বিয়ে করতে আসলে কত টাকা লাগে? বিবাহ কথন সিরিজের এই পর্যায়ে এটাই এখন আমাদের সামনে গুরুতর প্রশ্ন।
তবে এই প্রশ্নে নিজের মন্তব্য দেয়ার আগে আমি দুটি কেস হিস্ট্রি তুলে ধরবো। একতরফা না। একজন ছেলের, আর একজন মেয়ের।
কেস হিস্ট্রি-১:
আমাদের দেশে ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করতে চাওয়াটাকে এক ধরণের অপরাধ হিসেবেই ধরা হয়। আমার বাসায়ও ভয় পেয়ে গেল। আমাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বললো, "কোনমতে জাস্ট পাসটা কর, তারপরই বিয়ে দিয়ে দিব; চাকুরিও পাবার দরকার নাই। এখন বিয়ে করলে মানুষ কি বলবে? মান-সম্মান থাকবে?"
আমিও বুঝলাম। পাস করে বের হবার পর বেকার ছিলাম প্রায় ৯ মাস। তখন তো বিয়ের কথা মুখে আনা প্রায় অসম্ভবই। এরপর মোটামাটি আয়-রোজগারের একটা ব্যবস্থা হলো (মাসে ১৮ হাজার টাকার মত)। এর কিছুদিন পর বাসায় আবার বললাম বিয়ে করার কথা। আব্বা বললেন - এই টাকায় ফ্যামিলি চালাতে পারবি? ঢাকা শহরে তো বাড়িভাড়াই হবেনা এই টাকায়। আমি কিন্তু ১ টাকাও দিতে পারব না। You have to be at your own! ভেবে দেখ।
সাত-পাঁচ ভেবে পিছিয়ে আসলাম। ঠিকই তো! এই টাকায় চলব কিভাবে? এভাবে আরও কিছুদিন গেল। আবার বললাম। আবার একই উত্তর। আবার পিছালাম। এভাবেই চললো কিছুদিন।
শেষমেষ ঠিক করলাম। দরকার হলে রিস্কই নিব। আমার পরিচিত অনেকে তো মাসে ৮ হাজার টাকা স্যালারি পেয়েও ২-৩ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুন্দর সংসার চালাচ্ছে, তাঁরা পারলে আমি পারবোনা কেন? লাইফ-স্ট্যান্ডার্ড নিচে নামিয়ে আনতে হবে? আনবো। দরকার হলে বস্তিতে থাকবো।
এরপর বিয়েটা করেই ফেললাম (জুন, ২০১৩)। আমার ২ ফ্রেন্ডের কাছে ২০ হাজার ও ৩০ হাজার করে মোট ৫০ হাজার টাকা ধার করলাম। হবু বউকে আগেই জানিয়ে দিলাম আমি গরিব মানুষ। পুঁজি বলতে আমার এই ৫০ হাজার টাকাই। এর বেশি মোহরানা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না, আর পুরোটাই নগদ দিতে চাই। সে রাজি হলো।
কিভাবে জানি আরও ১০ হাজার টাকা ম্যানেজ হলো। বিয়ের দিন কি কি সব খরচে দেখি ২ হাজার টাকা শর্ট! দৌড়ায়ে গেলাম ছোট ভাইয়ের কাছে। বিভিন্ন সময়ে সে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া ১০০, ২০০ টাকা মিলিয়ে যে ২-৩ হাজার টাকা জমিয়েছিল তা থেকে ২ হাজার টাকা ধার দিল। বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের আগেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে রেখেছিলাম। ভাড়া ৭ হাজার টাকা প্রতি মাসে। বিয়ের ৩-৪ দিন পরই ঢাকায় চলে আসলাম নতুন বাসায়। ফার্নিচার বলতে মেসে থাকার জন্য কেনা ১ হাজার টাকা দামের একটা চৌকি আর ৫০০ টাকা দামের একটা টেবিল আর মেসে মিশুকের ফেলে রেখে যাওয়া একটা প্লাস্টিকের চেয়ার।
সংসার চালানোর জন্য যত খরচ হবে ভেবেছিলাম, দেখলাম বাস্তবে খরচ তার তুলনায় কমই। খরচ বেড়েছে বলতে বাসা ভাড়া ৪ হাজার টাকা (আগে ৩ হাজার লাগত আর তখন ৭ হাজার), খাওয়ার খরচ প্রায় অপরিবর্তিতই আছে (যেহেতু রান্না-বান্না কাজের লোক না রেখে নিজেরাই করি)। তবে আগে যেমন হাতখুলে খরচ করতাম, তখন সেটা মোটামুটি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হলো। পার্থক্য এটুকুই। সেই খরচেই সুন্দর চলে যেতে লাগলো।
