-‘আপনি? আপনি কে?’
-‘আমি নেছার । নেছার উদ্দিন ভুইয়া । বারো ভুঁইয়ার ত্রয়োদশ উত্তরপুরুষ’ ।
-‘ও তাই ? তা আপনি এরকম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন কেন ? ছ’মিলে ঢুকিয়ে কেউ এমন করেছে বুঝি ? আহারে !’
হাসতে শুরু করে মুনির এবং নেছার । নেছার মুনিরের দুই বছরের সিনিয়র । কিন্তু তবু ওদের সম্পর্কটা সিনিয়র জুনিয়রের গন্ডিতে আটকে নেই । যদিও সিনিয়র জুনিয়রের মধ্যেকার স্বাভাবিক স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধেরও ঘাটতি নেই দুজনের মধ্যে । ওদের সম্পর্কটাকে ভাই ভাই সম্পর্ক বললেও পুরোটা স্পষ্ট হয়না । এটাকে বরং ভাই ভাই ও সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্কের একটা মিশেল অথবা তার চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় ।
সিনিয়র হিসেবে নেছারকে মুনির আপনি করে বলবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন নেছারও মুনিরকে আপনি করে সম্বোধন করাটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে । চেহারায় দুইজন বলা চলে দুই প্রান্তের । মুনিরকে ঠিক শুকনা বলা চলেনা, তবে স্বাস্থ্যবানও বলা যায় না । মোটামুটি গোলগাল চেহারা । ওদিকে নেছার মেডিকেল কলেজের পুরো ক্যাম্পাসে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে অদ্বিতীয় না হলেও ওজনে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে দুবছর আগেই । এজন্য অবশ্য বেশ কসরতও করতে হয়েছে তাঁকে । তখন ওর ওজন ছিল পচানব্বই । সেঞ্চুরির এত কাছে এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় ? নেছার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে একশ কেজির মাইলফলক ছোঁবার । সেজন্য তাকে প্রায়ই দেখা যেতে লাগলো মেরিডিয়ানের বুফে ডিনারে । তারপর বছর ঘুরতেই ওজন গিয়ে দাঁড়ালো একশ পাঁচে । নেছারের চোখে তখন অন্যরকম তৃপ্তির আভা ফুটে উঠল । এই বিশেষ সংবাদ সবাইকে জানানোর জন্য একদিন একটা ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করে ফেললো নেছার ।
মুনিরের খুব ভালো লাগে নেছারকে । এই ভালো লাগাটাকে মুনির তুলনা করে সমূদ্রভ্রমনের সাথে ।
সমূদ্রের তীরে দাঁড়ালে আমাদের কেন ভালো লাগে ? কেন দুঃখ কষ্টগুলোকে তুচ্ছ মনে হয় ? কেন সঞ্জীব গেয়ে ওঠেন- ‘ও পোড়া চোখ সমূদ্রে যাও !’
কারণ, সমুদ্র বিশাল ।
নেছারের শরীরটাই যে শুধু বিশাল তা নয়, মনটাও বিশাল ।
সেজন্যই, ভালো লাগে । বড় মনের মানুষের সাথে কথা বলতেই ভালো লাগে, নিজেকেও বড় বড় মনে হয় ।
এবার অনেকদিন পর দেখা হলো দুজনের । নেছারের ওজন কমে গেছে । দেখতে অনেক শুকনো লাগছে । কী ব্যাপার ? কোন সমস্যা নয়তো ?
ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুললো মুনিরকে । কোন অসুখের কথাতো কানে আসেনি । কোন ব্যাপারে কি খুব দুশ্চিন্তা করছেন নেছার ভাই ? খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করছেন ? খাওয়ার ব্যাপারে তো সহজে আপোষ করার কথা না নেছার ভাই !
নেছার ভাই নিজেকে ভোজন বিলাসী নয়, ভোজন রসিক বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন । বেশি খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর হাতে আছে মোক্ষম যুক্তি। ‘আমার বডি সারফেস এরিয়া বেশি, মেটাবলিজম বেশি, আমার ক্যালোরি রিকোয়ারমেন্টও বেশি’ । ‘সুতরাং আমাকে বেশি করে খেতে হবে ! আর খাবই যখন, মজাদার এবং ভালো খাবারই খাবো !’
