এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

পাঁজরের বাঁকা হাড় !

মাঝে মাঝে পাঁজরে হাত বুলাই । ধারাপাতের মত গুণি
বাঁকা হাড়ের সংখ্যা :v। এক দুই তিন
চার পাঁচ !
হায় হায় ! সবই তো আছে ঠিকঠাক মতই !
তবে কি
তবে কি
তবে কি
হায় ! তবে কি
সৃজিত হয়নি কেউ, আমার পাঁজর হতে ?

ছিন্নমুকুল

এতটুকু একটা বাচ্চা, এতটুকু শরীর । কতটুকুই বা বুকের খাঁচা ? ঠিকমত আঙুল বসানোর উপায় নেই । তবু বৃদ্ধাঙ্গুলি দুটি বুকের মাঝখানে দুইপাশে রেখে চাপ দেয়া শুরু করলো নোমান ।

রাত প্রায় তিনটা । ঘুমঘুম চোখে ডক্টরস রুমে বসে ছিল নোমান । দরজার পর্দাটা উড়ছিল ফ্যানের বাতাসে । মাঝে মাঝে শিশুর কান্না ভেসে আসছিল ।

নোমান একজন ডাক্তার । ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করার পরে একবছর ইন্টার্ণশিপ ট্রেনিং নিতে হয় । নোমান এখন ইন্টার্নশিপ করছে । গতকালই জয়েন করেছে হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে । পেডিয়াট্রিকস ওয়ার্ড । এই ওয়ার্ডে এসে অনেকটাই মন খারাপ হয়ে গেছে নোমানের । ছোট ছোট বাচ্চাগুলি কতরকম কষ্টে ভুগছে , দেখতে ভালো লাগে না । ফুটফুটে পরীর বাচ্চার মত একটা শিশু, অথচ তার হার্ট ঠিকমত কাজ করছে না । কেউ কেউ ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ।

এতদিন মেডিসিন ওয়ার্ডে কাজ করেছে নোমান । কিন্তু তখন এতটা খারাপ লাগেনি । বড় মানুষেরা তাদের ব্যথার কথা বলতে পারে, শিশুরা পারেনা । তাদের কষ্ট থেকে যায় অব্যক্ত । এক কান্নার আওয়াজে কতটুকু বোঝানো যায় ? আর এই ব্যাপারটাই বেশি করে কষ্ট দেয় নোমানকে । শিশুর মা ছুটে আসে,  কেউ বলে ভাইয়া আমার বাবুটাকে একটু দেখেন – খুব কান্নাকাটি করছে । কেউ বলে, বাবা আমার নাতিডারে একটু দেইখা যাও । আমার ভালা ঠেকতাছে না । বুকটা ধ্বক করে ওঠে নোমানের । ইচ্ছে করে কোন এক জাদুর কাঠি বুলিয়ে সব বাচ্চার সব কষ্ট নিমেষেই দূর করে দেয় । ইচ্ছে হয় ; রুপকথার মত যদি বিপদ আপদে ঘেরা কোন এক অচিন পাহাড়ের চূড়ায়ও এমন কোন ওষুধ পাওয়া যেত, যা দিয়ে এইসব শিশুর কষ্ট দূর করা যায়- সব ছেড়েছুড়ে তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তো নোমান । কিন্তু সেরকম কিছু তো নেই । চিকিৎসাবিজ্ঞান সত্যি অনেকদূর এগিয়েছে । তবুও রয়ে গেছে অনেক সীমাবদ্ধতা । আর আমাদের দেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি গরীব দেশে সেই সীমাবদ্ধতার কোন সীমা নেই ।

মাঝে মাঝে স্রষ্টার প্রতি অভিযোগ করতে ইচ্ছা হয় । খোদা যত কষ্ট দাও বড়দের । এই শিশুদের কষ্টে না রাখলেই কি নয় ?
কিন্তু তা করা যায়না । কারণ, স্রষ্টার জ্ঞান অসীম, স্রষ্টা নিজেই অসীম । তাঁকে প্রশ্ন করা চলে না । তাঁর ইচ্ছা তিনিই ভালো জানেন । মানুষকে যতটুকু জানানো হয়েছে এর বেশি জানতে পারবে না । বরং যতটুকু সামর্থ আছে তা দিয়ে মানুষকে ভালোর জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে ।

একটা অবুঝ শিশুর জন্য বাবা মায়ের কতটা ভালোবাসা থাকে এই দু’দিনেই বুঝতে পেরেছে নোমান । সবাই যখন বারবার এটাসেটা জিজ্ঞেস করতে আসে, হয়তো কিছু কিছু কথা অপ্রাসংগিক – তবু সে বিরক্ত হয়না । বিরক্তি যে আসেনা তা নয় , কিন্তু যখনই ভাবে- ঐ শিশুটি হয়তো সারা পৃথিবীর কয়েকশত কোটি শিশুর একজন, হয়তো ওর কিছু হয়ে গেলে পৃথিবীর কিছু আসে যায়না – কিন্তু ঐ তরুণী মা’টির বুক শূন্য হয়ে যায় । তাঁর তো ঐ একটিই নাড়ী ছেড়া ধন ।

মায়েদের স্বার্থপরতা নিয়েও ভেবেছে নোমান । এখানে ডাক্তারের কাছে সব শিশুই তো রোগী, ডাক্তার রোগের গুরুত্ব ও জটিলতা অনুযায়ী গুরুত্ব দেবেন এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু প্রতিটি মায়ের কাছে মনে হয়, তাঁর শিশুটিই সবচেয়ে কষ্টে আছে । তাঁর বাচ্চাটাকেই আগে দেখতে হবে । শুধু ডাক্তারের কাছেই যে দাবি করে তা নয়, এ নিয়ে নিজেরা নিজেদের ভেতর ঝগড়াও বাঁধায় তারা মাঝে মাঝে ।
নোমান এসব দেখে আর ভাবে , আহারে ভালোবাসা ! ভালোবাসা মানুষকে এরকম  স্বার্থপর বানায় !

একটা তরুণী মায়ের প্রথম সন্তানের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকে এখন সেটা বোঝার চেষ্টা করে নোমান । নিজে সে কিছুটা কাঠখোট্টা বলেই মনে করে নিজেকে । বড়বোন যখন ভাগ্নে ভাগ্নিদের জন্য খেটে মরে, প্রায়ই সে বলে – এত আহ্লাদের কী আছে আপা । বাচ্চাগুলাকে নিজের মত করে বড় হতে দাও ।
আপা বলেন, এখন তো বুঝবি না । নিজের হলে বুঝবি ।
নিজের কবে কী হবে সে তো অনেক পরের কথা , তবে এখানে এসে কিছুটা বুঝতে পারছে সে ।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগের সাথেই লাগোয়া  স্পেশালাইজড নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট । সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতক  শিশুদের স্থান হয় এখানে । পুরো হাসপাতালের মধ্যে এইটা একটা ভয়ংকর জায়গা মনে হয় নোমানের । একজন বয়স্ক মানুষ মারা গেলে তবু হয়তো মেনে নেয়া যায়, কিন্তু একটা শিশুর মৃত্যু মেনে নেয়া যেন আরো কঠিন । অথচ প্রতিদিনই কত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে ।

কার্ডিওলজির সিসিইউ কে দ্বিতীয় ভয়ংকর জায়গা মনে হয় ওর । মৃত্যু কীভাবে যে আসে যায়, ওখানে সেটা খুব ভালো করে বোঝা যায় । জ্বলজ্যান্ত মানুষ নিজের হাতের ওপর কীভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সেই অভিজ্ঞতা নোমানের হয়েছিল সিসিইউ তে । হার্ট ফেইলুরের একজন রোগীকে সিপিআর (কার্ডিও রেসপিরেটরি রিসাসিটেশন) দিয়েছিল নোমান । বড় বড় চোখে নোমানের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল সে । তারপর সেভাবেই চলে যায় পরপারে । চোখ দুটো বুজে দিয়ে একজন পরাজিত মানুষের মত ফিরে এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়েছিল নোমানকে ।

মেডিসিন ওয়ার্ডের একটা কিশোরের কথাও খুব মনে পড়ে । একদিন আগে সে বলেছিল- স্যার আমি বাচুম না, আমারে বাচান ।
কী আশ্চর্য, পরদিন সকালে গিয়ে নোমান দেখে ঐ বেডে অন্য রোগী । রাতেই মারা গিয়েছিল ছেলেটি ।
হাসপাতালে প্রতিদিনই চোখের সামনে দিয়ে কত লাশ পার হয়ে যায়, তবু কারো কারো মৃত্যু ভোলা যায় না ।

নিওনেটাল আইসিইউ তে প্রতি রাতে কয়েকটি শিশু মারা যায় । এখানে আজই প্রথম নাইট ডিউটি পড়েছে নোমানের । আজ যে কী হবে ভেবে হাত জমে যাচ্ছে ওর । কীকরে এই ফুলের মত ফেরেশতাগুলোর ডেথ সার্টিফিকেট লিখবে সে ?

