আমাকে অপরাধী করে দেয় তোমাদের ভালোবাসা। সহসাই মহীরুহ হয়ে ধরা দেয় চোখে- যত অক্ষমতা, যত দারিদ্র্য আমার।
আমাকে অপরাধী করে দেয় তোমাদের ভালোবাসা। অপাত্রে ঢেলে ঢেলে কী নিদারুণ অপচয় হচ্ছে তোমাদের হৃদয় আবেগ !! অথচ, কে না জানে- আমি এর মোটেও যোগ্য নই, কখনোই ছিলামও না।
গতকাল ছিল আমার আটাশতম জন্মদিন। অর্থাৎ, সাতাশ বছরের জীবন কাটিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর আলো বাতাসে।
সাতাশ বছর মোটেও কম সময় নয়। যদি এভাবে ভাবি- আজ থেকে সাতাশ বছর আগে যারা
একইদিনে জন্মেছিলো, তারা সবাই কি আজও বেঁচে আছে? নেই। এমনকি আরো পরে যাদের
জন্ম, তারাও অনেকেই বেঁচে নেই।
আল্লাহর ইচ্ছায় আমি বেঁচে আছি।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে ফিরে এসে আজও বেঁচে আছি। তার মানে, আমি অনেক মানুষের
তুলনায় অলরেডি এক দীর্ঘ জীবন পেয়েছি।
বয়স হলো সাতাশ। সাত বছর বাদ দিতে হয়, কারণ সাত বছর বয়সের আগে আসলেই কিছু
বোঝার মত বয়স ছিলনা। তবু বিশ বছরেই এত এত ভিন্ন মাত্রার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে,
মাঝে মাঝে নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। শরীরের বয়স যাই হোক, আপেক্ষিকতার সূত্র
অনুযায়ী মনের বয়স যে কত হয়েছে ঠাওর করতে পারিনা।
আমি জন্মদিন
উদযাপন করিনা। ছুটির দিন থাকে, ঘুমিয়েই কাটাই। প্রশ্ন হলো- জন্মদিন কি আসলে
আনন্দের সাথে উদযাপন করার বিষয়? নাকি এই ভেবে কষ্ট পাওয়া উচিৎ যে-
নির্দিষ্ট হায়াতের হিসাব থেকে আরো একটি বছর কমে গেল! মহাকালের মহাশুন্যতায়
অন্তর্ধানের দিকে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলাম!!
জন্মদিনে অনেকেই আমাকে
শুভেচ্ছা জানান। আমিও জানাই। যেকোন শিশুর জন্মই আনন্দের উপলক্ষ্য। হয়তো
আমারটাও তাই। কিন্তু সেই শিশু যখন বড় হয়- তখন সে আর সবার জন্য আনন্দের কারণ
থাকে না।
জন্মদিনের সবচেয়ে বড় আত্মজিজ্ঞাসা হলোঃ যখন শিশু ছিলাম,
তখন হয়তো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জন্য আনন্দের কারণ ছিলাম। এখন এই পরিণত
বয়সেও আমি কি সত্যিই মানুষের জন্য আনন্দের উৎস হতে পেরেছি?
চট্টগ্রামে যখন পা রাখলাম তখনো সূয্যিমামার মুখ দেখা যায় নি। পৌষের প্রথম সকাল। বাস থেকে নেমেই শীতের আমেজ টের পাওয়া গেলো। চাঁদর জড়াতে হলো গায়ে।
বাসায় কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়েই ভ্রমণপিপাসুদের বিশেষ গ্রুপ "ভ্রমরের" কয়েকজন তরতাজা যুবক রওয়ানা হলাম "অক্সিজেনে"র উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটায় সকাল আটটা পেরিয়ে গেছে। মানুষের পদচারণায় চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড়ের বাতাসে তখন অক্সিজেনের তুলনায় কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
আমাদের বাসে উঠতে হলো ঠিক সাড়ে আটটায়। গন্তব্য... রাঙ্গামাটি.... তবে আপাতত রাঙ্গামাটি নয়। যাচ্ছি খাগড়াছড়ির পথ ধরে সাজেকের সবুজ উপত্যকায়। সাজেক পড়েছে রাঙ্গামাটি জেলায়, কিন্তু পুরোটা পথ পড়বে খাগড়াছড়ির মাটিতে।
চান্দি গরম!!
ভ্রমর গ্রুপের দু'জন সদস্য আগের দিন বিকেলেই শান্তি পরিবহনের টিকেট কাটতে এসেছিলেন। তাদেরকে বলা হয়েছিলো সামনের দিকে কোন সিট খালি নেই। অতএব বাধ্য হয়ে তারা পেছনের দিকের কয়েকটি সিটের টিকেট কিনে নিয়ে যান। কিন্তু সকালে এসে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র!! হেল্পার চিৎকার করে ডাকছে... আসেন খাগড়াছড়ি... সিট খালি...
এবং দেখা গেলো এইমাত্র এসে অনেকেই বাসের সামনের সিট পেয়ে যাচ্ছেন!! শান্তি পরিবহনের চট্টগ্রাম কাউন্টারের এই প্রতারণায় আমরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। এই শীতের সকালে আমাদের চান্দি গরম গেল। ব্যাটাদের একহাত দেখে নেয়া দরকার। কাউন্টারে যে দুজন বসা ছিল তাদের সাথে বেশ উচ্চবাচ্য হলো। ওদেরকে বেশ করে শাসিয়ে দিলাম। বাসে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু যাত্রার শুরুতেই শান্তি পরিবহনের এই প্রতারণামূলক আচরণ যে অশান্তির সৃষ্টি করলো তার শেষ কোথায় কে জানে!!
জানালায় ভোরের আলো
চারজন অলস বাস মিস করেছে। অতএব চারটা সিট খালি। অলসরা পরের বাসে পারলে আসবে। না পারলে নাই। ব্যাকপ্যাক গুলো খালি সিটে রেখে আয়েশ করে বসলাম আমরা। আর বাস ছুটলো গন্তব্যের টানে। হাটহাজারী, নাজিরহাট, মানিকছড়ি... পথের দুপাশে সবুজ গাছের সারি। কখনো কাটা ধানের ক্ষেত। শহর ছেড়ে আমরা গ্রামের আলোহাওয়ার ভেতর এগিয়ে চলেছি। ততক্ষণে সূর্য তার আলো ছড়াতে শুরু করেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে গায়ে। যেন আলতো করে মুখে চোখে বুলিয়ে দিচ্ছে উষ্ণ পরশ।
এই পথ যদি না শেষ হয়?
মানিকছড়ি পার হলে শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। দু'পাশে পাহাড়, টিলা। টিলার ঢালে সবুজের সমারোহ। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। এরকম পথে চলতে আমার এত ভালো লাগে, এজন্যই আমি শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে বারবার ফিরে আসি পাহাড়ের কোলে। অদ্ভুত সুন্দর আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু এইসব নির্জন রাস্তায় এলেই গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে হয়- এই পথ যদি না শেষ হয়!! তবে কেমন হত, তুমি বলতো!! (তবে শেষ পর্যন্ত গলা ছাড়লাম না। নিজেকে কন্ট্রোল করেছি আরকি! বিকজ, আমার গানের গলা এতই মধুর যে, সুরের মূর্ছনায় রাস্তার সবকিছু থেমে যেতে পারে, ইউ নো!!)
টেনশন টেনশন!!
খাগড়াছড়ি নেমে নামায আর খাওয়া সেরে আমরা উঠলাম পাহাড়ী পথের জন্য বিশেষ জীপ- চান্দের গাড়িতে। শুরু হলো চান্দের গাড়ির দুরন্ত গতির সাথে আমাদের রোমাঞ্চকর যাত্রা। আমরা জানতাম যে দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকর্ট টীম সাজেক যায় বিকেল সাড়ে তিনটায়। কিন্তু খাগড়াছড়িতে নেমে জানা গেল সময়টা এখন এগিয়ে আনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর টীম যাবে পৌনে তিনটায়। অর্থাৎ এর মধ্যে দীঘিনালা পৌঁছতে না পারলে আজ আমাদের সাজেক যাওয়া হবে না।
বাস মিস করা সেই চারজন অলস পরের বাসে রওনা দিয়েছিল। তারা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে আরো কিছুটা দেরি হয়ে গেল। সবাই কিছুটা টেনশন বোধ করতে লাগলাম। তবে কি তীরে এসে ডুবে যাবে তরী?
অবশেষে ঘুমকাতুরে অলসরা এসে পৌঁছলো। আর দেরি নয়। উল্কার বেগে ছুটলো চান্দের গাড়ি। গন্তব্য সাজেক, যেখানে মেঘের ওপর বাড়ি।
পথে পথে চেকপোস্ট!
আমাদের গাড়ি যখন আর্মি ক্যাম্পের কাছে পৌঁছলো, ততক্ষণে অন্যসব গাড়ি নিয়ে সেনাবাহিনীর টিম রেডি হয়ে গেছে। আর পাঁচ মিনিট দেরি করলেই মিস হয়ে যেত আজকের এসকর্ট।
পর্যটকদের নিয়ে ৩৮ টি গাড়ির দীর্ঘ বহর এগিয়ে চললো সাজেকের উদ্দেশ্যে।
দীর্ঘ পাহাড়ী পথ। আর পথে পথে চেকপোস্ট। কখনো সেনাবাহিনীর, কখনো বিজিবির, কখনো পুলিশের। মাঝে মাঝে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিলো, এ কি নিজের দেশে আছি? এখনো এতটা অনিরাপদ রয়ে গেছে পার্বত্য অঞ্চল!
কিছুদূর এগিয়েই উঠে পড়লাম গাড়ির ছাদে। হাওয়ার বেগে ছুটছে গাড়ি। আর হাওয়ায় উড়ছে আমাদের মন।
দীঘিনালা পেরিয়ে বাঘাইহাট। পথে কাচালং নদী, কাচালং বাজার, মাসালং বাজার। আঁকাবাকা আর উঁচুনিচু রাস্তা, তবে বান্দরবানের মত অতটা ভয়ংকর নয়। বলতে গেলে, সত্যিকারের এডভেঞ্চারারদের কিছুটা খারাপও লাগতে পারে। বিশেষ করে যারা আগেই বান্দরবানের গহীনে ঘুরে এসেছেন তাদের কাছে সাজেকের পথ হয়তো নতুন কোন অনুভূতি জাগাবে না। নতুন যা, রাস্তার পাশে প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উপজাতি শিশুরা আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াচ্ছিলো। ওরা কী বলছিলো শোনা যায় নি। তবে আমরা নিজেরাই ভেবে নিলামঃ নিশ্চয় ওরা বলছে- "ডিয়ার ট্রাভেলার্স, ওয়েলকাম টু সাজেক"!!!
পাহাড়চূড়ায় পূর্ণিমা স্নান
সাজেকে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে। রুইলুই পাড়ায় আমাদের জন্য বুক করা কটেজ "মেঘালয়" তে ব্যাগপত্তর রেখে বেরিয়ে পড়লাম দূর পাহাড়ের দেশে অস্তগামী সূর্যকে বিদায় জানাতে।
আরো উত্তরে হেঁটে গেলে পাওয়া গেল মসজিদ। সেখানেই মাগরিব এবং এশার নামাজ পড়লাম। পুবের আকাশে তখন অন্য দৃশ্য। ভোরের সূর্যের মত লাল হয়ে উঠে আসছে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ, তার ওপরে চাঁদ।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রাত ন'টা পর্যন্ত চললো আমাদের খুনসুটি আড্ডা। ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল, আরো সুন্দর, আরো মোহিনী রুপ ধারণ করলো চাঁদের আলো। হাজার ফুট উপরে, পৌষের প্রথম রাতে হিম হিম বাতাসে, এ যেন অদ্ভুত পূর্ণিমা স্নান। এ যেন মুগ্ধতার নতুন মাত্রা।
সূর্যের তাপ আরেকটু বাড়লে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম আরো উত্তরে কংলাক পাড়ার উদ্দেশ্যে। আরোহন করলাম কংলাক পাহাড়ে। অনেকেই হাঁপিয়ে উঠলো, কিন্তু কেওক্রাডং বিজয়ী পর্বতারোহী হিসেবে আমার কাছে এ যেন ছিল নিতান্তই ডালভাত!! বিনাক্লেশে উঠে পড়লাম কংলাক চূড়ায়। সেখানে লুসাই উপজাতির দুয়েকটা বাড়ি আছে। বাড়ির আঙিনায় তখনো জমাট মেঘ!! এ যেন সত্যিকারের- মেঘের ওপর বাড়ি।
ফেলে আসি নীলাকাশ
সকাল দশটায় সাজেক থেকে ফিরতি যাত্রা। আবার সেনাবাহিনীর একটি টিম আমাদের সাথে নিয়ে যাবে দীঘিনালা পর্যন্ত। মূলত আমরাই যাবো ওদের সাথে। সেনাবাহিনীর এসকর্ট ছাড়া যাওয়া আসা করা যায় না।
এবার আর ছাদে নয়। বসেছি গাড়ির পেছনের দিকে মুখ করে। সূর্যের তাপ বাড়ছে। আকাশে কোন মেঘ নেই। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর নীল আকাশ। এমন দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ বহুদিন দেখা হয়নি।
ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে পাহাড়ী পথ, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি শহুরে জীবনে।
বিকেলে ঘুরলাম আলুটিলার রহস্যময় গুহায়। দিনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটিয়ে দিলাম রিসাং ঝর্ণার গান শুনে।
সূর্য ডুবে গেলে সাঙ্গ হলো এবারের খেলা। অন্ধকারে ডুবে গেল পাহাড়, মেঘ, ঝর্ণা আর দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ।
১।
হাসপাতালের ক্যান্টিনে ঢুকতেই আমার চোখ গেল কর্নারের টেবিলে। একা বসে আছেন
ডাঃ বকুল। খুবই শান্ত শিষ্ট নিরীহ মানুষ। তবে আজ মনে হচ্ছে স্বাভাবিকের
চেয়ে একটু বেশি গম্ভীর। বেশ বিমর্ষ চেহারা। গিয়ে বসলাম পাশে।
-কী ব্যাপার বকুল ভাই, মন খারাপ?