এটা কোনভাবেই বিলাসিতা নয় নেছার ভাইয়ের কাছে, এটা হলো ‘ভোজনরসিকতা’ !
অবশ্য নেছার ভাইয়ের দুশ্চিন্তা করার কারণ আছে । নেছার ভাই পরিবারের একমাত্র ছেলে । কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই মারা যান নেছার ভাইয়ের বাবা । এখন পুরো পরিবারের দায় দায়িত্ব বলতে গেলে নেছার ভাইয়ের কাঁধে । বাবা মারা যাওয়ার ব্যাপারটা মুনিরের কাছে মনে হয়, চরম ঝড় জলোচ্ছাসে একটা ছাতা অথবা আশ্রয়কেন্দ্র উড়ে যাওয়ার মত । এরপর থেকে যত ঝড়ো বাতাস, শিলাবৃষ্টি, খড়কুটো বিদ্যুৎ চমক সবকিছু সরাসরি গায়ে এসে লাগে । শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না । যদিও নেছার ভাই শুধু শারিরীকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও অনেক শক্ত একটা ছেলে, কিন্তু তবুও হঠাৎ করে এতটা চাপ হয়তো তাকেও কষ্টে ফেলে দিয়েছে ।
নেছারের সাথে একান্তে আলাপ করার প্রয়োজন বোধ করে মুনির ।
-‘ভাই, এতদিন পরে এলাম । চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে কীভাবে আপ্যায়ন করা হবে জানতে পারি কি?’ কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করে মুনির ।
-‘আপনি যা বলবেন তাই হবে’ । তাৎক্ষণিক জবাব দেয় নেছার ।
-‘হুম । তাহলে আজকের ডিনারটা আনলিমিটেড হয়ে যাক ! চলেন, কারো লস করে দিয়ে আসি !’
আটটার দিকে জিইসি মোড়ের দিকে চলে যায় মুনির ও নেছার । বাফে ডিনার খাওয়ার ব্যাপারে ওদের স্পেশাল সিস্টেম আছে । সাধারণত সবাই গিয়ে প্রথমে সুপ, ভেজিটেবল খায় । নেছার ও মুনির ওসবের ধারেকাছে ভিড়বে না । নো সুপ, নো রাইস । ডাইরেক্ট এটাক অন চিকেন ফ্রাই, রোস্ট, বিফ, মাটন, প্রন, আইসক্রিম এন্ড ফ্রুটস । এছাড়া অন্য কোন ভালো আইটেম থাকলে চেখে দেখা যেতে পারে ।
হিসেব করলে আল্টিমেটলি অন্তত এই দুজনের ক্ষেত্রে রেস্টুরেন্টের লসই হয়ে যায় ।
খেতে খেতে মুনির প্রশ্ন করে-
-‘নেছার ভাই, এখন কত ?’
-‘নাইন্টি এইট’ ।
-‘এনিথিং রং ?’
-‘নো’ ।
-‘কী করছেন ? খাওয়া কমিয়েছেন নাকি ব্যায়াম করছেন ?’
-‘আরে খাওয়া কমাবো কেন? এই যে এখন খাচ্ছি না ! খাওয়া কমালে কি আর এই পথে পা মাড়াই ?’
-‘তাহলে ?’
-‘প্রতিদিন সকালে প্যারেড মাঠে দৌড়াচ্ছি’ ।
কিছুটা উদাস হয়ে যায় মুনির । একসময় প্যারেড মাঠে মুনিরও দৌড়াতো । নেছার ভাইয়ের সাথে অনেকবার ম্যারাথনে অংশ নিয়েছে । হাউ মাচ স্ট্যামিনা ইউ হ্যাভ । প্যারেড মাঠের কিনার ধরে একটানা দৌড়ে কতবার মাঠ প্রদক্ষিণ করা যায় এই নিয়ে প্রতিযোগিতা হত দুজনের । মুনির হাল্কা পাতলা, দুইবার তো সে অনায়াসেই পারে । কিন্তু নেছার এতটা ওজনদার মানুষ হয়েও কম যায়না । প্যারেড কর্নার দুইবার চক্কর দেয়া মানে প্রায় চার কিলোমিটার । নেছারও দুইবার চক্কর দেয় মুনিরের সাথে । নেছারের স্ট্যামিনা সম্পর্কে আগে ঠাট্টা করলেও এর পরে আর সেটা করার সুযোগ থাকে না মুনিরের ।
-‘নেছার ভাই, মোক্ষম প্রশ্নটা কী জানেন?’
