এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

হয়তো একদিন

কুরবানির ঈদে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এলাকায় গোশত বিতরন । লিস্ট করে প্যাকেট বানানো হয় । তারপর লিস্ট ধরে ধরে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসা হয় ।
লিস্ট করার কাজটা সবসময় আমিই করি । কিন্তু প্রতিবছরই আমার লিস্টে এমন কিছু মানুষের নাম থেকে যায়, যারা আর দুনিয়ায় নেই । তারপর আমাকে জানানো হয়, অমুক অমুক তো মারা গেছে ! ওদের নাম লিখেছ কেন ?
মসজিদে গিয়ে কাউকে হয়তো জিজ্ঞেস করলাম, আঃ গফুর চাচাকে দেখছি না যে !
শুনতে হয়, তোমারে কেউ বলে নাই ? উনিতো একমাস আগে মারা গেছেন !
কত পরিচিত মুখ প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে । একদিন হয়তো এভাবেই কোন একজনকে শুনতে হবে, 'আপনি কিছু জানেন না ? মুহসিন ভাই তো এক মাস আগে মারা গেছেন !'

বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪

বাঙ্গালির পরশ্রীকাতরতা

ছোটবেলায় দুই বন্ধু একসাথে লেখাপড়া করেছে । তারপর নানা পাকচক্রে পড়ে একজন লেখাপড়া বেশিদূর টানতে পারেনি । আরেকজন কোনভাবে হয়তো ভালো একটা অবস্থানে গেছে । ধরা যাক একটা সরকারি অফিসে চাকরি হয়েছে ।
তারপর একদিন সরকারি অফিসার গ্রামে গেলেন । রাস্তায় হাঁটতে বের হলেন , পাশ দিয়ে হয়তো ছোটবেলার ঐ বন্ধু হেঁটে গেছে । অন্যমনস্ক থাকায় বা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকায় হয়তো চোখেই পড়েনি বাল্যবন্ধুকে ।
বাড়িতে গিয়ে সেই বন্ধু মন্তব্য করবে- 'টুনির মা , সবই কপাল বুঝলা , সবই কপাল । আরিফুল্লা বড় অফিসার হয়া এখন আর আমাগো দিকে ফিরাও তাকায় না । অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না হেই বেডার, বুঝলা ! হেরে পাইলে একদিন কয়া দিও, অহংকার কিন্তু পতনের মূল !'
হয়তো কোন মুরুব্বীকে ঠিকমত চিনতে পারেনাই । মুরুব্বী আরেকজনের কাছে বলবেন, 'অমুকের পোলাডা বেয়াদব হয়া গেছে । বড় অফিসার হইছে বইলা এহন আর সালাম কালামও ঠিকমতন দেয়না । হায়রে কলিকাল ! আল্লা মালুম, আরো কতকিছুযে দেখতে হইবো এই জীবনে !'
ছুটিছাটায় যদি সময়ের অভাবে সব আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ না হয়, তাহলে যাদের বাড়িতে যাওয়া হয় নাই তারা বলবে, 'এখন তো বড় অফিসার হয়া গেছে । এখন কি আর আমাদের কথা মনে আছে? অহংকার বলে একটা কথা আছেনা !'
-
-
আসলেই, অন্য মানুষের সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা করতে আমাদের বাঙালি সমাজের কোন জুড়ি নেই । বাঙালির মত পরশ্রীকাতর জাতি পৃথিবীতে আর আছে কিনা কে জানে ! কিংবা এও হতে পারে- ব্যর্থদের কাছে হয়তো সফল ব্যক্তিমাত্রই অহংকারী মনে হয় !

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৪

রহস্য

-‘আপনি? আপনি কে?’
-‘আমি নেছার । নেছার উদ্দিন ভুইয়া । বারো ভুঁইয়ার ত্রয়োদশ উত্তরপুরুষ’ ।
-‘ও তাই ? তা আপনি এরকম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন কেন ? ছ’মিলে ঢুকিয়ে কেউ এমন করেছে বুঝি ? আহারে !’
হাসতে শুরু করে মুনির এবং নেছার । নেছার মুনিরের দুই বছরের সিনিয়র । কিন্তু তবু ওদের সম্পর্কটা সিনিয়র জুনিয়রের গন্ডিতে আটকে নেই । যদিও সিনিয়র জুনিয়রের মধ্যেকার স্বাভাবিক স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধেরও ঘাটতি নেই দুজনের মধ্যে । ওদের সম্পর্কটাকে ভাই ভাই সম্পর্ক বললেও পুরোটা স্পষ্ট হয়না । এটাকে বরং ভাই ভাই ও সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্কের একটা মিশেল অথবা তার চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় ।
সিনিয়র হিসেবে নেছারকে মুনির আপনি করে বলবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন নেছারও মুনিরকে আপনি করে সম্বোধন করাটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে । চেহারায় দুইজন বলা চলে দুই প্রান্তের । মুনিরকে ঠিক শুকনা বলা চলেনা, তবে স্বাস্থ্যবানও বলা যায় না । মোটামুটি গোলগাল চেহারা । ওদিকে নেছার মেডিকেল কলেজের পুরো ক্যাম্পাসে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে অদ্বিতীয় না হলেও ওজনে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে দুবছর আগেই । এজন্য অবশ্য বেশ কসরতও করতে হয়েছে তাঁকে । তখন ওর ওজন ছিল পচানব্বই । সেঞ্চুরির এত কাছে এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় ? নেছার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে একশ কেজির মাইলফলক ছোঁবার । সেজন্য তাকে প্রায়ই দেখা যেতে লাগলো মেরিডিয়ানের বুফে ডিনারে । তারপর বছর ঘুরতেই ওজন গিয়ে দাঁড়ালো একশ পাঁচে । নেছারের চোখে তখন অন্যরকম তৃপ্তির আভা ফুটে উঠল । এই বিশেষ সংবাদ সবাইকে জানানোর জন্য একদিন একটা ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করে ফেললো নেছার ।

মুনিরের খুব ভালো লাগে নেছারকে । এই ভালো লাগাটাকে মুনির তুলনা করে সমূদ্রভ্রমনের সাথে ।
সমূদ্রের তীরে দাঁড়ালে আমাদের কেন ভালো লাগে ? কেন দুঃখ কষ্টগুলোকে তুচ্ছ মনে হয় ? কেন সঞ্জীব গেয়ে ওঠেন- ‘ও পোড়া চোখ সমূদ্রে যাও !’
কারণ, সমুদ্র বিশাল ।
নেছারের শরীরটাই যে শুধু বিশাল তা নয়, মনটাও বিশাল ।
সেজন্যই, ভালো লাগে । বড় মনের মানুষের সাথে কথা বলতেই ভালো লাগে, নিজেকেও বড় বড় মনে হয় ।

