এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭

'সম্মানজনক পেশা' বলে কিছু আছে?

ডাক্তারি একটা 'সম্মানজনক' পেশা, অতএব ডাক্তার হইতে হইবে। শিক্ষকতা একটি 'সম্মানজনক' পেশা, অতএব শিক্ষক হইতে হইবে। ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, ব্যাংকার, মিলিটারি কিংবা পুলিশ... যেকোনভাবে হোক, একজন 'অফিসার' হতেই হবে। 'সম্মানজনক' পেশায় নিয়োজিত থাকতে হবে।
এইযে এভাবে পেশার মধ্যে সম্মান অসম্মানের একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, সমাজের মধ্যকার বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শ্রেণী বৈষম্যের মূলে এইটা হলো একটা প্রধান কারণ। কেউ নিজেকে সম্মানজনক পেশার লোক ভেবে অহংকারী হয়, অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করে, আর কেউবা নিজের পেশাকে হীন ভেবে হীনম্মন্যতায় ভোগে। মনে আছে, একবার ক্লাসে একজন শিক্ষিকা 'তোমার বাবা কী করে' জিজ্ঞেস করায় আমার বন্ধু মাথা নিচু করে জবাব দিয়েছিলো- তিনি মুহুরি। উকিলের সহযোগী। তার কাছে বাবার পেশাটা হয়তো 'সম্মানজনক' ছিল না।
আসলে কি 'সম্মানজনক পেশা' বলে কিছু আছে? আমি মনে করি, পেশার সাথে সম্মানের কিছু নাই। পেশার কারণে কেউ সম্মানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। সম্মান আসে জ্ঞান, চরিত্র আর সততা থেকে।
আপনি একজন পুলিশ অফিসার, বা কাস্টমস অফিসার, বা যেকোন অফিসের একজন 'অফিসার'। আপনি দু'হাতে ঘুষ খান। মানুষ আপনাকে সম্মান করবে? নাহ। মানুষ হয়তো আপনাকে সামনাসামনি সমীহ করতে পারে- সেটা ভয় থেকে। ডাকাতের সামনে যদি কেউ হাতজোড় করে দাঁড়ায়, কেউ কি বলবে যে- সে ডাকাতকে সম্মান করছে? ব্যাপারটা সেরকম।
মানুষ আপনাকে ভয় করতে পারে, কিন্তু সম্মান করবে না।
আপনি একজন শিক্ষক। কিন্তু আপনার জ্ঞান জোড়াতালি মার্কা, আপনি ভালো পড়াতে পারেন না, কিংবা পড়ান না-- ছাত্ররা আপনাকে সম্মান করবে? করবে না। তারা হয়তো পরীক্ষায় ফেলের ভয়ে আপনাকে তোয়াজ করবে, কিন্তু মন থেকে সম্মান করবে না। পরিমল বাবু একজন শিক্ষক ছিলেন, তাকে কি আপনারা সম্মান করেন?
আপনার চরিত্র যদি খারাপ হয়, আপনি যেই হোন- কেউ আপনাকে সম্মান করবে না। আপনি প্রেসিডেন্ট হলেও সম্মান পাবেন না, শিক্ষক হলেও না, অফিসার হলেও না।
আপনি ডাক্তার, রোগীর সাথে যদি ভালো ব্যবহার না করেন, শুধুমাত্র ডাক্তার হওয়ার কারণে কেউ আপনাকে সম্মান করবে? না। করবে না।
পেশার কারণে কেউ সম্মানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। পেশা হলো জীবিকা অর্জনের মাধ্যম মাত্র।
বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খেতে হয়, ভাত কাপড়ের দরকার হয়, থাকার জায়গা দরকার হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসা দরকার হয়। আমাদের ঘর বাড়ি রাস্তাঘাট পরিস্কার রাখতে হয়, আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ রাখতে হয়। আর এইসব কাজ আমরা মানুষেরা ভাগাভাগি করে করি। আমাদের খরচ নির্বাহ করি। এইটাই পেশা। এইখানে আলাদা করে সম্মান অসম্মানের কিছু নাই।
প্রত্যেকের জন্য রিযিক আছে, এবং সেটা কীভাবে আসবে তারও একটা পদ্ধতি আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারণ করা আছে। সেটারই নাম 'পেশা'। পরিবেশ পরিস্থিতি সময় ও প্রয়োজনের তাগিদে একেকজনকে একেক কাজ করতে হয়, একেকজন একেক কাজে পারদর্শী হয়, একেক জন একেক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
সৎ পথে, কাউকে না ঠকিয়ে, কারো সম্পদ লুট না করে, বৈধভাবে অর্জিত যেকোন জীবিকাই সম্মানের, যেকোন পেশাই সম্মানের। সবাইকে সবার প্রয়োজন হয়। কাউকে ছাড়া কারো চলে না।
ধরেন একজন মেথর, তো তার পেশাটাকে কি আপনি খুব অসম্মানজনক মনে করেন? যদি করেন, কেন? আপনার কি টয়লেট বাথরুম পরিষ্কার করতে হয় না? নিজেকে পরিষ্কার করতে হয় না? তখন কি আপনি অসম্মানিত হয়ে পড়েন?
নবী রাসুলগণ অনেকেই 'রাখাল' ছিলেন, সেটা কি কোন 'হীন' পেশা? অনেক মহামানব খুব সাধারণ কাজ করতেন। তারা কি পেশার কারণে মহান হয়েছেন? না, হয়েছেন তাদের জ্ঞান ও চিন্তাচেতনার কারণে। উত্তম ব্যবহারের কারণে। উত্তম শিক্ষার কারণে।
অর্থকরী পেশা মানেই সম্মানজনক পেশা নয়। পেশার কারণে কেউই সম্মানিত হয় না। মানুষ সম্মানিত হয় তার জ্ঞানে, তার সততায়, তার চরিত্রে, তার পরোপকারিতায়, ভালো ব্যবহারে, মহানুভবতায়। আর তাই, অর্থকরী পেশায় নিয়োজিত হতে পারাই জীবনের সফলতা হতে পারে না। সফলতা হলো সৎ, চরিত্রবান, জ্ঞানবান, পরোপকারী ও ভালো মানুষ হওয়া।
পেশা হলো জীবনধারণের প্রয়োজনে ব্যয় নির্বাহের মাধ্যম মাত্র, আর কিছু নয়। মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সব মানুষের মানবিক মর্যাদা সমান। পেশা যাই হোক তাতে আপনি খুব বড় কিছু বা খুব ছোট কেউ হয়ে যান না। 

মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০১৭

নারীদের মসজিদে যাওয়া কতটা জরুরী?

ঈদের জামাতে মহিলাদের অংশগ্রহণের সুযোগ আছে কোথাও? বাংলাদেশের কোন ঈদগাহে কি মহিলারা অংশ নেন? আমার জানা নাই। আর উত্তরটা সম্ভবত 'না'। কীভাবে মেয়েদেরকে ধর্মের কাজ থেকেও দূরে রাখা হয়েছে এইটা হলো তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আর এর কারণ হলো আমাদের দেশের, বলতে গেলে এই উপমহাদেশের আলেম-ওলামাদের অতিবুযুর্গীপনার নামে নারীদের বঞ্চিত করার বিশেষ প্রবণতা।
অথচ আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মহিলাদের ঈদের জামাতে অংশ নিতে জোর তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি যেসময় নারীদের জন্য নামাজ পড়াই নিষিদ্ধ, সে অবস্থায়ও তাদের ঈদগাহে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। যাদের ওড়না নেই, তাদেরকে অন্য বোনের ওড়না ধার করে নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল।
দেশের কতগুলি মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা আছে? প্রাত্যহিক নামাজ তো দূরের কথা, জুমার নামাজেও তাদের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ কোথাও আছে কি? নেই।
কেন নেই? রাসুলের সময় যেখানে নারীরা ফযর এবং এশার নামাজও মসজিদে গিয়ে পড়তে পারতেন, আজ কে এমন বুজুর্গ হলো যে নারীদের মসজিদে যাওয়াই বন্ধ করে দিলো? খুবই আশ্চর্যের কথা, কোন কোন মসজিদে নাকি এরকমও লেখা থাকে- মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ!!
জাতি হিসেবে মুসলিমদের দুরবস্থা বা অধঃপতনের কারণ হিসেবে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। আমি এই দুরবস্থার পেছনে দায়ী করি মুসলিম নারীদের মসজিদ বিমুখ করে রাখাকে। মসজিদ থেকে দূরে রাখাকে।
এজন্য কোন গুরুতর তত্ত্বীয় আলোচনার প্রয়োজন নেই। কমনসেন্স এপ্লাই করাই যথেষ্ট।
মুসলিম সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। মসজিদে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় এই অর্ধেক সংখ্যক মুসলিম ইসলামের শিক্ষা পাচ্ছেন না। কোন একটা জনগোষ্ঠির অর্ধেক মানুষকে জ্ঞানহীন রেখে কীকরে একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করা সম্ভব?
পুরুষেরা মসজিদে গিয়ে কিছু হলেও ধর্মীয় আলোচনা শুনতে পারে, মসজিদের এইসব আলোচনা থেকে তারা ইসলাম সম্বন্ধে কিছুটা হলেও জানার সুযোগ পায়। যদিও কাজের ব্যস্ততায় তারা অনেকেই সে সুযোগ নেয় না। আমাদের দেশের মেয়েরা ধর্মীয় আলোোচনা শোনার কোন সুযোগই পায় না। সাংসারিক কাজ শেষে সারাদিন বাড়ীতে বসে থাকা ছাড়া সময় কাটানোর অন্য কোন সুযোগ তারা পায় না।