-জ্বি ভাই। আজকে একজনের সাথে একটু রুড আচরণ করে ফেলেছি। এখন মনটা খারাপ
লাগছে। লোকটা ডাক্তারদের ব্যাপারে নিশ্চয় একটা খারাপ ধারণা নিয়ে গেলো।
মানুষ কষ্ট নিয়েই হাসপাতালে আসে, কিন্ত ভাই সবসময় মেজাজ ঠিক রাখা যায় না।
রাখতে পারি না। আর যারা এক লাইন বেশি বোঝে তাদের আমি কেন যেন সহ্য করতে
পারি না।
ডাঃ বকুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনারারী মেডিকেল
অফিসার। সোজা বাংলায় ইনি একজন ডাক্তার যিনি তার শ্রমের বিনিময়ে কোন
পারিশ্রমিক পান না। ডাক্তার হয়েছেন বছর খানেক আগেই। একটা ক্লিনিকে চাকরি
করেন। একদিন তাঁর মনে হলো, শুধু ক্লিনিকের চাকরি করে দিনকে দিন মেডিকেল
নলেজের ধার কমে আসছে। ট্রেনিং করা দরকার। আবারো পড়ালেখায় নামা দরকার।
তাছাড়া ভবিষ্যতের বাজারে টিকে থাকার জন্য একটা পোস্ট গ্রাজুয়েশান ডিগ্রীও
করা দরকার।
অতঃপর সিনিয়র ভাইদের পরামর্শে ডাঃ বকুল ঢুকে পড়লেন
অনারারী ট্রেনিং এ। হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের অদ্ভুত হেলথ সিস্টেমের এক কিম্ভুত
সদস্য, একজন বিনে পয়সার কামলা।
গতকাল রাতে তাকে ক্লিনিকে ডিউটি
করতে হয়েছে। রাতটা বেশ 'খারাপ'ই গেছে বলতে গেলে। ক্রিটিকাল পেশেন্ট ছিল,
ডেথ ডিক্লেয়ার করতে হয়েছে দু'জনের। ঘুমানোর কোন সুযোগই হয়নি। সকালে উঠে
আবার ট্রেনিং-এর নামে বিনেপয়সার কামলাগিরি করতে এসেছেন।
সকালে
এমনিতেই কাজের চাপ বেশি থাকে। নতুন ভর্তি রোগীর হিস্ট্রি রিভিউ, ফলো আপ,
ইনভেস্টিগেশান প্ল্যান, ট্রিটমেন্ট রিভিউ, পুরনো রোগীদের ফলো আপ,
ট্রিটমেন্ট এডজাস্ট করা, ছুটি দেয়া, রাউন্ড, ক্লাস, সেমিনার ইত্যাকার নানা
কাজ। দম ফেলা মুশকিল।
এরই মধ্যে যখন এক পেশেন্টের এটেন্ড্যান্ট
বিরুপ মন্তব্য করে বসলো তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন নি। কিছু কড়া কথা
শুনিয়ে দিয়েছেন । তারপর থেকে বেচারার নিজেরই মন খারাপ।
আমারও খারাপ
লাগলো। ডাঃ বকুল এবং সেই এটেন্ড্যান্ট উভয়ের জন্যই খারাপ লাগলো। কিন্তু
আমি কোনভাবেই ডাঃ বকুলকে দোষ দিতে পারলাম না। আমি জানি, ডাঃ বকুল অকারণে
মেজাজ খারাপ করার লোক নন। আসলে ডাঃ বকুল এমন এক অমানবিক সিস্টেমের শিকার,
যে সিস্টেম তার মত নিরীহ মানুষকেও আজ রুঢ় করেছে। যে সিস্টেম তার যৌবনের
সোনালি সময়কে সিস্টেমের মারপ্যাচে ফেলে অপব্যবহার করে যাচ্ছে। এর কিছুটা
বিরুপ প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়বেই, এখন আর এতে খুব একটা অবাক হই না।
আমি জানি, ডাঃ বকুলকে যদি আলাদাভাবে ক্লিনিক ডিউটি করতে না হত, তাকে যদি
পেটের চিন্তায় মগ্ন থাকতে না হত, তার কর্মঘন্টা যদি নির্দিষ্ট থাকতো এবং
ওয়েল পেইড হত, তাহলে তিনি কখনোই মেজাজের খেই হারাতেন না।
You haven't given him a sound sleep, how can he give you a good smile??
২।
এই অংশটুকু বিশেষত নন-মেডিকেল পাঠকদের উদ্দেশ্যে। আপনার মনে যে প্রশ্নটি
চলে এসেছে তাহলো- ট্রেনিং তো ডাক্তাররা করছেন তার নিজের জন্য, নিজের
ডিগ্রীর জন্য। এর জন্য সরকার ভাতা দেবে কেন? এত কথা কেন?
এই প্রশ্ন
যদি সত্যিই আপনার মনে এসে থাকে তাহলে সেটা বড়ই আফসোসের কথা। পর্যাপ্ত
ডাক্তার নিয়োগ দেয়া এবং ডাক্তারদের ভাতা দিয়ে ভালো করে ট্রেনিং করানোর দাবি
আপনাদের পক্ষ থেকেই তোলা উচিত। কারণ, ডাক্তার দক্ষ না হলে এর কুফলটা
আপনাকেই ভোগ করতে হবে। সরকারি হাসপাতাল বলেন আর বেসরকারি বলেন, কোথাও
পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়না। ফলে অল্প ক'জন ডাক্তারকে অতিরিক্ত চাপ
নিতে হয়। ডাক্তার নাহয় শায়েস্তা হলো, কিন্তু আপনি কি পূর্ণ মনোযোগ পান? না
পেলে আপনি কী করেন? ডাক্তারকে গালিগালাজ করেন? নাকি ডাক্তারের নামে অভিযোগ
করেন? কখনো কি কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেছেন- এতজন রোগীর জন্য একজন ডাক্তার
কেন? কখনো কি দাবি তুলেছেন- এত টাকা বিল দিলাম, ডাক্তারের বেতন এত কম কেন?
নাহ। তা করেন নি।
ডাক্তারদের ভালো ট্রেনিং এর ব্যবস্থা আপনাদের
নিজেদের স্বার্থেই করতে হবে। বিকজ, দে ডিলস উইথ ইওর লাইফ এন্ড ডেথ। তাদের
আপডেটেড নলেজ এন্ড স্কিল না থাকলে দিনশেষে আপনিই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপনার বাবা মা, আপনার সন্তান। হয়তো ভুল চিকিৎসার অভিযোগ
তুলে ভাংচুর করবেন, হয়তো পত্রিকায় নিউজ হবেন। কিন্তু যদি কোন ক্ষতি হয়েই
যায়, তা কি ফিরে পাবেন?
ডাক্তারদের পেটের চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে
হবে। বিকজ, দে হ্যাভ টু লিভ দা মোস্ট স্ট্রেসফুল লাইফ। পেট এবং মাথা দুই
জায়গায় চাপ নিয়ে ভালো সেবা দেয়া যায় না। আর এ কারণেই উন্নত বিশ্বে ডক্টরস
আর অলওয়েজ হাইলি পেইড। আমার দেশে একটা সরকারী হাসপাতালের একটা ওয়ার্ড
চালানোর জন্য যতজন ডাক্তার দরকার, আমার সরকার নিয়োগ দিয়েছে তার এক চতুর্থ
বা পঞ্চমাংশ। আর সেই জায়গা পুরণের জন্যই জিইয়ে রাখা হচ্ছে এই অমানবিক
সিস্টেম। ডিগ্রীর মুলো ঝুলিয়ে বিনেপয়সায় খাটিয়ে শোষণ করা হচ্ছে তরুণ
ডাক্তারদের সোনালি সময়। একটা দিনও যদি এই ডাক্তাররা কাজ না করেন, তাহলেই
হাসপাতাল অচল হয়ে পড়বে।
আপনি এই সিস্টেমকে সমর্থন করেন? যদি করেন,
তাহলে আপনি ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আপনি যদি এই সিস্টেম
পরিবর্তনের দাবি না তোলেন, তাহলে আপনি আন্তরিক চিকিৎসা পাবার আশা করতে
পারেন না।
আপনি ঘোড়াকে ক্রমাগত চাবুক মারবেন, সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপাবেন, আর বিনিময়ে সে আপনাকে মুচকি হাসি দিবে, তা হয় না।
২. - শ্বাসকষ্টটা কখন শুরু হইছিলো ভাই?
- ভাবীঃ হ্যারে বাজারে পাঠাইছিলাম। বাজার থাইকা আসি দুপুরে খাইতে বসছে।
বুঝছেন ভাই! এর ঘন্টা দুই ঘন্টা পরে খানিক শ্বাসকষ্ট শুরু হইছে।
৩. - চাচাজান, রোগী কখন থেকে অজ্ঞান?
- রুগী পুরাপুরি ভালা আছিলো ছার। কথা কইছে। রাইতে ভাত খাইছে। খাইয়া
ঘুমাইছে। তারপরে হঠাৎ দেখি হাত পায়ে খিচ মারতাছে। অজ্ঞান হই গেছে।
ঘটনা যাহাই হউক, বাঙালির সকল ইতিহাস শুরু হয় 'ভাত খাওয়া'র পর
থেকে। যিশুর জন্মের বছর হতে যেমন খ্রিষ্টীয় সাল গণনা শুরু করা হয়, তেমনি
রোগীর যেকোন সিম্পটম (রোগ-লক্ষণ) এর বয়স গণনা শুরু হয় 'ভাত খাওয়া'র
মুহূর্ত থেকে। বাঙালির জীবনে ভাত খাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর
নাই!!!!!!
না বলতে বলতে-
সব কথা জমে যাচ্ছে বুকের ভেতর।
বেরোবার পথ নেই বলে ওখানেই ওরা
গাইছে, খেলছে, হাসছে, কাঁদছে... আর
বংশবৃদ্ধি করছে ক্রমাগত মিয়োসিস প্রক্রিয়ায়!
না বলতে বলতে-
বুকের ভেতর জমে যাচ্ছে কথার পাহাড়।
দিনকে দিন তেতে উঠছে কয়েদী কথামালা,
শীঘ্রই মুক্তি না দিলে
একদিন তারা সব বিদ্রোহী হবে!
একদিন তারা হবে
জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ! কিশোর তরুণেরা সব
হয়ে যাবে বোমাবাজ সন্ত্রাসী ।
পাঁজরের সব হাড় চূর্ণ করে
একদিন তারা হবে মুক্ত স্বাধীন;
একদিন তারা সব
পাখা মেলে উড়ে যাবে - শুন্য হাওয়ায়।
আজীবন ডুবসাঁতার কাটবো বলে জন্মলগ্ন হতে হাত পা ছুঁড়ছি অবিরাম। শিখছি সাঁতারের যতসব অদ্ভুত কৌশল, আর ক্রমাগত ভেদ করছি জলের সীমানা।
জলপথের এই দীর্ঘ যাত্রায় আজো কোন ডুবোচরে আটকেনি হৃদয় আমার। গহীন জলের হাজারো মরিচীকা আর জলজ লতার হাতছানি পায়ে ঠেলে তীরে এসে মুখোমুখি হয়েছি এক দুর্লঙ্ঘ্য দেয়ালের। কী করে পেরোব বলো বাধার পাহাড়? আমি দক্ষ এক সাঁতারু বটে - পর্বতারোহী তো নই!!
ডাক্তার সবগুলা কসাই। আমার মতন গরীবের থাইকাও তিন হাজার টেকা নিলো। বকরিটা বেইচ্চা এই টেকা জোগাড় দিলাম।
হাসপাতালের বাইরে চায়ের দোকানে পেছনের টেবিলে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে
দিতে বন্ধুর সাথে গল্প করছিলো ডাঃ মুনীর। এমন সময় এমন একটা মন্তব্য কানে
আসে তার। উৎসুক চোখে লোকটাকে ভালো করে খেয়াল করে মুনীর। হ্যা, এই লোকের
রোগীকে আজকেই ছুটি দেয়া হয়েছে। তার স্ত্রীই ছিলেন রোগী।
কিন্তু এই মুহূর্তে তার মুখে এই কথা শুনে মুনীরের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। কারণ, গরীব বলে এই লোকের সবগুলো ইনভেস্টগেশান ফ্রি
করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সে। পুওর ফান্ড থেকে ব্যবস্থা করে দিয়েছে সব
ওষুধের। বলা বাহুল্য, এই পুওর ফান্ড কোন সরকারী ফান্ড নয়। ডাক্তাররা নিজেরা
চাঁদা দিয়ে, ঔষধ কোম্পানির কাছে ওষুধ অনুদান নিয়ে বানিয়েছে এই পুওর ফান্ড।
যাদের আসলেই কিছু নেই, তাদেরকে এখান থেকে সাহায্য করা হয়। অথচ এখন এই লোক বলে কিনা তার তিন হাজার টাকা ডাক্তাররা নিয়েছে!! ব্যাপারটা কী?
লোকটা যখন বাইরে বেরুবে তখনই তাকে পেছন থেকে ডাক দিলো মুনীর।
চাচা আছেন কেমন? আচ্ছা ব্যাপারটা কী একটু আমাকে খুলে বলেন তো! শুনলাম ডাক্তাররা নাকি আপনার তিনহাজার টাকা নিয়েছে?
চাচীর চিকিৎসা তো আমি করলাম। কই, আমারে তো কিছু দিলেন না!