এবার অনেকদিন পর দেখা হলো দুজনের । নেছারের ওজন কমে গেছে । দেখতে অনেক শুকনো লাগছে । কী ব্যাপার ? কোন সমস্যা নয়তো ?
ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুললো মুনিরকে । কোন অসুখের কথাতো কানে আসেনি । কোন ব্যাপারে কি খুব দুশ্চিন্তা করছেন নেছার ভাই ? খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করছেন ? খাওয়ার ব্যাপারে তো সহজে আপোষ করার কথা না নেছার ভাই !
নেছার ভাই নিজেকে ভোজন বিলাসী নয়, ভোজন রসিক বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন । বেশি খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর হাতে আছে মোক্ষম যুক্তি। ‘আমার বডি সারফেস এরিয়া বেশি, মেটাবলিজম বেশি, আমার ক্যালোরি রিকোয়ারমেন্টও বেশি’ । ‘সুতরাং আমাকে বেশি করে খেতে হবে ! আর খাবই যখন, মজাদার এবং ভালো খাবারই খাবো !’
এটা কোনভাবেই বিলাসিতা নয় নেছার ভাইয়ের কাছে, এটা হলো ‘ভোজনরসিকতা’ !
অবশ্য নেছার ভাইয়ের দুশ্চিন্তা করার কারণ আছে । নেছার ভাই পরিবারের একমাত্র ছেলে । কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই মারা যান নেছার ভাইয়ের বাবা । এখন পুরো পরিবারের দায় দায়িত্ব বলতে গেলে নেছার ভাইয়ের কাঁধে । বাবা মারা যাওয়ার ব্যাপারটা মুনিরের কাছে মনে হয়, চরম ঝড় জলোচ্ছাসে একটা ছাতা অথবা আশ্রয়কেন্দ্র উড়ে যাওয়ার মত । এরপর থেকে যত ঝড়ো বাতাস, শিলাবৃষ্টি, খড়কুটো বিদ্যুৎ চমক সবকিছু সরাসরি গায়ে এসে লাগে । শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না । যদিও নেছার ভাই শুধু শারিরীকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও অনেক শক্ত একটা ছেলে, কিন্তু তবুও হঠাৎ করে এতটা চাপ হয়তো তাকেও কষ্টে ফেলে দিয়েছে ।
নেছারের সাথে একান্তে আলাপ করার প্রয়োজন বোধ করে মুনির ।

-‘ভাই, এতদিন পরে এলাম । চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে কীভাবে আপ্যায়ন করা হবে জানতে পারি কি?’ কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করে মুনির ।
-‘আপনি যা বলবেন তাই হবে’ । তাৎক্ষণিক জবাব দেয় নেছার ।
-‘হুম । তাহলে আজকের ডিনারটা আনলিমিটেড হয়ে যাক ! চলেন, কারো লস করে দিয়ে আসি !’

আটটার দিকে জিইসি মোড়ের দিকে চলে যায় মুনির ও নেছার । বাফে ডিনার খাওয়ার ব্যাপারে ওদের স্পেশাল সিস্টেম আছে । সাধারণত সবাই গিয়ে প্রথমে সুপ, ভেজিটেবল খায় । নেছার ও মুনির ওসবের ধারেকাছে ভিড়বে না । নো সুপ, নো রাইস । ডাইরেক্ট এটাক অন চিকেন ফ্রাই, রোস্ট, বিফ, মাটন, প্রন, আইসক্রিম এন্ড ফ্রুটস । এছাড়া অন্য কোন ভালো আইটেম থাকলে চেখে দেখা যেতে পারে ।
হিসেব করলে আল্টিমেটলি অন্তত এই দুজনের ক্ষেত্রে রেস্টুরেন্টের লসই হয়ে যায় ।

খেতে খেতে মুনির প্রশ্ন করে-
-‘নেছার ভাই, এখন কত ?’
-‘নাইন্টি এইট’ ।
-‘এনিথিং রং ?’
-‘নো’ ।
-‘কী করছেন ? খাওয়া কমিয়েছেন নাকি ব্যায়াম করছেন ?’
-‘আরে খাওয়া কমাবো কেন? এই যে এখন খাচ্ছি না ! খাওয়া কমালে কি আর এই পথে পা মাড়াই ?’
-‘তাহলে ?’
-‘প্রতিদিন সকালে প্যারেড মাঠে দৌড়াচ্ছি’ ।
কিছুটা উদাস হয়ে যায় মুনির । একসময় প্যারেড মাঠে মুনিরও দৌড়াতো । নেছার ভাইয়ের সাথে অনেকবার ম্যারাথনে অংশ নিয়েছে । হাউ মাচ স্ট্যামিনা ইউ হ্যাভ । প্যারেড মাঠের কিনার ধরে একটানা দৌড়ে কতবার মাঠ প্রদক্ষিণ করা যায় এই নিয়ে প্রতিযোগিতা হত দুজনের । মুনির হাল্কা পাতলা, দুইবার তো সে অনায়াসেই পারে । কিন্তু নেছার এতটা ওজনদার মানুষ হয়েও কম যায়না । প্যারেড কর্নার দুইবার চক্কর দেয়া মানে প্রায় চার কিলোমিটার । নেছারও দুইবার চক্কর দেয় মুনিরের সাথে । নেছারের স্ট্যামিনা সম্পর্কে আগে ঠাট্টা করলেও এর পরে আর সেটা করার সুযোগ থাকে না মুনিরের ।
-‘নেছার ভাই, মোক্ষম প্রশ্নটা কী জানেন?’
অনেক ক্ষণ পরে নাটকীয় ভাবে আবার কথা শুরু করে মুনির । নাটকীয়তা জিনিসটা ওর ভেতর ভালোমতই আছে । নাটকীয়ভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু করতে সে ওস্তাদ । নেছারের সাথে এত ভালো সম্পর্কের এটাও হয়তো একটা কারন । দুজনে একসাথে হলে দেশ বিদেশ আকাশ পাতাল সাহিত্য রাজনীতি ধর্ম ইতিহাস ভূগোল কোনটাই বাদ পড়েনা আলোচনা থেকে । নানারকম থিওরি নিয়ে ওদের আলোচনা চলতেই থাকে । বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা, মিশর চীন এন্টার্কটিকা । দোয়েল কোকিল থেকে এমু পেঙ্গুইন । জীবনানন্দ থেকে গুন্টার গ্রাস । এরশাদ থেকে গাদ্দাফি । কোনকিছুই বাদ পড়েনা সে আলোচনায় । জাকির নায়েকের উত্থানের কারণ ও ফলাফল কী, ঈমাম মাহাদী কখন কীভাবে আসবেন, বিশ্বের পরিবর্তন কীভাবে হচ্ছে এসব বিষয়ে নেছারের ইউনিক থিওরি আছে । কতরাত যে ওরা শুধু এইসব আলোচনা করে পার করেছে তার ইয়ত্তা নাই । আজও হয়তো আলোচনা সেদিকেই এগোবে ।

-‘কোন্‌ প্রশ্নটা যে মোক্ষম সেটা আমি কীভাবে বুঝবো ?’ চোখ নাচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নেছার ।
-‘প্রশ্নটা হচ্ছে, এইযে প্যারেড মাঠ চক্কর দিচ্ছেন, তা হঠাৎ ওজন স্তরে ফাটল ধরানোর কারণ কী ?’
মুচকি হেসে নেয় নেছার ।
-‘আমি জানতাম এই প্রশ্নটা আজকে আমাকে বিদ্ধ করবেই । সেজন্য মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি !’
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে নেছার । সুন্দর করে একটা নাম লেখা তাতে । নামটা পড়ে কিছু একটা আন্দাজ করে মুনির । তবুও অবুঝের মত প্রশ্ন করে সে । যদি আন্দাজ সঠিক হয়, তাহলে সে বিষয়ে নাদানের মত প্রশ্ন করাই যায় !