এলোমেলোভাবে এসব কিছুই ভাবছিলো নোমান । এরই মাঝে ওয়ার্ড বয় এসে ডাক দিলো । স্যার, চার নম্বর বেবিটা নিঃশ্বাস নিতেছে না ।
চার নম্বর বেডে একটা মেয়েশিশু ভর্তি । প্রিম্যাচিউর বেবি উইথ ভেরি লো বার্থ ওয়েট । বারবার এপনিক (নিঃশ্বাস আটকে যাওয়া) হয়ে যাচ্ছে । কতক্ষণ টিকবে বলা মুশকিল ।

দৌড়ে গেল নোমান । এতটুকু একটা বাচ্চা, এতটুকু শরীর । কতটুকুই বা বুকের খাঁচা ? ঠিকমত আঙুল বসানোর উপায় নেই । তবু বৃদ্ধাঙ্গুলি দুটি বুকের মাঝখানে দুইপাশে রেখে চাপ দেয়া শুরু করলো নোমান । একজন নার্সকে লাগিয়ে দিল আম্বু ব্যাগ টিপতে । এই মুহূর্তে কেন জানি মনে পড়ে গেল ওর সেই ছোটবোনটির কথা যার কথা এখন আর মনে পড়ে না ।

নোমানের বয়স যখন চার কী পাঁচ তখন ওর একটি বোন হয়েছিল । এক সপ্তাহের মাথায় সেই বোনটি মারা যায় । সেই পিচ্চির মুখটা কেমন ছিল ? মনে পড়ে না নোমানের ।  মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে, যার চোখ তাকে আর, মনে পড়ে না । শুধু মনে পড়ে মা খুব কেঁদেছিলেন সেদিন । পিচ্চিটাকে বাড়ির পেছনের গোরস্তানে একটা ছোট্ট কবরে রাখা হয়েছিল । সবার পেছনে পেছনে গুটিগুটি পায়ে নোমানও গিয়েছিল । এখন আর সে কবরটাকেও আলাদা করে চেনা যায় না । ভাইবোনেরাও কেউ ওর কথা স্মরণ করেনা । মা নিশ্চয়ই ওকে ভোলেননি , কিন্তু মা-ও আর কখনো ওর প্রসংগ তোলেননা ।

সে যেন চলে গেছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্নমুকুল’ এর মত-

সব-চেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে,
সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিলো
সে গিয়েছে সবার আগে সরে
ছোট্ট যে জন ছিলো রে সব চেয়ে
সে দিয়েছে সকল শূন্য করে।

নোমানের হঠাৎ মনে হতে লাগলো, আচ্ছা ওর মুখটা কি এই বেবিটার মত ছিল ?
এখানে অন্য সময় সব বাচ্চাকে একই রকম লাগে । সেজন্য কারো চেহারার দিকে ঠিক আলাদা করে খেয়াল করা হয়না । সিপিআর দিতে দিতে নতুন করে বেবিটার মুখের দিকে তাকালো নোমান । নীল হয়ে আছে ছোট্ট মুখটা । একটু দূরেই বেবিটার মা দাঁড়িয়ে আছে মুখে আঁচল দিয়ে । হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় । এই মুহূর্তে তাঁর অনুভূতি কেমন, পৃথিবীর কেউ হয়তো তা বুঝতে পারবে না ।

বেবিটার অতটুকু বুকে চাপ দিতে দিতে নোমানের মনে হতে লাগলো, যেন সে ওর সেই নাম না জানা , মুখ না চেনা , হারিয়ে যাওয়া বোনটিকেই বাঁচানোর জন্য  সংগ্রাম করছে ।

[ফুটনোটঃ সত্যিই আমার একটি ছোট বোন জন্মের কয়েকদিনের মাথায় মারা গিয়েছিল । ওর কোন নাম ছিলনা । তখন ছোট ছিলাম । এখন আর সত্যি সত্যি শত চেষ্টা করেও আমি ওর মুখের ছবিটা মনের পটে  আঁকতে পারিনা ।]

সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জাফর ইকবাল বিরক্তিকর হয়ে উঠছেন

অধ্যাপক জাফর ইকবাল সাধাসিধে কথা নামে কলাম লেখেন । এতে প্রায়ই তিনি রাজনীতির নানা প্রসংগে মন্তব্য করেন । করতেই পারেন, দেশের যেকোন সচেতন নাগরিকের অধিকার আছে তার নিজস্ব চিন্তাধারা বা মতপ্রকাশের । সমস্যাটা হচ্ছে, রাজনীতির কথা বলতে গেলে স্পষ্ট করে বলতে হয় । কিন্তু তিনি কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে । রাজনীতি বিষয়ে লেখার আগে লেখেন, আমি রাজনীতি বুঝিনা । আমার কথাকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেবেনা । এরপর তার রাজনীতি বিষয়ক বক্তব্য পেশ করেন । তিনি ইতিহাস নিয়ে লেখার আগে মাথা চুলকিয়ে বলেন, আমি ইতিহাসবিদ নই । আমি ইতিহাস জানিনা । এরপর তিনি ইতিহাস লেখেন ।
রাজনীতি নিয়ে তিনি যাই লেখেন, ইনিয়ে বিনিয়ে শেষে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশংসা করেন । গনতন্ত্র মানবাধিকার চুলায় যাক । তিনি ছাত্রদল শিবিরের উদ্দেশ্যে নসিহত করেন কিন্তু ছাত্রলীগের খুন ধর্ষণ রাহাজানি চুরি ডাকাতি অপহরণ চাঁদাবাজি নিয়ে নিরুদ্বেগ । কখনো তার কাছে পাওয়া যায়না, তোমরা যারা ছাত্রলীগ করো ।
তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না । মাহমুদুর রহমানের ক্ষুরধার কলামের মোকাবেলা করতে না পেরে তিনি তাকে গ্রেপ্তারের সমর্থন করেন । সারাবিশ্ব ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে হাস্যকর বললেও তিনি এটাকে সমর্থন করেন । একে খন্দকারের বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে প্রকাশককে দোষারোপ করেন । অথচ নাবালকও জানে যে লেখকের ইচ্ছা অনুমতি ছাড়া কেউ লেখা প্রকাশ করতে পারে না ।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা হচ্ছে তিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার গ্লানি ঢাকার জন্য তেরো দিনের যুদ্ধের গল্প ফেঁদেছেন । ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলাটা শিশুদের জন্য মনোরঞ্জক হতে পারে, কিন্তু শিশুরা রাজনীতি নিয়ে ভাবেনা । বড়দের কাছে একজন বড় মানুষের ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা যথেষ্টই বিরক্তির উদ্রেক করে ।

রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধূয়া...

যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধূয়া
সবই শুনে শুনে যেতে হবে...
যদি আসি আসি করে দেরি করে সে
দিন গুনে গুনে যেতে হবে...

বিছানায় বসে গুনগুনিয়ে গাইছিলো রতন । সামনেই ‘একজন’ আয়নার সামনে  দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছে মনোযোগ দিয়ে । রতন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে । হঠাৎ করে সাজগোজে মগ্ন ‘একজনের’ খেয়াল হলো ব্যাপারটা । আয়নার দিক থেকে না মুখ ঘুরিয়েই বললো- এইভাবে তাকায় না থেকে এইবার একটু পলক ফেলা যায়না রাজামশায়?
রতন নিচুস্বরে জবাব দিলো-
-'আমার কী দোষ ? কবিই তো বলেছেন- তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, সেকি মোর অপরাধ ? আর তাছাড়া রাণীর সাজগোজ দেখাটাও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার !'
-বসে বসে গান গাওয়া হচ্ছে কেন সেটা তো আমরা বুঝি ! এহ, শখ কত ! মুখে বলার তো সাহস নাই । গান গেয়ে ইঙ্গিত দেয় !
যেভাবে সে সাজাবে , সাজবো যে সেভাবে, সুখ দুঃখ সবই মেনে নিতে হবে !
ওয়ার্ড রোব থেকে নীল শাড়িটা বের করতে করতে বিদ্রুপাত্মক সুরে পরের কয়েকটি কলি গায় অবনী ।

নীল শাড়ি রতনের পছন্দের । বিশেষ বিশেষ দিনে নীল শাড়ি পড়াটা এই দম্পতির নিয়ম । অবনীরও পছন্দ, কিন্তু সেটা সে মুখ ফুটে কখনো বলে না । রতনকে বলে, 'দেখো- আমি কিন্তু শুধু তোমার কথা চিন্তা করেই নীল শাড়ি পড়েছি !' এটা একধরণের ছলনা কিনা কে জানে ! কিন্তু অবনীর মনে হয়, ভালোবাসার প্রয়োজনে কিছুটা ছলনা করাই যায় !

আজকের দিনটায় একটু মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে দুজনের ভেতরেই । কিছুটা আনন্দ । কিছুটা বিষাদ । কালই ঢাকা ছাড়তে হবে অবনীকে । রতন এবং অবনী দুজনেই ডাক্তার । এবার অবনীর বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ হয়েছে । আগামীকালই জয়েন করতে হবে । পোস্টিং দিয়েছে গ্রামে । অবশ্য নিজেরই গ্রাম । নিজের বাড়িতে থেকেই অফিস করতে পারবে । এদিকে রতন পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং করছে ঢাকা মেডিকেলে । ট্রেনিং গ্যাপ দেয়া যাবেনা । সুতরাং বলতে গেলে আপাতত বিচ্ছেদ ।  রতন মাঝে মাঝে ছুটি পেলেই চলে যাবে । কিন্তু... প্রতিদিনতো আর দেখা হবে না । সকাল বিকাল ঝগড়া করা হবেনা । ঝগড়া করতে না পারাটাও যে মন খারাপের কারণ হতে পারে, এর আগে কখনো মনে হয়নি রতনের ।

প্ল্যান করেছে আজ বিকালটা ওরা রিক্সায় করে ঘুরবে । যান্ত্রিক শহর হলেও ঢাকার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে অবনীর । অথচ বিয়ের আগে সে একপ্রকার শর্ত দিয়ে বসেছিল, আর যেখানেই হোক, ঢাকায় থাকা চলবে না । ধুলোবালি জ্যাম যান্ত্রিকতার শহরে থাকতে কোনভাবেই ইচ্ছুক ছিলনা অবনী । বিয়ের পর কিছুদিন গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে ছিল । তারপর রতন ঢাকায় নিয়ে আসে । বলেছিল, ‘কিছুদিন থাকো । যদি ভালো না লাগে তখন নাহয় অন্য ব্যবস্থা করবো’ । কিন্তু সেইযে ঢাকায় এলো, এরপর কীভাবে কীভাবে যে কয়েকটা বছর চলে গেল । ঢাকা শহরটা এখন আর খারাপ লাগে না । বরং গ্রামে গেলেই কেমন যেন খালি খালি লাগে । সবখানেই একটা নাই নাই ভাব । কেমন যেন হাহাকার ।

কিন্তু এখন যেতে হচ্ছে । প্রথমে ভেবেছিল জয়েন করবে না । কেমন লাগবে কে জানে ! কিন্তু রতন সাহস দেয়, ‘আপাতত জয়েন করে দেখো । ভালো না লাগলে পরে দেখা যাবে!’
অবনীও ভেবেছে, নিজের উপজেলা , নিজের গ্রাম । হয়তো খারাপ লাগবে না ।  যদিও ভাইবোনেরা কেউ বাড়িতে নেই । লেখাপড়া , চাকরির প্রয়োজনে সবাই বিভিন্ন জায়গায় । বাবা মা তো আছেন । বাবা মায়ের সাথে থাকা হবে এটাই বা কম কিসে ? এখন যদি একটু সেবাযত্ন করতে পারে সেটাতো সৌভাগ্যের ব্যাপার । ক’টা মেয়ের ভাগ্য হয় শেষ বয়সে বাবা মায়ের সেবা করার ? আর তাছাড়া নিজের গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দিতে পারবে । এইসব ভেবে অবশেষে জয়েন করার সিদ্ধান্তই নিয়েছে অবনী ।
আজ বিকেলটা একসাথে ঘুরে ফিরে রাতের বাসে রওনা দেবে গ্রামের উদ্দেশ্যে । সাথে লাগেজপত্র থাকবে না বেশি । কিছু কাপড় চোপড় , এই ।