কয়েকমাস পর বউ বললো একটা ফ্রিজ কেনা দরকার। টাকা জমাতে হবে। কয়েকমাস টাকা জমিয়ে ২০ হাজার টাকার মত হলো। ফ্রিজের দোকানে গেলাম। বউ পছন্দ করলো প্রায় ৩০ হাজার টাকা দামের একটা ফ্রিজ। আমি আনইজি ফিল করা শুরু করলাম। আমার কাছে তো এত টাকা নাই। সব মিলিয়ে বাইশ হাজার টাকা হতে পারে। বউ দেখি হাসে। এই কয়দিনে বউও প্রায় ৮ হাজার টাকার মতো জমিয়ে ফেলেছে সংসারের খরচ সেভ করে।
এখনো মাঝে মাঝে অবাক লাগে। আগে টাকার ভয়ে বিয়ে করতে পারিনি আমি। বিয়ের আগে প্রায় এক-দেড় বছর যে আয় ছিল, বিয়ের প্রায় বছরখানেক পর পর্যন্তও আয় ছিল একই। বিয়ের আগের প্রায় এক বছরে সেভিংস ছিল শূন্য টাকা। বিয়ের পরের এক বছরেও সেভিংস শূন্য, কিন্তু ২ জনের একটা সংসার চালিয়েও ফ্রিজসহ আরও অনেক কিছু কেনা হয়ে গেছে!
বিয়ে করলে আসলেই আয়ে বরকত আসে। রিজিকের মালিক আল্লাহ- এটা নতুন করে অনুভব করেছিলাম তখন। যারা টাকার ভয়ে বিয়ে করতে পারছেন না, সাহস করে বিয়েটা করেই ফেলুন। ইনশাল্লাহ, আয়ে বরকত আসবে। রিজিকের মালিক তো আল্লাহই।
ফুটনোটঃ বিয়ের জন্য যে দুই ফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম, ধার শোধ করে তাঁদের বিয়ের সময়ও সেই একই পরিমান টাকা ধার দিতে পারার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মাঝে মাঝে এই ৫০ হাজার টাকাকে খুব বরকতময় মনে হয়! কি সুন্দর এই হাত থেকে ঐ হাতে যাবার অছিলায় ৩ জনের বিয়ে সুন্দরভাবে হয়ে গেল! (রনি পারভেজ)
(বিবাহ কথন-১৭)
****
বিয়ে করতে কত টাকা লাগে? এই প্রশ্নে আমি একটা অদ্ভুত উত্তর দেবো, তবে তা আগামী পর্বে। নিজের মন্তব্য দেয়ার আগে যে দুটো কেস হিস্ট্রি উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম, আজ থাকছে তার দ্বিতীয়টি।
কেস হিস্ট্রি-২:
আমার বিয়ের শাড়িটির দাম চার হাজার আট'শ টাকা। যেখানে আমারই বোন কিংবা কাজিনদের বিয়ের শাড়ির দাম পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত। আর্থিক সংকটের কারণে যে আমি কম দাম দিয়ে বিয়ের শাড়ি কিনেছি, এমন নয়। আসলে আমার মনে হয়েছে, কী দরকার, একদিনের জন্য এত বেশি টাকা নষ্ট করে! হাতে টাকা পেলে আমি পোশাক কেনার চেয়ে বই কেনায় বেশি মনোযোগ দেই। সে যাক, যার যার রুচির ব্যাপার। তবে এটা বলতে পারি, এক লক্ষ টাকার শাড়ি গায়ে জড়ানো বোনটির চেয়ে আমি মোটেও খারাপ নেই। ভালো থাকা যার যার মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি মনে করেন, আপনি ভালো আছেন, তাহলেই আপনি ভালো থাকবেন।
আমার যখন বিয়ে হয়, আমরা দুজনই স্টুডেন্ট। আমার একুশ, আতিকের তেইশ। আতিক কম বেতনের একটা চাকরি করে, আমার তেমন কোনো আয়-ইনকাম নেই। তবু আমার পরিবার বিয়েতে অমত করেনি। বিয়ের পরে আমরা একরূম সাবলেট নিয়ে উঠেছি। সস্তার আসবাবপত্রের দোকান থেকে কেনা দুই হাজার টাকার একটি খাট, একটি আলনা আর কম্পিউটার ছাড়া আর কিছুই ছিল না আমাদের ঘরে। দীর্ঘদিন আমরা দুইজন কোনো দামী ফোন ব্যবহার করিনি। মনে আছে, দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর আমি কোনো নতুন জামা, জুতো, ব্যাগ কিনিনি। আগের যা ছিল, তাই দিয়েই চালিয়ে নিয়েছি।