-‘এটা কী? কার নাম? আপনার বোনের?’
-‘আরে নাহ ! আমার বোনেরা যাকে পছন্দ করেছে তাঁর !’
লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ে নেছারের চোখে মুখে । মুনির তবুও না বোঝার ভান করে । এইসব ব্যাপারে সহজে ছেড়ে দিতে নেই !
-‘কেন কেন? আপনার বোনেরা পছন্দ করেছে কেন? কে ইনি? আর কার জন্যেই বা পছন্দ করলো?’

নেছার এবার পকেট থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে । বলে, ‘ইনিই সেই ব্যক্তি !’
এক পলক দেখে ছবিটা ফিরিয়ে দেয় মুনির । এক বিংশাদশীর ছবি ! দ্বাবিংশও হতে পারে !

নেছার লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে- ‘গত মাসে দেখাদেখি হয়েছে । সবকিছু ওকে হয়ে আছে । তবে...’
-‘তবে কী?’
-‘উনি বলেছেন, ওজন কমিয়ে নব্বইয়ের নিচে নামাতে হবে । সময় তিন মাস !’
-‘এই তাহলে ওজোন স্তরে ফাটল ধরার রহস্য?’ ...

হাসতে শুরু করে মুনির এবং নেছার দুজনেই ।
‘বিফ শেষ হয়ে গেছে’ বলে উঠে খাবার আনতে যায় নেছার । এটা যে লজ্জা ঢাকার উছিলা সেটা না বোঝার কোন কারণই আর অবশিষ্ট থাকেনা মুনিরের কাছে । ঐতো, কিঞ্চিৎ আরক্ত মুখটা পেছন থেকেও বেশ দেখা যাচ্ছে !

রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪

সব নিয়ে যা

সব নিয়ে যা সব নিয়ে যা
কিচ্ছু আমার নেই প্রয়োজন
কিছুই আমি বলবো না আর
লুট ডাকাতির কর্ আয়োজন ।
-
বুক ফেঁড়ে মোর যা নিয়ে তুই
স্বপ্নভুক এ হৃদয়টাকে
সকাল সন্ধ্যা মুঠোয় ভরে
দিস খেতে দিস 'স্বপ্ন' তাকে ।
-
চোখ দুটোকে চোখেই রেখে
নিতে পারিস যা ইচ্ছে তোর
স্বপ্ন দেখার চোখ হারালে
কী থাকে আর বুকের ভেতর?

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

মেডিকেল ছাত্রীর আত্মহত্যাঃ দায় কার?

আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে । পরীক্ষায় ফেল করায় সে ডিপ্রেশনে ভুগছিল । চিন্তা ছিল টাকারও । কারণ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে একবার ফেল করা মানে অনেক টাকা গচ্চা । গতবছর বগুড়া মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে একই কারণে । বারবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারছিল না । চিটাগাং মেডিকেলে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র ফরিদ ভাই, ফ্রাস্ট্রেশান এবং ডিপ্রেশানে ভুগে মেডিকেল কন্টিনিউ করতে না পেরে বাড়িতে চলে যান । একদিন খবর পাই, তিনি আত্মহত্যা করেছেন ।
এইসব অকাল মৃত্যুর দায় কার ?
দায় খোঁজার আগে একটু বলা ভালো- মেডিকেলে পাস বলতে ৩৩ নম্বরে পাস নয় । এখানে প্রতি সাবজেক্টে পাঁচটা পার্ট- অবজেক্টিভ, রিটেন, ভাইভা(দুই বোর্ড), অস্পি এবং প্রাক্টিকাল । পাস করতে হলে প্রতিটি পার্টে আলাদা আলাদাভাবে ৬০% মার্কস পেতে হবে ।
যে আত্মহত্যা করেছে তার নিজের দায় অবশ্যই সবার আগে । কারণ, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, যত খারাপই হোক, আত্মহত্যা কোন সমাধান নয় । একটু ধৈর্য ধরলেই কোন না কোনভাবে মুক্তি মিলবেই । Time is the best Healer.
এরপরেই দায় নিতে হবে বাবা-মাকে । ছেলে/মেয়ে কে ডাক্তার বানানোর বাবা-মায়ের তথাকথিত ‘স্বপ্ন’ আর জেদের বলি হয়ে কতজনকে যে নিজের স্বপ্ন, ভালোলাগা বিসর্জন দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই । বাবা মা তাঁদের সন্তানকে জোর করে মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়েই খালাস। ছেলে আমার ডাক্তারি পড়ছে, তাধিন তাধিন ! এখানে যে একটা ছেলে/মেয়েকে কী পরিমাণ স্ট্রেস সহ্য করতে হয় তার ধারণা অনেকেরই নেই ।
শিক্ষকদের দায়ও কম না । একটা ছেলে আইটেম পরীক্ষা দিতে আসছে না, অথবা ক্লাসে আসছে না । কোন শিক্ষক তার খবর রাখেন ? কেন আসে না ? কেন পরীক্ষা দিচ্ছে না ? বরং কয়েকদিন পর যখন সে ক্লাসে আসে, হয়তো পেছনের দিকে গুটিয়ে বসে আছে । তখনই শিক্ষক মনে মনে বলেন, ‘আইজকা পাইছি তোরে’। সবার সামনে এনে বকাঝকা করে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেন । অনেকে টিচারের বকাঝকার ভয়ে আরো পিছিয়ে যায় । ক্লাসে আসেনা । ক্লাসে সবার সামনে জিজ্ঞেস করলে সব সমস্যা বলা যায় না । এইটুকু বোঝার মত জ্ঞানও বেশিরভাগ শিক্ষকের নেই।
সিনিয়র জুনিয়র অনেকের কথা জানি, যারা শুধুমাত্র শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের কারণে ইয়ার লস দিয়েছে । যে ছেলেটা ডিপ্রেশনে ভুগছে তাকে আপনি ক্লাসে পাওয়ামাত্রই সবার সামনে ডেকে বকাঝকা করলে সে কীভাবে এগিয়ে আসবে ? যে পড়াশোনায় মন বসাতে পারছেনা, তাকে আপনি বারবার আইটেম-কার্ড পেন্ডিং দিচ্ছেন, বকাবকি করে ফিরিয়ে দিচ্ছেন- সে আগাবে কীভাবে ?
পরীক্ষার পর যারা ফেল করেছে- কোন শিক্ষক কি খোঁজ নেন, এই ছেলেগুলো কেন ফেল করলো ? না । তাঁরা নিজেদের কোন দোষ দেখেন না, সিস্টেমের কোন দোষ দেখেন না, তাঁরা কোন বাস্তব সমস্যার ধার ধারেন না । তাঁদের কাছে উত্তর রেডি আছে- ‘পড়ালেখা করে না । খালি হোস্টেলে ঘুমায় ! গার্জিয়ানকে চিঠি দিতে হবে ।’
গার্জিয়ানকে চিঠি দেয়ার হয়তো দরকার হতে পারে, কিন্তু তার আগে কি যথাযথ মোটিভেশান দেয়া হয় ? স্টুডেন্টের প্রবলেম সলভ করার চেষ্টা করা হয়, সাহায্য করা হয় ?
Being a teacher not just reading, explaining & questioning from text, it’s something more than that.
একেকটা প্রফেশনাল পরীক্ষাকে আমি তুলনা করি লেবার পেইনের সাথে । লেবার পেইন নাকি অনেক অনেক বেশি । সাধারণভাবে কেউ এতটা পেইন সহ্য করার কথা না । মা ছাড়া অন্য কেউ যেমন সেই কষ্ট বোঝেনা, মেডিকেল স্টুডেন্ট ছাড়া অন্য কেউ প্রফ পরীক্ষার স্ট্রেস বুঝতে পারবেনা । প্রসবের বেদনা খুব তীব্র হলেও যেমন পৃথিবীতে মানুষের জন্ম থেমে নেই, যত কঠিনই হোক- ডাক্তার হওয়াও থেমে থাকবে না । কিন্তু সবারই নরমাল ডেলিভারি হয়না, কারো কারো কমপ্লিকেশান থাকে । সিজারিয়ান সেকশন করতে হয় । কারো কারো এসিস্টেড ডেলিভারি করতে হয় ।
পরীক্ষার পর যারা খারাপ করেছে-কেউ কি তাঁদের ডেকে একটু আদর দিয়ে বলে, একবার ফেল করলে জীবনে বেশি কিছু আসে যায় না ? অথচ যারা খারাপ করে, তাদের নিয়ে আলাদা ভাবে সাইকোলজিক্যাল মটিভেশান দেয়া দরকার । তাদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া দরকার । কিন্তু আমি জানি, কোথাও কেউ এই কাজটা করেনা ।
পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও ভাবা দরকার । সবগুলো সাবজেক্টের সবগুলো পরীক্ষা একটানা তিন চার মাস ধরে নিতে হবে কেন ? বিভিন্ন সময়ে ভাগ ভাগ করে বেশি বেশি সময় দিয়ে নেয়া যায় না ? শিক্ষাই আসল, নাকি পরীক্ষা ?
বাবা-মায়ের ইচ্ছামত ধরে বেঁধে মেডিকেলে ভর্তি করাতে থাকলে, আর টিচারদের মানসিকতা পরিবর্তন না হলে এভাবেই প্রতিবছর কাউকে না কাউকে হারাতে হবে। বাস্তবে কেউ দায় নিতে না চাইলেও , বাবামা, শিক্ষক, সমাজ, রাষ্ট্র- আসলে কেউই এর দায় এড়াতে পারেনা ।

বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৪

এক ফোঁটা বৃষ্টি

এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে- কতকাল ধরে বুভুক্ষু হয়ে বসে আছি-
কত নক্ষত্র নুয়ে এসে চুমে গেল আমার দুহাত
কত জলোচ্ছাস সুনামি বয়ে গেল নর্দমার ভেতর
কত সাদা মেঘ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল প্রচন্ড উত্তাপে
অথচ এক ফোঁটা বৃষ্টি হলোনা আজও ।
কলুষে ভরে আছে আমার মানবিক অন্তর
ঐশী আলোর বর্ষণে পরিশুদ্ধ করবো বলে
হাত পেতে বসে আছি কতকাল
এক ফোঁটা বৃষ্টির অপেক্ষায় ।

চিকিৎসা যখন বণিকের হাতেঃ স্বাস্থ্যসেবা নাকি স্বাস্থ্যব্যবসা ?

চিকিৎসা যখন বণিকের হাতেঃ স্বাস্থ্যসেবা নাকি স্বাস্থ্যব্যবসা ?
তিক্ত অভিজ্ঞতা-১:
কয়েকমাস আগে আমার বড় ভাই বান্দরবান সফরে গিয়েছিলেন । ফেরার পথে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন । ট্রাভেলারস ডায়রিয়া । কুমিল্লায় নেমে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন রাতেই। ফোন বন্ধ থাকায় রাতে খবর পাইনি । সকালে খবর পেয়ে ঢাকা থেকে রওনা হলাম । কুমিল্লা পৌঁছতে দশটা পার হয়ে গেলো ।
গিয়ে ভাইয়ের অবস্থা দেখে তো আমি হতবাক । Severe Dehydration এর পেশেন্টকে ওরা ১২ ঘন্টায় দিয়েছে মাত্র দেড় লিটার ফ্লুইড ! ক্যাথেটার দিয়ে রেখেছে । ১৪ ঘন্টা ধরে কোন Urine output নাই ।
মাথা এত গরম হলো যে বলার মত না । নিজ দায়িত্বে ফ্লুইড দেয়ার ব্যবস্থা করে ঢাকায় নিয়ে এলাম । দেখা গেল Serum Creatinine দাঁড়িয়েছে 3.5 এ । আমি যদি ডাক্তার না হতাম, আর সকাল সকাল গিয়ে না পৌঁছতাম তাহলে এরা ভাইয়ের কিডনির অবস্থা কী করতো ভেবে আমার এখনো গায়ে কাটা দেয় ।

তিক্ত অভিজ্ঞতা-২:
ঈদুল আযহার পরে ঢাকা চলে এসেছি । রাতে ফোন পেলাম আব্বা মোটর সাইকেল সহ গর্তে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন । নিউরোসার্জন দেখানোর কথা বলে আমি রাতেই রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । সকালে গিয়ে পৌঁছলাম । আব্বাকে নিউরোসার্জন দেখিয়ে একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে । অবস্থা দেখে আবারো মাথা গরম হয়ে গেল । আব্বার স্পাইনাল ইনজুরি হয়েছে, নিউরোসার্জন Methyl Prednisolone প্রেসক্রাইব করেছেন । এই ড্রাগ স্পাইনাল ইনজুরির পর যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায় তত ভালো । অন্তত আট ঘন্টার মধ্যে দিতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায় । পেশেন্ট ভর্তি হবার ১২ ঘন্টা হয়ে গেছে, এরা তখনো এক এম্পুলও দেয়নি । তারচেয়ে বড় ব্যাপার, পেশেন্ট ডায়াবেটিক জেনেও এরা একবারও ব্লাড গ্লুকোজ চেক করেনি । ইনপুট আউটপুটের হিসাব নাই । ইউরিন আউটপুট এডিকোয়েট না । ১৪ ঘন্টায় এরা একটা নরমাল স্যালাইনও দেয়নি ।
.........
৬৪ জেলার বাংলাদেশে এখন সরকারি মেডিকেল কলেজ ২৯ টি । আরো ১১ টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার । আগামী জানুয়ারি থেকে সেগুলোর কার্যক্রম শুরু হবে । এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৫৬ টি । আরো ১১ টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার । এই নিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে প্রতিবছর । এর উদ্দেশ্য কী ? স্বাস্থ্যসেবা ? টাকা থাকলেই খুলে বসছে মেডিকেল কলেজ । পনেরো বিশ লাখ টাকা করে নিচ্ছে প্রতি স্টুডেন্টে । টিচার নিয়োগের খবর নাই, অবকাঠামো উন্নয়নের খবর নাই । জায়গামত টুপাইস ঢাললে মিলছে অনুমোদন । একজন রোগীর কাছ থেকে যদি দশহাজার টাকা বিল আসে, ডাক্তার হয়তো পাচ্ছেন পাঁচশ টাকা । বাকিটার অন্তত অর্ধেক লাভ ! স্বাস্থ্য খাত যখন বণিকদের হাতে চলে গেছে, বণিকেরা যখন লাভের গুড় খেতে শিখেছে তখন স্বাস্থ্য- ‘সেবা’ থাকবে তা হতে পারেনা । ব্যবসায়ীর কাছে সবকিছু বিবেচিত হয় টাকার অংকে । ভালোবাসাও । মানবতাও ।