আধাঘন্টা পরে ওরা  বাসা থেকে বের হলো । একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো । রিক্সাওয়ালা বয়স্ক মানুষ । অবশ্য বয়স্ক মানুষ দেখেই তার রিক্সায় উঠেছে ওরা । বয়স্ক একজন মানুষ রিক্সা চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই নিরুপায় হয়েই । কেমন চুপচাপ ধরণের লোকটা । হয়তো ছেলেপুলে নেই । অথবা থাকলেও বৃদ্ধ বাবার ভরনপোষণ দেয় না ।

অবনীকে দেখে কয়েকটা চ্যাংড়া রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিল- আপা কই যাইবেন ? এইটা এদের একটা বদভ্যাস । অথবা বলা যেতে পারে বাঙ্গাল চরিত্র । যদি দেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বা রিক্সা খুঁজছে, এরা যেচে এসে সাধবে- আপা কই যাইবেন ? অথচ পুরুষ মানুষ যদি জিজ্ঞেস করে, যাইবা ? এরা ঘেট হয়ে বসে থাকবে । যামুনা ।

একদিন তো এক রিক্সাওয়ালাকে হাতে নাতে লজ্জা দিয়েছিল রতন । ব্যাটা ধানমন্ডি যাবেই না । একটু পর অবনী গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে- যাবেন ? এইবার তো রিক্সাওয়ালা রাজী ! অবনী রিক্সায় উঠে বসলে আড়াল থেকে রতনও এসে সেই রিক্সায় উঠে পড়ে । বলে- মামা চলেন !
সেদিন বেচারা রিক্সাওয়ালার মুখটা হয়েছিল দেখার মত!

বয়স্ক রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কই যামু ?
রতন বললো, চাচা চলেন আপনের যেইখানে ইচ্ছা !

এটাও একধরণের খেলা । একসাথে বের হলে মাঝে মাঝেই ওরা এই খেলা খেলে । কোথায় যাবে কিছু মনস্থির না করেই রিক্সায় উঠে পড়ে । তারপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেয় রিক্সাওয়ালার ওপর । বেচারি রিকশাওয়ালা পড়ে মহা ফ্যাসাদে । ‘কোথায় যাবো ?’ এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা আসলে সহজ কাজ না । আসলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াই সহজ কাজ না ।  বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় রিক্সাওয়ালা হার মেনে যায় । আজকের রিক্সাওয়ালাও হার মানলো । অবশ্য এই লোকের হার মানারই কথা । জীবনযুদ্ধে হারতে হারতেই তো এতদূর চলে এসেছেন ।
রিক্সাওয়ালা চাচা বললেন, বাবা কইয়া দেন কই যামু ।
রতন সহজ সমাধান দেয় , যান চাচা। সামনের দিকে যান । যেদিকে দেখবেন রাস্তা খালি, জ্যাম নাই- সেইদিকে যাইবেন ।

রিক্সায় উঠে হঠাৎ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে দু’জনই । সাময়িক বিচ্ছেদ, এটুকুও মানতে চায়না মন । মনে তোলপাড়, কত কথার তুফান ছুটছে । অথচ মুখে আসছে না কিছুই ।
রতন পড়েছে সাদার ওপর নীল স্ট্রাইপের শার্ট । রিকশার বাম পাশের সিটে বসেছে সে, ডান পাশে অবনী । অবনীর কোলের ওপর ওর লাল ভ্যানিটি ব্যাগ ।
-‘কী হলো ? কিছু বলছো না যে ?’ অধৈর্য হয়ে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রতন । এটা রতনের কথা শুরু করার স্টাইল । বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় রতন নীরবতা ভাঙ্গে এই কথার মাধ্যমে ।
অবনী বলে ,
-কী বলবো ? আমার কিছু বলার নাই ।
-আরে কী তাজ্জব ! কিছু বলার নাই মানে ? কেমন লাগছে অন্তত সেটা বলো ।
-বলার কী আছে ? আমার কেমন লাগছে সেটা তোমার অজানা না ।

এই এক সমস্যা । মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা । মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা । এখন অবনীর মন খারাপ । আকাশ বাতাস কুয়াশাচ্ছন্ন । বেশি কথা বলা যাবে না । তিস্তা হয়ে যেতে পারে । রাস্তার মাঝখানে রিক্সায় বসে একটা মেয়ে কাঁদছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না ।
স্রষ্টা যে এঁদের মনে কেন এত আবেগ দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন । সেই এসএসসির পর থেকেই তো রতন বাড়ির বাইরে । প্রতিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একমনে হেঁটে চলে যেত । কারণ, ফিরে তাকালেই দেখা যেত, আঁচলে মুখ ঢেকে মা কাঁদছেন । গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোটবোনটা কাঁদছে । সত্যি বলতে- রতনের বুকটাও যে গুমরে উঠতো না তা নয় । একবার তো ভুলে পেছন ফিরে তাকিয়ে সেও কেঁদে ফেলেছিল । সেবার আর যাওয়া হয়নি । বাসের টিকেট ক্যান্সেল করে পরে আরেকদিন যেতে হয়েছিল ।

এই মুহূর্তে রাস্তাটা বেশ ফাঁকা । মাঝে মাঝে দুএকটা প্রাইভেট কার হুসহাস করে চলে যাচ্ছে । পকেট থেকে মোবাইল বের করে রতন । হেডফোনের একটা এয়ারপিস জুড়ে দেয় অবনীর বাম কানে , নিজের ডান কানে আরেকটা ।
তারপর প্লে করে ওর খুব পছন্দের একটা গান । এই গানটা শুনলে অবনীরও মন ভালো হয়ে যায় ।

'যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ, একদিন, গলেও যায় । তবুও তুমি আমার । যদি নায়াগ্রা জলপ্রপাত,  একদিন, সাহারার কাছে চলেও যায়... যদি প্রশান্ত মহাসাগরের, একফোঁটা, জল আর নাও থাকে । যদি গঙ্গা ভলগা হোয়াংহো, নিজেদের শুকিয়েও রাখে...যদি ভিসুভিয়াস ফুজিয়ামা, একদিন, জ্বলতে জ্বলতে জ্বলেও যায়...তবুও তুমি আমার । যদি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে একদিন তৃতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধে , যদি নিভেও যায় কোনদিন, যতটুকু আলো আছে, ওই সূর্য আর চাঁদে...'

তন্ময় হয়ে গান শুনছিল দুজনেই । হঠাৎ আর্তচিৎকার করে উঠলো অবনী । একটা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিয়েছে ছিনতাই কারী ।  কিছু বুঝে ওঠার আগেই রতন দেখলো অবনী রিক্সা থেকে পড়ে যাচ্ছে । একটা হাত ধরার চেষ্টা করে রতন, কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা । অবনীর মাথাটা গিয়ে ঠেকলো পিচঢালা রাস্তায় । আর ঠিক তখনি পেছন হতে বেপরোয়া আরেকটি কারের ধাক্কা লাগলো অবনীর শরীরে । কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে পড়লো রতনের সাদা শার্টে ।

[উৎসর্গঃ ডাঃ সানজানা জেরিন । চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র এই আপু কিছুদিন আগেই এমনি এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।  এখনো স্বাভাবিক হয়নি তাঁর জীবন । যদিও আমার সাথে কখনো পরিচয় হয়নি, তবুও তাঁর এই দূর্ঘটনার কথা আমি ভুলতে পারিনা ।]

শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

একদিন মন চেয়েছিল...

একদিন খুব করে মন চেয়েছিল, যেন হই  
বিজন গাঙের উদাস মাঝি । 
বজরা চাইনি, চাইনি সদাগরি নাও । একটুকরো ডিঙি হলেই 
বেরিয়ে যেতাম, দূর গাঁয়ে - প্রাণভোমরার সন্ধানে ! 
আতিউঁতি করে চষে ফিরলাম সমগ্র মহাশূন্য; 
বিশ্বব্রহ্মান্ড 
কোথাও পাইনি আমি একটুকরো কাঠ, একটা বৈঠা 
সবাই বললে, 
তুই তো সাঁতার জানিস !
.
একদিন 
খুব করে মন চেয়েছিল, যেন হই 
বাউল পথিক । 
চাইনি কায়াসঙ্গীনি, গেরুয়া বসন, জটাধারি কেশ । শুধু
একটা একতারা হলে, একবার 
হৃদয় উজার করে গেয়ে উঠতাম- 
সবহারানোর গান । 
আতিউঁতি করে কত খুঁজলাম সমগ্র মহাশুন্য;  
বিশ্বব্রহ্মান্ড
কোথাও পাইনি আমি একটাও লাউয়ের খোলস 
একটাও একতারা বাজানো হলোনা আজও 
সবাই বললে,  
তুই তো সংসার চিনিস !  

বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অর্ধেক জীবন

কেটেই তো গেল অর্ধেক জীবন । কিংবা 
তারও কিছুটা বেশি । এখন কি একবার
চোখ ফেরানো দরকার পেছনের রাস্তায়? হাঁটা হলো-  
কতটা পথ ? মাত্র দুটিই তো চোখ সম্মুখ কোটরে
কতটুকুই বা দেখা হলো পথের দু'ধার ?
দেবদারু ভাওয়ালের গাছ 
মানুষ, সরিষার ক্ষেত,  
আরো কিছু কি ছিল ?
.
কেটেই তো গেল অর্ধেক জীবন । কিংবা
তারও কিছুটা বেশি । অর্ধেক জীবনের ক্লান্তি 
খুঁজছে আশ্রয় আমার ভেতর । এখন কি দেয়া চলে ওকে 
খানিকটা প্রশ্রয় ? 