এক কেজি গরুর মাংস চার ভাগ করে রান্না করেছি। দিনের পর দিন শুধু সবজি দিয়েই ভাত খেয়েছি। এত যে কষ্ট করেছি, তবু একজনের বিরুদ্ধে আরেকজন কখনো অভিযোগ করিনি। আমাদের পরিবারকেও কখনো বলতে যাইনি, যে আমরা কষ্ট করছি। তারা জানতো, আমরা ভালো আছি। সত্যিই আমরা ভালো আছি। প্রয়োজন ছিল কিছুটা সময় ধৈর্য ধরার। আমরা তা করেছি, তাই দেখতে দেখতে দৃশ্য বদলে গেল, যে জীবন আমরা শুরু করেছিলাম, তার সঙ্গে বর্তমান জীবনের কোনো মিলই নেই! ভাগ্য বদলের জন্য তো প্রচেষ্টা থাকতে হবে, তাই না?
আরেকজনের সাজানো-গোছানো জীবনে প্রবেশ করার চেয়ে দুজন মিলে সাজিয়ে নিলে, সেই জীবনটা আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। (হাবিবা নাসরিন)
(বিবাহ কথন-১৮)
****
এর আগে দুটি কেস স্টাডি দিয়ে আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি- বিয়ে করতে খুব বেশি টাকার দরকার নেই। যদি নিয়ত ঠিক থাকে, যদি উভয়ের মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকে- তাহলে থাকার জন্য দালানের দরকার হয় না, মাটির ঘরই যথেষ্ট হয়। লাখ লাখ টাকা মোহরানা লাগে না, কোরআনের কয়েকটি সুরাও যথেষ্ট হয়। লাখ টাকার শাড়ি গহনা পাগড়ী শেরোয়ানি লাগে না, লুঙ্গি ফতুয়া আর সাধারণ একটা শাড়ি হলেই চলে। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে হাজার মানুষ খাওয়ানো ওয়ালিমা দরকার হয়না, এক প্যাকেট খেজুরের ওয়ালিমাই বরকতপূর্ণ হয়।
এইযে এত জাঁকজমকের আয়োজন, এত আনুষ্ঠানিকতা, এত দর-কষাকষি, এইসব কেন করা হয়? করা হয় শুধুমাত্র তথাকথিত এই সমাজের চোখে, সমাজের মানুষের চোখে বড় সাজার জন্য। মানুষের চোখে প্রশংসা পাওয়ার জন্য। মানুষ কী বলবে- এই তাড়না থেকেই শুরু হয় শো-অফ এর যতসব অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
কিন্তু বাস্তবে বিয়ের উদ্দেশ্য যে একটা সুন্দর পরিবার গঠন, সেইখানে এতসব খানাদানা জাঁকজমকের একপয়সার মূল্য নেই। দিনশেষে এই তথাকথিত সমাজ আর সমাজের মানুষেরা শুধু নিন্দাই করে, শুধুই পরশ্রীকাতর হয়, শুধু হিংসাই করে, শুধু সমস্যাই বাড়ায়।
সবকিছু মোকাবেলা করতে হয় শুধু দুজনকেই, পরিবারটাকে টেনে নিতে হয় মাত্র দুজনকেই।
বিয়ে করতে কত টাকা দরকার? আমার উত্তর হলোঃ বিয়ে করতে তত টাকাই দরকার, যতটাকা হলে একটা লুঙ্গি কেনা যায়!! অদ্ভুত শোনাচ্ছে? হাদীস থেকে বাস্তব প্রমাণ দিচ্ছিঃ