মুনীরের কথায় থতমত খেয়ে গেল বেচারা। চেহারায় ফিরে এলো পুরনো কাচুমাচু ভাবটাও।
- না বাবা, আপ্নেই তো সব ব্যবস্থা কইরা দিলেন। তয় আপ্নাগো কথা বইলা তো
ওয়ার্ড বয়ে টেকা নিলো। আয়া ২০০ টেকা নিলো ক্যাথেটার করাইয়া । সিট দেয়ার
জইন্যে একজনে নিল ৫০০ টেকা, আর আপনেগো ফি বাবদ একজন লোকে নিছে তিনদিনে
দেড়হাজার টেকা। কইছে টেকা দিলে আপনেরা ভালা কইরা দেখপেন। না দিলে নাকি
সমস্যা হইবো।
আর ট্রলিতে কইরা যে এক্সরে করতে নিছিলাম হেরা নিছে ৫০০ ট্যাকা।
কইছে, এই টেকা ডাক্তারগো দিতে অইবো।
মুনীর হতবাক হয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কাকে দোষ দেবে?? গ্রাম
থেকে আসা এইসব অবুঝ মানুষকে, নাকি কর্মচারীদেরকে, নাকি হাসপাতাল প্রশাসনকে!
হাসপাতালে রোগী চিকিৎসা ঠিকই ফ্রি পাচ্ছে, কিন্তু নানাভাবে তার
টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক গোষ্ঠি- যার একটা বড় অংশের সাথে জড়িত
হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা।
আর সব প্রতারকই খাচ্ছে ডাক্তারের নাম ভাঙ্গিয়ে।
মুনীর জানে, এরকম হয়। তবু নতুন করে কিছুটা হতাশা বোধ করে সে। বিনামূল্যে
খেটে, দরদ নিয়ে রোগীর জন্য কাজ করেও শেষমেষ বদনামটা ডাক্তারকেই কাঁধে নিতে
হয়। কারণ, সাধারণ মানুষ হাসপাতাল প্রশাসন চেনে না। তারা জানেনা হাসপাতালের
ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব হাসপাতাল প্রশাসনের।
তাদের কাছে হাসপাতাল মানেই- "ডাক্তার"।
ওয়াবিল ওয়ালিদাইনে ইহসানা। তোমরা পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। এইটুকু
সবাই জানে। কারণ, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের শিক্ষা সবাইকে দেয়া হয়।
কিন্তু সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব কী- এইটা কোথাও শিক্ষা দেয়া হয়
না। সন্তানের ওপর পিতামাতার অধিকার কী তা নিয়া অনেক ওয়াজ নসিহত হয়,
কিন্তু সন্তানের অধিকার কী- সেটা নিয়া কোন নসিহত পাওয়া যায় না। কোন বয়ান
শোনা যায় না।
ফলে বাস্তব অবস্থাটা হতাশাজনকই থাকে। গাছের নিকট সবাই ফল প্রত্যাশা করে, সবাই জানে- আমগাছের উচিৎ ভালো ভালো আম উপহার দেওয়া। কিন্তু
আমগাছকে যে গোড়ায় পানি দিয়ে, যত্ন করে বাড়তে দিলে তবেই ভালো ফল পাওয়া
যাবে এইটা আমাদের সমাজের পিতামাতারা বোঝেন না। আর দিনশেষে সব দোষ ঐ
ছেলেমেয়েদের ঘাড়েই বর্তানোর ধান্দায় থাকেন। ছেলেটা বিগড়ে গেছে, মেয়েটা
বেয়াদব হয়ে গেছে এইসব বলে তাঁরা নিজেদের দায় এড়িয়ে যান।
কোন কোন বাবা-মা সন্তানদেরকে ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্রের মত একান্ত
ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন, জড়বস্তুর মত মনে করেন। নিজের সিদ্ধান্তই
সর্বেসর্বা, দুইদিনের বাচ্চা- এরা আর কী বুঝবে (!) এইরকম মনোভাব পোষণ করেন।
তারা হয়ে ওঠেন সংসারের স্বৈরাচারী শাসক। নিজের পছন্দ অপছন্দকে সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেন। ওরাও যে একেকজন স্বতন্ত্র মানুষ এই সত্যটা একদম স্বীকার করতে চান না।
সমাজের যতসব বিশৃঙখলা অরাজকতা, তার পেছনে বাবা-মায়েদের এইসব দৃষ্টিভঙ্গিকে
আমি অনেকাংশে দায়ী মনে করি। আসলে, বাচ্চাদের শিক্ষার পাশাপাশি
বাপ-মায়েদেরও শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটাই-
বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?
তবু আমরা হেঁটেছিলাম, ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে- ক্রমাগত হেঁটেছিলাম রাত্রির দীর্ঘ পথ।
তারপর ভোর হলে দেখা গেল পৌঁছেছি গিয়ে এক অদ্ভুত ঠিকানায়। যেখানে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য ম্লান মনে হয়। যেখানে চাঁদকে মনে হয় ঘরের পিদিম, যেখানে পুরোপুরি বদলে গিয়েছিলো সুখ ও সৌন্দর্যের পুরনো সংজ্ঞা।
ডাক্তাররা
কমিশন খাওয়া বন্ধ করলে চিকিৎসা ব্যয় ৪০% কমে যাবে। এই ছিল দৈনিক
ইত্তেফাকের সাম্প্রতিক একটি খবরের শিরোনাম। প্রফেসর প্রাণ গোপাল স্যারকে
উদ্ধৃত করে তারা এই সংবাদটি করেছে। আমি নিশ্চিত এটা প্রাণ গোপাল স্যারের
বক্তব্যের একটা খন্ডিত অংশ মাত্র। তিনি নিশ্চয়ই আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা
বলেছেন। কিন্তু সাংবাদিক মহাশয় সেসব বাদ দিয়ে এই খন্ডিত অংশটিকে হাইলাইট
করেছেন। এবং বলা বাহুল্য, খবরটি বংগ জনতার খুবই "মনে ধরেছে"!! কোন এক
অদ্ভুত কারণে এদেশের মানুষের একটা অংশ ডাক্তারের বিরুদ্ধে কথা বলতে
পৈশাচিক আনন্দ বোধ করেন।
যাহোক, প্রশ্ন হচ্ছে, সমস্যাটা আসলে কি "ডাক্তারদের কমিশন খাওয়া"?
সম্পূরক প্রশ্নগুলো হচ্ছে, ডাক্তাররা কীভাবে কমিশন খায়? ডাক্তাররা কি
কাউকে কমিশন দিতে বাধ্য করতে পারে? আর কীভাবে এটা বন্ধ করা যায়?
প্রথমত, ডাক্তারদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনরকম কমিশন খান না। বরং যেখানেই সম্ভব, চেষ্টা করেন রোগীর ল্যাব খরচ কমাতে।
গুটিকয়েক অসাধু ডাক্তার কমিশন খান। তারা এটা খান "ডাক্তার" হিসেবে না,
মন্দ মানুষ হিসেবে। প্রত্যেক প্রফেশনে যেমন কিছু মন্দ মানুষ আছে, তেমনই।
দ্বিতীয়ত, কোন ডাক্তারই কমিশন দিতে কাউকে বাধ্য করেন না। বরং,
ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোই অনেকসময় ডাক্তারকে বাধ্য করে কমিশন নিতে।
কারণ, তারা ল্যাব টেস্টের দাম কমায় না। বরং, রেফারেলের জন্য বরাদ্দ টাকাটা
ডাক্তার না নিলেও ল্যাবেরই কেউ না কেউ ডাক্তারের নাম করে মেরে দেয়। এজন্য
অনেক ডাক্তারই আছেন, রেফারেল ফি নামে যে টাকা ডায়াগনোস্টিকগুলো দেয়,
সেটা তারা পুরোপুরি গরীব রোগীদের জন্য ব্যয় করেন।
আর বড়
হাসপাতালগুলোতে যারা বসেন, তারা আসলে কোনভাবেই এইসব কমিশন টমিশন পান না।
এইসব ঘটে মূলত ছোটখাটো নামকাওয়াস্তে হাসপাতাল ও ডায়াগনোস্টিক গুলোতে।
তৃতীয়ত, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই কমিশন প্রথার জন্য দায়ী কে? ডাক্তার, নাকি অন্য কেউ? এটা বন্ধ করার উপায়টাই বা কী?
আসলে এই প্রথা কোনভাবেই ডাক্তারদের তৈরি নয়। এটা তৈরি করেছে ব্যবসায়ীরা,
যারা মানুষের অসুস্থতাকে ব্যবসার পুঁজি করেছে টাকা বানানোর উপায় হিসেবে।
তারা বিভিন্ন ল্যাব টেস্ট এর মূল্য অস্বাভাবিক বেশি রেখে মুনাফা করছে, আরো
বেশি মুনাফার লোভে ডাক্তারদের পেছনে টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করে, আর কিছু কিছু
ডাক্তারকে খাওয়াতেও পেরেছে।
এটা বন্ধ করার উপায় কী? ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে নসিহত কিংবা উষ্মা প্রকাশে কোন সমাধান আসবে কি?
মোটেও না। গোড়ায় হাত দিতে হবে। এইযে ল্যাব টেস্টগুলোর অস্বাভাবিক মূল্য,
এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন টেস্টের
মূল্য বেঁধে দিতে হবে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টার যদি অতিরিক্ত মূল্য নিতে না
পারে, তাহলে তারা কোথা থেকে কমিশন দেবে? ফলে অটোমেটিকালি বন্ধ হয়ে যাবে এই
তথাকথিত কমিশন প্রথা ।
একই কথা ঔষধের ক্ষেত্রেও। ঔষধের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি। এটা নিয়ন্ত্রণ করলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে।
কিন্তু এই দায়িত্ব তো ডাক্তারদের না! এটা প্রশাসনের দায়িত্ব, সরকারের
দায়িত্ব। সুতরাং, "ডাক্তাররা কমিশন খাওয়া" বন্ধ করলে চিকিৎসা ব্যয় কমবে,
এটা একটা অযৌক্তিক কথা। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তিমূলক এবং বলা যায়
পরশ্রীকাতরতানির্ভর বক্তব্য। এটা প্রাণ গোপাল স্যারের বক্তব্য নয়, এটা ঐ
সাংবাদিকেরই টুইস্টেড কথা। আসলে বক্তব্যটা হওয়া উচিৎ, ঔষধ ও
ডায়াগনোস্টিক টেস্টের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে চিকিৎসা ব্যয় কমবে। কিন্তু
সেকথা না বলে, সমস্যার মূলে আঘাত না করে, শুধু ডাক্তারদের ঘাড়ে দোষ
চাপিয়ে বক্তব্য দেয়া আসলে অসুস্থ মানসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
স্বাস্থ্যসেবা আইন' ২০১৬ নামে আইনের একটি খসড়া আইন কমিশনের বিবেচনাধীন আছে। এতে বারোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত ৫২ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনের প্রয়োজন আছে। তবে আইন
হতে হবে যৌক্তিক, যাতে সব পক্ষের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে। এই আইনে অনেক
ভালো দিক রয়েছে, কিন্তু চিকিৎসায় অবহেলাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা
নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সুযোগ আছে। এখানে পেশাগত অবহেলা বলতে বোঝানো হয়েছে-
'ভুল চিকিৎসা' যা দ্বারা 'রোগ মুক্তি ঘটে না' বা 'বিলম্বিত হয়'।
যেকোন চিকিৎসার অনেক ধাপ আছে। এর যেকোন পর্যায়ে সমস্যা হলে কাংখিত ফল পাওয়া নাও যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, চিকিৎসার শুরুটা কিন্তু রোগীর হাতেই । রোগী সঠিক সময়ে
ডাক্তারের কাছে গেলেন কিনা, রোগের কোন অবস্থায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন,
ডাক্তারের কাছে ঠিকঠিক মত তার সমস্যার কথা বললেন কিনা, রোগের ইতিহাস ঠিকমত
দিতে পারলেন কিনা, কোনকিছু গোপন করলেন কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতের
চিকিৎসা । এরপর কিছু অংশ ডাক্তারের হাতে। ডাক্তার কতটা দক্ষ, কতটা অভিজ্ঞ, কতটা জ্ঞানী সেটার ওপর নির্ভর করবে তাঁর রোগ নির্ণয়ের দক্ষতা।
তারপরের কিছু অংশ প্যাথলজি বা অন্যান্য ডায়াগনোস্টিক টেস্টের ওপর। সেগুলো
আবার নির্ভর করে ল্যাবের যন্ত্রপাতির গুণগত মান, টেকনিশিয়ানের দক্ষতার ওপর।
রোগ নির্ণীত হলে পরে চিকিৎসা। একই রোগের চিকিৎসা আবার সকল রোগীর
ক্ষেত্রে একরকম হবে না। পার্থক্য হবে রোগীর শারীরিক অবস্থা, অন্যান্য রিস্ক
ফ্যাক্টরের উপস্থিতির ওপর। একটি রোগের সাথে অন্যান্য রোগের সহাবস্থানও
চিকিৎসার বিরাট অন্তরায়। রোগীর আর্থিক সক্ষমতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
একটি রোগের চিকিৎসার বিভিন্ন পন্থা থাকে। রোগী কোন পন্থা গ্রহণ করতে চান সেটাও একটা ব্যাপার।
সবশেষে ঔষধ প্রয়োগ। ডাক্তার রোগীকে ঔষধ গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু সেই
ঔষধ রোগী সঠিক সময়মত, সঠিক পরিমাণে, সঠিক পন্থায় গ্রহণ করছেন কিনা তার ওপর
নির্ভর করবে ওষুধের রেসপন্স।
শুধু ওষুধ গ্রহণ করলেই চলে না, ঠিকমত
মানতে হবে অন্যান্য পরামর্শও। নিয়মিত ফলো আপ করাও অত্যন্ত জরুরী। ওষুধের
প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজন অনুসারে ডোজ এডজাস্ট করা দরকার হয়।
এছাড়াও ডাক্তার যে ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন সে ওষুধ কিন্তু তিনি প্রস্তুত
করেন না। ওষুধ কোম্পানি যথাযথভাবে ঔষধ প্রস্তুত করেছে কিনা, ফার্মেসি ঠিকমত
সংরক্ষণ করেছিল কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ওষুধের কার্যকারীতা। আবার ওষুধ
একই হলেও বিভিন্ন জনের শরীরে তার কার্যকারীতা বিভিন্নরকম হতে পারে।
এতগুলো ফ্যাক্টর জড়িত একজন মানুষের যেকোন একটি রোগের চিকিৎসায়। এখন রোগীর
রোগ মুক্তি না ঘটলেই বা বিলম্ব হলেই কি তাকে ভুল চিকিৎসা বলা যাবে? তাই যদি
হয়, তাহলে এদেশে চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতেই পারবেন না। আর বিলম্বের
সংজ্ঞাটাই বা কী? এক সপ্তাহে ক্যান্সার থেকে মুক্তি না মিললে সেটাকে কি
রোগ মুক্তিতে বিলম্ব বলা যাবে?