ভাঙন

ভরা বর্ষায় পদ্মা নদীর পাড়ের মতন
ভাঙছে যেন ক্রমাগত আমাদেরও অন্তর
মন ও মনন
মধ্যরাতে ঢেউয়ের বুকে হারিয়ে যাওয়া বাড়ির মত
হারিয়ে যাচ্ছে দয়া মায়া
স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ।
মূল্যবোধটাই বাজারদরে এখন সবচেয়ে মূল্যহীন
খড়কুটো বা কচুরিপানা
যান্ত্রিকতার স্রোতে ভাসা ।
.
শহর রক্ষা বাঁধ নিয়ে যে
টেনশনে খুব মরছো
মনুষ্যত্ব যাচ্ছে ধুঁয়ে
তার লাগি কী করছো ?

বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

নিভেই তো যাবো !

মরেই তো যাবো ; তার আগে
জ্বলে উঠতে চাই একবার
দপ করে ।
নিভেই তো যাবো;
ক্ষতি কি এইটুকু জেনে গেলে-
আমি কি ছিলাম দেয়ালের শোভা,
দয়ামায়াহীন নিয়ন বাতি ?
নাকি
কুড়েঘরে জ্বালানো সত্যিকার কোন এক
মমতামাখানো মাটির পিদিম !

মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মরণোন্মুখ বিবর্তন !

পথের ধারে
আজও তো ঘটে যায় কতকিছু,
অস্বাভাবিক অন্যরকম । ছেলেবেলার মত
এখন কি আর ভিড় ঠেলে যাই ? 
আচ্ছা আংকেল, বলতে পারেন, এইখানটায়,
কী হয়েছে ?
 .
তবে কি
হয়ে গেল এতটা বয়স
হয়ে গেল কি তবে আমার ভেতর 
মৃত্যু প্রক্রিয়ার সূচনা !
.
সবার আগে কি মরে গেল আমার 'কৌতুহল'?  এভাবেই একে একে
ভালোবাসা প্রেম সংসার- 
ভেঙে যাবে, সবগুলো চলকের পাখা?
তারপর একদিন-  
একদিন চশমা উঠবে চোখে  
কানের শোভাবর্ধন করবে হেয়ারিং এইড
আলঝেইমার্সে ভোগা স্মৃতিভ্রষ্ট একজন
খুঁজে ফিরবে কবিতার পংক্তিগুলো 
কুচকানো চামড়ায় !

এবং সবশেষে আত্মার শেষ নির্যাসটুকু
আজরায়েলের অলৌকিক হাতে- ছাড়বে স্বস্তির নিঃশ্বাস-  
মুক্তির আনন্দে !

টাকার মেশিন

সরদার জয়েনউদ্দিনের একটা গল্প ছোটবেলায় পড়েছিলাম । গল্পটা ছিল কিছুটা রম্য ধাঁচের । কিন্তু সেই রম্য ধাঁচের গল্পটাই দিনে দিনে আমার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে ভয়ংকরভাবে ।
গল্পের নাম ‘টাকার মেশিন’ । এক কৌতুহলী কিশোরের গল্প । ছেলেটা শুনেছিল যে আমেরিকায় নাকি অনেক ধনী লোকেরা থাকে । তাদের অনেক টাকা । এত টাকা যে গুনে শেষ করা যায়না । কিন্তু কোনদিন সেরকম ধনী কাউকে দেখেনি বালক । হঠাত একদিন খবর পেল, বিদেশ থেকে একজন ধনী মানুষ এসেছেন সার্কিট হাউজে । শুনে পরি কি মরি করে দৌড় । তারপর প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনভাবে সে ঢুকে পড়ে ভেতরে । অনেকগুলো ঘরের কোনটাতে যে সেই ধনী লোকটা আছে তা তো জানা নেই । ভয়ে ভয়ে একটা ঘরের দরজায় উঁকি দেয় সে । ঘরটাতে একজন হাল্কাপাতলা মানুষ বসে ছিলেন । লোকটা দেখতে পেয়ে কিশোর  ছেলেটাকে ডাক দেন ।
-‘বাবু, কাউকে খুঁজছো ?’
-‘হ্যা,আংকেল । শুনলাম আমেরিকা থেকে খুব ধনী একজন মানুষ এসেছেন । তাঁকে খুজছিলাম । বলতে পারেন, তিনি কোথায় আছেন ?’ ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় কিশোর।
মুচকি হেসে লোকটা বললেন, ‘এসো ভেতরে এসো । আমিই সেই লোক’ ।
কিশোর তো বিস্ময়ে হতবাক । সে বলে, ‘আপনি সেই লোক ? নাহ । আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছেন । বলুন না তিনি কোথায় আছেন ! আমি শুধু একবার তাঁকে দেখেই চলে যাবো । একদম ডিস্টার্ব করবো না’ ।
লোকটাও অবাক হয়ে বলেন- ‘কেন, তোমার বিশ্বাস হয় না আমিই সেই লোক?’
কিশোর বলে- ‘আপনি সেই লোক হলে দেখিতো আপনার হাত কয়টা ?’
‘আমার হাততো তোমার মতই দুইটি’ । হাত দুটি দেখান ধনী ভদ্রলোক ।
অবিশ্বাস বেড়ে যায় কিশোরের ।
আচ্ছা বলুনতো, আপনি কী খান ? প্রশ্ন করে সে  ।
ধনী বলেন- আসলে বাপু আমার তো ডায়াবেটিস, তেমন কিছু খাইনা । এই ধরো সকালে ও রাতে দুই পিস রুটি, দুপুরে কিছু ফলমূল । এই ।
কিশোর অবিশ্বাস নিয়ে বলে, 'না না । আপনি তাহলে সেইলোক হতেই পারেন না । যার এত টাকা, তার শরীর হবে কয়েকটি হাতির সমান, তার নিশ্চয়ই কমছে কম দশটি হাত থাকবে, সেই দশহাত দিয়ে সারাদিন শুধু খাবে খাবে আর খাবে । কিন্তু আপনি তো কিছুই খান না । আমার চেয়েও কম খান !'
'আচ্ছা আপনি যদি সেই লোক হন, তাহলে সত্যি করে বলুন তো অত টাকা দিয়ে আপনি কী করেন ?'
ধনী লোক বলেন, আর বলোনা বাপু- খুব সংকটে আছি । শুনেছি আফ্রিকায় একটা তেলের খনি আবিস্কৃত হয়েছে । সেটা কিনতে চাইছি । কিন্তু কয়েকশত কোটি টাকা ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে ।
-সেই খনি কিনে কী করবেন ?
-বলো কী ? তেল উত্তোলন করে বিক্রি করবো । অনেক লাভ হবে ।
-সেই টাকা দিয়ে কী করবেন ?
-কেন, আরেকটি খনি কিনবো । তোমাদের দেশে নাকি কয়লার খনি আছে । সেগুলোও কিনতে পারি ।
-তাতে কী হবে ?
-কেন, আরো টাকা আসবে !
-আরো টাকা দিয়ে কী করবেন ?
-আরো ফ্যাক্টরি দিব ।
-আরো ফ্যাক্টরি দিয়ে কী হবে ?
-কেন, আরো টাকা আসবে !
-ওটা দিয়ে কী হবে ?
-আরো টাকা আসবে ।
-আরো টাকা দিয়ে কী হবে ?
-আরো টাকা আসবে...
কিছুক্ষণ ভেবে কিশোর বললো, আসলে আংকেল, আপনি তো মানুষ না ! আপনি তো আস্ত একটা ‘টাকার মেশিন !’

২।
সেইসময় গল্পটা আমার কাছে ছিল স্রেফ একটা মজার গল্প । আমাদের মত গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা কিশোরের পক্ষে টাকার মেশিন চেনাটা সহজ ছিলনা । আমরা চাহিবামাত্র কিছু পেতাম না, অপেক্ষা করতে হত বাবার বেতনের। আমাদের বাবাকে এখান সেখান থেকে টাকা জোগাড় করে বড় প্রয়োজন মেটাতে হত । তারপর বড় হতে হতে ধীরে ধীরে টাকার মেশিনের সাথে পরিচয় ঘটতে লাগলো আমার । তারাও আমাদের মত মানুষ, কিন্তু জীবনটা বন্দী টাকার খাঁচায় । বেশি বেশি টাকা উপার্জনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য । ডাক্তারদের মধ্যেও এই সংখ্যাটা কম নয় । এদের কাউকে যদি জীবনের শেষ প্রান্তে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি সারাজীবন কী করেছেন ? হয়তো উত্তর হবে- ভালো উপার্জনের জন্য বেশি লেখাপড়া করেছেন, ভালো চাকরি-ব্যবসা করেছেন, টাকা কামিয়েছেন, সেই টাকা খেয়েছেন, হজম করেছেন, বিয়ে করেছেন, বউ-বাচ্চার জন্যে টাকা খরচ করেছেন । এইতো জীবন !

এই ধরণের মানুষের কথা চিন্তা করি আর সেই অবোধ কিশোরের মত আমিও নিজেকে প্রশ্ন করি- একজন মানুষের খাওয়ার জন্য কতটুকু খাবার প্রয়োজন ? একজন মানুষের থাকার জন্য কতটুকু জায়গা প্রয়োজন ? একজন মানুষের শরীর ঢাকার জন্য কতগুলো কাপড় প্রয়োজন ?

মন চায় টাকার পেছনে অন্ধের মত ছুটে চলা মানুষদের ধরে ধরে নকুলের গান শোনাই ।

কষ্ট করে দিনে রাইতে
কত টাকা করছো কামাই
অত টাকা কেমনে নিবা
কাফনের তো পকেট নাই...
বাড়ি গাড়ি আহামরি সোনাদানা ভরিভরি
টিভি ফ্রিজ চেন ঘড়ি
নেতাগিরি বাহাদুরি উমিদারি জমিদারি পড়ে রইবো
কিচ্ছা খতম হইবো...
কিচ্ছা খত...ম হই...বো ।


খোদার কাছে এই ফরিয়াদ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকার পেছনে যেন কখনো না ছুটি । সামান্য রিযিকের ব্যবস্থা হলে বাকি সময়টা যেন কাজ করতে পারি মানুষের কল্যাণে । মানুষকে যেন ডাকতে পারি হকের পথে। কখনো যেন না হই টাকার মেশিন ।

আদম সন্তানের যদি দুটি উপত্যকাপূর্ণ ধনসম্পদ থাকে তবুও সে তৃতীয়টার আকাঙ্ক্ষা করবে। আর মাটি ছাড়া লোভী আদম সন্তানের পেট ভরবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি তওবা করবে, আল্লাহ তা'আলা তার তওবা কবুল করবেন। (আল হাদীস)

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

লাক্স চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতাঃ উদ্দেশ্য কী ?