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার জীবনকে আপনার হাতে সমর্পণ করতে এসেছি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাঁকালেন এবং সতর্ক দৃষ্টিতে তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করলেন। তারপর তিনি মাথা নিচু করলেন। যখন মহিলাটি দেখল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে কোন ফয়সালা দিচ্ছেন না, তখন সে বসে পড়ল। এরপর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের মধ্যে একজন দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনার বিয়ের প্রয়োজন না থাকে, তবে আমার সঙ্গে এর বিয়ে দিয়ে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? সে উত্তর করলো- না, আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে গিয়ে দেখ, কিছু পাও কিনা। এরপর লোকটি চলে গেল। ফিরে এসে বলল, আল্লাহর কসম! আমি কিছুই পাইনি। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবার দেখ, লোহার একটি আংটিও যদি পাও। তারপর লোকটি আবার ফিরে গেল। এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাও পেলাম না, কিন্তু এই আমার লুঙ্গি (শুধু এটাই আছে)। লোকটি এর অর্ধেক তাকে দিতে চাইল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে তোমার লুঙ্গি দিয়ে কী করবে? তুমি যদি পরিধান কর, তাহলে তার কোন কাজে আসবে না, আর সে যদি পরিধান করে, তবে তোমার কোন কাজে আসবে না। বেশ কিছুক্ষণ লোকটি নীরবে বসে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়াল। সে যেতে উদ্যত হলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে আনলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী পরিমাণ কুরআন মাজীদ মুখস্থ আছে? সে বলল, আমার অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে এবং সে গণনা করল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কি তোমার মুখস্থ আছে? সে বলল, হাঁ। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে পরিমাণ কুরআন তোমার মুখস্থ আছে তার বিনিময়ে এ মেয়েটিকে তোমার অধীনস্থ করে (বিয়ে) দিলাম।
(সহীহ বুখারী)
আপনার যা আছে বিয়ে করার জন্য তা-ই যথেষ্ট। শুধু আপনাকে হতে হবে আরো একটু বেশি কষ্টসহিষ্ণু, টেনে ধরতে হবে আপনার উচ্চাভিলাষের লাগাম, সাময়িকভাবে হয়তো কমিয়ে আনতে হবে জীবনযাত্রার মান। আর হ্যা, খুঁজে বের করতে হবে এমন একজনকে- যিনি আপনার এইটুকু নিয়েই সন্তুষ্টচিত্তে সংসার করতে রাজী আছেন।
(বিবাহ কথন-১৯)
তবে এই প্রশ্নে নিজের মন্তব্য দেয়ার আগে আমি দুটি কেস হিস্ট্রি তুলে ধরবো। একতরফা না। একজন ছেলের, আর একজন মেয়ের।
কেস হিস্ট্রি-১:
আমাদের দেশে ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করতে চাওয়াটাকে এক ধরণের অপরাধ হিসেবেই ধরা হয়। আমার বাসায়ও ভয় পেয়ে গেল। আমাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বললো, "কোনমতে জাস্ট পাসটা কর, তারপরই বিয়ে দিয়ে দিব; চাকুরিও পাবার দরকার নাই। এখন বিয়ে করলে মানুষ কি বলবে? মান-সম্মান থাকবে?"
আমিও বুঝলাম। পাস করে বের হবার পর বেকার ছিলাম প্রায় ৯ মাস। তখন তো বিয়ের কথা মুখে আনা প্রায় অসম্ভবই। এরপর মোটামাটি আয়-রোজগারের একটা ব্যবস্থা হলো (মাসে ১৮ হাজার টাকার মত)। এর কিছুদিন পর বাসায় আবার বললাম বিয়ে করার কথা। আব্বা বললেন - এই টাকায় ফ্যামিলি চালাতে পারবি? ঢাকা শহরে তো বাড়িভাড়াই হবেনা এই টাকায়। আমি কিন্তু ১ টাকাও দিতে পারব না। You have to be at your own! ভেবে দেখ।