চোখ? নাকি মন? ঝাপসা হয়েছে কোনটা? কেন আবছা লাগে আজ ফেলে আসা সোনালি সময়? কেন অস্পষ্ট হয়ে আসে প্রিয় মানুষের মুখ? কেন অসাধারণ দৃশ্যগুলো আজ শুধু আলো ছায়ার খেলা মনে হয়?
জীবনের শেকড় হতে ক্ষণে ক্ষণে বাষ্পীভূত হতেছে প্রতিদিন শুধু কি সময়? নাকি আরো অনেক অনেক অজানা মূলধন হইতেছে ক্রমাগত ক্ষয়?
ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান ডাঃ আব্দুল করিম সাহেব। তিনি এই শহরের একজন
সিনিয়র, নামকরা, প্রথিতযশা ডাক্তার। সম্প্রতি কয়েকজন বন্ধুর সাথে
শেয়ারে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজকে সেই ক্লিনিকের ডাক্তার
নিয়োগের জন্য ভাইভা আহবান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। প্রফেসর
সাহেবের সামনে এই মুহূর্তে বসে আছে তরুণ ডাক্তার মুনীর।
- স্যার বেতন সম্পর্কে যদি একটু ধারণা দিতেন। - বেতন আমরা ঠিক করেছি মাসিক ২০০০০ টাকা দেব। - স্যার এটাতো খুব কম হয়ে যায়। - বলো কী! তুমি জানো আমি কত টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলাম? বলো, আন্দাজ করে বলো দেখি। - জানি না স্যার। - মাত্র ৫০০ টাকা! বুঝলা, মাত্র ৫০০ টাকা।
প্রফেসর সাহেব কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। সেসময় ৫০০ টাকায় কী কী
করেছিলেন তার হিসাব দিতে শুরু করলেন। কীভাবে ৮০ টাকায় একটা মোটাতাজা গরু
কিনেছিলেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ বুজে এলো প্রফেসর সাহেবের!
তারপর তিনি বললেন- দেখো বাবা, ২০০০০ টাকা অনেক বেশি টাকা। এর বেশি আমরা দিতে পারবো না!
মুনীর বের হয়ে এলো। তার বলতে ইচ্ছে হয়ঃ স্যারগো স্যার, এইটা ২০১৬ সাল।
২০০০০ টাকায় এখন ষাঁড় নয়, বড়জোর একটা বকনা বাছুর কেনা যায়। যেকোন
একটা ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার যেখানে এট লিস্ট চল্লিশ হাজার টাকা বেতন
পায়, সেখানে কীকরে আপনি একজন পূর্ণকালীন ডাক্তারের বেতন বিশ হাজার টাকা
প্রস্তাব করেন?
কিন্তু মুনীর ভদ্র ছেলে, সে কিছুই বলতে পারে নি। বড়দের সামনে বেশি কথা বলতে নেই, এতে নাকি বেয়াদবি হয়ে যায়!
।।।এভাবেই সিনিয়র ডাক্তারদের ইচ্ছায় অথবা তাদের নির্লিপ্ত চোখের সামনে
নিষ্পেষিত হয় জুনিয়র ডাক্তাররা। কারণ, সিনিয়রদের চোখের সামনে আজও ভাসে
ষাটের দশকের সেই ৫০০ টাকা, যখন ৮০ টাকায় পাওয়া যেত একটা মোটাতাজা
গরু...।।।
ভাইভা বোর্ড। মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালে নতুন ট্রেইনি ডাক্তাররা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং এ যোগ
দিতে এসেছেন। বলা বাহুল্য, সম্পূর্ণ বিনা বেতনে। পেট চালানোর জন্য তাদের
অন্য কোথাও অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এই মুহূর্তে ভাইভার টেবিলে আছে তরুণ
ডাক্তার মুনীর।
প্রফেসরঃ
দেখো, আমার এখানে প্রতিদিন সকাল ৮ টায় আসতে হবে। এক মিনিট যেন এদিক ওদিক
না হয়! আর তিনটার আগে কোনভাবেই যাওয়া চলবে না। সপ্তাহে দুইদিন এভেনিং ও
নাইট ডিউটি করতে হবে। মুনীরঃ স্যার সপ্তাহে এক দিন যদি অফ দিতেন স্যার... প্রফেসরঃ না, এইখানে কোন অফ টফ চলবে না। ঠিকমত রোগী দেখবা। তুমি ডিগ্রী করতে আসছো না? জ্বি স্যার।
মুনীরের
একবার মনে হলো মুখ ফুটে বলে দেয়, যে তার মত জুনিয়র ডাক্তাররা হাওয়া
খেয়ে বাঁচে না। তারাও রক্তমাংসের মানুষ, তাদেরও ক্ষুধা আছে, তাদেরও পরিবার
পরিজন আছে। এমবিবিএস পাস করে এসে একজন ডাক্তারের পক্ষে বিনা পারিশ্রমিকে
এইভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু
মুনীর কিছুই বলতে পারে না। এইসব বলা যায় না। পাছে যদি বেয়াদবি হয়ে
যায়! প্রফেসরের কুনজরে পড়লে যে পরবর্তীতে পরীক্ষার ভাইভায় কোনভাবেই
উতরানো যাবে না।
(এভাবেই দিনের পর দিন টিকে থাকে অবৈতনিক/অনারারী
চিকিৎসা কর্মকর্তা নামের অমানবিক প্রথা.. হাজার কোটি টাকা ঠিকাদাররা
লুটেপুটে খায়, কিন্তু প্রফেসররা তার অধীনে প্রশিক্ষণরত ডাক্তারদের জন্য
মাত্র কয়েক'শ কোটি টাকা বরাদ্দ নিতে পারেন না।)
রাত প্রায় দু'টা বেজে গেছে। ডিউটি আওয়ার শেষ হতে আরো ছয় ঘন্টা বাকি। মুনীর এখন আছে সরকারী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে।
আজকে এই ওয়ার্ডে এডমিশন নেই, মানে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে অন্য ওয়ার্ডে। সেজন্য কিছুটা রিলাক্স হয়ে বসার সুযোগ পাওয়া গেল এতক্ষণ পর হলেও। এডমিশন নাইট হলেতো এক মুহূর্ত বসার সুযোগ হত না।
মুনীর কোথায় যেন পড়েছে, কবিরা নাকি খুব সৌন্দর্যপিপাসু হয়। চা-খোর যেমন মজা করে চা খায়, কবিরা নাকি সেরকম একটু একটু করে সবকিছুর সৌন্দর্য চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। মুনীর কবি নয়, কিন্তু সেও সৌন্দর্য পিয়াসীদের একজন। এই মুহূর্তে মুনীরের মনে পড়ে, হোস্টেলের ছাঁদে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কত রাত কাটিয়ে দিয়েছে সে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাতার ফাঁকে দেখেছে চাঁদের লুকোচুরি। পশ্চিমের চাঁদ একসময় ঢলে গেছে পূবের আকাশে, পূবের চাঁদ পশ্চিমে। একেকটা মুহূর্তের একেকরকম সৌন্দর্য। অমাবশ্যার রাতে যখন পেঁচারা উড়ে যায়, তারও একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে।
"স্যার একটু আইবেন?" চিন্তায় ছেদ পড়ে মুনীরের। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে এক পিচ্চি মেয়ে। বয়স সাত কি আট হবে হয়তো। "কী হয়েছে বাবু?" নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে মুনীর। "স্যার আমার মায়ের শ্বাসকষ্ট। মায় আপনারে ডাকতে কইছে।" স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে মুনীর। চলো চলো চলো, পিচ্চিটাকে তাগাদা দিয়ে নিয়ে চলে নির্দিষ্ট বেডের দিকে। যাওয়ার সময় নার্সকেও একটা হাঁক দিয়ে যায়। সিস্টার তেইশ নাম্বারে আসেন।
রোগীর ডায়াগনোসিস একিউট সিভিয়ার এজমা। গতকাল ভর্তি হয়েছে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে। পাক্কা দুই ঘন্টা চেষ্টার পর তার অবস্থা স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছিল।
শ্বাসের কষ্ট খুব খারাপ। জীবন সংশয়ের কথা বাদ দিলেও, একজন মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা, এটা কি যা-তা কথা? মুনীর ভাবে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের কত আরামে রেখেছেন। তবু মানুষ কত অকৃতজ্ঞ। মুনীরের মনে হয়, একজন মানুষের যদি কিছুই না থাকে, সে যদি শুধু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারে- তাতেই তার মস্তক অবনত করে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। দুনিয়ায় কিছু কিছু মানুষকে শ্বাসকষ্টের রোগ দিয়ে আল্লাহ হয়তো সকল মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন তাঁর অশেষ নেয়ামতের কথা।
মুনীর রোগীর পাশে বসে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলো। শুধু ওষুধ দিয়ে ক্ষান্ত নয়, মুনীর সবসময় চেষ্টা করে রোগীকে পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক শক্তি যোগানোর। যদিও সবসময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মুনীরের অবজার্ভেশান হলো, ওষুধের পাশাপাশি মানসিক শক্তি যোগালে রোগীর উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। একবার এমন হলো, বয়স্ক এক রোগী হাত ধরে বলে, বাবা আপনি আমার পাশে থাকেন, আপনি গেলে আমি বাঁচবো না। সত্যিই দেখা গেলো, মুনীর সেই রোগীর কাছে থাকলে তার শ্বাসকষ্ট কমে যায়, আবার দূরে গেলে বাড়ে। সাইকোলজিকাল ব্যাপার স্যাপার।
ঘড়ির কাঁটায় তিনটা অতিক্রম করে গেছে। হেঁটে হেঁটে রোগীদের অবস্থা দেখছে মুনীর। রাতের এই প্রহরে প্রায় সব রোগীই ঘুমিয়ে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মুনীর আবার এসে দাঁড়ায় তেইশ নাম্বার বেডের পাশে। এক বেডেই মা মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একটু আগে কী কষ্টই না পাচ্ছিলো মা-টা। আর বাচ্চাটার মুখে ফুটে উঠেছিল কী সীমাহীন উৎকন্ঠা!
আজ বাইরের পূর্নিমা চাঁদ দেখা হয়নি মুনীরের। কিন্ত এই মুহূর্তে হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে ঘুমন্ত রোগীদের মুখ যেন একেকটা চাঁদ হয়ে ধরা দেয় মুনীরের চোখে। ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলো এই প্রশান্তির কাছে ম্লান হয়ে যায়।
মুসলমানদের মধ্যে এমনিতেই বিভেদের শেষ নাই। এই মাযহাব সেই মাযহাব সালাফী ওহাবী পীর পন্থি মাজার পন্থি এই পন্থি সেই পন্থি আরো কত কী! এর মধ্যে আবার কিছু লোক একটা নতুন টার্ম নিয়ে এসেছে। তারা মুসলমানদের নতুন করে দুই ভাগে ভাগ করেছে- প্রাক্টিসিং মুসলিম এবং নন প্রাক্টিসিং মুসলিম !! মানে হইলো- যার দাড়ি আছে বা যে মহিলা নিকাব পড়ে সে হইলো গিয়া প্রাক্টিসিং মুসলিম আর যার দাড়ি নাই সে হইলো গিয়া নন প্রাক্টিসিং মুসলিম!!!