লাক্স চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতার আসল উদ্দেশ্য কী ? উদ্দেশ্য সহজ, ‘প্রতিযোগিতা’র নাম দিয়ে চামড়াসর্বস্ব মেয়েদের টেনে আনা হবে ঝলমলে মঞ্চে । তারপর তাদের উজ্ব্বল চামড়ার ছবি তোলা হবে বিভিন্ন ঢংয়ে । বিভিন্ন পোজে । আর দিনের পর দিন সেইসব চামড়ার ছবি এবং ভিডিও প্রচার করা হবে পত্রিকা ও টিভির রঙ্গিন বিজ্ঞাপনে । অপলক চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবে জনতা । মনে করবে, আহা ! লাক্স কিনলে আমিও এরকম উজ্জ্বল চামড়ার অধিকারী হবো ! তারপর দোকানে গিয়ে লাক্স সাবান কিনে আনবে । কোম্পানীর ব্যবসা হবে রমরমা ।
তারা নানানভাবে সারাদিনরাত আপনাকে শুনিয়ে যাবে, মেয়েদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা গায়ের রঙ । তারা আপনাকে প্রলুব্ধ করবে আপনার গায়ের রঙকে উজ্জ্বল করতে, তারা আপনার মনে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করবে – আপনার চামড়ার রঙ অতটা চকচকে নয় বলে ।
যদিও এটা বাই ডেফিনিশান বর্ণবাদের কাতারে পড়ে ।
ব্যবসার প্রয়োজনে তারা নারীদের ব্যবহার করবে । ব্যবসার প্রয়োজনে তারা বর্ণবাদকে উস্কে দেবে , ব্যবসার প্রয়োজনে তারা অশ্লীলতাকে উস্কে দেবে । প্রচার করবে অশ্লীলতার মহিমা । অন্ধ ছাড়া এ থেকে রক্ষা পাবেনা কারো চোখ ।
আর মেয়েদের একটা অংশ, অংশ নেবে তথাকথিত এই প্রতিযোগিতায় । কিছু লম্পটের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি পাবার আশায়- হ্যা, ‘তোমার গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল !’
যদি সত্যিই ওরা নারীর জন্য কিছু করতে চাইত, তাহলে যে টাকা দিয়ে এই সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় , সেই টাকা দিয়ে তারা তো সংবর্ধিত করতে পারতো সংগ্রামী নারীদের, যারা নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে কাজ করে যাচ্ছেন নানান অংগনে । সেই টাকা দিয়ে অসহায় নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারতো । কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতো । সেই টাকা দিয়ে তারা অসহায় মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতো ।
কিন্তু ওরা তা করবে না । এতে ওদের ব্যবসার সুবিধা হয়না । মা বাবাহীন যে মেয়েটি একা একা সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেছে, ওদের কাছে তাঁর কোন মূল্য নেই । প্রতিবন্ধী হয়েও যে মেয়েটি লেখাপড়া করে অনেকদূর এগিয়েছে, ওদের কাছে তাঁর কোন মূল্য নেই । ওদের কাছে নারীর সমাজসচেতনতার মূল্য নেই , সাহিত্যপ্রতিভার মূল্য নেই, গবেষণার মূল্য নেই, মেধার মূল্য নেই, মস্তিষ্কের মূল্য নেই । ওদের কাছে মূল্য আছে- উজ্জ্বল চামড়ার ।
আর কতদিন এভাবে চলতে দেয়া যায় ?
আশার কথা মেয়েরা এদের দূরভিসন্ধির ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে । কিন্তু শুধু সচেতনতা সৃষ্টিই যথেষ্ট নয় । যে ব্যবসায় মুনাফার লোভে এরা বর্ণবাদ ও অশ্লীলতাকে বেছে নিয়েছে ওদের সেই ব্যবসাতেই আঘাত করতে হবে । তবেই ওদের থামানো যাবে । আর এর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, যে লাক্সের প্রচারের জন্য ওদের এই অশ্লীলতা ও বর্ণবাদের প্রচার- সেই লাক্সকেই বয়কট করতে হবে । এবং এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে মেয়েদেরকেই ।

শিকড়বিহীন কষ্টগুলো !

কষ্টগুলোর জন্মের ইতিহাস নিয়ে, এখন আর-
মাথা ঘামাই না একদম । কী করে ওরা এলো 
আমার বুকের ভেতর ? শিকড়বিহীন কষ্টগুলো !
ওরা কি কোন রাজ-রাজড়ার পুত্র-কন্যা ?
ধনীর দুলাল, ননীর পুতুল ? নাকি
সারাজনম নদীর বুকে নাও ভাসানো
অচিন কোন বেদেনির সন্তান ?  এখন আর-
আছে কি কোন প্রয়োজন 
পূর্বপুরুষের খোঁজে ? 


যেখান থেকেই আসে আসুক,
উড়ে আসুক ভেসে আসুক ; এখন ওরা 
শুধুই 'আমার' ! গোবরে হোক কি পদ্মফুলে 
কী আসে যায় তাতে ? লাল নীল জামা পড়িয়ে
দুধ মাখা ভাত খাইয়ে দাইয়ে ,
ভরদুপুরে শান বাধানো
দিঘীর জলে নিত্য নাইয়ে
আদর দিয়ে পেলে পুষে -
আমিই ওদের করবো মানুষ ! এই তো এখন আমার
একমাত্র কাজ-
অবশিষ্ট জীবনের ! 

শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

শকুনির ঢেঁকুর !

নেকড়েরা ময়ুরের ছদ্মবেশ নিয়ে
হেঁটে হেঁটে সমস্ত লোকালয়- ভরিয়ে তুলছে- 
লাল নীল কিংবা জলে ভিজে শোলার মত 
ফেঁপে ওঠা লাশে,
ডোবা খাল বিল নদী
এবং নর্দমা । আর আমরা
বাম হাতে নাক চেপে ধরে, 'ওমাগো' বলে সটকে পড়ছি 
যার যার মত !
.
তারপর, (নিরীহ নিরপেক্ষ ভান ধরে)
আপন প্রাণ বাঁচাবার প্রাণান্তকর চেষ্টায় পলায়নপর আমরাও    
একে একে 
বেঘোরে হারাচ্ছি প্রাণ; উলুখাগড়ার মত ।
.
দিনভর নির্বিঘ্নে মৃতদের লাশ - 
ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে শকুনির দল,  
আর
স্বার্থপরতা চেটেপুটে খাচ্ছে (জীবিত !) মানুষের আত্মা 
পরম তৃপ্তিতে ।

কেউ কি শুনতে পাও-  
ঢেকুরের শব্দ ?

অনুকাব্যঃ বৃষ্টি ও ব্যস্ততা

ফোন করে কে বললো আমায়
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব
হুম ঠিকাছে বলেই আমি
আবার কাজে দিলাম ডুব !

শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মানুষের কষ্টগুলো

মানুষের কষ্টগুলো একেক জনের একেক রকম । সমস্যাগুলোও কেমন আলাদা আলাদা । একজনের কাছে আরেকজনের সমস্যাটা ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকের নিজের কাছে তার সমস্যাটা মারাত্মক । কারণ, সেই সমস্যাটা তার নিজেকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে । আর কাউকে নয় । আরেকজনের কষ্টের সাথে তুলনা করার সুযোগ না থাকলে সবসময় নিজের কষ্টকেই সবচেয়ে বড় কষ্ট মনে হয় । মনে হয়, আমার চেয়ে বড় কষ্টে আর কেউ নেই ।
বাইরে থেকে দেখে যাকে সবচেয়ে সুখী মনে হয়, তার ভেতরেও এমন দুঃখ আছে শুনলে হয়তো কান্নারত একজন মানুষ তার কান্না থামিয়ে দেবে । মানুষের মন এমন এক জলাশয়, যেখানে দুঃখের শত শত মহাসাগর নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থাকতে পারে । বাইরে থেকে তার ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়না ।

এমনই হয় !

এমনি হয় । সবকিছু, এমনই হয় । 
যেদিন খুব তাড়া থাকে কোথাও যাবার, সেদিনই  
ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাবে গাড়ি  
সময় পেরোবার আগে  
আর ছুটবে না ! 
যেদিন কেউ অপেক্ষা করছে কোথাও, সেদিনই 
ভুল পথে ভুল সময়ে নেমে যাবো 
ভুল জায়গায় । 
যেদিন ভোরবেলা জেগে থাকা খুব প্রয়োজন  
সেদিনই বোবায় ধরার মত চেপে ধরবে 
আধমরা ঘুম ।  
যেদিন করতে হবে একটু বেশি কাজ  
সেইদিন ম্যাজ ম্যাজ করবে সমস্ত শরীর ।
যেদিন মন খারাপ করা মোটেও ঠিক নয়-    
সেদিনই ঘটবে অনাকাঙ্খিত সবকিছু ।
এমনই হয়, হুম । সবকিছু 
এমনই হয় । 

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

স্বপ্নের মত মনে পড়ে

একহাতে রঙের কৌটা, পকেটে ব্রাশ, রঙতুলি  
মুষ্টিবদ্ধ আরেকটি হাত  
বুকের ভেতর টগবগে রক্ত, 'আল্লাহু আকবার' বলে  
হৃদপিন্ড হতে বেরিয়ে আসে মিনিটে সত্তরবার ।
তারপর  
অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে দেয় সমগ্র শরীরে । 
নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে চলে তিনজন মানুষের কাফেলা  
চোখে মুখে মিশে আছে এক- মহান বিপ্লবের নেশা-  
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে ।    
.
স্বপ্নের মত মনে পড়ে  
মধ্যরাতের আলো আঁধারিতে  
দেয়াল পেরিয়ে দেয়ালে দেয়ালে  
রক্তের অক্ষরে লিখে আসা দৃপ্ত শ্লোগান । শাসকের  
অন্যায় জুলুম আর শোষণের বিপরীতে 
একজন প্রতিবাদী কিশোরের লিখে আসা সেইসব  
নির্বাক প্রতিবাদলিপি     
.
আজো 
স্বপ্নের মত মনে পড়ে ।  

আপনি মুহসিন ভাই ?