অনেক ক্ষণ পরে নাটকীয় ভাবে আবার কথা শুরু করে মুনির । নাটকীয়তা জিনিসটা ওর ভেতর ভালোমতই আছে । নাটকীয়ভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু করতে সে ওস্তাদ । নেছারের সাথে এত ভালো সম্পর্কের এটাও হয়তো একটা কারন । দুজনে একসাথে হলে দেশ বিদেশ আকাশ পাতাল সাহিত্য রাজনীতি ধর্ম ইতিহাস ভূগোল কোনটাই বাদ পড়েনা আলোচনা থেকে । নানারকম থিওরি নিয়ে ওদের আলোচনা চলতেই থাকে । বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা, মিশর চীন এন্টার্কটিকা । দোয়েল কোকিল থেকে এমু পেঙ্গুইন । জীবনানন্দ থেকে গুন্টার গ্রাস । এরশাদ থেকে গাদ্দাফি । কোনকিছুই বাদ পড়েনা সে আলোচনায় । জাকির নায়েকের উত্থানের কারণ ও ফলাফল কী, ঈমাম মাহাদী কখন কীভাবে আসবেন, বিশ্বের পরিবর্তন কীভাবে হচ্ছে এসব বিষয়ে নেছারের ইউনিক থিওরি আছে । কতরাত যে ওরা শুধু এইসব আলোচনা করে পার করেছে তার ইয়ত্তা নাই । আজও হয়তো আলোচনা সেদিকেই এগোবে ।
-‘কোন্ প্রশ্নটা যে মোক্ষম সেটা আমি কীভাবে বুঝবো ?’ চোখ নাচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নেছার ।
-‘প্রশ্নটা হচ্ছে, এইযে প্যারেড মাঠ চক্কর দিচ্ছেন, তা হঠাৎ ওজন স্তরে ফাটল ধরানোর কারণ কী ?’
মুচকি হেসে নেয় নেছার ।
-‘আমি জানতাম এই প্রশ্নটা আজকে আমাকে বিদ্ধ করবেই । সেজন্য মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি !’
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে নেছার । সুন্দর করে একটা নাম লেখা তাতে । নামটা পড়ে কিছু একটা আন্দাজ করে মুনির । তবুও অবুঝের মত প্রশ্ন করে সে । যদি আন্দাজ সঠিক হয়, তাহলে সে বিষয়ে নাদানের মত প্রশ্ন করাই যায় !
-‘এটা কী? কার নাম? আপনার বোনের?’
-‘আরে নাহ ! আমার বোনেরা যাকে পছন্দ করেছে তাঁর !’
লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ে নেছারের চোখে মুখে । মুনির তবুও না বোঝার ভান করে । এইসব ব্যাপারে সহজে ছেড়ে দিতে নেই !
-‘কেন কেন? আপনার বোনেরা পছন্দ করেছে কেন? কে ইনি? আর কার জন্যেই বা পছন্দ করলো?’
নেছার এবার পকেট থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে । বলে, ‘ইনিই সেই ব্যক্তি !’
এক পলক দেখে ছবিটা ফিরিয়ে দেয় মুনির । এক বিংশাদশীর ছবি ! দ্বাবিংশও হতে পারে !
নেছার লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে- ‘গত মাসে দেখাদেখি হয়েছে । সবকিছু ওকে হয়ে আছে । তবে...’
-‘তবে কী?’
-‘উনি বলেছেন, ওজন কমিয়ে নব্বইয়ের নিচে নামাতে হবে । সময় তিন মাস !’
-‘এই তাহলে ওজোন স্তরে ফাটল ধরার রহস্য?’ ...
হাসতে শুরু করে মুনির এবং নেছার দুজনেই ।
‘বিফ শেষ হয়ে গেছে’ বলে উঠে খাবার আনতে যায় নেছার । এটা যে লজ্জা ঢাকার উছিলা সেটা না বোঝার কোন কারণই আর অবশিষ্ট থাকেনা মুনিরের কাছে । ঐতো, কিঞ্চিৎ আরক্ত মুখটা পেছন থেকেও বেশ দেখা যাচ্ছে !