মুসলিমদের অবশ্যই ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলা উচিৎ। যারা মানেন না তাদেরকে মানার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া ও সহযোগিতা করা উচিৎ। কিন্তু এইসব প্রাক্টিসিং নন প্রাক্টিসিং টার্ম ব্যবহার চরম বেকুবি ছাড়া আর কিছু না। যারা এইসব টার্ম ব্যবহার করে, আমার মনে হয় তারা ভেতরে ভেতরে নিজেদের বুজুর্গী নিয়া অহংকার বোধ করেন। অন্যদেরকে নিজেদের তুলনায় খানিকটা ইনিফেরিওর ভাবেন।
ভাইবইনগন, আল্লাহর কাছে কোন বুজুর্গের অবস্থা কী হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন। দুনিয়ায় বুজুর্গীর অহংকার দেখাইয়েন না।
সিলেটের ঘটনায় যে মেয়েটা ভিডিও করেছে, তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। এর বেশি কিছু করা ঐসময় তার পক্ষে মোটেও সম্ভব ছিলনা। সুতরাং সে যা করেছে একদম ঠিক কাজটাই করেছে। ভিডিও দেখে আমার মনে হয়েছে, অন্য কেউ এগিয়ে গেলেও সেসময় খুব বেশি কিছু করতে পারতো না। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বদরুল খুব বেশি সময় নেয় নাই নার্গিসকে কোপানোর জন্য। সে পুরোপুরি উন্মাদ ছিল। মনে হয়, এইরকম প্রকাশ্যে কোপানোর ফলে তার নিজের পরিণতিও যে খারাপ হবে, এটা জেনেবুঝেই সে কোপাতে এসেছিল।
ধারালো অস্ত্রের মুখে নিজের বাপ-মা ভাইবোন ছাড়া অন্য কেউ খালি হাতে এগিয়ে যাবে, এই নষ্ট সময়ের নষ্ট সমাজে আপনি আমি কেউই তা আশা করতে পারিনা। আপনি নিজেও হয়তো কারো সাহায্যের জন্য হুট করে এমন ধারালো অস্ত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন না। পরে কিন্তু ঠিকই বদরুলকে ধরে গনপিটুনি দিয়েছে। এরকম সময়ে এমন একটা অতর্কিত নৃশংস হামলার মোকাবেলায় মানসিক ও শারিরীক প্রস্তুতির জন্য উপস্থিত লোকজনকে ওটুকু সময় দিতেই হবে।
কেউ পানিতে ডুবে যাচ্ছে, অথবা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে এমন সময় ভিডিও করার সুযোগ নেই, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কিন্ত অপরাধমূলক কোন ঘটনা সংঘটিত হতে দেখলে সুযোগ থাকলে অবশ্যই ভিডিও করতে হবে। সবাই ভিডিও করবে তা নয়, কিন্তু কাউকে না কাউকে ভিডিও বা অডিও নিতে হবে। নিজে হেল্প করতে গেলেও অন্য কাউকে ভিডিও নিতে বলে যাওয়া দরকার। অতি রাজনৈতিক বিভাজন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন আর চরম মিথ্যাচারী বায়াসড মিডিয়ার এই যুগে ভিডিওর মত অকাট্য প্রমাণ অত্যন্ত জরুরী। এপর্যন্ত বেশ কিছু ঘটনায় শুধুমাত্র ভিডিও থাকার কারণে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ভিডিও না থাকলে তা কতটুকু সম্ভব হত জানিনা।
দীর্ঘদিন পরিকল্পনা নিয়ে যখন কেউ অপরাধ করতে আসে, তখন তাকে প্রতিরোধ করা যায় না। এটা সহজ না। কিন্তু ডকুমেন্ট রাখতে পারলে তাকে খুঁজে বের করা যায়। শাস্তি দেয়া যায়। অপরাধীদের জন্য এটা কম ভয়ের বিষয় নয়।
এইযে শুন্য খাতা পড়ে আছে টেবিলের একপাশে, ল্যাপটপের ভেতর এমএস ওয়ার্ডের নতুন একটা ফাইল বহুদিন ধরে একদম ফাঁকা হয়ে আছে- লিখবার মানুষটা লিখছে না কিছু আর গহন হৃদয়ের কথা, কোন ব্যথা, কোন অনুভূতি তার- আসছেনা অক্ষরের রুপ নিয়ে কাব্যভূক চোখের ভেতর জানেন, কেন হারায় এইভাবে মানুষের পাললিক অন্তর?
তবে কি সকলেই গেয়ে যাবো নষ্ট এ সময়ের গান? ব্যস্ততা মানে কি এইভাবে ভুলে থাকা হৃদয়ের টান?
একটা কবিতা হবে তোমার কাছে? তোমাদের কাছে? না না, রবীন্দ্রনাথ কিংবা আল মাহমুদ নয়, আমার চাই একদম আনকোরা কবিতা। হবে?
নারী ও পুরুষের প্রেম ভালোবাসা- অনেক হয়েছে বিগত শতকে। অনেক হয়েছে পদ্যের জালে গাঁথা পৌরাণিক কাহিনী। অথচ, আজ এই অশান্ত পৃথিবীতে বড্ড প্রয়োজন নতুন কবিতার। না না কাজী নজরুল নয়, আজ আমি বিদ্রোহ চাই না; আজ আমি চাইনা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। আমি চাই- কবিতার আবেশে খুনিরাও হয়ে যাক নতুন মানুষ লুটেরার দল ফিরিয়ে দিয়ে যাক যক্ষের ধন আর রক্তপিপাসু পিশাচেরা সব ধ্বংস করে দিক অস্ত্রের ভান্ডার।
এমন একটা কবিতা আছে কি ডায়েরিতে? তোমাদের কারো কাছে? যদি নাই থাকে এসো তুমি আর আমি মিলে মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকি। এসো আজ একটা নতুন কবিতা লিখে যাই আগামী পৃথিবীর জন্যে।
সাংবাদিকদের মধ্যে একটা অংশ মনে করেন, সাংবাদিকতা মানেই নেগেটিভ নিউজ করা!
এরা এতটুকু জ্ঞানও রাখেন না, কোন নিউজ কীভাবে করলে প্রকৃত অর্থে দেশ ও জনগন
উপকৃত হবে।
রাজশাহী মেডিকেলে ঈদের সময় রোগীদের পাশাপাশি দায়িত্ব
পালনকারী ইন্টার্ন ডাক্তারদেরকেও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় খাবার সরবরাহ করা
হয়েছে। এটা ছিল অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কারণ, ঈদের সময়
যখন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ এবং হোস্টেলের ক্যান্টিন বন্ধ থাকে, আশেপাশের
খাবার দোকান বন্ধ থাকে, এসময় পরিবার পরিজন ছেড়ে হাসপাতালে দায়িত্ব
পালনকারী ডাক্তারদের খাবারের ব্যবস্থা করায় তারা নিশ্চিন্তে দায়িত্ব পালন
করতে পারবেন। রোগীরা পাবে আন্তরিক ও ভালো সেবা। নিশ্চয়ই রাজশাহী মেডিকেলে
তা পেয়েছেও। কিন্তু প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি এতটাই বেকুব যে, তিনি
ভালো খারাপ বোঝার মত এতটুকু জ্ঞান রাখেন না। যেহেতু আলাদা কোন বরাদ্দ নেই,
ডাক্তারদের খাবারও দেয়া হয়েছে রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে। বেকুব
সাংবাদিক নিউজ করেছে- "রোগীর টাকায় ডাক্তারের ভোজ"! অথচ নিউজটা এভাবেও করা
যেত - 'বরাদ্দ নেই ডাক্তারদের জন্য!' সেটা হত ডাক্তার রোগী সবার জন্য
উপকারী। কিন্তু এই বেকুব তথাকথিত সাংবাদিক এতটাই নেগেটিভ মেন্টালিটির
লোক, ভালো মন্দ বোঝার সামান্য যোগ্যতাও তার নেই। একচুয়ালি এদের পত্রিকা
অফিস থেকে বের করে দেয়া উচিত। শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কারণ, এদের এইসব
আউল ফাউল নিউজ নষ্ট করছে মানুষের বিশ্বাস। সৃষ্টি করছে সন্দেহ সংশয় ও
আস্থাহীনতা। সর্বোপরি নষ্ট করছে সেবাদানকারীদের সেবা দেয়ার মানসিকতা।
দিনরাত কষ্ট করেও বদনাম পেতে কারো নিশ্চয় ভালো লাগার কথা নয়।
এই বিরাণ রাস্তায় আর কতকাল হেঁটে যাবো একা একা? শীর্ণ পায়ে আমি একাকী পথিক কী করে পাড়ি দেবো- এত দীর্ঘ পথ? . বন্ধুর এই পথচলায় যার কথা ছিল সহযাত্রী হবার কথা ছিল সারাপথ সঙ্গ দেবার কথা ছিল যার সাথে দেখা হবে এইখানে পথের বাঁকে, কোন এক মধ্য দুপুর; স্বর্নবিকেল ; কিংবা কোন এক গোধূলী বেলায়- কথা ছিল যার হাত ধরে হেঁটে যাবো অনন্ত পথ- হায়! আজও পাইনি দেখা তার, আজও হয়নি আমাদের সাক্ষাত। . আলমে আরওয়া হতে নেমে এসে এই মহাকালের গর্ভে ক্রমাগত হাঁটছি তো হাটছিই। কে জানে- আর কতটা পথ হেঁটে গেলে তবে কোন খানে কোন ক্ষণে আমাদের দেখা হবে !
পাবলিক সার্ভেন্ট। অর্থটা সহজেই বোধগম্য- 'জনগনের চাকর'। ভদ্রভাষায়
জনতার 'সেবক'ও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিয়োগকৃত কর্মচারীরা দেশের
নাগরিকদের সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। নাগরিকদের কষ্টলাঘব করবেন।
কিন্তু
বাস্তবে ঘটছে তার সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। যারা আসলে জনগনের চাকর, তারাই যেন
হয়ে উঠেছেন জনগনের প্রভু! কথা ছিল নিজে কষ্ট করে জনগনের কষ্ট লাঘব করবেন,
কিন্তু বাস্তবে তারা এখন নিজের আরামের জন্য জনগনকেই কষ্ট দিয়ে থাকেন।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। যাচ্ছিলাম ব্যস্ত রাস্তায়। হঠাত দেখি রাস্তা
আটকে দেয়া হয়েছে। কারণটা জানা গেল একটু পরেই। একজন উচ্চপদস্থ (!) সরকারি
কর্মচারী তার গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে বের হবেন। তাই জনতার গাড়ি আটকিয়ে রাস্তা
ফাঁকা করে রাখা হচ্ছে!!
কথা
ছিল আগে জনগনের চলাচল নির্বিঘ্ন করার, অথচ ঘটছে উল্টো ঘটনা। তাহলে মালিক
কে, আর গোলাম কে? এযেন সেই প্রফেসির বাস্তবরুপ- দাসীর পেটে হচ্ছে এখন
মালিকের জন্ম!!
স্মার্টফোন এখন সবার হাতে হাতে। আর স্মার্টফোনে ইন্সটল করা হচ্ছে
'স্মার্ট' গেমস। অনলাইনে বা অফলাইনে যতগুলো গেমস আছে, এর একটা বিরাট অংশ
তৈরি হয়েছে সহিংসতাকে ভিত্তি করে। গেমস মানেই সংঘাত, সংঘর্ষ। নায়কের হাতে
বন্দুক, গ্রেনেড। শত্রুর হাতে বন্দুক, গ্রেনেড। যুদ্ধ, আক্রমণ, আত্মরক্ষা-
এইসব হয়ে দাঁড়িয়েছে গেমসের মূল বিষয়। নিরীহ স্নেক বা মোটো রেসের গেম এখন
নিতান্তই সেকেলে।
এতে সমস্যা কী? সমস্যাটা হচ্ছে, এইসব সহিংসতা নির্ভর গেম এখন শিশুরাও খেলছে। বাবার মোবাইল কিংবা মামা চাচা ভাইয়া আপুদের মোবাইল হাতে নিয়ে শিশুরাও নিমগ্ন হয়ে যাচ্ছে এইসব গেমসে।
এটা কোন নির্মল আনন্দ নয়। আসলে অর্থহীন খেলাধুলাতেই শুধু আছে নির্মল
আনন্দ। এইসব জটিল গেমস শিশুদেরকে স্মার্ট বানানোর চেয়ে অনেক বেশি জটিল
বানাচ্ছে। যতটা জটিলতা থাকার কথা নয় তার চেয়ে বেশি জটিল হয়ে পড়ছে বাচ্চাদের
চিন্তাভাবনা। তাদের বেড়ে ওঠাটা হচ্ছে না ধারাবাহিক, হচ্ছে না ক্রমান্বয়ী।
এমনকি বাচ্চাদের হাতে এইসব গেমস ভেতরে ভেতরে হয়তো অজান্তেই উগ্র করে তুলছে
তাদেরকে! তাদের কাছে মনে হতে পারে, এইসব গোলাগুলি এটাক পাল্টা এটাক বোধহয়
খুবই স্বাভাবিক! সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটা হচ্ছে- বড় হতে হতে একসময় তারা বাস্তবে
এইসব এডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে আগ্রহী হতে পারে। আর তাদেরকে এই এডভেঞ্চারের
স্বাদ দিতে বর্তমান পৃথিবীতে অনেক গোষ্ঠী তো প্রস্তুত আছেই।
সতর্ক না হলে এইসব গেমসের শেষটা হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের অনেক খারাপ কিছুর মুখোমুখি করবে।
একটা রোগী? নাকি দুইটা রোগী? কয়টা রোগী আছে? অনেক ডাক্তার নার্সদের মুখে
অনেক সময় এমন কথা শোনা যায়। "একটা" বা "দুইটা", এগুলো বস্তু বা অবোধ
প্রাণীর সংখ্যা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। মানুষের ক্ষেত্রে সংখ্যাবাচক হিসেবে
ব্যবহৃত হওয়া উচিত "কতজন"।
হয়তো এই 'একটা' 'দুটা' 'কয়টা' শব্দগুলি
উদ্দেশ্যমূলক নয়, হয়তো কেউ কেউ সহজে বলার সুবিধার্থে এভাবে বলে থাকেন,
কিন্তু তবু শব্দটা বেশ শ্রুতিকটু। রোগীর জন্য সম্মানজনক নয়। এতে করে কিছুটা
হলেও রোগীর প্রতি সম্মানহীনতা ফুটে ওঠে।
ডাক্তার ও নার্সদের মনে রাখতে হবে,
রোগী কোন 'বস্তু' নন, রোগী একজন মানুষ, আশরাফুল মাখলুকাত। আর সৃষ্টিকর্তার
কাছে প্রত্যেক মানুষই সম্মানিত। মানুষের কাছেও প্রত্যেক মানুষই সম্মান
পাবার অধিকার রাখেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, ধনী গরীব ভেদাভেদের উর্ধ্বে,
সকলেই।
একইভাবে রোগীকে
"তুমি" সম্বোধন প্রসংগও উল্লেখ করা যায়। অনেককেই দেখি গরীব রোগীকে "তুমি"
সম্বোধন করতে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। ধনী গরীব সকল রোগীকে "আপনি" সম্বোধন করা
উচিত। মনে রাখতে হবে, রোগী প্রথমত একজন 'মানুষ'।
মানুষের প্রতি
সম্মান মানুষকেই করতে হবে। ডাক্তারদের মত উচ্চশিক্ষিত মানুষদের কাছে যদি
একজন মানুষ ধর্ম বর্ণ সম্পত্তি নির্বিশেষে সম্মান না পায়, তাহলে এ সমাজে
আর কার কাছ থেকে সভ্যতা আশা করা যেতে পারে?
