এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সাকসেস বনাম হ্যাপিনেস

সাফল্য (Success) এর সাথে সুখের (Happiness) সম্পর্কটা খুব জটিল। মানুষ চায় Happy হতে, কিন্তু সে ছোটে Success এর পেছনে। এটা ঠিক যে Success সুখ আনে, কিন্তু Success কখনো কখনো সুখকে নষ্টও করে।
Success কে সংজ্ঞায়িত করাটা কঠিন। এটা নির্ভর করে কিসের মানদন্ডে বিচার করা হচ্ছে তার ওপর। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোই কি সাফল্য? ধরি ঢাকায় পৌঁছানো টার্গেট। এখন একজন লোক গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছালো। অন্য একজন মানুষ রংপুর থেকে রওয়ানা দিয়ে সেই সময়ে টাঙ্গাইল পৌঁছালো।
আপনি কাকে সফল বলবেন? দ্বিতীয়জন হয়তো পরের দিন ঢাকায় পৌঁছাবে। অথবা সে সাভারে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেলো। আপনি কি তাকে ব্যর্থ বলবেন? শুধুমাত্র এ কারণ যে সে ঢাকায় পৌঁছাতে পারে নাই? অথচ দূরত্বের বিচারে দ্বিতীয় জনই বেশি পথ পাড়ি দিয়েছে!
সাফল্য বিচার করাটা চরম মাত্রার আপেক্ষিক ব্যাপার। স্টার্টিং পয়েন্টটাকে আমলে নিতে হবে, পথের বাধা বিপত্তিকে আমলে নিতে হবে, উপায় উপকরণের সহজলভ্যতা বা প্রাপ্যতাকে আমলে নিতে হবে।
আমরা বেশিরভাগ সময়েই আমাদের উদ্দেশ্য ভুলে যাই। সফল হতে চাই কেন? Happy হবার জন্য। Happy থাকার জন্য। অথচ Success এর পেছেনে ছুটতে ছুটতে আমরা হ্যাপিনেসকেই বিসর্জন দিয়ে ফেলি।
বিষয়টা অনেকটা এরকম, আরামে থাকার জন্য অনেক দামী বাসা ভাড়া করলাম, কিন্তু সেই বাসার ভাড়া যোগাড় করতে এত কাজ করতে হয় যে বাসাতেই থাকা হয় না।
ছেলেমেয়ের ভালোর জন্যই সব করেন, কিন্তু এত কাজ করেন যে ছেলেমেয়েদের সাথেই ঠিকমত কথা বলতে পারেন না।
পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, আমাদের চোখে যারা Successful, কিন্ত তাদের জীবনে হ্যাপিনেস নেই। জীবনটা তাদের কাছে দুর্বিষহ। তাদের আনন্দের একমাত্র উৎস হলো ড্রাগ। প্রতিদিন তাদের ঘুমের জন্য ঔষধের প্রয়োজন হয়।
Success এর পেছনে আমাদের দৌঁড়াতে হবে। কারণ, ব্যর্থ জীবনে সুখ নেই। তবে তা হতে হবে- To a certain limit. যতক্ষণ পর্যন্ত তা Happiness কে নষ্ট না করে। চূড়ান্ত লক্ষ্যই যেখানে Happy হওয়া, সেখানে Happiness কে বিসর্জন দিয়ে Success পেয়ে লাভ কী?

সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মানুষ কেন বিয়ে করে?