বহুদিন থেকে দেশের রাজনীতি নিয়ে তেমন একটা মন্তব্য করিনা । মনে হয়, এইদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলা মানে সময়ের নিদারুণ অপচয় । কিন্তু এখন ক্ষান্ত দিলেও একসময় তো ফেসবুকেই অনেক গুরুগম্ভীর লেখা লিখেছি । বিভিন্ন থিওরি বা মতবাদের পক্ষে বিপক্ষে তাত্ত্বিক আলোচনা সমালোচনা করেছি । সমসাময়িক রাজনীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ লিখেছি । সেকারণে অপরিচিত অনেকেই সম্ভবত আমাকে একজন মোটাসোটা বয়স্ক মানুষ , নিদেনপক্ষে একজন পরিপূর্ণ দাঁড়িগোঁফওয়ালা যুবক মনে করে রাখেন ! ইদানিং সেটা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি । নিভৃতে থাকতে চাইলেও কারো না কারো সাথে তো দেখা হয়ই । বিভিন্ন উপলক্ষে পথেঘাটে অনেকের সাথে দেখা হচ্ছে যারা ফেসবুকে শুধু একটা নাম হিসেবে ছিলেন । কোনদিন না দেখেও কেউ আমাকে ভালোবাসে জেনে আসলেই অনেক ভালো লাগে । হঠাৎ যখন কারো সাথে পরিচয় হয়, আমার এই ফাস্টিয়ার(First Year) মার্কা চেহারা দেখে- 'আপনি মুহসিন ভাই?' বলে কেমন একটা হতাশ চেহারা নিয়ে তাকায় । ভাইদের চোখে হতাশা দেখে আমিও হতাশ হই । মনে হয়, আহা ! মানুষের আশাভঙ্গ করাটা কতবড় পাপ কে জানে ! ক্যান যে একটা মোটাসোটা বয়স্ক মানুষ হইলাম না !

মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সিঁড়ির মত জীবন !

আগে যে বাসায় থাকতাম সেটা ছিল ছয়তলায় । লিফট ছিলনা । আমার ঘাড়ে যে ব্যাগটা থাকে , ওটার ওজন সাধারণত দশ কেজির নিচে থাকেনা । বাইরে থেকে এসে এই একটা ওজনদার ব্যাগ নিয়ে ছয়তলায় ওঠাটা খুবই কষ্টকর একটা কাজ । সেজন্য আমি সিঁড়িতে পা দিয়েই পকেট থেকে মোবাইল বের করতাম । মোবাইলে কিছু পড়তাম আর সিঁড়িতে পা রাখতাম একের পর এক । উপরে তাকাতাম না খুব একটা । জানা ছিল , যেখানে সিঁড়ি শেষ হবে ওটাই আমার বাসার দরজা । একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে গেলেই একসময় সব সিঁড়ি ফুরিয়ে যাবে ।
.
আমাদের জীবনের সাথে এই ব্যাপারটার খুব মিল আছে বলে মনে হয় । মনে হয়, জীবনটাও এরকম সিঁড়ির মত । বারবার বেশি দূরে তাকানোর, কতটা বাকি আছে বারবার সেটা দেখার দরকার নেই । সামনের সিঁড়িটা পেরোনোই এই মুহূর্তের কাজ । যতক্ষণ জীবন , ততক্ষণে যতটা সিঁড়ি পার হওয়া যায় ততটাই লাভ । বারবার উপরে তাকালে শুধু হতাশাই বাড়বে । কিন্তু কাজের ভেতর থাকলে কখন যে সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবে, হয়তো টেরই পাবো না !

সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

চুরি



গাড়ি জ্যামে আটকে আছে কতক্ষণ ধরে । এই সময়টায় বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হয় , আর ধানমন্ডির এই রাস্তাটাতে ধুন্দুমার জ্যাম লেগে যায় । জ্যামে বসে থেকে বিরক্ত হতে হতে এখন সে অনুভূতিটাও কেমন থিতু হয়ে এসেছে । ভালো স্কুল মানেই কি স্কুলের সামনে জ্যাম থাকতে হবে ?
             
তবু রক্ষা যে আজকের দিনটার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা । আকাশে কিছু সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে । মেঘ ছাড়া বাকিটা ঝকঝকে নীল আকাশ । জ্যামে বসে আকাশ দেখা ! কী আর করা , তাও ভালো !
জানালাটা খুলে দেয় রেখা । রুনুটা এতক্ষণ মোবাইল নিয়ে খেলছিল , গাড়ির জানালা খুলতে দেখে মোবাইল রেখে বাইরে তাকালো । আর এমন সময়ই কোত্থেকে যেন এলো লোকটা । হাতে কয়েকটা পুতুল । এমন পুতুল সত্যিই আগে কখনো চোখে পড়েনি রেখারওরুনু চেঁচিয়ে উঠলো, এই আংকেল – একটা পুতুল আমাকে দেবে ?

রুনু ক্লাস ওয়ানে পড়ছে । পুতুল যে খুব একটা ভালোবাসে তা না । এখনকার বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই মোবাইল, টিভি, কম্পিউটার এইসবে আসক্ত হয়ে পড়ছে ওদেরও বা উপায় কী ? স্কুলের সময়টা ছাড়া সারাটা দিনই তো বাসায় একপ্রকার বন্দী । খেলার মাঠ কোথায় ? খেলার সাথীই বা কোথায় ? সেই জায়গাটা দখল করছে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ।   
রেখা ভেবেছিল লোকটা হয়তো তার নিজের বাচ্চার জন্য কোথাও থেকে কিনেছে পুতুলগুলি । লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানবে, কোথায় পাওয়া যায়কিন্তু লোকটা এসে জানালো এগুলো বিক্রি করার জন্যই ফেরি করছে সে । লাল আর নীলের কম্বিনেশনে একটা পুতুল পছন্দ করে রুনু ।
সেই থেকে পুতুলটা ছিল রুনুর সর্বক্ষণের সঙ্গী । তুলতুলে নরম শরীর, মাথায় কী সুন্দর চুল । লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পড়া । আর নীল রঙের চোখ দুটো কী মায়াবী ! যেন জীবন্ত বাচ্চার চোখ ।
পুতুলটা সুন্দর ছড়া আবৃত্তি করতে পারতো ! টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার , কানা বগির ছাঁ, টেডি বিয়ার, আয় আয় চাঁদ মামা, ঝুমকো জবা বনের ফুল । রেকর্ড সেট করা ছিল ভেতরে, পুতুলটার কানমলা দিলে এই ছড়াগুলো আবৃত্তি করতো । ওর একটা নামও দিয়েছিল রুনু । নিজের নামের সাথে মিল রেখে পুতুলের নাম রেখেছিল ‘ঝুনু’ যেখানেই যায় ঝুনুকে কোলে করে নিয়ে যায় । শুধু স্কুলে যাওয়ার সময় বিছানায় শুইয়ে রেখে যায় ঝুনুকে

এসবই একমাস আগের কথা । আপার কাছে রুনুর পুতুল কেনার কথা আগেই শুনেছিলাম । একটু আগেই ওদের বাসায় চুরির খবরটা পেলাম । বাসার সব কিছু ঠিক আছে । শুধু আপার গয়নাগুলো নেই ! আর একটা জিনিস নেই , সেটা হলো রুনুর পুতুলটা । অবাক কান্ড !
রুনুর জন্য কষ্ট বেশি হচ্ছেপুতুলটা রুনুর খুব পছন্দের ছিল । গত মাসেই কিনেছিল । রুনুর কাছে পুতুলটার কথা কত শুনেছি । দুইমিনিট কথা বললে তার এক মিনিট রুনু কথা বলতো ওর পুতুলটাকে নিয়ে । পুতুলটাকে দেখার আমারও খুব ইচ্ছে ছিল
আজ রেখা আপা স্কুল থেকে রুনুকে নিয়ে বাসায় ফিরে দেখে রুনুর পুতুল নেই । সবগুলো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও না পেয়ে কিছুটা অবাকই হয় আমার বড় বোন রেখা । কানের দুল খুলে রাখতে গিয়ে টের পায় আলমারির ড্রয়ারে বাকি গয়নাগুলোও নেই । তারপরই আমাকে ফোন করে ।


আমি হলাম ওর সার্বক্ষণিক উপদেষ্টা । যেকোন সমস্যায় সে আমাকে ফোন করবেই । আর আমি যা সমাধান দেবো সেটাই করবে । আমার ওপর ওর এতটা বিশ্বাস দেখে অবাক হয়ে যাই । মাঝে মাঝে একটু ধমকও দেই, ‘তুমি নিজে একটুও চিন্তা করোনা কেন ? তোমার মাথাটা একটু খাটাতে পারোনা ?’
আবার মনে হয়, হয়তো এটাই ওর ভালোবাসা । এটা সেটার ছলে আমার সাথে কথা বলে । মা বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম, আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না রেখা আপা ভাইই ছিল ওর সব । বড় হয়ে আমি যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে বাসা ছাড়লাম, সেকি কান্না ওর ।

আজ বেচারির সব গয়না চোরে নিয়ে গেছে । গয়নার প্রতি ওর আকর্ষণটা ছিল অদ্ভুত । সব মেয়েরই নাকি গয়নার প্রতি আকর্ষণ থাকে, কিন্তু ওরটা আমার কাছে কেমন যেন বেশি বেশি মনে হত । কে জানে, নিজের বোন বলেই হয়তোবা ! যাহোক, ওর জন্যে খারাপই লাগছে আমার

একটু আগে আমাকে ফোন করেই সেকি ভেউ ভেউ করে কান্না । দুলাভাইও আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে ওদেরকে সামলাও । কী হয়েছে দেখো । আমি শহরের বাইরে । সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবো না ।

কী আর করা । যাচ্ছি এখন বোনের বাসায় । রুনুও ফোনে অনেক কান্নাকাটি করলো । আহা, ওর প্রিয় পুতুলটা চোরে নিয়ে গেছে । চোরটা কীরকম বেরসিক, একটা বাচ্চার খেলনা পুতুলটাও নিয়ে গেলো !