সাত-পাঁচ ভেবে পিছিয়ে আসলাম। ঠিকই তো! এই টাকায় চলব কিভাবে? এভাবে আরও কিছুদিন গেল। আবার বললাম। আবার একই উত্তর। আবার পিছালাম। এভাবেই চললো কিছুদিন।
শেষমেষ ঠিক করলাম। দরকার হলে রিস্কই নিব। আমার পরিচিত অনেকে তো মাসে ৮ হাজার টাকা স্যালারি পেয়েও ২-৩ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুন্দর সংসার চালাচ্ছে, তাঁরা পারলে আমি পারবোনা কেন? লাইফ-স্ট্যান্ডার্ড নিচে নামিয়ে আনতে হবে? আনবো। দরকার হলে বস্তিতে থাকবো।
এরপর বিয়েটা করেই ফেললাম (জুন, ২০১৩)। আমার ২ ফ্রেন্ডের কাছে ২০ হাজার ও ৩০ হাজার করে মোট ৫০ হাজার টাকা ধার করলাম। হবু বউকে আগেই জানিয়ে দিলাম আমি গরিব মানুষ। পুঁজি বলতে আমার এই ৫০ হাজার টাকাই। এর বেশি মোহরানা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না, আর পুরোটাই নগদ দিতে চাই। সে রাজি হলো।
কিভাবে জানি আরও ১০ হাজার টাকা ম্যানেজ হলো। বিয়ের দিন কি কি সব খরচে দেখি ২ হাজার টাকা শর্ট! দৌড়ায়ে গেলাম ছোট ভাইয়ের কাছে। বিভিন্ন সময়ে সে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া ১০০, ২০০ টাকা মিলিয়ে যে ২-৩ হাজার টাকা জমিয়েছিল তা থেকে ২ হাজার টাকা ধার দিল। বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের আগেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে রেখেছিলাম। ভাড়া ৭ হাজার টাকা প্রতি মাসে। বিয়ের ৩-৪ দিন পরই ঢাকায় চলে আসলাম নতুন বাসায়। ফার্নিচার বলতে মেসে থাকার জন্য কেনা ১ হাজার টাকা দামের একটা চৌকি আর ৫০০ টাকা দামের একটা টেবিল আর মেসে মিশুকের ফেলে রেখে যাওয়া একটা প্লাস্টিকের চেয়ার।
সংসার চালানোর জন্য যত খরচ হবে ভেবেছিলাম, দেখলাম বাস্তবে খরচ তার তুলনায় কমই। খরচ বেড়েছে বলতে বাসা ভাড়া ৪ হাজার টাকা (আগে ৩ হাজার লাগত আর তখন ৭ হাজার), খাওয়ার খরচ প্রায় অপরিবর্তিতই আছে (যেহেতু রান্না-বান্না কাজের লোক না রেখে নিজেরাই করি)। তবে আগে যেমন হাতখুলে খরচ করতাম, তখন সেটা মোটামুটি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হলো। পার্থক্য এটুকুই। সেই খরচেই সুন্দর চলে যেতে লাগলো।
কয়েকমাস পর বউ বললো একটা ফ্রিজ কেনা দরকার। টাকা জমাতে হবে। কয়েকমাস টাকা জমিয়ে ২০ হাজার টাকার মত হলো। ফ্রিজের দোকানে গেলাম। বউ পছন্দ করলো প্রায় ৩০ হাজার টাকা দামের একটা ফ্রিজ। আমি আনইজি ফিল করা শুরু করলাম। আমার কাছে তো এত টাকা নাই। সব মিলিয়ে বাইশ হাজার টাকা হতে পারে। বউ দেখি হাসে। এই কয়দিনে বউও প্রায় ৮ হাজার টাকার মতো জমিয়ে ফেলেছে সংসারের খরচ সেভ করে।
এখনো মাঝে মাঝে অবাক লাগে। আগে টাকার ভয়ে বিয়ে করতে পারিনি আমি। বিয়ের আগে প্রায় এক-দেড় বছর যে আয় ছিল, বিয়ের প্রায় বছরখানেক পর পর্যন্তও আয় ছিল একই। বিয়ের আগের প্রায় এক বছরে সেভিংস ছিল শূন্য টাকা। বিয়ের পরের এক বছরেও সেভিংস শূন্য, কিন্তু ২ জনের একটা সংসার চালিয়েও ফ্রিজসহ আরও অনেক কিছু কেনা হয়ে গেছে!