মানুষ কেন বিয়ে করে? প্রশ্নের উত্তরটা এক কথায় দেয়া মুশকিল। কারণ, এখানে জৈবিক প্রয়োজনের চেয়েও বেশি কিছু আছে।
আদম (আঃ) এর জীবন থেকেই এর উত্তরটা আমরা সহজে পেয়ে যাই। ভালোই ছিলেন তিনি, জান্নাতের অফুরন্ত অভাবনীয় সব প্রাচুর্যের ভেতর সময় কাটছিল তাঁর। বলা হয়- জান্নাতে কোনকিছুরই অভাব নেই, একমাত্র যে বিষয়টা সেখানে অনুপস্থিত, তাহলো 'অভাব'। অথচ সেই জান্নাতে থেকেও কিসের যেন 'অভাব' বোধ করছিলেন আদম (আঃ)।
তিনি চরম নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন। বলা হয়, তার নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেন হাওয়া (Eve) কে।
মানুষ কিছু সময়ের জন্য একা থাকতে ভালোবাসে, কিন্তু দীর্ঘ সময় সে একা থাকতে পারেনা। তার একজন সঙ্গী দরকার হয়। মানুষ এমন এক প্রাণী, যে কথা না বলে থাকতে পারেনা, কথা না শুনে থাকতে পারেনা। কিছু কিছু কথা থাকে, কাউকে বলতে না পারলে যেন দম আটকে আসে।
একটা মেয়ের বয়স যখন ১৮-২০ পার হয়, তখন থেকেই সে একে একে তার বান্ধবীদের হারাতে থাকে। অনেকের বিয়ে হয়ে যায়, অনেকেই দূরে চলে যায়। কারো সাথে বছরে দু'বছরে একবার দেখা হয়, কারো সাথে তাও হয় না। ধীরে ধীরে সে নিজেকে আবিস্কার করে নিঃসঙ্গ জগতে।
ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। বয়স যতই বাড়তে থাকে, ততই বাড়তে থাকে একাকীত্ব, বাড়তে থাকে নিঃসঙ্গতা। পড়ালেখা শেষে বন্ধুরা কেউ বিয়ে করে পর হয়, কেউ চাকরি নিয়ে দূরে চলে যায়। কাছে থাকলেও ব্যস্ততার কারণে চাইলেই যখন তখন আর আগের মত টি-স্টলে বা কফিশপে আড্ডা দেয়া হয়ে ওঠে না।
কর্মস্থলে কলিগেরা থাকে, কিন্তু কলিগ কলিগই। কলিগের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কম। কারণ, সেখানে কিছুনা কিছু স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকেই যায়।
অনেক কিছু ঘটে যায় প্রতিদিনকার জীবনে, কাউকে বলা যায় না। অনেক কথা জমে থাকে। কাউকেই বলা হয় না।
এসময় খুব বেশি করে এমন একজনের অভাব বোধ হতে থাকে, যাকে সবকিছু নিশ্চিন্তে বলা যায়। যার সবকিছু শোনা যায়।
সবসময় দরকারী কথা শুনতে মানুষের ভালো লাগেনা, কখনো কখনো তার একদম অদরকারী, নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় কথা শুনতে ইচ্ছে হয়। শুনতে ভালো লাগে। বলতে ইচ্ছে হয়। বলতে ভালো লাগে।
যে ছেলেটা মেসে থাকতে বিয়ের নামও মুখে নিতোনা, চাকরি নিয়ে দূরে চলে যাওয়ার ক'মাসের মধ্যে তার বিয়ের খবর শোনা যায়। যে ছেলেটা ছিল খুব সৌন্দর্যপ্রবণ, সুন্দরী মেয়ে ছাড়া যে বিয়েই করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল, দেখা যায় নিঃসঙ্গতার আঘাতে সব পণ ভেঙ্গে গেছে তার। কারণ, সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল একজন কথা বলার সঙ্গীর, একজন সমব্যথী মানুষের। সেটা খুঁজে পেলেই ঘটনা খতম হয়ে যায়।
জীবনের নানান সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে খুব কনফিডেন্ট ছেলেটাও একটা সময় কেমন যেন দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে। সে চায়, কেউ অন্তত একজন তাকে সাহস যোগাক- কেউ একজন মন থেকে বলুকঃ 'তুমি ঠিক পথে আছো'। অথবা, কেউ একজন তাকে বলুক, ও কাজ করোনা। আমার মন বলছে- ওটা তোমার জন্য ভালো হবে না।
নির্মলেন্দু গুণের 'তোমার চোখ এত লাল কেন?' কবিতায় উঠে এসেছে এই আকাঙখার কাব্যিক রুপ।
"আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুকঃ
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কিনা।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুকঃ 'তোমার চোখ এতো লাল কেন?'
(বিবাহ কথন-৩৫)

শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ওরা আসছে

ওরা আসছে।
কোলে অবুঝ শিশু, পিছু পিছু হাঁটছে বড় বাচ্চারা
কাঁধের পুটলিতে কয়েকটি কাপড়
থালা-বাসন, হাড়ি পাতিল, হাতের কাছে যা পাওয়া গেছে।
ওরা আসছে। বাবা নেই, মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই,
বুলেট কিংবা আগুন নিয়ে গেছে জীবনের সবটুকু সম্বল।
ওরা আসছে এইটুকু আশা নিয়ে- হয়তো নদীর ওপারে গেলে
ঘুমানো যাবে একটা রাত,
হয়তো দুধের বাচ্চাটা পাবে একফোঁটা দুধ,
হয়তো অনাহারী উদরে মিলবে একবাটি পান্তাভাত।
ওপাশে তারা কখনো মানুষ দেখেনি। দেখেছে শুধু দু'পেয়ে জানোয়ার।
ওরা আসছে অনেক আশা নিয়ে,
হয়তো নদীর এইপারে তারা দেখতে পাবে কিছু
সত্যিকার মানুষ। 

(ওরা আসছে/ মুহসিন আব্দুল্লাহ)

বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

পাত্র পছন্দের ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া উচিত?