২।
নাস্তা করছি । আপার স্পেশাল রেসিপি । চুরির ঘটনার পর গতকাল অনেক স্বান্তনা দিয়ে অবশেষে কিছুটা শান্ত করতে পেরেছি । যা হবার হয়ে গেছে, এখন কান্নাকাটি করলে কি গয়না ফেরত পাওয়া যাবে ?
রুনুর আজকে স্কুল ছুটি আজ রুনু আমার সাথে সাপ লুডু খেলবে ।
খাচ্ছি আপার বানানো বিশেষ রেসিপির নাস্তা । এই খাবারের নাম আমি জানিনা । তবে একটু পরেই জানতে পারবো ।
আপা মনোযোগ দিয়ে টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখে । বাজারে রেসিপির বই পেলেই কিনে নিয়ে আসে । আর ওর সব নতুন নতুন রেসিপি টেস্ট করায় আমাকে দিয়ে । ফুড ক্রিটিক হিসেবে আমি আমার মূল্যবান বক্তব্য পেশ করি । পেশ করি মানে শুধু যে মুখে বলি তাই নয়, আপার একটা ডায়েরি আছে । সেখানে ও লিখে রাখে কোনদিন কী নতুন রেসিপি রান্না করেছে ! আর তার নিচে নীল কালির একটা কলম দিয়ে খাদকদের মন্তব্য লিখতে হয় ! আপা নিজের মন্তব্য লেখে । দুলাভাইর কাছ থেকে মন্তব্য লিখে নেয় । রুনুর মন্তব্যও নেয় । আর স্পেশাল ফুড ক্রিটিক হিসেবে আমার মন্তব্য ।

খাবার যেমনই হোক, আমি সবসময় লিখি ‘অসাধারণ খাবার ! এমন সুস্বাদু খাবার আমি জীবনে খাইনি !’ তারপর নিচে একটানে আমার বিখ্যাত বাঁকা তেড়া সাইন করে দিই ।
গতরাতে সেই ‘খাদ্যবিলাস’ খাতাটা নিয়ে দেখেছি, বিগত বেশকিছু মন্তব্যে আমি এই একই কথা লিখেছি । এবার একটু হলেও নতুন কিছু লিখতে হবে ।

কী লিখবো ভাবছিলাম , এমন সময় আমার কানে এলো রেখা আপার উত্তেজিত কন্ঠ । ‘বলেন কী ভাবি ?’ আপনাকে তো জানানোই হয়নি , কাল আমারও সব গয়না চুরি হয়ে গেছে । আর রুনুর পুতুলটা ।
বলেন কী ? রিমিরও পুতুল নিয়ে গেছে ?
না না , সবকিছুই তো ঠিকই ছিল । চোর দরজা খুলেছে মাস্টার কী দিয়ে । কোনকিছুতে হাত দেয়নি ভাবি, শুধু গয়নাগুলো আর পুতুলটা । হ্যা হ্যা । ...

আরো কীসব কথা বলতে লাগলো ও আমি চুপচাপ খেয়ে হাত ধুয়ে ফেললাম । ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে । রুনু এখন ওর রুমে একা একা সাপ-লুডু খেলছে । রুনুর কাছে গিয়ে আমি রুনুকে জিজ্ঞেস করলাম- রুনু, রিমি কে রে ? রুনু বললো – রিমি ? রিমি আমার ক্লাসের বন্ধু । মামা জানো রিমি না...’
‘রিমিরও কি তোমার মত পুতুল আছে ?’ আমি রুনুকে থামিয়ে দেই । প্রশ্নটা আমার জন্যে গুরুত্বপুর্ণ ।

আপাকে বললাম- আপা কার বাসায় চুরি হয়েছে ? আপার কাছে সব শুনে আমি  বলে দিলাম রিমি ও রিমির মাকে বাসায় দাওয়াত করতে

৩।
রিমি ও রিমির মা এসেছে । রিমি যে শুধু রুনুর ক্লাসমেট বান্ধবী তাই নয়, রিমির মায়ের সাথেও রেখা আপার সম্পর্ক গলায় গলায় । এখন বাচ্চাদের স্কুল গুলো শুধু বাচ্চাদের স্কুল নয়, অভিভাবকদেরও স্কুল ! বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে মায়েরা গার্ডিয়ান টেন্টে অপেক্ষা করে । পরস্পরের সাথে পরিচিত হয় । গল্প গুজব করে । অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে- বাচ্চার স্কুল বন্ধ থাকলে বাচ্চা খুশি হয়, কিন্তু মন খারাপ হয় মায়েদের !
‘আচ্ছা রিমির পুতুলটা কেমন ছিল ?’
খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করে বর্ণনাটা শুনলাম আমি হুবহু রুনুর পুতুলটার মতই । আর কেনার ঘটনাটাও একই রকম । একটা হ্যাংলা পাতলা মানুষের কাছে রাস্তায় কিনেছিল । চুরি হবার ঘটনাটাও শুনলাম । আমার সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হলো ।
‘আচ্ছা এরকম পুতুল কি আর কারো কাছে আছে ? মানে আর কেউ কি কিনেছিল ?’  সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করলাম আমি ।
কিন্তু ঐ মুহূর্তে খেয়াল করতে পারলো না কেউই । 
বিকালে রুনুর সাথে কথা বলতে বলতে রুনুর বন্ধুদের কথা শুনছিলাম । তখনই রুনু জানালো যে ওর আরেক বন্ধু সিমিও একটা পুতুল কিনেছে গতমাসে । আমি রুনুকে দিয়ে ফোন করালাম সিমিদের বাসায় । আমরা আসছি । পুতুলটা যেন হাতের কাছেই রাখে ।

আমার বন্ধু আরিফকে ফোন করে সংক্ষিপ্ত ঘটনা বললাম । আমার সন্দেহের কথাও জানালাম । প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে হাজির হলো আরিফ । ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির ব্যাপারে আরিফের অনেক দক্ষতা । রেখা আপা, রুনু, আমি আর আরিফ বিকাল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছলাম সিমিদের বাসায় । রুনু আর রেখা আপাকে পুতুলটার কাছ থেকে দূরে থাকতে বললাম । পুতুলটাকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে আমরা ছিটকিনি লাগিয়ে বসলাম । আরিফ ওর যন্ত্রপাতি দিয়ে পুতুলটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলো । সাবধানে খুলেও দেখলো । এই পুরো সময়টাতে পুতুলটার চোখদুটো একটা কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হল

হালকা নাস্তা খেয়ে আমরা সিমিদের বাসা থেকে বিদায় নিলাম । আপার বাসায় আর গেলাম না । ‘জরুরী কাজ আছে , পরে আসছি’ বলে আরিফের সাথে চলে এলাম আমি অন্য সময় হলে আপা চিল্লাচিল্লি করতো, কিন্তু আরিফ সাথে থাকায় শুধু একটু বিরক্তি আর প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে বাসায় চলে গেল । আমি আর আরিফ চলে গেলাম র‍্যাবের অফিসে ।
র‍্যাব কমান্ডারকে আমাদের পরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বললাম । অপরাধী চক্রের অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আরিফ করেছিল , সেটা কনফার্ম করা হলো র‍্যাবের হাতে থাকা উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে । ঠিক হলো রাত নয়টায় অপারেশন চালানো হবেআমরা সাথে থাকার আগ্রহ দেখালাম , কিন্তু আমাদেরকে সাথে নিতে চাইলোনা র‍্যাব । কমান্ডার বললেন , ‘এরা কতবড় গ্যাং সে ব্যাপারে যেহেতু আমাদের কোন ধারণা নাই সেজন্য আপনাদের নিতে পারছি না । আর তাছাড়া কী পরিস্থিতি হবে সে ব্যাপারেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না’

উপায় না দেখে আরিফকে বিদায় করে আমি আপার বাসায় ফিরে এলাম ।

৪।  
খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম । রেখা আপার চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । ঘড়িতে দেখি রাত ১২টা বাজে
‘এই ওঠ ওঠ । এই দেখ খবরে কী দেখাচ্ছে ।

চোখ ডলতে ডলতে ড্রয়িং রুমে এলাম ।
টিভিতে নিউজ দেখাচ্ছে- ব্রেকিং নিউজ ! চোরচক্রের আস্তানায় র‍্যাবের হামলা , সাতজন আটক । চুরি হওয়া বিপুল পরিমাণ স্বর্নালংকার উদ্ধার । অভিনব কায়দায় চুরি করে যাচ্ছিল এই অপরাধীচক্র । তারা অভিজাত এলাকার স্কুলের আশেপাশে বিশেষ ধরণের পুতুল বিক্রি করতো । ঐ পুতুলগুলোর চোখে সেট করা ছিল বিশেষ ধরণের সিসি ক্যামেরা । সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ঘরের ভেতরের চিত্রধারণ করে বিশেষ ধরণের মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূর থেকেই ভেতরের অবস্থা দেখে চুরির পরিকল্পনা নিত এই অপরাধীরা । গত তিনদিনে এই পদ্ধতিতে তারা দুটি বাসায় বড় ধরণের চুরি করে । গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আজ তাদের আস্তানায় অভিযান চালায় র‍্যাব । এসময় র‍্যাবের সাথে সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি বিনিময় হয় । র‍্যাব ঘটনাস্থল থেকে সাত জনকে গ্রেপ্তার করেছে । এছাড়া স্বর্ণালংকার সহ চুরি করা মূল্যবান জিনিসপত্রের সাথে কয়েকটি কম্পিউটার ও বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তিপন্য উদ্ধার করা হয় । অপরাধীচক্রের আস্তানা থেকে জব্দকৃত কম্পিউটারে থাকা সকল ভিডিও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে । উদ্ধারকৃত অলংকারসমূহ অতি শীঘ্রই মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হবে ।

‘হায় আল্লাহ্‌ ! রুনুর পুতুলের চোখে সিসি ক্যামেরা ছিল ?’ আর্তনাদ করে উঠলো রেখা আপা ।
আপার আর্তনাদকে পাত্তা না দিয়ে আমি বললাম , ‘কাল সকালে তো তোমার গয়না পেয়ে যাচ্ছ । এখন নতুন কী রেসিপি রেঁধে গুণধর ভাইয়ের উদরপূর্তি করবে সেই চিন্তা করো আপা । সকালে ডাক দিও, আমি ঘুমাতে গেলাম’ !

নষ্ট সময়ের কেত্তন !

