ডাক্তারি একটা 'সম্মানজনক' পেশা, অতএব ডাক্তার হইতে হইবে। শিক্ষকতা একটি 'সম্মানজনক' পেশা, অতএব শিক্ষক হইতে হইবে। ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, ব্যাংকার, মিলিটারি কিংবা পুলিশ... যেকোনভাবে হোক, একজন 'অফিসার' হতেই হবে। 'সম্মানজনক' পেশায় নিয়োজিত থাকতে হবে।
এইযে এভাবে পেশার মধ্যে সম্মান অসম্মানের একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, সমাজের মধ্যকার বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শ্রেণী বৈষম্যের মূলে এইটা হলো একটা প্রধান কারণ। কেউ নিজেকে সম্মানজনক পেশার লোক ভেবে অহংকারী হয়, অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করে, আর কেউবা নিজের পেশাকে হীন ভেবে হীনম্মন্যতায় ভোগে। মনে আছে, একবার ক্লাসে একজন শিক্ষিকা 'তোমার বাবা কী করে' জিজ্ঞেস করায় আমার বন্ধু মাথা নিচু করে জবাব দিয়েছিলো- তিনি মুহুরি। উকিলের সহযোগী। তার কাছে বাবার পেশাটা হয়তো 'সম্মানজনক' ছিল না।
আসলে কি 'সম্মানজনক পেশা' বলে কিছু আছে? আমি মনে করি, পেশার সাথে সম্মানের কিছু নাই। পেশার কারণে কেউ সম্মানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। সম্মান আসে জ্ঞান, চরিত্র আর সততা থেকে।
আপনি একজন পুলিশ অফিসার, বা কাস্টমস অফিসার, বা যেকোন অফিসের একজন 'অফিসার'। আপনি দু'হাতে ঘুষ খান। মানুষ আপনাকে সম্মান করবে? নাহ। মানুষ হয়তো আপনাকে সামনাসামনি সমীহ করতে পারে- সেটা ভয় থেকে। ডাকাতের সামনে যদি কেউ হাতজোড় করে দাঁড়ায়, কেউ কি বলবে যে- সে ডাকাতকে সম্মান করছে? ব্যাপারটা সেরকম।
মানুষ আপনাকে ভয় করতে পারে, কিন্তু সম্মান করবে না।
মানুষ আপনাকে ভয় করতে পারে, কিন্তু সম্মান করবে না।
আপনি একজন শিক্ষক। কিন্তু আপনার জ্ঞান জোড়াতালি মার্কা, আপনি ভালো পড়াতে পারেন না, কিংবা পড়ান না-- ছাত্ররা আপনাকে সম্মান করবে? করবে না। তারা হয়তো পরীক্ষায় ফেলের ভয়ে আপনাকে তোয়াজ করবে, কিন্তু মন থেকে সম্মান করবে না। পরিমল বাবু একজন শিক্ষক ছিলেন, তাকে কি আপনারা সম্মান করেন?
আপনার চরিত্র যদি খারাপ হয়, আপনি যেই হোন- কেউ আপনাকে সম্মান করবে না। আপনি প্রেসিডেন্ট হলেও সম্মান পাবেন না, শিক্ষক হলেও না, অফিসার হলেও না।
আপনি ডাক্তার, রোগীর সাথে যদি ভালো ব্যবহার না করেন, শুধুমাত্র ডাক্তার হওয়ার কারণে কেউ আপনাকে সম্মান করবে? না। করবে না।
পেশার কারণে কেউ সম্মানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। পেশা হলো জীবিকা অর্জনের মাধ্যম মাত্র।
বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খেতে হয়, ভাত কাপড়ের দরকার হয়, থাকার জায়গা দরকার হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসা দরকার হয়। আমাদের ঘর বাড়ি রাস্তাঘাট পরিস্কার রাখতে হয়, আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ রাখতে হয়। আর এইসব কাজ আমরা মানুষেরা ভাগাভাগি করে করি। আমাদের খরচ নির্বাহ করি। এইটাই পেশা। এইখানে আলাদা করে সম্মান অসম্মানের কিছু নাই।
প্রত্যেকের জন্য রিযিক আছে, এবং সেটা কীভাবে আসবে তারও একটা পদ্ধতি আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারণ করা আছে। সেটারই নাম 'পেশা'। পরিবেশ পরিস্থিতি সময় ও প্রয়োজনের তাগিদে একেকজনকে একেক কাজ করতে হয়, একেকজন একেক কাজে পারদর্শী হয়, একেক জন একেক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
সৎ পথে, কাউকে না ঠকিয়ে, কারো সম্পদ লুট না করে, বৈধভাবে অর্জিত যেকোন জীবিকাই সম্মানের, যেকোন পেশাই সম্মানের। সবাইকে সবার প্রয়োজন হয়। কাউকে ছাড়া কারো চলে না।
ধরেন একজন মেথর, তো তার পেশাটাকে কি আপনি খুব অসম্মানজনক মনে করেন? যদি করেন, কেন? আপনার কি টয়লেট বাথরুম পরিষ্কার করতে হয় না? নিজেকে পরিষ্কার করতে হয় না? তখন কি আপনি অসম্মানিত হয়ে পড়েন?
নবী রাসুলগণ অনেকেই 'রাখাল' ছিলেন, সেটা কি কোন 'হীন' পেশা? অনেক মহামানব খুব সাধারণ কাজ করতেন। তারা কি পেশার কারণে মহান হয়েছেন? না, হয়েছেন তাদের জ্ঞান ও চিন্তাচেতনার কারণে। উত্তম ব্যবহারের কারণে। উত্তম শিক্ষার কারণে।
অর্থকরী পেশা মানেই সম্মানজনক পেশা নয়। পেশার কারণে কেউই সম্মানিত হয় না। মানুষ সম্মানিত হয় তার জ্ঞানে, তার সততায়, তার চরিত্রে, তার পরোপকারিতায়, ভালো ব্যবহারে, মহানুভবতায়। আর তাই, অর্থকরী পেশায় নিয়োজিত হতে পারাই জীবনের সফলতা হতে পারে না। সফলতা হলো সৎ, চরিত্রবান, জ্ঞানবান, পরোপকারী ও ভালো মানুষ হওয়া।
পেশা হলো জীবনধারণের প্রয়োজনে ব্যয় নির্বাহের মাধ্যম মাত্র, আর কিছু নয়। মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সব মানুষের মানবিক মর্যাদা সমান। পেশা যাই হোক তাতে আপনি খুব বড় কিছু বা খুব ছোট কেউ হয়ে যান না।