সরকার ৬৮হাজার গ্রামে গ্রামে মেডিকেল কলেজ করার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন আর অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । স্বাস্থ্যখাত এখন রমরমা ব্যবসার ক্ষেত্র । পকেটে টাকা আছে তো একটা মেডিকেল কলেজ দিন । মন্ত্রী হয়েছেন ? এখন কী করবেন ? গ্রামে গ্রামে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিন । এই দাঁড়িয়েছে অবস্থা । ভর্তি পরীক্ষায় ১০ মার্ক পেয়েও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে গেল বছর । অথচ ক্লাস ওয়ানে পড়া একটা বাচ্চাকেও যদি কলম নিয়ে বসিয়ে দেয়া যায়, ইচ্ছেমত গোল্লা ভরাট করেও কমছে কম ২০ মার্ক তুলে ফেলবে । সামনে হয়তো এমন দৃশ্যও দেখতে হবে- কমার্স থেকে মেডিকেলে ভর্তি হচ্ছে । টাকায় কিনা হয় !
বেসরকারি খাতে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক হতে পারে । কিন্তু সেগুলোর একটা মিনিমাম মান রক্ষা করা দরকার । শত শত ভার্সিটি খোলেন, ইতিহাস পড়ান, ডিগ্রী দেন অসুবিধা নাই । কোন মুঘল সম্রাটের কতটা হেরেম ছিল, হলোকাস্টে কতজন ইহুদি মারা গিয়েছিল সেই সংখ্যার ভিত্তিতে ইচ্ছেমত পিএইচডি দেন- অসুবিধা নাই । কিন্তু মেডিকেল কলেজ আর ক্লিনিক হাসপাতাল দিয়েন না । ডায়রিয়ার রোগী মেরে ফেলে এমন মেডিকেল কলেজ শত শত দিয়েও লাভ হবে না । পাতার পর পাতা পড়ার নাম ডাক্তার হওয়া নয়, এখানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে হয় । জীবন একবার গেলে আর ফেরানো যায় না ।
দু’দিন আগেও অধ্যক্ষদের বরাতে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, পুরাতন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ছাড়া বেশিরভাগ মেডিকেলেই প্রয়োজনীয় টিচার নেই । প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই । হাতেকলমে চিকিৎসা শেখার সুযোগ নেই । বাবা মায়েরা হয়তো চাইতেই পারেন তাঁর ছেলে মেয়ে ডাক্তার হোক, টাকারও অভাব নেই । প্রয়োজনে এক বিঘা জমি বিক্রি করলেই তো হয় । বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন-আমার ছেলে/মেয়ে ডাক্তার। প্রতিবছর নামের সামনে ডাঃ লেখা অনেক মানুষ হয়তো বের হবে, কিন্তু চিকিৎসার অবস্থা হবে আমার অভিজ্ঞতার মত ।
এমবিবিএস পাস করে যখন সত্যিকার প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, তখন হতাশ ডাক্তারের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবেনা । ডাক্তার মানেই টাকা- বাস্তবে যখন এই হিসেব মিলবেনা তখন অনেকেই জড়িয়ে পড়বে দুর্নীতিতে । এটা তো ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ।
আর সর্বোপরি যা ঘটবে- প্রকৃত মেধাবী ডাক্তাররা, এরা তো সারাবিশ্বের যেকোন প্রান্তে অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম । এদের একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন । এখনই অনেক ডাক্তারের প্রথম টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশ ছেড়ে যাওয়া । যারা আছেন, বাবামা ভাই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে, দেশের মানুষের দিকে তাকিয়ে থেকে যাচ্ছেন । এই সংখ্যাটা হয়তো দিন দিন কমে যাবে । প্রকৃত মেধাবীরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে, রয়ে যাবে ভর্তি পরীক্ষায় ১০ মার্ক পাওয়া, কমার্স থেকে মেডিকেলে আসা মেধাবীরা । হ্যা, মন্ত্রী এমপি রাষ্ট্রপতি হয়তো সিঙ্গাপুরে ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন’ । আমার আপনার বাবা মা-র কী হবে ?

গন্তব্যের দায়

হে গন্তব্য,
আমার সাক্ষাত পেতে চাইলে এগিয়ে আসতে হবে তোমাকেও
আমি তো হাঁটছি, হেঁটে যাবো যতদূর পারি- ক্লান্ত শীর্ণ পায়ে ।
অতটা পাগলপারা নই, অতটা তাড়া নেই আমার পদসঞ্চালনে
পৌঁছতেই হবে গন্তব্যের আঙিনায়- অমন কোন প্রতিজ্ঞাও করিনি কোনদিন ।
কবে গিয়ে দাঁড়াবো তোমার চৌকাঠে, কবে ডাক দেবো প্রেমঘন মদির কন্ঠে-
অনাগত সে ক্ষণের অপেক্ষায় যদি বসে থাকো চুপচাপ,
হয়তো অনন্তকাল পেরিয়ে যাবে, তুমিও বুড়িয়ে যাবে চাঁদের বুড়ির মত
হয়তো পথেই কোথাও রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে দুহাত বাড়িয়ে দেবে যৌবনবতী মৃত্যু
ক্লান্ত কাঙ্গাল আমি হয়তো প্রেমের তৃষ্ণায়- ব্যাকুল প্রেমিকের মত নির্লজ্জ হয়ে
মৃত্যুকেই জড়াবো আমার আলিঙ্গনে ।
হে গন্তব্য, যদি ছুঁয়ে দেখতে চাও আমার আঙ্গুল
যদি চাও একবার হোক প্রথম কিংবা শেষ সাক্ষাত তোমাতে আমাতে
এগিয়ে আসতে হবে তোমাকেও। আমি তো হেঁটেই চলেছি ধুলোময় পৃথিবীর পথের উপর
এখানেই পাবে আমায় সুবহে সাদিক হতে শুকতারা অবধি 
এগিয়ে এসো তুমি, মৃত্যুর সাথে বোঝাপড়া করে আজ রাতে আমাকে জানাও 
কে হবে প্রেয়সী আমার । 

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৪

হাঁটুজলের কৈফিয়ত

ভাবছো, কতটা পাষাণ আমি ! সামান্য হাঁটুজলের নদী হয়ে
উপেক্ষা করি সাগরের ডাক ! কী করে বোঝাই হে অসীম জলধি-
অতটুকু জল যে আমায় ঢেলে দিতে হয় দুধারের জমিনে
তৃষ্ণার্ত ধানক্ষেতে, চৌচির মৃত্তিকায় ।
অতটুকু জলেই ভরিয়ে দিতে হয়, শত গাঁয়ের সবগুলো শুন্য কলস ।
আপামর আবাল বৃদ্ধবণিতার ঘর্মাক্ত দেহ, ধুয়ে দিতে হয় আমাকেই
অতটুকুন টলটল জলে ।
.
অতটুকু মিঠে পানি আছে বলেই
বেলে মাছ ঠোকর দেয় অকস্মাৎ-
কিনারে দাঁড়ানো চঞ্চল কিশোরীর সুবর্ণ পায়
লজ্জাবনত শেওলাগুলি আড়চোখে দৃষ্টি হানে তীরের কোলাহলে
খলসে চিংড়ির ঝাঁক কান পেতে শোনে
জেলেনির কঙ্কনধ্বনি ।
এদের ছেড়ে হে সমূদ্র,
কী করে ছুটে যাই অশান্ত মোহনায়?
তোমার তো আছে অগুণতি নৌকো, জাহাজ
কিছু খড়কুটো নাহয় আমারই থাকুক
তোমার তো আছে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা-যমুনা
নাইবা পেলে এইটুকুন একহাঁটু জলের ভালোবাসা
কী আসে যায় তাতে
তোমার বিশালতায়?

শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত

বোকারাই শুধু ভয় পায় রাতের গভীরতা । আমি নই ।
গভীর হতে গভীরতর না হলে
রাতের স্বার্থকতা কী থাকে ?
চতুর সৈনিকেরা বরং অপেক্ষায় থাকে গভীর রাতের ।
সুরক্ষিত দুর্গ যখন হয়ে পড়ে কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন 
ঐতো মোক্ষম সময় প্রাচীর ভেদ করে কেল্লা বিজয়ের।
রাত্রির গভীরতা যত বাড়ে, একে একে খুলে যায় ক্রমাগত
আকাশের সবকটি  অলৌকিক দরোজার খিল ।
তারপর শেষ মুহূর্তগুলিতে
ঘুঁচে গিয়ে সৃষ্টি ও স্রষ্টার অভেদ্য দেয়াল-
একাকার হয়ে যায় বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমগ্র অস্তিত্ব
একত্ববাদের অদ্বিতীয় মহিমায় ।
পৃথিবী ও মহাবিশ্বের জন্ম হতে ধ্বংস অবধি 
আর কিছু কি হতে পারে-
এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ? 

শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৪

নির্যাতিত শব্দগুলো

রাজনীতি ছাড়িয়ে দখলবাজি এখন ঢুকে পড়েছে অভিধানে
শব্দগুলোকে দখলে নিয়ে ইচ্ছেমত খেলছে কবিরা
কেউ আস্ত হাতিকে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে
কেউ মগে ভরে ঢকঢক করে খাচ্ছে আমাদের ভালোবাসা
কেউ হাড়-পাঁজর জাতীয় শব্দগুলোকে বানিয়ে নিয়েছে
একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি !
আর আমরা কিনা ভীরু কাপুরুষ নপুংসকের দল
বসে আছি চুপচাপ !
শব্দদের করুণ আর্তনাদ শুনেও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ! বরং
পৈশাচিক আনন্দ নিচ্ছি !
কবিদের জুলুম হতে নিরীহ শব্দদের বাঁচাতে
এখনো গড়িনি একটাও দুর্গ । একটা কামানও প্রস্তুত করিনি-
জালিম কবিদের দিকে ছুড়ে দিতে-
ঝাঁকে ঝাঁকে জীবন্ত বুলেট !
কবির বুক ঝাঁঝড়া করে দিলে অব্যর্থ বেয়নেটে
একটা টগবগে হৃদপিন্ড ছাড়া
কী এমন বেরিয়ে আসবে, যাকে আমরা-
এতটা ভয় পাই?

বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৪

প্রতিশব্দ

বেশি কিছু চাইনাকো আমি
চাইওনি কখনো ।
বেশি ভাত নয়
বেশি তরকারি নয়
বেশি টাকা নয়
এমনকি, বেশি ভালোবাসাও নয় ।
চেনা এবং অচেনা সুহৃদ,
খুব বেশি ভালোবাসা দিওনা আমাকে
আমার কলসীটা খুব খুব ছোট ,
উথলে পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে তোমাদের
অমূল্য সম্প্রদান ।
প্রতিদানে বেশি কিছু দিতেও জানিনা আমি
বেশি কিছুই নেই আমার ভান্ডারে ।
'কেমন আছি তবে' এই জিজ্ঞাসা-
টগবগ করছে তোমার চোখে ? জেনো, ভালো আছি ।
বলতে পারো, বেশিই ভালো আছি । কারণ,
বেশি থাকা আর ভালো থাকা কখনোই
প্রতিশব্দ নয় জীবনের অভিধানে ।

বক্ষভেদী জ্যোৎস্না !

চাঁদের কিরণ, ভেদ করে রাত্রির হৃৎপিণ্ড
ঠিক ঠিক বিঁধছে এসে আমার আঙিনায়
যেন একঝাঁক মোলায়েম বুলেট,
খুঁজে ফিরছে নরোম শিকার !
আর আমাকেও বলছে ডেকে, বুক পেতে দাও
বুক পেতে দাও
পাঁজরের কুঠরি ভরে নাও জোৎস্নায় ।
অলিন্দ নিলয় হতে নিংড়ে নিয়ে রুধির ধারা
বইয়ে দাও সবটুকু পৃথিবীর পথে
আজ রাতে
জোছনা প্রবাহিত হোক হৃদপিন্ড হতে ধমনী শিরায়
আজ রাতে, রুপালী জোছনার স্রোতে-
বিলীন হয়ে যাক ঠুনকো প্রাণ
অস্তিত্বহীনতায়...

শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৪

রাজনীতিতে নীতিভ্রষ্টতার দলিল

'রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই' এই বাক্যটা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এভাবে বলা হয় কিনা আমার জানা নেই । কিন্তু বাংলাদেশে এটাকে বানিয়ে তোলা হয়েছে রাজনীতির মূলমন্ত্র । নীতিভ্রষ্টতার দলিল । নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিকদের আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে এই বাক্যটি । নীতি নৈতিকতার মাথা খেয়ে হালুয়া রুটির লোভে রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিকরা ইচ্ছেমত মেরু পরিবর্তন করবেন আর বলবেন- 'রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই' ! আর জনগনও সবকিছু মেনে নিয়ে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলবে, 'কী আর করা ! রাজনীতিতে শেষকথা বলে তো কিছু নেই !'

এ যেন ঐশি বাণী ! অদ্ভুত এই মানসিকতা । অথচ বাস্তবিক অর্থে এটির প্রকৃত অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে- 'রাজনীতিতে নীতি নৈতিকতা বলে কিছু নেই'।

রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাইলে এই বাক্যটিকে গলাধাক্কা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় পাঠিয়ে দিতে হবে । যেকেউ এই কথা বলবে, তাকে স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে- থামুন মহাশয় । রাজনীতিতেও শেষ কথা থাকতে হবে । আপনি আপনার শেষ কথা বলে যান । নাহলে আমাদের শেষ কথা শুনে যান ।

মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৪

আত্মার টান !

কেউ কেউ ডাক দিলে
অবান্তর হয়ে যায় সময়ের প্রশ্ন ।
কারো কারো জন্যে প্রতিদিন জমা হয়
স্নেহ মায়া মমতা
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা;
পাটিগণিত হার মেনে যায়
বেহিসেব শুভকামনায় ।
আচ্ছা,
এই কি আত্মার টান ?
অদৃশ্য বন্ধন !

সোমবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৪

কুরবানীর একটি শিক্ষা

প্রতিবছর কুরবানীর ঈদে যে প্রশ্নটা মনে জাগে, যদি কোরবানীকৃত পশুর গোশত নিজে খাওয়ার সুযোগ না থাকতো, যদি সবটাই বিলিয়ে দিতে হত নিঃস্বার্থভাবে, তাহলে কতজনে কুরবানি দিত ?
কুরআন হাদীসে তো আরো নানাভাবে প্রাণ ও সম্পদ খরচের তাগিদ দেয়া হয়েছে । ক'জনে তা করে ? কুরবানির একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ধারণা দেয়া যে, মানুষের যা কিছু আছে সবকিছুই আসলে আল্লাহর । আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তা যখন প্রয়োজন কুরবানি করতে হবে । এই শিক্ষা কি আদৌ কেউ পায় ? পেলে তো এতদিনে সমাজের অবিচার অনাচারের অবসান ঘটত ।
আল্লাহ সবাইকে কোরবানীর শিক্ষা উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন । আমীন ।

শনিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৪

ছন্নছাড়া সুখ !