পাত্রী নিয়ে যত কথা বলা হয়, পাত্র নিয়ে তত কথা বলা হয় না। কারণটা পুরুষের সামাজিক আধিপত্য। সবসময় ছেলেরাই পাত্রী পছন্দ করে, পাত্র পছন্দের ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিলনা বললেই চলে। যদিও এটা ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত এবং অত্যাবশ্যক।
পাত্র পছন্দের ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা তিন-চারটি বিয়ের ঘটনা উল্লেখ করবো। দেখা যাক, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা কীভাবে পাত্র পছন্দ করেছেন।
১.
মুসলিম নারীদের মধ্যে অন্যতম সম্মানিত নারী হলেন খাদিজা (রাঃ)। তিনি সম্মানিত রাসুলের স্ত্রী হিসেবে, সেই সাথে তার নিজের মহান কর্মকান্ডের কারণে। মজার ব্যাপার হলো, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেননি। তিনিই মুহাম্মাদ (সাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
তিনি যখন রাসুল (সাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন তাঁর বয়স ৪০। ইতোপূর্বে তার দু'বার বিয়ে হয়েছিল। তিনি ছিলেন বড় মাপের ব্যবসায়ী ও ধনী মহিলা।
বয়স ও অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন পরিপক্ক। সুতরাং খাদিজা অল্পবয়সী কিশোরী তরুণিদের মত আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলার সুযোগ আমাদের হাতে থাকছে না। এছাড়া, তার ছিল সংসার করার অভিজ্ঞতা। এর আগে তার দু'বার বিয়ে হয়েছিল। একজন স্বামী মারা যান, আরেকজনের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
অতএব তিনি জানতেন, সংসার করার জন্য কেমন পুরুষ দরকার। সেজন্য তার বিবেচনাকে অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ আমাদের হাতে নাই।
মক্কায় সেসময় অনেক ধনাঢ্য লোক ছিল। বড় ব্যবসায়ী ছিল। অনেক গোত্রপতি ছিল। খাদিজাকে বিয়ে করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল অনেকেই।
অপরদিকে মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন এতিম। চাচা আঃ মুত্তালিবের আশ্রয়ে লালিত। ২৫ বছর বয়সে তিনি নিজে তেমন একটা ধনীও ছিলেন না। মুহাম্মাদ (সা) এর চাচা আবু তালিবের আর্থিক অবস্থাও সেসময় ভালো ছিলনা।
তবু কী কারণে তাঁকে পছন্দ করেছিলেন খাদিজা?
উত্তরটা হলোঃ তিনি পছন্দ করেছিলেন মুহাম্মাদের সততা, বিশ্বস্ততা এবং উত্তম চরিত্র।
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বয়স যখন পঁচিশ বছর, তখন চাচা আবু তালিব একদিন তাঁকে ডেকে বললেনঃ ভাতিজা, আমি একজন বিত্তহীন মানুষ। সময়টাও আমাদের জন্য খুব সঙ্কটজনক। আমরা মারাত্মক অভাবের মধ্যে আছি। আমাদের কোন ব্যবসা বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়ায় যাচ্ছে। খাদিজা তার পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হযতো তোমাকে সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিস্কলুষতা তার জানা আছে। যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনা এবং ইহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি, তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।
সেবছর মুহাম্মাদ (সাঃ) মজুরির বিনিময়ে খাদিজার বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব নেন। এই সফরের সঙ্গীরা খাদিজার কাছে মুহাম্মাদের ব্যবহার ও চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেন। যদিও আগে থেকেই জানতেন, এবার খাদিজা মুহাম্মাদকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি তার একজন দূতের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাঃ)কে বলেনঃ হে আমার চাচাতো ভাই! আপনার বিশ্বস্ততা, সততা ও উন্নত নৈতিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
খাদিজার প্রতিনিধি নাফিসা বিনতে মুনইয়া'র ভাষায়ঃ মুহাম্মদ সিরিয়া থেকে ফেরার পর তাঁর মনোভাব জানার জন্য খাদিজা আমাকে পাঠালেন। আমি তাঁকে বললামঃ মুহাম্মদ! আপনি বিয়ে করছেন না কেন? তিনি বললেন, বিয়ে করার মতো অর্থ তো আমার হাতে নেই। বললামঃ যদি আপনাকে একটি সুন্দর প্রস্তাবের প্রতি আহবান জানানো হয়, অর্থ-বিত্ত, মর্যাদা ও অভিজাত বংশের প্রস্তাব দেওয়া হয়, রাজি হবেন? বললেনঃ কে তিনি? বললামঃ খাদিজা। বললেনঃ এ আমার জন্য কিভাবে সম্ভব হতে পারে? বললামঃ সে দায়িত্ব আমার।
তিনি রাজি হয়ে গেলেন।
পরে খাদিজা (রাঃ) নিজেই মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্য মুহাম্মাদকে (সাঃ) অনুরোধ করেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ) এই বলে অস্বীকৃতি জানান যে, দারিদ্র‍্যের কারণে হয়তো খাদিজার বাবা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন। অবশেষে খাদিজা নিজেই বিষয়টি তাঁর পিতার কাছে উত্থাপন করেন।
খাদিজা(রাঃ)র বাবা এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। তিনি বলেছিলেনঃ তোমাকে আমি আবু তালিবের এই এতিমের সাথে বিয়ে দিব? আমার জীবনের শপথ! কক্ষণও তা হবে না। কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, আর মুহাম্মদের সাথে আমি তোমাকে বিয়ে দেবো?
পরে খাদিজা কৌশলে বাবার সম্মতি আদায় করেন, এবং বিয়ে সম্পন্ন হয়।
খাদিজা (রাঃ) নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালিমার ব্যবস্থা করতে বলেন। (তথ্যসূত্রঃ আসহাবে রাসুলের জীবন কথা)
চলবে...
(বিবাহ কথন- ৩২) 