আজকাল
বুক ভরে শ্বাস নিতে পারিনা । 
বড় কষ্ট হয় । বিষাক্ত চেতনার হাওয়া-
ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে ।
পত্রিকার পাতায়, 
নেতার বক্তৃতায়,  
মধ্যরাতে টিভির পর্দায় 
বুদ্ধিবেশ্যাদের জ্ঞানপাপী বয়ানে,
সাড়ে আটটার রেডিও সংবাদে । অফিস কক্ষে 
কলিগের আলাপচারিতায়, 
চায়ের দোকানের অমীমাংসিত আড্ডায় ।
ইতিহাসে, 
ঐতিহ্যে,  
গল্পে, 
এবং উপন্যাসেও । 
.
এক মুঠো শুদ্ধ বাতাসের সন্ধানে- খুলে বসি কবিতার বই 
অথচ কী অদ্ভুত ! কবিতার বইও আর 
ঝকঝকে সাদা নেই ! জমাট বাধা হিংসা আর পরশ্রীকাতরতা 
প্রতিস্থাপন করেছে কৃষ্ণচূড়াকে ।
কালো অক্ষরগুলো হতে উঠে আসছে 
অসহ্য দুর্গন্ধ ! তবে কি 
আমাদের কবিরাও লিখে চলেছেন- 
নষ্ট সময়ের কেত্তন ?

রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

নির্লিপ্তির সুখ !

এটা করতে হবে,
ওটা করতে হবে,
কোটি মানুষের এই শহরে 
এভাবেই পেরিয়ে যায় কর্মব্যস্ত দিন ।
তারপর সূর্যটা ডুবে গিয়ে- রাত এলে পৃথিবীর বুকে
আমি নির্লিপ্ত হয়ে যাই; অন্ধ বধির ধ্যানমগ্ন দরবেশ  
কিংবা   
নিশুতি রাতের মতই ।  

যদি কিছু চেয়ে থাকি, চেয়েছি 
যদি কিছু পেয়ে থাকি, পেয়েছি । দিনশেষে,
নাইবা করলাম চাওয়া আর পাওয়ার হিসাব !

যা পাইনি হয়তো পেয়ে যাবো ; কিংবা পাবোনা-
এর বেশি কিছু তো নয় !
নাইবা করলাম যোগ বিয়োগের অংক 
ভবিষ্যতের খেরোখাতায় ! 

রাত্রির গভীরতা নিয়ে আসে সুমধুর এশার আযান, 
ঝিঁঝিঁ পোকার নিরন্তর ডাক  
জিবরিলের ডানার মত অদৃশ্য পাখায় 
অদ্ভুত এক সুখ বুকে চেপে ধরে- ঘুমোতে যাই আমি- 
নির্লিপ্তির সুখ ।

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

নারীর শত্রু নারীই, পুরুষ নয়

ইদানিং অনেককেই নারীবাদী লেখা লিখতে দেখা যায় । গড়ে উঠেছে নারীবান্ধব ব্লগও । এগুলোতে নারীদের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে দেখা যায় লেখিকাদের । এবং অবধারিতভাবে শেষমেষ পুরুষ জাতের ওপর দোষ চাপিয়ে আক্রোশ ঝাড়া হয় । (এটাকে আমি মেয়েলী স্বভাবের স্বাভাবিক প্রকাশ হিসেবে দেখি)
মেয়েরা সচেতন হোক, নিজেরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলুক, আদায় করুক এটা আমি ভালোভাবেই চাই। কিন্তু সেই সাথে যে প্রশ্নটির দিকে নজর ফেরাতে বলি সেটা হলো , তীর ছোড়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে 'মেয়েদের শত্রু কে?'

চর্মচক্ষে পুরুষকেই শত্রু মনে হতে পারে। সেজন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করা হয় পুরুষদের উদ্দেশ্যেই ।(আমার ছোটবোনকে দেখতাম কান্নাকাটি করার আগে হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে)

কিন্তু আমি বলি মেয়েদের শত্রু মেয়েরাই । পুরুষ নয় ।

প্রথম কথায় আসি গায়ের রঙ নিয়ে । এ ব্যাপারে নারীবাদি লেখিকাদের অভিযোগ, পুরুষরা গায়ের রঙ কে বেশি গুরুত্ব দেয় । তারা 'আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী' নীতিতে বিশ্বাসী ।
বাস্তব কী বলে ? বাস্তবে দেখা যায়, বাড়ির বউয়ের চামড়ার রঙ নিয়ে স্বামী শ্বশুড় কারো বিকার নেই , যত গঞ্জনা খোটা আসে শাশুড়ী-ননদ-জা-প্রতিবেশি মহিলাদের কাছ থেকে । অমুকের বউটা কালো বা শ্যামলা এ নিয়ে পুরুষদের কথা বলতে দেখা যায়না । জটলা পাকাতে দেখা যায় পাড়ার মহিলাদেরকে ।
স্বামীর কোন খেদ নাই, যত খেদ শাশুড়ী ননদ দের মনে ।
অনেক রাজপুত্রের মত সুন্দর ছেলেকে (আমার ভাই বেরাদার কাজিনদের মধ্যে যারা বেশি সুন্দর তাদের বউ কালো/শ্যামলা) কালো বউ নিয়ে সুখে থাকতে দেখছি । অসুখী কে ? অসুখী হলো চাচী খালা নানী দাদীরা ।
কালো মেয়েদের যদি বিয়ে না হত তাহলে তো কালো মেয়েরা সবাই অবিবাহিত থেকে যেত । তেমনটা হয়েছে কি ? তাহলে আর ছেলেদের দোষারোপ কেন ?
ছেলেদের কার কোন্‌ গুণ ভালো লাগে বলা মুশকিল । কিন্তু বাজারে উজ্বল চকচকে কাপড়ের দিকে নজর বেশি দেয় মেয়েরাই । ছেলেরা ফুটপাত থেকে টিশার্ট কিনেই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয় । তারা টেকসই ব্রান্ডের জিনিস কেনে ।

খালার বাসায় দেখেছিলাম সুন্দর হাতের কাজ করে ওয়ালম্যাট বানিয়ে টাঙিয়েছে খালাতো বোন ।
'জাতের মেয়ে কালোও ভালো, নদীর জল ঘোলাও ভালো।'
কালো মেয়েকে নদীর ঘোলা জলের সাথে তুলনা কে করেছে ? এটা তো মেয়েদের নিজস্ব হীনম্মন্যতা । ছেলেরা কেউ তো বলেনি !

কালো মেয়েকে বাবা মায়েরা একটু বেশিই আদর করেন । ভাবেন, পরের বাড়িতে মেয়েটাকে কী গঞ্জনা সইতে হয় কে জানে ? আগেই বলেছি, সেই গঞ্জনা কে দেয় ? 'ও বাড়ির' শাশুড়ী ননদেরা । স্বামী বেচারা নয় । ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গেলে যদি কালো বা শ্যামলা হয় , কে আগে ভেটো দেয় ? মা অথবা বোন । বাবা, ভাইয়েরা নয় । (তা যত বড় ইসলামপন্থি নেত্রী বুজুর্গ রাবেয়া বসরীই হোন না কেন এই ব্যাপারে সব শিয়ালের এক রা ।)
ছেলের জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ আনার গল্প ছোটবেলা থেকে কে শোনায় ? নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাবারা শোনায় না ।

সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ দোষেরও নয় । মেয়েরা কি চায়না তার স্বামীটা সুন্দর স্মার্ট হোক ? মেয়ের  বাপ দেখে ছেলের এস্টাবলিশমেন্ট , টাকা পয়সা । মেয়ে কী দেখে ? মেয়ে তো বাবার সাথে পুরোমাত্রায় একমত , সেই সাথে তাদের চাই সুন্দর স্মার্ট ছেলে । কে অস্বীকার করতে পারবে ?
আর মেয়ে যদি একটু সুন্দর হয় তাহলে তার দাম বেড়ে যায় অথবা বাড়িয়ে দেয়া হয় কয়েকগুণ । মেয়ের মা বলবেন, আমার মেয়ে লাখে একটা । যার তার হাতে দেবো কেন ? মেয়ে কি ভাইসা আসছে ?

ওয়েল । আসি দ্বিতীয় ব্যাপারে । ইসলামে পিতা মাতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার স্বীকৃত । যথাযথভাবে এই অধিকার দেয়ার ব্যাপারে পুরুষদের গাফলতি আছে । এ ব্যাপারে আমি আগেই লিখেছি (http://goo.gl/iJHWnX) । কিন্তু নারীদের ভূমিকা কী? ননদ যদি তার সম্পত্তির দাবি তোলে তাহলে প্রথমেই গর্জে ওঠে ভাইয়ের বউরা । তারা ননদকে বাঁকা চোখে দেখে । ভাই যদি বোনকে তার অধিকার বুঝিয়ে দিতে চায়, প্রথম বাধা আসে বউয়ের কাছ থেকে । যে ননদ তার প্রাপ্য সম্পত্তি নিয়ে যায়, বাবার বাড়িতে তার কদর কমে যায় । আর এসবের মূলে থাকে ঐ 'মেয়েরাই' । ভাইয়ের সাথে বোনের সম্পর্ক থাকে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্কের চেয়ে বেশি গভীর । ভাই চায় বোনের খুশি । চায়না কে ? চায়না ভাইয়ের বউ ! একই মেয়ে নিজে তার ননদের কাছে যেরকম ব্যবহার আশা করে, নিজের ননদের সাথে তেমন ব্যবহার করেনা । একই নারী তার মেয়ের শ্বশুড় বাড়িতে যেমন আচরণ আশা করে, নিজের ছেলের বউয়ের সাথে তেমন ব্যবহার করেন না । একই মেয়ে তার ভাবি দের কাছে যেমন আচরণ আশা করে, নিজের ননদের সাথে তেমন আচরণ করেনা ।
অনেকটা শর্ট সাইটেড এবং আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষুদ্র গন্ডিতে আবদ্ধ চিন্তাভাবনা তাদের । একটা স্বামী, দুটো বাচ্চা আর চার রুমের একটা বাসাকেই তাদের পৃথিবী বানিয়ে ফেলে । সমস্ত চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খায় পনেরশ স্কয়ার ফিটের ভেতর । দুজন বান্ধবীর দেখা হলে আলোচনার নব্বই ভাগ জুড়ে থাকে শাড়ী গয়না বাচ্চা শ্বশুড় শ্বাশুড়ী আর পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী । এর কথা তাকে লাগানোতে জুড়ি নেই নারীদের । সে তুলনায় ছেলেদের চিন্তাভাবনা অনেক ব্রড ।  উদারতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ছেলেদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য । এক্সেপশন মে নট বি আন এগজাম্পল ।

তো সেজন্য পুরুষদের উদ্দেশ্যে ক্ষোভের বয়ান না দিয়ে নারীদের উচিত্‍ ঘরের শত্রুকে জানা । আগে নিজেদের ঠিক করা ।