মেডিকেল এবং ভার্সিটির ভর্তি এসএসসির পরেই হওয়া উচিত । আমার মনে হয়, উচ্চ
মাধ্যমিকের নামে দুই তিনটি বছর অযথাই নষ্ট করা হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিকে যা
শেখানো হয় তা আসলে পরবর্তী জীবনে কোন কাজে আসে না। বরং এসএসসি পর্যন্ত যা
শেখানো হয়, ভিত্তি হিসেবে সেটুকুই যথেষ্ট। সেটুকুই সবার মনে থাকে।
পরবর্তীতে কাজে লাগে।
মেডিকেল কলেজে যে ছেলে ভর্তি হয়, তার জন্য উচ্চ
মাধ্যমিকের বায়োলজি বই কতটুকু কাজে লাগে? আরশোলার জীবন কাহিনী আর
ব্যবচ্ছেদবিদ্যা কী কাজে লাগে? মস ফার্নের জীবনকাহিনী কী কাজে লাগে? উচ্চ মাধ্যমিক জ্যামিতি কী কাজে লাগে?
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই একেকটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে- সেখানে উচ্চ
মাধ্যমিকে যা পড়ানো হয়- সেগুলোর কোন দরকার নেই। ভিত্তি হিসেবে ততটুকুই
যথেষ্ট, যতটুকু এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো হয়। বরং অতিরিক্ত এই দুইবছর সময়
কার্যকরভাবে কাজে লাগানো উচিত। মেডিকেল ছাত্রদের জন্য ট্রেনিং পিরিয়ড
বাড়ানো যেতে পারে। এমবিবিএস পাসের পরই বিষয়ভিত্তিক স্পেশালাইজড ট্রেনিং এর
ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলা ইংরেজী ইতিহাস গণিত পদার্থ রসায়নের ছাত্রদের
গ্রামের স্কুলে শিক্ষাদানের জন্য পাঠানো যেতে পারে। শিক্ষানবিশ হিসেবে কোন
সরকারী অফিসের কাজে লাগানো যেতে পারে। এভাবে প্রত্যেকটা সাবজেক্টের ছেলেমেয়েদের বিশেষ বিশেষ উৎপাদনমুখি কাজে লাগানো যেতে পারে। অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম আরো কিছুটা বড় করা যেতে পারে। বিহেভিওরাল সায়েন্স, দেশের অর্থনীতি এসব যোগ করা যেতে পারে।
যাকে দিয়ে যে কাজ করাবো, তাকে সেই কাজেই বেশি সময় ব্যয় করার সুযোগ দিতে
হবে। যার যার অর্জিত জ্ঞান নিজস্ব ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর সুযোগ না পেলে
দক্ষ মানবশক্তি কখনোই তৈরি হবে না।
এই এক সমস্যা আমার। পথে নামলেই পথের প্রেমে পড়ে যাই। মনে হয়ঃ পথে পথে কাটিয়ে দিইনা কেন জীবনের বাকিটা সময়? . এইযে পথ- দুধারে নানান গাছের সারি দেবদারু - অশ্বথ - বাশঝাঁড় - কাশবন, তাকিয়ে থাকলেই চোখে নেশা ধরে আসে; যেন অপরুপ সৌন্দর্যের পানে- মুগ্ধ প্রেমিকের চেয়ে থাকা.... . এই এক সমস্যা আমার।
হয়তো একদিন এ শহর ছেড়ে পথে নেমে গেলে হয়তো হারিয়ে যাবো অচিন পথের বাঁকে- হয়তোবা আর কভু হবে নাকো ফেরা পুরনো কামরায়।
দেখো কীরকম নিশ্চুপ হয়ে গেছি আমি অমাবশ্যার মত ভয়ানক নৈঃশব্দ গ্রাস করে রেখেছে আমাকে। কতদিন আমি কোন কবিতা লিখিনা, মনে পড়ে? কতদিন গলা ছেড়ে গাইনি একটাও ভাটিয়ালি গান! . দেখো, কীরকম নিরাবেগ হয়ে গেছি আমি যেন হিম বরফের মত শীতল হয়ে আছে আমার হৃদয়। কতদিন দেখনি আমার প্রাণখোলা হাসি? মনে পড়ে? . আর কীরকম উদাসীন হয়ে গেছি আজকাল! যেন গৈরিক সন্ন্যাসীর মত ভয়ানক বৈরাগ আচ্ছন্ন করেছে আমাকে। শোনো, মানবিক উষ্ণতা ছাড়া এ বরফ আর গলবে না। তীব্র কোলাহল ছাড়া ঘুঁচবেনা নৈঃশব্দ। আর সম্ভবতঃ ভয়ানক প্রেম ছাড়া ফিরবেনা- পুরনো আবেগ!
ইদানিং অনেক ডাক্তারকে দেখি ফেসবুকে রোগীর ছবি পোস্ট করেন । এটা করা
কোনভাবেই ঠিক নয় । মেডিকেল ইথিক্স অনুযায়ী রোগীর সকল তথ্য গোপন রাখা
ডাক্তারের অবশ্য কর্তব্য, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া । যেমন ইনফেকশাস ডিজিজ বা
পুলিশ কেস সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয় । একাডেমিক আলোচনা ও
গবেষণার প্রয়োজনে রোগীর অনুমতি সাপেক্ষে তাঁর তথ্য ব্যবহার করা যায় । এসব
ক্ষেত্র ছাড়া নিজের খেয়ালখুশিমত কারো ছবি, বা রোগ সম্পর্কিত অন্য কোন তথ্য
সামাজিক মিডিয়া তো দূরের কথা, রোগীর নিকটাত্মীয় নন অথবা রোগী চান না এমন কারো কাছে প্রকাশ করার সুযোগ নেই । এটা মেডিকেল এথিক্সের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ।
ডাক্তারের কাছে রোগীর অবস্থা জানার জন্য অনেকেই আসেন । দেখা যায়-
হাসপাতালে রোগী দেখতে এলে সবাই একবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগীর অবস্থা
জানতে চান। কিন্তু রোগীর স্বজনদের বুঝতে হবে- সবকিছু জানার অধিকার আপনার
নেই । অনেক সময়ই ডাক্তাররা আপনাদের সাথে কথা বলতে চান না । অনেক সময় বিরক্ত
হন । কারণ, এখানে ডাক্তারের ওপর অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় চাপের বাইরে নীতির
প্রশ্নও জড়িত আছে ।
ডাক্তারদেরও সচেতন থাকতে হবে । রোগীর কোন তথ্য
কেউ জানতে চাইলে অবশ্যই রোগীর সাথে তাঁর সম্পর্ক যাচাই করে নিতে হবে ।
সম্ভব হলে রোগীর অনুমতি নিতে হবে । কাকে কতটুকু বলা যাবে তা ভেবে নিয়ে তাকে
ততটুকুই বলতে হবে । তার বেশি কখনোই নয় ।
রোগী হয়তো চিকিৎসায়
শারীরিক সুস্থতা লাভ করবেন, কিন্তু রোগীর অনুমতি ছাড়া কোন কোন তথ্য অন্য
কারো হস্তগত হলে পরবর্তীতে রোগীর সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে ।
মেডিকেল ইথিক্স তা কখনোই হতে দিতে পারে না ।
জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় উগ্রবাদ উত্থানের কারণ কী? মোটাদাগে দুটি কারণকে
তুলে আনা যায়। একটা হচ্ছে- হতাশা । প্রতিশোধস্পৃহা । আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে
সঠিক শিক্ষার অভাব ।
দীর্ঘদিন নির্যাতন নিপীড়ন শোষণ বঞ্চনার শিকার
হলে যেকোন জনগোষ্ঠীই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । যখন বঞ্চনার জায়গা থেকে উত্তরণের
স্বাভাবিক কোন পন্থা থাকে না, নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা কাজে আসে না, তখন
মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে । শুধু মানুষ নয়, যেকোন প্রাণীই সহিংস হয়ে ওঠে । মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণতা । এ উপমহাদেশ থেকে শুরু করে সারা
বিশ্বের সকল উগ্রবাদীদের উত্থানের পেছনে এই কারণটিই প্রধান । এমনকি
ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বিরোধী সহিংস আন্দোলনসহ বিশ্বের প্রায় সকল সহিংস
আন্দোলন-সংগ্রাম বা যুদ্ধের পেছনের কারণ এটিই । ইসলামকে পুঁজি করে যে
উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে, যার ঢেউ এসে পড়েছে আমাদের দেশেও, তারও
প্রধান কারণ এটি । আমরা দেখি, আইএস আল কায়েদা এইসব গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের হতাশা থেকে, ক্ষোভ থেকে । প্রতিশোধস্পৃহা থেকে
। ইরাক যুদ্ধ, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ- এইসব ঘটনার পরেই
ক্ষুদ্র উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো ফুলে ফেপে উঠেছে । আরো বেশি মানুষকে তাদের দলে
ভিড়াতে পেরেছে । আরো বেশি শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছে । সিরিয়া, ইরাক,
আফগানিস্তান, লিবিয়া, এইসব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তরুন যুবকেরাই আইএস আল
কায়েদার মূল শক্তি । পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জীবন সম্পর্কে
হতাশ, রেডিকালি চেঞ্জড কিছু যুবক তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ।
আইএস সহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম তরুনদের মাঝে একটা ধারণা ছড়িয়ে
দিচ্ছে- দেখো, সারাবিশ্বে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে । আর ইহুদী খ্রিস্টান
অমুসলিমরাই হচ্ছে নির্যাতনকারী । অতএব তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে ।
তাদেরকে খুন করতে হবে ! আর বিশ্বের মুসলিমদের দুরবস্থায় হতাশ তরুনরা আবেগে
জড়িয়ে পড়ছে উগ্রবাদী সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে । যোগ দিচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ
মানুষ হত্যার মত জঘন্য কাজে ।
মুসলিমরা অবশ্যই নির্যাতিত হচ্ছে, এই
বাস্তবতা কারো অস্বীকার করার সুযোগ নেই । কিন্তু তাই বলে অন্য কোন নিরীহ
মানুষকে হত্যা তো দূরের কথা, সামান্য ক্ষতি করার অনুমতিও ইসলাম দেয় না ।
কুরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা একজন নিরীহ মানুষ হত্যাকে পৃথিবীর সকল মানুষকে
হত্যার সমান বলে ঘোষণা করেছেন । নিরীহ মানুষ হত্যার ব্যাপারে উগ্র
গোষ্ঠীগুলো মুসলিম যুবকদের ধারণা দেয় যে- ইহুদি খ্রিস্টানরাও তো নিরীহ
মুসলিমদের হত্যা করছে ! অতএব তোমরা করলে দোষ কী? সঠিক ইসলামী শিক্ষা না
পাওয়া আবেগি মুসলিম তরুনেরা এইসব কথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে
ধ্বংসের পথে ।
তাদেরকে isolated ভাবে কুরআনের এমন কিছু কিছু আয়াত
থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়, যেখানে ‘ক্বিতাল’এর কথা বলা হয়েছে । কিন্তু কখন,
কোন্ প্রেক্ষাপটে, কেন সেইসব আয়াত নাযিল হয়েছিল তা বলা হয়না । তারা
নিজেরাও জানার সুযোগ পায় না, চেষ্টা করে না । আগে থেকে ইসলামের শিক্ষা না
থাকার ফলে তাদের ধারণা হয়ঃ ঠিকই তো ! এগুলো তো কুরআনেরই কথা !