২. 
নির্যাতনের শিকার নিজ গোত্রের একজন মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নির্যাতনকারী ব্যক্তিকে আঘাত করে বসেন মুসা (আঃ)। এতে ঐ লোক মারা যায়। অনাকাংখিত এই দুর্ঘটনায় মুসা (আঃ) খুব কষ্ট পান। পরে তার কাছে খবর আসে যে তাঁকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে মিশর ছেড়ে মাদিয়ানে (জর্ডান) চলে যান মুসা (আঃ)।
মাদিয়ানে প্রবেশ করে তিনি একটা কূপের কাছে পৌঁছলেন। দেখলেন, সেখান থেকে সবাই পানি নিচ্ছে, কিন্তু দু’টি মেয়ে তাদের তৃষ্ণার্ত পশুগুলি সহ অসহায়ভাবে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তারাও পানি নিতে পারছে না।
মুসা (আঃ) মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে যায়। আর আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ’ (যিনি ঘরে বসে আমাদের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছেন)।
মুসা (আঃ) তাদের পশুগুলোকে পানি পান করালেন’ (তারপর মেয়ে দু’টি পশুগুলি নিয়ে বাড়ী চলে গেল)।
তারপর মুসা একটি গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার উপর যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তারই মুখাপেক্ষী’।
কিছুক্ষণ পর ঐ দুজন মেয়ের একজন সলজ্জ পদক্ষেপে তাঁর কাছে এগিয়ে এলো। মেয়েটি এসে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে মুসাকে বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি যে আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় স্বরূপ আপনাকে পুরস্কার দিতে পারেন’।
এই মেয়েদের বাবা ছিলেন মাদিয়ানবাসীদের কাছে প্রেরিত নবী হযরত শুআইব (আঃ)। মুসা (আঃ) ইতোপূর্বে কখনো তাঁর নাম শোনেননি বা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর কাছে পৌঁছে মুসা (আঃ) সব বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। শুআইব (আঃ) সবকিছু শুনে বললেন, ‘ভয় করো না। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছ’।
এমন সময় দুই মেয়ের একজন বলল, আব্বাজান! তাকে আমাদের বাড়িতে চাকরি দিয়ে নিয়োগ দিন। আপনার সাহায্যকারী হিসাবে এমন একজনই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত।
শুয়াইব (আঃ) ছিলেন একজন নবী ও বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি মেয়ের মনের কথা বুঝতে পারলেন। তিনি মুসা (আঃ) কে বললেন, আমি আমার মেয়েদের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই।
মুসা রাজী হলেন। তারপর, আট থেকে দশ বছর তাঁদের সাথে থাকার শর্ত দিয়ে শুয়াইব (আঃ) তাঁর মেয়েকে মুসা (আঃ) এর সাথে বিয়ে দিলেন।
এভাবে শুয়াইব (আঃ) ও তাঁর মেয়ে এমন একজন যুবককে পাত্র হিসেবে বাছাই করলেন, ঐ বিদেশ বিভূঁইয়ে যিনি ছিলেন একজন নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন মানুষ। খুনের দায়ে পলাতক এক ফেরারি যুবক।
সাহস, পরোপকারিতা আর বিশ্বস্ততাই ছিল শুয়াইব (আঃ) ও তার মেয়ের চোখে মুসা (আঃ) এর আসল গুণ, যেকারণে শুয়াইব (আঃ) এর মেয়ে তাঁকে নিজের স্বামী হিসেবে বাছাই করেছিলেন।
(তথ্যসূত্রঃ সুরা কাসাস, ২৩-২৮)
(বিবাহ কথন- ৩৩) চলবে... 