বিয়ে করলে আসলেই আয়ে বরকত আসে। রিজিকের মালিক আল্লাহ- এটা নতুন করে অনুভব করেছিলাম তখন। যারা টাকার ভয়ে বিয়ে করতে পারছেন না, সাহস করে বিয়েটা করেই ফেলুন। ইনশাল্লাহ, আয়ে বরকত আসবে। রিজিকের মালিক তো আল্লাহই।
ফুটনোটঃ বিয়ের জন্য যে দুই ফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম, ধার শোধ করে তাঁদের বিয়ের সময়ও সেই একই পরিমান টাকা ধার দিতে পারার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মাঝে মাঝে এই ৫০ হাজার টাকাকে খুব বরকতময় মনে হয়! কি সুন্দর এই হাত থেকে ঐ হাতে যাবার অছিলায় ৩ জনের বিয়ে সুন্দরভাবে হয়ে গেল! (রনি পারভেজ)
(বিবাহ কথন-১৭)
****
বিয়ে করতে কত টাকা লাগে? এই প্রশ্নে আমি একটা অদ্ভুত উত্তর দেবো, তবে তা আগামী পর্বে। নিজের মন্তব্য দেয়ার আগে যে দুটো কেস হিস্ট্রি উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম, আজ থাকছে তার দ্বিতীয়টি।
কেস হিস্ট্রি-২:
আমার বিয়ের শাড়িটির দাম চার হাজার আট'শ টাকা। যেখানে আমারই বোন কিংবা কাজিনদের বিয়ের শাড়ির দাম পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত। আর্থিক সংকটের কারণে যে আমি কম দাম দিয়ে বিয়ের শাড়ি কিনেছি, এমন নয়। আসলে আমার মনে হয়েছে, কী দরকার, একদিনের জন্য এত বেশি টাকা নষ্ট করে! হাতে টাকা পেলে আমি পোশাক কেনার চেয়ে বই কেনায় বেশি মনোযোগ দেই। সে যাক, যার যার রুচির ব্যাপার। তবে এটা বলতে পারি, এক লক্ষ টাকার শাড়ি গায়ে জড়ানো বোনটির চেয়ে আমি মোটেও খারাপ নেই। ভালো থাকা যার যার মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি মনে করেন, আপনি ভালো আছেন, তাহলেই আপনি ভালো থাকবেন।
আমার যখন বিয়ে হয়, আমরা দুজনই স্টুডেন্ট। আমার একুশ, আতিকের তেইশ। আতিক কম বেতনের একটা চাকরি করে, আমার তেমন কোনো আয়-ইনকাম নেই। তবু আমার পরিবার বিয়েতে অমত করেনি। বিয়ের পরে আমরা একরূম সাবলেট নিয়ে উঠেছি। সস্তার আসবাবপত্রের দোকান থেকে কেনা দুই হাজার টাকার একটি খাট, একটি আলনা আর কম্পিউটার ছাড়া আর কিছুই ছিল না আমাদের ঘরে। দীর্ঘদিন আমরা দুইজন কোনো দামী ফোন ব্যবহার করিনি। মনে আছে, দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর আমি কোনো নতুন জামা, জুতো, ব্যাগ কিনিনি। আগের যা ছিল, তাই দিয়েই চালিয়ে নিয়েছি।
এক কেজি গরুর মাংস চার ভাগ করে রান্না করেছি। দিনের পর দিন শুধু সবজি দিয়েই ভাত খেয়েছি। এত যে কষ্ট করেছি, তবু একজনের বিরুদ্ধে আরেকজন কখনো অভিযোগ করিনি। আমাদের পরিবারকেও কখনো বলতে যাইনি, যে আমরা কষ্ট করছি। তারা জানতো, আমরা ভালো আছি। সত্যিই আমরা ভালো আছি। প্রয়োজন ছিল কিছুটা সময় ধৈর্য ধরার। আমরা তা করেছি, তাই দেখতে দেখতে দৃশ্য বদলে গেল, যে জীবন আমরা শুরু করেছিলাম, তার সঙ্গে বর্তমান জীবনের কোনো মিলই নেই! ভাগ্য বদলের জন্য তো প্রচেষ্টা থাকতে হবে, তাই না?