অথচ
Context ছাড়া কুরআনের কোন Text থেকে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই । যদি
তাই হতো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা শুধু বই আকারে কুরআন নাযিল করতেন, রাসুল
পাঠাতেন না । সমগ্র কুরআন একসাথে নাযিল করতেন, ২৩ বছর সময় দিতেন না ।
‘উগ্রবাদের কারণ ও প্রতিকার- ১ (চলবে)
কারা বেশি করে জড়াচ্ছে উগ্রপন্থায়? যারা জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছে
ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে । ফলে হঠাৎ করে যখন তারা জীবনে কোন একটা বড় ধাক্কা
খায়, যখন কোনভাবে তার মনে হয়- কী করছি আমি এসব? আমি তো অনেক পাপ করেছি, হায়
হায় আমার কী হবে ! আমার তো দুনিয়া আখেরাত সব বরবাদ হয়ে গেলো ! ঠিক এসময়ই
তারা সন্ধান পায়, অথবা তাদেরকে খুঁজে নেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী । তাদেরকে বলা
হয়- আল্লাহর কাছে মাফ পেতে চাও? তাহলে এই নাও অস্ত্র! খুন করে ফেলো
ওকে-তাকে । ওরা ইসলামের শত্রু ! ওদেরকে মেরে নিজেও মরে যাও , শহীদ হয়ে যাও ।
শহীদ(?) হবার এই সহজ রাস্তা পেয়ে আবেগি তরুন নেমে পড়ে মানুষ হত্যায় ।
এমনিতেই সে ছিল জীবন সম্পর্কে হতাশ, ক্ষুব্ধ । এমনিতেই সে ছিল জীবন
সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ । তারপর যখন উগ্রবাদীরা তার সামনে আত্মাহুতি দেয়ার একটা
'মহান' (?) কারণ দাঁড় করায়, অস্থিরহৃদয় যুবক তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে । কারণ-
সারাটা জীবন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মেনে চলার চেয়ে হঠাৎ
আবেগে জীবন দেয়াটা অনেক সহজ ।
উল্টোদিকে যারা ছোটবেলা থেকেই
ইসলামের শিক্ষা পেয়ে, ধর্মীয় আচার আচরণের মধ্যে বড় হয়- তাদের ভেতর একটা
তৃপ্তি থাকে- আমি ধর্মের পথেই আছি । ফলে তাদেরকে র্যাডিকালাইজড করা সম্ভব
হয় না ।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে- ধর্মীয় শিক্ষা নেবার জায়গাটা । এটা
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তরুনদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে । ধর্ম নিয়ে, জীবন
নিয়ে । এইসব প্রশ্নের জবাব সে কোথায় পাবে? প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়ার
জায়গাটা হাতের কাছে থাকতে হবে । ধর্মীয় বই পুস্তক, ধর্মীয় নেতা, আলেম
ওলামাদের গতিবিধি, মাহফিল মজলিশ মক্তব মাদ্রাসা ওয়াজ নসিহত বক্তৃতা সীমিত
হয়ে পড়লে সেই জায়গাটা দখল করে নেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী । ফলে মানুষের বিপথগামী
হবার সুযোগ সম্ভাবনাও বেড়ে যায় ।
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা
যতটুকু বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে তার পেছনে এইসব কার্যকারণ জড়িত আছে । বিগত
বছরগুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দিনকে দিন সীমিত হয়েছে । অনেক মক্তব
মাদ্রাসা, ধর্মীয় জলসা মাহফিল মজলিশ টিভি পত্র পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে । আর
এর সুযোগটা নিতে পেরেছে উগ্রবাদীরা । ফলে তরুণ- যুবকদের একটা অংশকে
বিপথগামী করার সুযোগ পেয়েছে উগ্রবাদিরা । ধর্মের শিক্ষার পথ বন্ধ করা নয়-
বরং সহজলভ্য করতে হবে । যাতে তরুন মনের প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে পায়
পিতামাতার কাছে, শুভাকাঙ্খি কারো কাছে । পরিচিত কারো কাছে । আর যারা
ইসলামের যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানে, শেখে, বোঝে, তাদেরকে বিপথে নেয়া কারো জন্য
সহজ হয় না । তাদেরকে র্যাডিকালাইজড করা যায় না ।
‘উগ্রবাদের কারণ ও প্রতিকার- ২ (চলবে)
কথা ছিল শ্রীমঙ্গলে নামবার । কিন্তু ট্রেনেই আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ হয়ে গেল । স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, মাধবপুর এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সবচেয়ে কাছাকাছি হবে ভানুগাছ স্টেশন । অতএব আমরা এখন ভানুগাছেই নামবো ! সারারাত ঘুমাইনি । গল্পগুজব করেই কেটে গেল কয়েকটা ঘন্টা । শ্রীমঙ্গল আসার আগেই চেয়ার ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছি ট্রেনের দরজায় । হুহু বাতাস এসে লাগছিল শরীরে । দুপাশে গাছ আর গাছ । যেন বনের ভেতর দিয়ে চলছে ট্রেন । একটা অসাধারণ ভ্রমণের রোমাঞ্চ শুরু হলো সেখান থেকেই । তারপর যেই কথা সেই কাজ । রাত তিনটায়, বলা চলে ‘ভররাত্রে’ই আমাদের ভানুগাছ স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে চলে গেল উপবন এক্সপ্রেস । আমরা নেমে পড়লাম ‘পথে’ । বাকি দিনগুলো আমরা যেভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি তাকে কোন ভ্রমণ না বলে ‘পথে পথে ঘুরে বেড়ানো’ বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত । হুম । সিলেটের পথে পথে ।
চা বাগানের ভোর
সিলেট মানে চা বাগান । অতএব শুরুটা অবশ্যই হতে হবে চা বাগান দিয়েই। কাছাকাছি রয়েছে ন্যাশনাল টি এস্টেট এর চা বাগান । চা বাগানের ভেতর লেক । মাধবপুর লেক । কিন্তু এই রাত তিনটায় তো আর সেখানে যাওয়া যায় না! অতএব ভানুগাছ স্টেশনে হাত মুখ ধুয়ে গরম পরোটা ডিম ডাল আর চা খেয়ে পেটকে বশে আনলাম । ফযরের আজান হলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে একটা সিএনজি ভাড়া করলাম আমরা । তখন ভোর ছয়টা। সিএনজি ছুটছে গ্রামের পথ ধরে । দুপাশে মাঠ, ধানক্ষেত, পুকুর, দীঘি । ভোরের শীতল স্নিগ্ধ হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছিলো শরীর। ছোট একটা নদীও দেখলাম একেবেঁকে চলে গেছে । অনেক অনেক দিন পর এমন দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল আমাদের । অফিসিয়ালি চা বাগানে ঢোকার সময় সকাল আটটার পর হতে । অতএব এই ভোরবেলায় গার্ডকে অনুরোধ করে আমাদের ঢুকতে হলো ভেতরে । চা বাগান, ভেতরের লেক দুটোই অনেক সুন্দর । লেকটা অনেকটা বান্দরবানের বগা লেকের মত লাগলো ।
উল্লুকের অভয়ারণ্যে !
ঘন্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে গাড়ির মুখ ঘোরাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দিকে । পথে চা নাস্তা খেয়ে নিলাম । স্থানীয়দের সাথে আলাপ করলাম। লাউয়াছড়ায় যখন পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে আটটা। অফিসিয়ালি টিকেট নিয়ে ঢোকার সময় নয়টার পর হতে। দেখলাম আরো অনেকেই ঢুকে পড়ছে টিকেট ছাড়াই । কারণ, কাউন্টারে কেউ নেই । আমরাও কালবিলম্ব না করে ঢুকে গেলাম লাউয়াছড়ার বনে । পরে টিকেট নেয়া যাবে । অবশ্যই- পায়ে হেঁটে ! পথের দুপাশে গাছ । মাঝখানে ইট বিছানো রাস্তা । ততক্ষণে আকাশে সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে । বনের ভেতর যেন আলো আধারির খেলা । হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম গিয়ে রেললাইনে । লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন । কথিত আছে, জুলভার্নের বিখ্যাত সিনেমা Round the world in 80 days এর এক অংশের শুটিং হয়েছিল এখানে ।
এই বনের সৃষ্টি বৃটিশদের হাতে, সেই ১৯২৫ সালে । পরে এই বনকে জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য ঘোষণা করে সরকার। বানর, আর উল্লুকের দেখা মিললেও অন্য কোন প্রাণির অবশ্য দেখা পাওয়া গেলনা । তবে এখানে নাকি দুএকটি হরিণ, অজগর আর অনেক রকম সাপ আছে । কয়েকদিন আগেই নাকি এক অজগর সাপ একটা সম্পূর্ণ হরিণ গলাধঃকরণ করেছিল ! ভেতরে আছে জরাজীর্ণ কয়েকটি অফিস ঘর । টিলার ওপরে একটি দোকান। একটি বাংলো । একটি মসজিদও আছে । ঘন্টা দুয়েক ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে আরো অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলাম মসজিদের বারান্দায় । লাউয়াছড়ায় একটি ডরমিটরি আছে যেটা নাকি গবেষকদের বা স্টুডেন্টদের থাকার জন্য । কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হলাম । বিদ্যুৎ সংযোগ নেই । অতএব, রাতে থাকা সম্ভব নয় ।
গন্তব্য মাধবকুন্ড!
আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে । ছোটবেলায় মাত্র দুটো ঝর্ণার কথা জানতাম । চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড আর মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড । সীতাকুন্ড দেখা হয়ে গেছে সাত বছর আগেই । এবার লক্ষ্য মাধবকুন্ড । এতক্ষণে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে । বন থেকে বেরিয়ে আবার সিএনজিতে উঠলাম আমরা । এবার ‘লোকাল’ যাত্রী হিসেবে । বিকজ, সিএনজি রিজার্ভ নিতে গেলেই আকাশচুম্বি দাম চেয়ে বসে । সিএনজিওয়ালাদের ধারণা, পর্যটক মানেই একেকটা টাকার গাছ ! চাইলেই কেল্লা ফতেহ ! সিএনজি চললো । আমরা এলাম সমশেরনগর । সেখান থেকে কুলাউড়া । তারপর জুড়ী পার হয়ে কাঠালতলী হয়ে মাধবকুন্ড । বিকেল হয়ে গেছে এতক্ষণে । সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত মাধবকুন্ডের শীতল পানিতে শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকলাম ।
মনে হলো মাধবকুণ্ডকে বেশ যত্ন করে ‘পর্যটন কেন্দ্র’ হিসেবে সাজানো হয়েছে । বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলি অবহেলায় পড়ে আছে । সেই তুলনায় মাধবকুন্ড যথেষ্টই সমাদর পেয়েছে বলতে হয়। আফসোস হলো, যেখানটায় ঝর্নার পানি পড়ছে, সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ । পানিতে ডুবে কয়েকজনের মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে । ওখানে নাকি পানির গভীরতা অনেক । সন্ধ্যা যখন হয় হয় তখন আমরা মাধবকুন্ডের মায়া ত্যাগ করে চলে এলাম কাঠালতলী । মাধবকুন্ড হতে কাঠালতলী বাজার, মাত্র ৭-১০ মিনিটের রাস্তা । সিএনজি ভাড়া লাগলো আড়াইশ টাকা ! মাধবকুন্ডের এই এলাকায় সিএনজিচালকরা একটা বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে ।
হাওরে ভাসাই ভেলা
কুলাউড়া পার হয়ে জুড়ী উপজেলায় ঢুকতেই চোখে এসেছিলো দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি । যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি । এ আবার কোন্ সমূদ্র? সিলেটে তো সাগর আছে বলে জানতাম না ! জানা গেলো, এটাই হাকালুকি হাওর । অতএব আমাদের পরিকল্পনায় যোগ হলো হাওর দর্শন । সিলেটে এসে হাওর না দেখে ফিরে যাবো? তা অয় না মিয়া । বড়লেখায় এক হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন নামলাম হাওরের পথে । বড়লেখা হতে সিএনজি ভাড়া করে যেতে হলো ঘন্টাখানেকের পথ । সেখানে নৌকা ভাড়া করে হাওরের ঘোলাজলে ভাসতে লাগলাম আমরা ।
জাফলং কতদূর?
পরবর্তী গন্তব্য জাফলং । দুপুরের পরপর সিএনজি নিয়ে জাফলং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম । কিন্তু কোথায় জাফলং? কতদূর ? জানা নেই । এবার আমাদের রাস্তা চেনানোর দায়িত্বভার চাপালাম গুগল ম্যাপের কাঁধে । দাসের হাট হয়ে বিয়ানীবাজার । সেখান থেকে দুবাগ, তারপর শাহবাগ । তারপর সুরমা ব্রীজ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম কানাইঘাট । ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায় । কানাইঘাটে খাওয়া দাওয়া করে শুরু হলো আরেক যাত্রা । পার্বতীপুর, দুর্গাপুর হয়ে গেলাম দরবস্ত বাজার । সেখান থেকে জৈন্তাপুর । জৈন্তাপুরে শুরু হলো সিলেটের চিরাচরিত ভর বর্ষণের রাত । এরইমধ্যে এলো জাফলং এর উদ্দেশ্যে রাতের সবশেষ বাস । উঠে পড়লাম আমরা । বাস চললো জাফলং এর উদ্দেশ্যে । রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ । বাইরে প্রবল বৃষ্টি, জানালা দিয়ে গায়ে লাগছে বৃষ্টির ছাট । গাড়ি দুলছে রোলার কোস্টারের মত । ভেতরে আমরা, যেন এগিয়ে যাচ্ছি অজানার উদ্দেশ্যে । অজান্তেই মনে এলো পুরনো সেই গান - এই পথ যদি না শেষ হয়... তবে কেমন হত... তুমি বলতো !! হঠাৎ মনে হলো- জীবনটা আসলে একেবারে মন্দ নয় !!
জাফলং এ ভোর
এই বৃষ্টির মাঝে একটা হোটেল খুঁজে বের করলাম । মামার বাজার । বিদ্যুৎ নেই । বেশ ঠান্ডাও পড়েছে । এরমধ্যে রাত কাটিয়ে সকালে উঠেই পায়ে হেঁটে চলে গেলাম জাফলং এ । পাথর উত্তোলনের মহাযজ্ঞ চলছে সেখানে । সামনে এগিয়ে একটা নৌকা নিলাম । ওপারে গিয়ে ঘন্টাখানেক পরে ফিরে এলাম এপারে । ফ্রেশ মাছ ভাজা হচ্ছিল তীরের এক ছাপড়া হোটেলে । গরম ভাত, টাটকা মাছ ভাজা আর কাঁচামরিচ । ভোজনটা হলো অমৃত সমান । পরবর্তী গন্তব্য সারিঘাট- লালাখাল ।
লালাখালে এক মধ্যাহ্ন !
সারি নদীর ঘাটে নেমে আমরা চললাম লালাখালে । বাহন – অটোরিক্সা । প্রবল বর্ষণে লালাখালের পানির স্বচ্ছতা অনেকাংশে কমে গেছে । লালাখাল আমাদের খুব একটা মুগ্ধ করতে পারলো না । এর আরেকটা কারণ হতে পারে- রাঙামাটি আর কাপ্তাইয়ের লেকে ঘুরে ঘুরে আমাদের নজরটা হয়ে উঠেছে নাকউঁচা । অতএব সময়ের বড় অংশটা কাটলো নাজিমগড় রিসোর্টে । ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল । আমাদের যেতে হবে আরো বহুদূর । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নেমেছে । আর বসে থাকা যায় না ।
গোয়াইন নদীর বুকে
সারিঘাট থেকে গেলাম গোয়াইনঘাটে । গন্তব্য রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট । সড়কপথে যাওয়া যায় । কিন্তু আমরা যাব নদীপথে । ঘাটে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে এক বিরাট ট্রলার ভাড়া পেলাম মাত্র ছয়শ টাকায় । মাত্র বলছি এ কারণে- প্রায় দুইশ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ট্রলারের ভাড়া কমপক্ষে এক দেড় হাজার টাকা হবার কথা । কিন্তু মাঝি যাবে বাড়িতে- সোয়াম্প ফরেস্টের পাশেই । আর আমরা হলাম তাঁর ফিরতিপথের যাত্রী । তখন পড়ন্ত বিকেল । গোয়াইন নদীতে এগিয়ে চলেছে ট্রলার । বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । কখনো কখনো তা রুপ নিচ্ছে মুষলধারায় । দুধারে বাড়িঘর । কাশবন । সবুজ তীর । কোথাও কোথাও ধানক্ষেত । কৃষকের কাঁধে ধান । খুঁটিতে বাঁধা গরু ভিজছে অবিরাম বর্ষণে । কিছু কিছু পাখি ফিরে যাচ্ছে নীড়ে । কতদিন দেখিনা নদী আর গ্রামের এই চিরায়ত দৃশ্য ! এতবড় নৌকায় মানুষ মাত্র পাঁচজন । দুজন মাঝি, আর আমরা তিন বন্ধু । নৌকার খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুচোখ ভরে দেখছিলাম তীরের মনোরম দৃশ্য । মনে হলো- কী দরকার ঢাকা চট্টগ্রামের ইট পাথরের মাঝে ফিরে যাওয়ার? এইখানে, কোন এক নদীর তীরে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে কতইনা ভালো হত ! আহা ! জীবন এখানে কত সুন্দর !