৩. ফাতেমা (রাঃ) কে বিয়ের জন্য রাসুল (সাঃ) এর কাছে আরো অনেকের মত প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন হযরত আবু বকর এবং ওমরও (রাঃ)। কিন্তু রাসুল (সাঃ) বিনয়ের সাথে, ভদ্রোচিতভাবে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
দারিদ্র‍্যের কারণে রাসুল (সাঃ) এর কাছে ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে সাহস করতে পারছিলেন না হযরত আলী (রাঃ)। তখন অনেকেই আলী (রাঃ) কে উৎসাহিত করেন রাসুলের কাছে ফাতিমার ব্যাপারে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য।
অনেকের প্ররোচনা ও উৎসাহে একদিন তিনি সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলেন।
তাঁর ভাষায়ঃ অবশেষে আমি একদিন রাসুলুল্লাহর (সাঃ) নিকট গেলাম। তাঁর সামনে বসার পর আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। তাঁর মহত্ত্ব ও তাঁর মধ্যে বিরাজমান গাম্ভীর্য ও ভীতির ভাবের কারণে আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। এক সময় তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেনঃ কী জন্য এসেছো? কোন প্রয়োজন আছে কি? আমি চুপ করে থাকলাম। রাসুল (সাঃ) বললেনঃ নিশ্চয় ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছো?
আমি বললামঃ হ্যা। তিনি বললেনঃ তোমার কাছে এমন কিছু আছে কি, যা দ্বারা তুমি তাকে হালাল করবে? বললামঃ আল্লাহর কসম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! নেই। তিনি বললেনঃ যে বর্মটি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম সেটা কী করেছো?
বললামঃ সেটা আমার কাছে আছে। আলীর জীবন যে সত্তার হাতে- তাঁর কসম, সেটা তো একটি “হুতামী” বর্ম। তার দাম চার দিরহামও হবে না।
রাসুল (সাঃ) বললেনঃ আমি তারই বিনিময়ে ফাতিমাকে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। সেটা তার কাছে পাঠিয়ে দাও এবং তা দ্বারাই তাকে হালাল করে নাও।
আলী (রাঃ) খুব দ্রুত বাড়ি গিয়ে বর্মটি নিয়ে আসেন। কনের সাজগোজের জিনিসপত্র কেনার জন্য রাসুল (সাঃ) সেটি বিক্রি করতে বলেন।
বর্মটি উসমান ইবন আফফান (রাঃ) চারশ সত্তর দিরহাম দিয়ে কিনে নেন। এই অর্থ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাতে দেয়া হয়। তিনি তা বিলালের (রাঃ) হাতে দিয়ে কিছু আতর-সুগন্ধি কিনতে বলেন, আর বাকি যা থাকে উম্মু সালামার (রাঃ) হাতে দিতে বলেন। যাতে তিনি তা দিয়ে কনের সাজগোজের জিনিস কিনতে পারেন।
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের ডেকে পাঠান। তাঁরা উপস্থিত হলে তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি তাঁর মেয়ে ফাতিমাকে চারশ মিছকাল রূপার বিনিময়ে আলী(রাঃ)র সাথে বিয়ে দিয়েছেন। তারপর আরবের প্রথা অনুযায়ী কনের পক্ষ থেকে রাসুল (সাঃ) ও বর আলী (রাঃ) নিজে সংক্ষিপ্ত খুতবা দান করেন। তারপর উপস্থিত অতিথি সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে খোরমা ভর্তি একটা পাত্র উপস্থাপন করা হয়।
এভাবে অতি সাধারণ ও সাদাসিধে ভাবে আলীর সাথে নবী দুহিতা ফাতিমাতুয যাহরার বিয়ে সম্পন্ন হয়। স্থাপিত হয় ইসলামের ইতিহাসে একটি মহান গৌরবময় বৈবাহিক সম্পর্ক।
হিজরী দ্বিতীয় সনে, বদর যুদ্ধের পর আলী (রা) তাঁর স্ত্রীকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য একটি ঘর ভাড়া করতে সক্ষম হন। সে ঘর ছিল অতি সাধারণ মানের। বিত্ত-বৈভবের কোন স্পর্শ সেখানে ছিল না। ছিলনা কোন মূল্যবান আসবাব পত্র, খাট-পালঙ্ক, জাজিম, গদি, কোনোকিছুই। ‘
আলীর (রাঃ) ছিল কেবল একটি ভেড়ার চামড়া, সেটি বিছিয়ে তিনি রাতে ঘুমাতেন আর দিনে সেটি মশকের কাজে ব্যবহার হতো। কোন চাকর-বাকরও ছিল না। আসমা বিনত উমাইস (রাঃ), যিনি আলী-ফাতিমার (রাঃ) বিয়ে ও তাঁদের বাসর ঘরের সাজ-সজ্জা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, বলেছেন, খেজুর গাছের ছাল ভর্তি বালিশ-বিছানা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই ছিল না।
আলী (রাঃ) তাঁর একটি বর্ম এক ইহুদীর কাছে বন্ধক রেখে কিছু যব আনেন। তা দিয়েই তৈরি হয়েছিল তাঁদের বাসর রাতের খাবার, সম্পন্ন হয়েছিল সাদাসিধে ওয়ালিমা।
****
কেন ফাতিমার জন্য আরো অনেক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নিঃস্ব আলীকে বাছাই করেছিলেন মহানবী (সাঃ)? উত্তরটা তিনিই দিয়ে গেছেন ফাতিমাকে।
আলীর প্রস্তাব সম্পর্কে ফাতিমাকে জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেনঃ ফাতিমা! আমি তোমাকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে বেশী বিচক্ষণ এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিচ্ছি।
বিয়ের পর বিদায় নেয়ার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ফাতিমা (রাঃ)। তাঁর কান্নায় আবেগাপ্লুত হন রাসুল(সাঃ) নিজেও।
আবেগাক্রান্ত রাসুল (সাঃ) ফাতিমাকে বলেনঃ আমি তোমাকে সবচেয়ে শক্ত ঈমানের অধিকারী, সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো নৈতিকতা আর উন্নত মন-মানসের অধিকারী ব্যক্তির নিকট গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি।
(তথ্যসূত্রঃ আসহাবে রাসুলের জীবন কথা)
(বিবাহ কথন-৩৪) 

মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

কাউকে কাউকে প্রথম দেখাতেই খুব আপন মনে হয় কেন?

কাউকে কাউকে প্রথম দেখাতেই খুব আপন, খুব পরিচিত মনে হয়। আবার কারো কারো সাথে অনেক বছর কাটিয়ে দিলেও সম্পর্কটা আলগাই থেকে যায়।
তো, এর একটা স্পিরিচুয়াল ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা হলোঃ আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টির আগেই আমাদের রুহগুলো সৃষ্টি করেন। তারপর তাদেরকে আলমে আরওয়া বা রুহের জগতে রাখেন। পৃথিবীতে আসার আগ পর্যন্ত আমরা সেখানেই ছিলাম।
ঐসময় যেসব রুহ কাছাকাছি ছিল, পাশাপাশি ছিল, পৃথিবীতে যদি তারা একটা নির্দিষ্ট সময়ে জন্মগ্রহণ করে- তাহলে এখানেও তাদের পরস্পরকে পরিচিত মনে হয়। অনেক বেশি আপন মনে হয়।
আমার পরিচিত মানুষের সংখ্যাটা নেহায়েত কম না। আবার জীবনে অপরিচিত এমন অনেক মানুষকে পেয়েছি, যারা বলেছেন- 'বাবা, তোমারে দেইখ্যা খুব চিনা চিনা লাগতাছে', কিংবা 'ভাই, আপনাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন?'
মাঝে মাঝে মনে হয়,  আলমে আরওয়াতে আমার রুহটা কি সারাক্ষণই শুধু ঘোরাঘুরি করত? 

রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

কুরবানির পশুর গোশত তিন দিনের বেশি জমা রেখে খাওয়া

স্বাভাবিক সময়ে কুরবানির গোশত জমা রেখে যেকোন সময় খাওয়া যায়। কিন্তু, আমার মনে হয়, এইবছর কুরবানির পশুর গোশত তিন দিনের বেশি জমা রেখে খাওয়া বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য উচিত হবে না। 
একবার মদীনার বেদুইনদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। সেইবছর রাসুল (সাঃ) ঘোষণা করেন, কেউ যেন তিনদিনের বেশি কুরবানির গোশত না খায়। অর্থাৎ তিন দিনের জন্য রেখে বাকিটা যেন দান করে দেয়। পরে অবস্থার উন্নতি হলে রাসুল (সাঃ) এই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন।  
এইবছর বাংলাদেশেও অনেকটা সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়।  
প্রথমে হাওরে বন্যা হলো। ফসল নষ্ট হলো। মাছ, গবাদিপশু মারা গেল। আমি নিজে সেসময় হাওরবাসীর দুরবস্থা দেখে এসেছি। 
তারপর সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হলো। মানুষের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে, গবাদিপশু মারা গেছে, গোলার ধান ভেসে গেছে। ফসল নষ্ট হয়েছে। চরম দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। 
তাছাড়া মায়ানমারের আরাকানে সেনাবাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। আরাকান থেকে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। তারা তাদের সব সহায় সম্বল ফেলে শুধু জীবন নিয়ে পালিয়ে আসছে। 
এত এত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে রেখে আমরা কীভাবে গোশত জমা করে খাই? দেশে যদি কোন কার্যকর ইসলামী শরীয়া পরিষদ থাকত, আমার মনে হয় তারা আমার এই বক্তব্য ফতোয়া হিসেবে জারি করতেন। কিন্তু সেটা যেহেতু নেই, আমাদের নিজেদেরকেই সচেতন হতে হবে। 
আসুন, আমরা কুরবানির গোশত তিনদিনের বেশি জমিয়ে না রেখে যত বেশি সম্ভব গরীব অসহায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের দান করি। 
(আগ্রহীদের মুসলিম শরীফের কুরবানি অধ্যায় পড়ে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।) 

শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

আজকে ঈদের দিন

-কী রুবেল মিয়া, মন খারাপ করে বসে আছো ক্যান?
-আইজকা ঈদের দিন ছার, বাড়িত যাইতে পারলাম না।
-তো কী হইছে, আমিও তো আছি, না?
-আপনে তো ছার ব্যাচেলার মানুষ। আপনার চিন্তা কী! বাচ্চাডায় খুব কানতেছিলো ছার। ইচ্ছা হইতাছিল চাকরি বাকরি ছাইড়া চইলা যাই। 
চোখ ছলছল করে ওঠে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় রুবেল মিয়ার। মনটা আনচান করে ওঠে ডাঃ মুনীরেরও।
-রুবেল মিয়া, যাও সবার জন্যে চা নিয়া আসো। আর সবাইকে আমার রুমে আসতে বলো।
ঈদের দিনেও যাদের ছুটি হয় না তাদের একটা বড় অংশ হলেন এরা। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয়, দারোয়ান, হাসপাতালের অন্যান্য স্টাফ। কী সরকারি হাসপাতাল, কী বেসরকারি। ঈদের সময়কার ডিউটির জন্য নেই অতিরিক্ত এলাউয়েন্স। মনটা অনেকেরই খারাপ থাকে। সকাল থেকেই তাই কর্মচারীদের দিকে খেয়াল রাখছিলেন ডাঃ মুনীর। অনেকেরই বিমর্ষ মুখ চোখে পড়ে তার। 
সবাই চলে এসেছে ডক্টরস রুমে। সবার হাতে চায়ের কাপ। এই ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু সময়ের জন্যে হলেও সবার ভেতর যেন একটা সাম্যের অনুভূতি তৈরি হয়। 
ডাঃ মুনীর চায়ে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করেন। আজকে ঈদের দিন। আপনারা যারা আজ এখানে ডিউটি করছেন, আমি খেয়াল করেছি, অনেকেরই মন খারাপ। আমার অনুরোধ, আপনারা মন খারাপ করবেন না। আপনারা যে কত বড় একটা কাজ করছেন, সেটা হয়তো এখন উপলব্ধি করতে পারছেন না। আমি শুধু এটুকু বলবো, এই হাসপাতালে যে শত শত রোগী ভর্তি আছেন, তাদের কথা একবার চিন্তা করুন তো! তারা, তাদের পরিবার, কতটা কষ্টে আছে! আজ এমনও তো হতে পারতো, হাসপাতালের বেডে এরকম অবস্থায় আপনি বা আমিও থাকতে পারতাম! কিংবা আমাদেরই কোন নিকটাত্মীয়! কিন্তু তা না হয়ে আমরা এই অসুস্থ মানুষগুলোর সাথে আছি। এটাকি আল্লাহর রহমত না?
আজ হয়তো ভালো আছি, কিন্তু অন্যকোন ঈদে, পূজায়, কোন ছুটির দিনে, আমরা অসুস্থ হয়ে যেতে পারিনা! আজ যদি আমরা কষ্ট স্বীকার না করি, সেদিন আমাদের জন্য কে কষ্ট করবে? 
মন খারাপ করবেন না। সবকিছুর প্রতিদান আল্লাহ সরাসরি দেন না। আবার সবকিছুর প্রতিদান এই দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। শুধু এইটুকু মনে রাখবেন, কোন ভালো কাজই শেষ পর্যন্ত আনপেইড থাকে না। দুনিয়ায় এবং আখেরাতেও, যেকোন ভালো কাজের প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা অনেকগুণ বেশি করে ফিরিয়ে দেন। 
কথা বলতে বলতে রুবেল মিয়াকে খেয়াল করেন ডাঃ মুনীর। বেদনার কালো মেঘ সরে গিয়ে ধীরে ধীরে তার মুখে ফিরে আসছে স্বাভাবিক সূর্যের আলো। 

শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

অবাস্তব শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে জাতীয়ভাবে পঙ্গু করে রেখেছে