'খাঁটিয়া মরিতে হইবে সুখের লাগিয়া'
এইতো তোমাদের, জীবনের আপ্তবাক্য । অথচ
বেশ জানি আমি
কখনো পাবোনা আর অতটুকু সুখ, যা ছিল
বানের জলে ঝাঁপিয়ে পড়া, মায়ের অবাধ্য এক
ছন্নছাড়া বালকের মনে ।
কখনো হবেনা আর ততটুকু সুখ, যা ছিল আমার
মধ্যদুপুরে,
গাছের ডালেই ঘুমিয়ে পড়ার মাঝে ।
.
সুখ সুখ বলে- ডেকে আনলে আমায়
এ কোন্ সর্বনাশা পথে ?
কোন্ সুখের কথা বলো তোমরা ? ও কি পারবে দিতে-
একটি মুহূর্ত,
শুভ্র কাশবনে- লুকিয়ে থাকার আনন্দ?

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪

গুলি

-স্যার, দশটারে গাড়িতে উঠাইছি ।
-ঠিক আছে, থানায় নিয়া যাও । বিস্ফোরক আইনে একটা মামলা রেডি করো । আর কেউ যোগাযোগ করতে আসলে কী করতে হবে বুঝাইয়া বইলো । আমার যেন  কিছু বলতে না হয় ।
-দুইজনের গুলি লাগছে স্যার, একজনের পেটে আরেকজনের পায়ে । এদের কী করুম স্যার ?
-আচ্ছা আগে থানায় লও । তারপর দেখা যাইবো ।
-স্যার এদের বয়স কম, অবস্থাও ভালো না ।
-আচ্ছা ঠিকাছে, ঐ দুইটারে হাসপাতালে পাঠাও ।
-জ্বি স্যার ।


***
জরি, আরেক কাপ চা দে ।

সকাল আটটা বাজতে বাজতে তিন কাপ চা খেয়ে ফেলেছেন আরিফ সাহেব ।  ইদানিং চা খাওয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে । অবশ্য স্ট্রেস কিছুটা বেশি যাচ্ছে এখন । কিন্ত তাই বলে এত চা খাওয়া ঠিক না । ঘন ঘন প্রস্রাব হয় আজকাল, ডায়াবেটিস হয়ে গেল কিনা কে জানে ! চা খাওয়ার কারণেও হতে পারে, কিন্তু তারপরেও একবার সুগারটা চেক করে নেয়া দরকার । বাবা মা দুজনেরই ডায়াবেটিস ছিল, সেজন্যে ভয়টা বেশি ।

আরিফ সাহেব কোতোয়ালী থানার ওসি । পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন একরকম  ক্ষোভের বশে । যুবক বয়সে একবার বিনা কারণে পুলিশের হাতে পড়েছিলেন । বাবা  গিয়ে ছাড়িয়ে আনার আগেই বেশ কিছু লাঠির আঘাত সইতে হয়েছিল তাকে । তারপর মাথায় জেদ চেপে গেল । আরো বিভিন্ন জায়গায় দেখেছেন, ডান্ডার ক্ষমতা ভালোই । বাঙালি ডাণ্ডাকেই একমাত্র ভয় করে । সিভিল পোষাকে একজন  ম্যাজিস্ট্রেট আর হাতে লাঠি নিয়ে একজন কন্সটেবল যদি পাশাপাশি হেঁটে যায়,  মানুষ কন্সটেবলকেই সালাম দিবে । ডান্ডা মানেই পাওয়ার । নানা কিছু ভেবে  শেষমেশ পুলিশেই জয়েন করেন তিনি ।

পুলিশে জয়েন করেই বুঝতে পারেন, জায়গাটা অত সোজা না । সবাইকে ডিল  করতে হয় । চোর বাটপার ছিনতাইকারী ডাকাত নেশাখোর চোরাচালান এইসব  নিয়ে কারবার । সারাক্ষণ এইসব নিয়ে থাকতে ভালো লাগে না । নিজের  মেজাজটাও কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে আজকাল । বুঝতে পারেন, কিন্তু বেশিক্ষণ  ঠিক রাখতে পারেন না । থানার সবার সাথে সবসময় অর্ডার দিয়ে কথা বলতে হয়, আর উপরের অর্ডার স্যার স্যার করে শুনতে হয় । অর্ডার শোনা আর অর্ডার পালন  করা- এই হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন ।

কেউ অনুরোধ করে, কেউ টাকা সাধে, কেউ উপরের লেভেল থেকে ফোন করায় । প্রথম প্রথম একটা ইচ্ছা ছিল মনে- সমাজ থেকে অন্যায় দূর করবেন । দূর্নীতি  করবেন না । আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু এখন আর বলতে গেলে এর কোনটাই অবশিষ্ট নেই । ছিঁচকে অপরাধী ধরা যায়, বড়দের ধরা যায় না । দুএকজনকে ধরে খুশি হয়েছিলেন, ভেবেছিলেন সবাই প্রশংসা করবে  । প্রশংসা করেছিলও বটে । কিন্তু মাস না পেরোতেই হাতে এসেছিল বদলির অর্ডার । কখনো কখনো এমপি মন্ত্রীদের গালি শুনতে হয়েছে । থানা থেকেই ছেড়ে দিতে হয়েছে বড় বড় সন্ত্রাসীকে ।

প্রথম প্রথম টাকা নিতে পারতেন না । কিন্তু দিনে দিনে সব সয়ে এলো । একা টাকা না নিলে কী হবে, উপরে নিচে ঠিকই লেনদেন চলছে । ঐসব বন্ধ করার সামর্থ তার  নেই । দেখা গেল- তার নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা নিচ্ছে এসআই-রা । তার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছে এসআই দের পরিবার । ব্যাংকে বউয়ের নামে বিরাট অংকের টাকা, ছেলেমেয়েদের নামিদামি স্কুল কলেজে লেখাপড়া । একসময় তিনিও ঢুকে গেলেন সিস্টেমে । কাউকে কিছু বলতে হয় না । কীভাবে কীভাবে যেন এখানে একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে । দিনশেষে তার ড্রয়ারে কয়েকটা হলুদ খাম জমা হয়ে থাকে । বাসায় যাওয়ার সময় উনি শুধু সেগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নেন । ব্যাস ।

আগে চোর ডাকাত ধরার একটা আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল, ইদানিং সেটাও আর নেই তেমন । সরকারের নির্দেশ হলো- সরকার বিরোধী কোন কার্যক্রম সেটা রাজনৈতিক হোক কি অরাজনৈতিক- হতে দেয়া যাবে না । ফলে সবসময়ই থাকতে হয় সেই কাজে । আর আরিফ সাহেবের থানাটা হলো শহরের মূল থানা । যতসব পলিটিকাল মিটিং মিছিল সমাবেশ ভাংচুর হাঙ্গামা এই থানার এরিয়াতেই হয় । সব সময় খোঁজ রাখতে হয় কোথায় কখন মিটিং হচ্ছে, কোথায় মিছিল হচ্ছে এইসব । বিরোধী দলও এখন বেশ চালাক হয়ে গেছে । এরা অসময়ে মিছিল মিটিং করে । দুপুরে খাওয়ার পর একটু রেস্ট নেয়ারও সুযোগ পাওয়া যায় না । হঠাৎ খবর আসে- অমুক জায়গায় মিছিল শুরু করেছে ! সরকারী দলের লোকেরাই খবর দেয় । সকালে মিছিল করে, রাতে মিছিল করে । যখন তখন ফোর্স নিয়ে যেতে হয় । বেশিরভাগ সময়ই আসল মিছিলকারী কাউকে পাওয়া যায়না । পথচারী হোক আর যাই হোক ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় । আর অসময়ে কষ্ট দেয়ার রাগ ঝাড়া হয় তাঁদের ওপর । এটা অবশ্য খারাপ না । বেশ কাঁচা টাকা পয়সা আসে ।
বিশেষ করে পাজামা পাঞ্জাবী পরা থাকলে বা মুখে দাড়ি থাকলে সুবিধা হয় ।