সোয়াম্প ফরেস্ট !
ঘন্টা দেড়েক লাগলো সোয়াম্প ফরেস্টে পৌঁছতে । বড় নৌকা ছেড়ে এবার নিতে হলো ছোট নৌকা । থই থই করছে পানি । গাছের অর্ধেকটা পানির নিচে । গাছ গাছালির ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট নৌকা । অজান্তেই মুখ হতে বেরিয়ে আসে ! অসসাধারণ ! আলহামদুলিল্লাহ ! গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তখনো পড়ছেই । এরইমধ্যে পৌঁছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে । ওয়াচ টাওয়ারেরও অনেকটা ডুবে গেছে পানিতে । মাঝি বললো- এতটা পানি নাকি কখনো থাকে না । পশ্চিম আকাশে লালচে সূর্য, যতদূর চোখ যায় পানি, আর পানিতে কোমর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারি । মিঠাপানির এমন বন পৃথিবীতে খুব বেশি নেই । শেষবেলায় পাখির কিচিরমিচির । পুরো পরিবেশটা যেন একটা অপার্থিব রুপ ধারণ করেছে ।
ফেরাঃ
বনে তো আর থাকা যায় না ! অতএব ফিরতেই হবে । নৌকা বেরিয়ে এলো বাইরে । গোয়াইন নদীতে । একটা সরু রাস্তার ধারে নামলাম আমরা । তারপর সিএনজি ভাড়া করে সোজা সিলেট শহরের উদ্দেশ্যে । রাতে খেলাম পাঁচভাই রেস্টুরেন্টে । আম্বরখানা থেকে শুরু করে জিন্দাবাজার মুর্দাবাজার – জামতলা তালতলা জল্লার পার কল্লার পার-মেডিকেল কলেজ রিক্সায় করে এক চক্কর দিলাম । হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন গেলাম শাহজালালের মাজার, শাহপরাণের মাজার, ঐতিহাসিক ক্বীন ব্রিজ। খাওয়া দাওয়া হলো নামকরা দুএকটি রেস্টুরেন্টে ।
ও হ্যা, বিছানাকান্দি আমরা যাই নি । কক্সবাজার সেন্টমার্টিনের প্রবাল দ্বীপ আর রাঙামাটি বান্দরবানের ছড়ায়-ঝর্ণায় ঘুরে বেড়ানো আমাদের কাছে বিছানাকান্দি খুব একটা আকর্ষণীয় কিছু মনে হয় নি । আর হামহাম যাবার মত সময় ছিলনা হাতে । ইচ্ছে ছিল ট্রেনেই ঢাকা ফিরবো । কিন্তু স্টেশনে গিয়ে দেখি সেদিনের কোন ট্রেন ঢাকা যাবে না । কী আর করা ! বাসের আসনে পিঠ এলিয়ে দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে । পেছনে পড়ে থাকলো সিলেট, মৌলভীবাজার । সাথে নিয়ে এলাম একরাশ সুখস্মৃতি ।
হাবিবুর রহমান একসময় নানারকম স্ট্যাটাস দিয়া ফেসবুক কাপাইতো। সমাজ
রাষ্ট্র ধর্ম সাহিত্য রাজনীতি সকল বিষয়ে ছিল তাহার একচ্ছত্র পদচারণা(পড়ুন-
আঙুল চালনা)। কেহই তাহার সাঁড়াশি আক্রমণ হইতে রেহাই পাইতো না। সমাজের সকল
অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সে ছিল সোচ্চার কন্ঠ (পড়ুন- কীবোর্ড)। অতঃপর
কীভাবে যেন কী হয়ে গেল, তাহাকে আর কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাচ্ছিলো না। কত
বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে ফেসবুকে ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু কোথাও তাহার জ্ঞানগর্ভ
মতামত পাওয়া যায় না। অবশেষে কৌতূহলী ফেসবুকারগন তাহার প্রোফাইলে ঢু মারিতে
বাধ্য হইলেন। তাহার সর্বশেষ আপডেট পাওয়া গেল কয়েক মাস আগেঃ "Got Married" :P:P #ফেসবুকারের_মহাপ্রয়াণ
কয়েকটা দিন এইখানেতে কাটিয়ে যাবো নিঃস্ব একা পথিক হয়ে- এইতো আমার ভবিষ্যতের মাস্টার প্ল্যান এই হচ্ছে এখন আমার, আকাশছোঁয়ার এম্বি-শান। কী করছি? কী খাচ্ছি? করছি কবে বিয়ে শাদী? হৃদয় জমিন, আর কতদিন, থাকবে এমন অনাবাদী? চাকরি বাকরি? পড়ালেখা? ডিগ্রী কিংবা ব্যবসাপাতি? কবে হবে বাড়ী- গাড়ি? টয়োটা বা ঘোড়া হাতি? রাতদুপুরে বসে বসে ঘরের দাওয়ায় প্রশ্নগুলো উড়িয়ে দিচ্ছি দখিন হাওয়ায় এসব এখন আমার কানে বিরক্তিকর কলের গান; কয়েকটা দিন এইখানেতে কাটিয়ে যাবো নিঃস্ব একা পথিক হয়ে- এটাই আমার ভবিষ্যতের মাস্টার প্ল্যান; এই হয়েছে এখন আমার, আকাশছোঁয়ার এম্বি- শান।
সকালবেলায় ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে হাজির আশরাফ । হঠাত
আশরাফের এই গৃহ প্রত্যাগমনে তাহার মাতা খুশি হইলেও পিতা খুশি হইতে পারিলেন
না । তিনি গম্ভীর হইয়া শুধাইলেনঃ
-কিরে, এইভাবে হঠাত চইলা আইলি যে? কয়দিন পর না তোর পরীক্ষা?
-বাড়িওয়ালা এক সপ্তাহের মধ্যে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছিল । আর নতুন কোন বাসাও ভাড়া পাই না । এখন কেউ 'ব্যাচেলর' রাখতে চায় না ।
-তাইলে এখন কী করবি?
-আমি আর কী করবো । তোমরাই চিন্তা কইরা দেখ কী করা যায় :):):)
ডাঃ রফিকের হাসপাতাল থেকে বের হবার কথা বেলা আড়াইটায়। এরপর তাঁকে ব্যাংকে যেতে হবে। জরুরী প্রয়োজনে টাকা ট্রান্সফার করতে হবে।
কিন্তু ঠিক বের হবার সময়টাতেই একসাথে তিনজন রোগী হাজির। এরমধ্যে দুজনের
অবস্থা খারাপ। অতএব তাঁর আর বের হওয়া হলো না। যখন বের হলেন তখন বেলা সাড়ে
তিনটা। ব্যাংকে গিয়ে পৌঁছলেন চারটার পর। তাঁকে বলা হলোঃ স্যরি, আজকের লেনদেন চারটায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আপনার ট্রানজেকশনটি সম্ভব নয়। কাল একবার আসুন। ২। কিছুদিন আগের কথা। ডাঃ রফিক গিয়েছিলেন এক সরকারি অফিসে, তাঁর এক বন্ধুর কাছে।
কথা ছিল দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করবেন। যখনই লাঞ্চ টাইম হলো, বন্ধুবর তার
সামনে বসে থাকা ব্যক্তিকে বসে থাকতে বলে সটান উঠে পড়লেন। টেবিলের ওপর ছড়ানো
ছিটানো অবস্থায় পড়ে থাকলো সকল কাগজপত্র।
সরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ। খুব মনোযোগ দিয়ে ওয়ার্ডে তার
দায়িত্বভুক্ত রোগী দেখছেন ডাঃ করিম। আজকের দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কাটবে।
কারণ, অনেক রোগী ভর্তি হয়েছেন গতকাল।
সবার হিস্ট্রি নেয়া, ফিজিকাল
এগজামিনেশান করা, ইনভেস্টিগাশান ও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করা, রোগীকে বুঝিয়ে
দেয়া- সব মিলে বেশ সময় সাপেক্ষ কাজ। আজকে পা ব্যথা হয়ে যাবে। একঘন্টা আগেই
শুরু করেছেন, কিন্তু এখনো অর্ধেক রোগী দেখা শেষ হয় নাই।
৩৯ নম্বর বেডের রোগীর হিস্ট্রি নেয়া শেষে চেস্ট অস্কালটেট করছিলেন ডাঃ করিম। কান থেকে স্টেথো নামিয়েই দেখলেন, একজন ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। - এক্সকিউজ মি ডক্টর, একটা প্রশ্ন করতে পারি? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন। -হ্যা, অবশ্যই। বলুন, কী জানতে চান? ডাঃ করিম ভাবলেন, নিশ্চয়ই ইনি এই রোগীর উদ্বিগ্ন স্বজন। হয়তো রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। তারপর যে প্রশ্নটা তাঁকে করা হলো এর জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তিনি 'থ' হয়ে গেলেন। -ডক্টর, এখানে টয়লেট টা ঠিক কোন দিকে বলতে পারেন? প্রশ্ন শুনে মাথা ভোঁ করে উঠলো ডাঃ করিমের। অনেক কষ্টে মেজাজ সামলে তিনি উত্তর দিলেনঃ -অহ! টয়লেট! সেতো আপনার মাথায়!!
"আমি মৃত্যুদন্ডের পক্ষে না", এটা কোন যৌক্তিক কথা হতে পারে না। আপনার
মৃত্যুদন্ডের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার কিছু নেই। আপনাকে ন্যায়বিচারের
পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। কেউ যদি অন্য কোন নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা
করে, এটা যদি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়, তাহলে আপনি কেন তার মৃত্যুদণ্ডের
পক্ষে থাকবেন না?
আপনি যদি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রমাণিত খুনি
অপরাধীর মৃত্যুদন্ড না দেন, তাহলে তো খুন হওয়া ব্যক্তির কোন স্বজন
প্রতিশোধপরায়ন হয়ে নিজেই খুন করতে উৎসাহিত হতে পারে। এভাবে সমাজে খুনোখুনি
একটা মামুলি বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
মূল কথা হলো, আপনাকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আইনের আপ্তবাক্য স্মরণ
রাখতে হবে- হাজার অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু একজনও নিরপরাধ ব্যক্তি যেন
কষ্ট না পায়। বেনেফিট অব ডাউট সবসময় অভিযুক্তের পক্ষে থাকতে হবে। তথ্য
যুক্তি সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির খুনী হওয়া নিঃসন্দেহে
প্রমাণিত হয়, তাহলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড হওয়াই মানবতার দাবী। ন্যায়বিচার
ছাড়া কাউকে যদি এক মিনিটও শাস্তি দেয়া হয় সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। কাউকে যদি
ভুল বিচারে যাবজ্জীবন সাজা দেন, এই বেঁচে থাকায় তার কী লাভ? সাজার পরিমাণ বা রুপ বড় কথা নয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই বড় কথা।
এই অস্থির সময়ের কোপানলে হারিয়ে যাচ্ছে সব সুকুমার বৃত্তি। কোমল আবেগ। সাহিত্যে এখন শুধুই দ্রোহের কথা উঠে আসে; মনে হয়- প্রেম নয়, এখন শুধুই যেন দ্রোহের সময়।।
এখন সময় শুধুই প্রতিবাদ প্রতিরোধ আর ট্যাংকের সামনে এসে বুক তুলে দাঁড়াবার।
এই অস্থির সময়ের কোপানলে হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা। মানবিক অনুভূতি। মনে হয়- আমিও হচ্ছি অমানুষ! আমারও চোখের তারায় ফুলের বদলে এখন ভেসে ওঠে নিহত শিশুর লাশ পাখির বদলে দেখি বোমারু বিমান আমারও কন্ঠে উঠে আসে কবিতার বদলে সব দৃপ্ত শ্লোগান। মনে হয়ঃ প্রেম নয়; এখন শুধুই যেন দ্রোহের সময়।। #অস্থির_সময়
নীলক্ষেত থেকে কিনেছিলাম নির্মলেন্দু গুণের "না প্রেমিক না বিপ্লবী"।
পুরনো বই। মলাট উল্টাতেই চোখে পড়লো মেয়েলি হাতের লেখা জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
জীর্ণ যাহা কিছু, যাহা কিছু ক্ষীণ জীবনের মাঝে হোক তা বিলীন ধুয়ে যাক যত পুরনো মলিন নব আলোকের স্নানে.... (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মালেকার জন্মদিনে- মিনা ০৪-০৮-৭২
বইটা কেনা হয়েছিল উদয়ন গ্রন্থ নিলয়, রাজশাহী থেকে। কে জানে আজ উদয়ন গ্রন্থ
নিলয় আছে কিনা! মালেকা কিংবা মিনা কেউ বেঁচে আছেন কিনা। কিন্তু বইটা আছে
আমার হাতে। এভাবেই সময় চলে যায়। এভাবেই জীবন চলে যায়।