অবাস্তব শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে জাতীয়ভাবে পঙ্গু করে রেখেছে। আমাদের দেশে শিক্ষা মানে শুধুই বুকিশ নলেজ। এখানে প্রাক্টিকাল কিছুই শেখানো হয়না। যেমন, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য শেখানো হয়, উগান্ডার রাজধানীর নাম শেখানো হয়, আমাজন জঙ্গলের প্রাণীদের নাম মুখস্ত করানো হয়। কিন্তু সাঁতার শেখানো হয় না।
সাতার না জানার কারণে প্রতিবছর কত শিশু কিশোর এবং বয়স্ক মানুষ মারা যায় ধারণা আছে? লঞ্চডুবিতে, লেকের পানিতে, নদীতে, পুকুরে ডুবে কত মানুষ মারা যায়? সাতার জানলে নিশ্চয় এত মানুষ মারা যেতো না।
স্কুলগুলোতে শত শত পৃষ্ঠার বুকিশ জ্ঞান দেয়া হয়, সাতার শেখানো হয়না কেন? কারণ, এটাকে কোন শিক্ষা মনে করা হয় না।
জীবন বাঁচানোর জ্ঞান না দিয়ে আমাদের শুধু দেয়া হচ্ছে 'চাকরি পাবার' জ্ঞান।
আমি মনে করি, ১০ বছর বয়সের মধ্যে প্রত্যেক শিশুর সাতার শেখা বাধ্যতামূলক করা দরকার।
তারপর ধরুন, সাইকেল চালানো। সাইকেল চালাতে পারা একটা বেসিক স্কিল। কিন্তু কোন স্কুলে কি সাইকেল চালানো শেখায়? আমি অবাক হই, অসংখ্য ছেলে সাইকেল চালাতে পারেনা। মোটরসাইকেল বা কার ড্রাইভিং- এগুলোও বেসিক স্কিল। কিন্তু কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইসব শেখানো হয় না। শিক্ষানীতিতে, শিক্ষাব্যবস্থায় এর কোন গুরুত্ব নেই।
বাচ্চাদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো খুব জরুরি। বিশেষ করে মেয়েদের। কিছুদিন আগে মিরপুরে এক ইভটিজারকে ক্লাস সিক্স পড়ুয়া দুইটা বাচ্চা মেয়ে ব্যাপক প্যাদানি দিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছিল। কারণ, ঐ বাচ্চারা তায়কোয়ান্দো জানতো।
কিন্তু কোন স্কুলে, কলেজে কোথাও আত্মরক্ষার কোন শিক্ষা দেয়া হয় না। ড্রিল ক্লাস বা শারীরিক শিক্ষা নামে যে ক্লাস হয় তা নামকাওয়াস্তে কিছু ইনডোর গেমস দিয়ে শেষ করা হয়।
স্কুলের বাচ্চারা কি জানে, কীভাবে ধান রোপন করতে হয়? কীভাবে ধানক্ষেতে সেচ দেয়া হয়? কীভাবে ধান মাড়াই করা হয়?
কৃষি শিক্ষা বইয়ে অনেক থিওরি আছে, কিন্তু বাস্তবে আমি কখনো দেখিনি স্কুলের বাচ্চাদের কোন ক্ষেতখামারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই বাচ্চারা বই-পুস্তকে কৃষকদের চেহারা দেখে, ধুলিমলিন খালি গায়ের কিছু মানুষ। তারা শুধু জানে- কৃষকেরা গরীব। অনেকেই এই কৃষকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শিখে যায়। ফসল ফলানো যে একটা মহৎ কাজ, জরুরি কাজ, এইটা কেউ উপলব্ধি করতে শেখে না। ধান উৎপাদন করার আগ্রহ কারো জন্মে না, সবাই শুধু শেখে ধান বিক্রির হিসাব। সুদের হার আর লাভ ক্ষতির হিসাব।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের উৎপাদন করতে শেখায় না, শেখায় মধ্যস্বত্ত্ব ভোগী হতে।
কর্মমুখী শিক্ষার নামে যে কারিগরি বিভাগ চালু আছে, সেখানেও থিওরির কপচানি বেশি, বাস্তব কাজ শেখানো হয় খুবই কম। ঘরের একটা ইলেক্ট্রিক বাতি নষ্ট হলে আমরা ক'জন সেটা নিজে নিজে ঠিক করতে জানি? এই বেসিক শিক্ষাগুলো কি আমাদের স্কুল কলেজ থেকে পেয়ে আসা উচিত ছিলনা?
যতদিন শুধু এইরকম হাওয়াই জ্ঞাননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকবে, ততদিন আমরা অনেক শিক্ষিত 'তত্ত্ববাগীশ' জ্ঞানী মানুষ পেতে থাকবো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের অবস্থার উন্নতি হবে না