোয়াইন নদীর বুকে
সারিঘাট থেকে গেলাম গোয়াইনঘাটে । গন্তব্য রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট । সড়কপথে যাওয়া যায় । কিন্তু আমরা যাব নদীপথে । ঘাটে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে এক বিরাট ট্রলার ভাড়া পেলাম মাত্র ছয়শ টাকায় । মাত্র বলছি এ কারণে- প্রায় দুইশ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ট্রলারের ভাড়া কমপক্ষে এক দেড় হাজার টাকা হবার কথা । কিন্তু মাঝি যাবে বাড়িতে- সোয়াম্প ফরেস্টের পাশেই । আর আমরা হলাম তাঁর ফিরতিপথের যাত্রী । তখন পড়ন্ত বিকেল । গোয়াইন নদীতে এগিয়ে চলেছে ট্রলার । বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । কখনো কখনো তা রুপ নিচ্ছে মুষলধারায় । দুধারে বাড়িঘর । কাশবন । সবুজ তীর । কোথাও কোথাও ধানক্ষেত । কৃষকের কাঁধে ধান । খুঁটিতে বাঁধা গরু ভিজছে অবিরাম বর্ষণে । কিছু কিছু পাখি ফিরে যাচ্ছে নীড়ে । কতদিন দেখিনা নদী আর গ্রামের এই চিরায়ত দৃশ্য ! এতবড় নৌকায় মানুষ মাত্র পাঁচজন । দুজন মাঝি, আর আমরা তিন বন্ধু । নৌকার খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুচোখ ভরে দেখছিলাম তীরের মনোরম দৃশ্য । মনে হলো- কী দরকার ঢাকা চট্টগ্রামের ইট পাথরের মাঝে ফিরে যাওয়ার? এইখানে, কোন এক নদীর তীরে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে কতইনা ভালো হত ! আহা ! জীবন এখানে কত সুন্দর !
সোয়াম্প ফরেস্ট !
ঘন্টা দেড়েক লাগলো সোয়াম্প ফরেস্টে পৌঁছতে । বড় নৌকা ছেড়ে এবার নিতে হলো ছোট নৌকা । থই থই করছে পানি । গাছের অর্ধেকটা পানির নিচে । গাছ গাছালির ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট নৌকা । অজান্তেই মুখ হতে বেরিয়ে আসে ! অসসাধারণ ! আলহামদুলিল্লাহ ! গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তখনো পড়ছেই । এরইমধ্যে পৌঁছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে । ওয়াচ টাওয়ারেরও অনেকটা ডুবে গেছে পানিতে । মাঝি বললো- এতটা পানি নাকি কখনো থাকে না । পশ্চিম আকাশে লালচে সূর্য, যতদূর চোখ যায় পানি, আর পানিতে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারি । মিঠাপানির এমন বন পৃথিবীতে খুব বেশি নেই । শেষবেলায় পাখির কিচিরমিচির । পুরো পরিবেশটা যেন একটা অপার্থিব রুপ ধারণ করেছে ।
ফেরাঃ
বনে তো আর থাকা যায় না ! অতএব ফিরতেই হবে । নৌকা বেরিয়ে এলো বাইরে । গোয়াইন নদীতে । একটা সরু রাস্তার ধারে নামলাম আমরা । তারপর সিএনজি ভাড়া করে সোজা সিলেট শহরের উদ্দেশ্যে । রাতে খেলাম পাঁচভাই রেস্টুরেন্টে । আম্বরখানা থেকে শুরু করে জিন্দাবাজার মুর্দাবাজার – জামতলা তালতলা জল্লার পার কল্লার পার-মেডিকেল কলেজ রিক্সায় করে এক চক্কর দিলাম । হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন গেলাম শাহজালালের মাজার, শাহপরাণের মাজার, ঐতিহাসিক ক্বীন ব্রিজ। খাওয়া দাওয়া হলো নামকরা দুএকটি রেস্টুরেন্টে ।
ও হ্যা, বিছানাকান্দি আমরা যাই নি । কক্সবাজার সেন্টমার্টিনের প্রবাল দ্বীপ আর রাঙামাটি বান্দরবানের ছড়ায়-ঝর্ণায় ঘুরে বেড়ানো আমাদের কাছে বিছানাকান্দি খুব একটা আকর্ষণীয় কিছু মনে হয় নি । আর হামহাম যাবার মত সময় ছিলনা হাতে । ইচ্ছে ছিল ট্রেনেই ঢাকা ফিরবো । কিন্তু স্টেশনে গিয়ে দেখি সেদিনের কোন ট্রেন ঢাকা যাবে না । কী আর করা ! বাসের আসনে পিঠ এলিয়ে দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে । পেছনে পড়ে থাকলো সিলেট, মৌলভীবাজার । সাথে নিয়ে এলাম একরাশ সুখস্মৃতি ।
হাবিবুর রহমান একসময় নানারকম স্ট্যাটাস দিয়া ফেসবুক কাপাইতো। সমাজ
রাষ্ট্র ধর্ম সাহিত্য রাজনীতি সকল বিষয়ে ছিল তাহার একচ্ছত্র পদচারণা(পড়ুন-
আঙুল চালনা)। কেহই তাহার সাঁড়াশি আক্রমণ হইতে রেহাই পাইতো না। সমাজের সকল
অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সে ছিল সোচ্চার কন্ঠ (পড়ুন- কীবোর্ড)। অতঃপর
কীভাবে যেন কী হয়ে গেল, তাহাকে আর কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাচ্ছিলো না। কত
বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে ফেসবুকে ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু কোথাও তাহার জ্ঞানগর্ভ
মতামত পাওয়া যায় না। অবশেষে কৌতূহলী ফেসবুকারগন তাহার প্রোফাইলে ঢু মারিতে
বাধ্য হইলেন। তাহার সর্বশেষ আপডেট পাওয়া গেল কয়েক মাস আগেঃ "Got Married" :P:P #ফেসবুকারের_মহাপ্রয়াণ
কয়েকটা দিন এইখানেতে কাটিয়ে যাবো নিঃস্ব একা পথিক হয়ে- এইতো আমার ভবিষ্যতের মাস্টার প্ল্যান এই হচ্ছে এখন আমার, আকাশছোঁয়ার এম্বি-শান। কী করছি? কী খাচ্ছি? করছি কবে বিয়ে শাদী? হৃদয় জমিন, আর কতদিন, থাকবে এমন অনাবাদী? চাকরি বাকরি? পড়ালেখা? ডিগ্রী কিংবা ব্যবসাপাতি? কবে হবে বাড়ী- গাড়ি? টয়োটা বা ঘোড়া হাতি? রাতদুপুরে বসে বসে ঘরের দাওয়ায় প্রশ্নগুলো উড়িয়ে দিচ্ছি দখিন হাওয়ায় এসব এখন আমার কানে বিরক্তিকর কলের গান; কয়েকটা দিন এইখানেতে কাটিয়ে যাবো নিঃস্ব একা পথিক হয়ে- এটাই আমার ভবিষ্যতের মাস্টার প্ল্যান; এই হয়েছে এখন আমার, আকাশছোঁয়ার এম্বি- শান।