আরেকজনের সাজানো-গোছানো জীবনে প্রবেশ করার চেয়ে দুজন মিলে সাজিয়ে নিলে, সেই জীবনটা আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। (হাবিবা নাসরিন)
(বিবাহ কথন-১৮)
****
এর আগে দুটি কেস স্টাডি দিয়ে আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি- বিয়ে করতে খুব বেশি টাকার দরকার নেই। যদি নিয়ত ঠিক থাকে, যদি উভয়ের মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকে- তাহলে থাকার জন্য দালানের দরকার হয় না, মাটির ঘরই যথেষ্ট হয়। লাখ লাখ টাকা মোহরানা লাগে না, কোরআনের কয়েকটি সুরাও যথেষ্ট হয়। লাখ টাকার শাড়ি গহনা পাগড়ী শেরোয়ানি লাগে না, লুঙ্গি ফতুয়া আর সাধারণ একটা শাড়ি হলেই চলে। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে হাজার মানুষ খাওয়ানো ওয়ালিমা দরকার হয়না, এক প্যাকেট খেজুরের ওয়ালিমাই বরকতপূর্ণ হয়।
এইযে এত জাঁকজমকের আয়োজন, এত আনুষ্ঠানিকতা, এত দর-কষাকষি, এইসব কেন করা হয়? করা হয় শুধুমাত্র তথাকথিত এই সমাজের চোখে, সমাজের মানুষের চোখে বড় সাজার জন্য। মানুষের চোখে প্রশংসা পাওয়ার জন্য। মানুষ কী বলবে- এই তাড়না থেকেই শুরু হয় শো-অফ এর যতসব অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
কিন্তু বাস্তবে বিয়ের উদ্দেশ্য যে একটা সুন্দর পরিবার গঠন, সেইখানে এতসব খানাদানা জাঁকজমকের একপয়সার মূল্য নেই। দিনশেষে এই তথাকথিত সমাজ আর সমাজের মানুষেরা শুধু নিন্দাই করে, শুধুই পরশ্রীকাতর হয়, শুধু হিংসাই করে, শুধু সমস্যাই বাড়ায়।
সবকিছু মোকাবেলা করতে হয় শুধু দুজনকেই, পরিবারটাকে টেনে নিতে হয় মাত্র দুজনকেই।
বিয়ে করতে কত টাকা দরকার? আমার উত্তর হলোঃ বিয়ে করতে তত টাকাই দরকার, যতটাকা হলে একটা লুঙ্গি কেনা যায়!! অদ্ভুত শোনাচ্ছে? হাদীস থেকে বাস্তব প্রমাণ দিচ্ছিঃ
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার জীবনকে আপনার হাতে সমর্পণ করতে এসেছি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাঁকালেন এবং সতর্ক দৃষ্টিতে তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করলেন। তারপর তিনি মাথা নিচু করলেন। যখন মহিলাটি দেখল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে কোন ফয়সালা দিচ্ছেন না, তখন সে বসে পড়ল। এরপর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের মধ্যে একজন দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনার বিয়ের প্রয়োজন না থাকে, তবে আমার সঙ্গে এর বিয়ে দিয়ে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? সে উত্তর করলো- না, আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে গিয়ে দেখ, কিছু পাও কিনা। এরপর লোকটি চলে গেল। ফিরে এসে বলল, আল্লাহর কসম! আমি কিছুই পাইনি। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবার দেখ, লোহার একটি আংটিও যদি পাও। তারপর লোকটি আবার ফিরে গেল। এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাও পেলাম না, কিন্তু এই আমার লুঙ্গি (শুধু এটাই আছে)। লোকটি এর অর্ধেক তাকে দিতে চাইল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে তোমার লুঙ্গি দিয়ে কী করবে? তুমি যদি পরিধান কর, তাহলে তার কোন কাজে আসবে না, আর সে যদি পরিধান করে, তবে তোমার কোন কাজে আসবে না। বেশ কিছুক্ষণ লোকটি নীরবে বসে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়াল। সে যেতে উদ্যত হলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে আনলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী পরিমাণ কুরআন মাজীদ মুখস্থ আছে? সে বলল, আমার অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে এবং সে গণনা করল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কি তোমার মুখস্থ আছে? সে বলল, হাঁ। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে পরিমাণ কুরআন তোমার মুখস্থ আছে তার বিনিময়ে এ মেয়েটিকে তোমার অধীনস্থ করে (বিয়ে) দিলাম।
(সহীহ বুখারী)
আপনার যা আছে বিয়ে করার জন্য তা-ই যথেষ্ট। শুধু আপনাকে হতে হবে আরো একটু বেশি কষ্টসহিষ্ণু, টেনে ধরতে হবে আপনার উচ্চাভিলাষের লাগাম, সাময়িকভাবে হয়তো কমিয়ে আনতে হবে জীবনযাত্রার মান। আর হ্যা, খুঁজে বের করতে হবে এমন একজনকে- যিনি আপনার এইটুকু নিয়েই সন্তুষ্টচিত্তে সংসার করতে রাজী আছেন।
(বিবাহ কথন-১৯)