চা খেতে খেতে টিভিতে খবর দেখছিলেন আরিফ সাহেব ।  একটু পরেই বের হতে হবে । আজকের দিনটাও মনে হয় হাঙ্গামায় যাবে । সরকারের এক মন্ত্রী মুখ ফসকে বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে । ইসলাম ধর্মের নামে উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন । নবীর নামে উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন । তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের ডাক দিয়েছে ধর্মীয় দলগুলি ।

বিরক্তি লাগছে আরিফ সাহেবের । তিনি নিজেও সরকারের সমর্থক । কিন্তু মন্ত্রী এমপিরা মাঝে মাঝে এমন এমন কথা বলে, মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । ক্ষমতায় আছে পুলিশের ঘাড়ে পা দিয়ে, আবার বড় বড় কথা বলে । তাও আবার ধর্ম নিয়া । কোন মানে হয় ? এখন সামলাও ঠেলা । এইদেশের মানুষ এমনিতেই ধর্মকর্ম নিয়ে চিন্তিত না । কিন্তু আল্লাহ–রসুল–কোরআন–হাদীস নিয়া উল্টাপাল্টা কথা বললে মাথা গরম হয়ে যায় । আরিফ সাহেব নিজেও তেমন একটা নামাজ রোযা করেন না, কিন্তু ধর্ম নিয়া উল্টাপাল্টা কিছু বললে তারও আসলে ভালো লাগে না ।

থানা থেকে গাড়ি চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই । ছেলেমেয়ে দুটাকে ওদের কলেজে-স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যেতে হবে । উপর থেকে অর্ডার এসেছে কোনরকম মিছিল মিটিং হতে দেয়া যাবেনা । প্রয়োজনে গুলি করতে হবে ।

আরিফ সাহেবের এক ছেলে এক মেয়ে । আরমান ও আনিতা । আরমান কলেজে উঠেছে , ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে । যথেষ্ট ভদ্র হয়েছে । মাঝে মাঝে নামাজও পড়তে যায় মসজিদে । ওর মায়ের কিছুটা পেয়েছে বোধহয় । লেখাপড়ায়ও ভালো ।  এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে ।
মেয়েটা ছোট । ক্লাস ফাইভে উঠেছে এবার ।

‘বাবা আটটা বাজে । নয়টায় ক্লাস আছে আমার’ । তাগাদা দিয়ে গেল আরমান ।

সত্যিই আর দেরি করা যায় না । ডাইনিং এ খেতে বসলেন আরিফ সাহেব । ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খবর নিলেন । এই সময়টায় সবার সাথে একসাথে দেখা হয় । রাতে কখন আসতে পারেন তার কোন ঠিক নেই ।

গাড়ি চলে এসেছে । পোষাক পরে নিলেন আরিফ সাহেব । আরমান ও আনিতাকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবেন ।


***
-‘স্যার, স্যার । জ্বী স্যার । স্যার । কোন সমস্যা হবেনা স্যার’ ।

কমিশনার সাহেবের ফোন । আরিফ সাহেব শুধু শুনে গেলেন । এটাই নিয়ম । স্পষ্ট নির্দেশ, কোনরকম মিটিং শোভাযাত্রা হতে দেয়া যাবে না ।

ফোর্স রেডি করে বেরিয়ে পড়লেন আরিফ সাহেব । খবর এসেছে, পূর্বঘোষিত স্থানে জড়ো হতে শুরু করেছে মানুষ । কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিল শুরু করবে ।

ফোর্স সহ গিয়ে প্রথমে মাইকে ঘোষণা দিলেন জনতাকে ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যাবার জন্য । কিন্তু দেরি না করে তখনই মিছিল শুরু করে দিলো তারা ।
শুরু হলো লাঠিচার্জ । টিয়ার শেল ছুড়তে হলো । কিন্তু কোনভাবেই নিবৃত করা যাচ্ছেনা জনতাকে । বরং ওরাও ইট পাটকেল মারা শুরু করলো ।

এরপরই গুলি করার নির্দেশ দিলেন আরিফ সাহেব ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল মানুষ । যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেলো ।

গ্রেপ্তারকৃতদের থানায় পাঠিয়ে নিজেও অফিসে চলে এলেন আরিফ সাহেব । এসেই শুনলেন আহত দুজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে । বাকিদেরকে হাজতে রাখা হয়েছে ।

অফিসে বসে টিভিটা অন করলেন তিনি । কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিকরা চলে আসবে মতামত নেয়ার জন্য । তার আগে একবার দেখা দরকার স্ক্রলিং এ ওরা কী দিয়েছে ।

রিমোট হাতে একের পর এক চ্যানেল চেঞ্জ করতে লাগলেন আরিফ সাহেব । অনেকগুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল এখন । চ্যানেলগুলোতে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের সংঘাতের খবর দেখাচ্ছে । একটা চ্যানেলের পর্দায় চোখ পড়তেই সারা শরীরে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল আরিফ সাহেবের। লাইভ দেখাচ্ছে, তাঁর এরিয়ায় তাঁর অধীনস্ত ফোর্সের গুলিতে আহত হওয়া দুইজনের একজন তাঁরই ছেলে আরমান । ভুলেই গিয়েছিলেন, ঐ পথ দিয়েই তো কলেজ থেকে ফেরার কথা আরমানের । স্পষ্ট দেখলেন তিনি, স্ট্রেচারের ওপর আরমানের নিথর দেহটা পড়ে আছে হাসপাতাল এমার্জেন্সির ভেতর । এমনও কি হতে পারে, আরমানও প্রতিবাদ মিছিলে গিয়েছিল ?

মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো আরিফ সাহেবের । ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে গেলেন তিনি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ।

বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৪

অলীক অস্তিত্ব !

ধরো একদিন জানতে পারলে তোমরা
সত্যিকার পৃথিবীতে, আমি আর নেই । কিংবা 
ছিলাম না কখনোই ! 
আমার অস্তিত্ব বলে ভেবেছিলে যাকে 
হয়তো দিয়েছিলে তারে কিছুটা ভালোবাসাও
হয়তো দিতে চেয়েছিলে আরও কিছুটা বেশি 
তারপর, 
তারপর- 
ধরো একদিন জানলে তোমরা হঠাৎ, আসলে সবকিছু 
ছিল মরিচীকা;
মনের ভুল, 
হ্যালুসিনেশান, 
অলীক কল্পনা ! 
.
তখনো কি, 
মনে রাখবে কেউ এই অধমেরে? কেউ কি ফেলবে বলো 
একফোঁটা আঁখিজল? 
লিখবে কি কেউ একটা কবিতা আমায় ভেবে? 
নাকি সকলেই ধিক্কার দেবে নিজেকে এই ভেবে- 
অলীক কল্পনায় নষ্ট হয়ে গেল- 
কতটা সময় !