যারা মেয়েদের সিরিয়াল দেখা নিয়ে কটাক্ষ করেন, হাসি তামাশা করেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেন- আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, সিরিয়াল না দেখে তাদের উপায়টা কী? ঘরে বসে তারা করবেটা কী সারাটা দিন?
বাচ্চাদের প্রথম শিক্ষক হলো মা। সেই মায়েরাই যদি থেকে যায় জ্ঞানহীন, তারাই যদি থেকে যায় ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন, তাহলে বাচ্চাদের ধর্ম ও চরিত্রের শিক্ষা দেবে কে? দিনকে দিন সমাজে যে ধর্মীয়ভাবে উদাসীন একটা ডিজুস প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এর একটা কারণ হলো মায়েদের জ্ঞানশুন্যতা। মায়েরা নিজেরাই যেখানে জ্ঞান রাখে না সেখানে তারা বাচ্চাদের কী শেখাবে?
মায়েরা মসজিদে গেলে ছোট বাচ্চারা মায়ের সাথে মসজিদে যেতে অভ্যস্ত হবে। বাচ্চারা যদি ছোট থেকেই ধর্মীয় অনুশাসন, সততা, ন্যায়, আর উত্তম চরিত্রের শিক্ষা পায়, তবেই একটা সুস্থ সুন্দর প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। যারা সমাজটাকে সুন্দর করবে, দেশকে সুন্দর করবে।
মুসলিম নারীদেরকে ধর্ম সম্বন্ধে জানার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশের সব/বেশিরভাগ মসজিদেই মহিলাদের জন্য স্থান রাখা দরকার। পাশের বাসার ভাবীদের সাথে গীবত পরনিন্দা আর চোগলখুরির আসর বসানোর চাইতে তাদের মসজিদে যাওয়া ভালো না?
যারা বলতে চান যে, এই ফেতনার যুগে মহিলারা মসজিদে গেলে ফেতনা/বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে, ফেতনা বৃদ্ধি পাবে, তারা বোকার স্বর্গে আছেন।
ভাইসাব, নারীদের মসজিদ থেকে দূরে রেখে কি ফেতনা বন্ধ করতে পারছেন? নাকি ফেতনা বাড়াচ্ছেন? নারীরা স্কুলে কলেজে ভার্সিটিতে বাজারে সবখানে যেতে পারবে, শুধু মসজিদে গেলেই ফেতনা?
দুনিয়ায় ফেতনা সৃষ্টির জন্য শয়তানের একটা প্রধান মাধ্যম হলো নারী। আর তাদেরকেই যদি ধর্মানুরাগী, ধর্মের বিধিবিধান অনুসারী না বানাতে পারেন, তাহলে তো ফেতনা বাড়তেই থাকবে। মহিলারা মসজিদে যাওয়া আসা করলেই বরং ফেতনা বন্ধ হবে। সমাজে বিশৃংখলা কমবে।
কবি বলেছিলেন, দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? আপনারা অন্ধকারের ভয়ে দরজা বন্ধ করতে চান, এদিকে আলো ঢোকার পথটাই যে বন্ধ করে দিয়েছেন সে খেয়াল নেই। মক্কা মদীনায় যে নারীরা মসজিদে নামাজ পড়ছে, সেখানে কি খুব ফেতনা হচ্ছে?
ইবনে উমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন- “নারীদেরকে তাদের মসজিদে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না।”
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) এর ছেলে বিলাল একবার বলেছিলেন- 'আল্লাহর কসম আমি তাদেরকে (নারীদেরকে) অবশ্যই নিষেধ করব।'
কথিত আছে যে, ইবনে উমর (রাঃ) নাকি ছেলের এমন কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে থাপ্পড়ই মেরে বসেছিলেন!!!!

শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭

মেকাপের সং সেজে লাভ কী?

বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে সবাই একবার 'বৌ' দেখার চেষ্টা করে। খাওয়া দাওয়ার পর অনেকেরই মনে হয় 'বউডা দেইখ্যা যাই'!
আমার এ বদভ্যাস নেই, সচেতনভাবেই আমি এরকম কিছু থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। পর্দার ব্যাপারে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে। তাছাড়া, একজন মানুষ সেজেগুজে বসে আছে, আর চেনা অচেনা সবাই তাকে দেখতে আসছে, নিচুস্বরে কমেন্ট করছে, বিষয়টা আমার কাছে রুচিকর মনে হয় না। যে 'বৌ' দেখার জন্য লোকজন ভীড় করে, তার মানসিক অবস্থাটাই বা কেমন থাকে? কে চায় প্রদর্শনীর বস্তু হতে? একের পর এক চেনা অচেনা লোকেরা আমার 'চেহারা' দেখতে আসছে, ভাবলেই তো শরীর গুলিয়ে আসে।
যাহোক, বিষয় সেটা না। বিষয় হলো, সেদিন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে কণের সামনে পরে গেলাম। বর-কণে দুজনেই সেজেগুজে বসে আছে, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও সেখানেই। তাছাড়া বর যথেষ্ট নিকটজন, তার সাথে কুশল বিনিময় করতেই হলো। পাশেই যেহেতু 'বৌ' বসা, সুতরাং এইবার চোখ রক্ষা করা গেলো না। তবে, খুশির(!) খবর হলো, মুখোমুখি হলেও এবারও কণের মুখ দেখতে হলো না। কারণ, মুখে এত পরিমাণ ময়দা মেখেছে যে স্কিনের ওপর একটা আলাদা স্তর হয়ে আছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো। এ যেন মুখ নয়, ময়দার মুখোশ।
এইভাবে মেকাপ দিলে কারোই আসল চেহারা বোঝা সম্ভব না। আমি নিশ্চিত, এই মেয়েকে পরে কখনো দেখলেও চিনতে পারবো না।
আশ্চর্য হলাম এই ভেবেঃ মেয়ে তো যথেষ্টই উচ্চশিক্ষিত; কিন্তু তার মানসিক উন্নতি এখনো ময়দার লেভেল অতিক্রম করে নাই।
(বৌ-দর্শকদের আমি খুব একটা দোষ দিচ্ছি না। কারণ, আপনি যদি সঙ সেজে বসে থাকেন, তাহলে কৌতূহলী দর্শক ও সমালোচকের অভাব কখনোই হবে না। ইহা বাঙালির মজ্জাগত অভ্যাস। সামান্য বানরের নাচও বাঙালি উপেক্ষা করতে পারে না।)
২.
বিয়ের মেকাপের নামে সঙ সাজাটা কীভাবে কীভাবে যে বিয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, কে জানে!!! পুরুষের কথাই ধরি। তারা সাধারণ পোষাক বাদ দিয়ে এক ধরণের মোটা কাপড় পরে, যার নাম দেয়া হয়েছে 'শেরওয়ানি'। যতদূর জানি, শের মানে বাঘ। তার মানে কি শেরওয়ানি পরে বিয়ের দিনে বাঘ হবার চেষ্টা? শোনেন পুরুষ ভাই, মনে বিড়াল হলে বাঘের চামড়ায়ও কিছু আসে যায় না। শেরওয়ানি কোনছাড়!!!
শেরওয়ানির দামও কম না। দশ হাজার থেকে শুরু করে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকাও আছে। আরো বেশিও থাকতে পারে। (আমি গরীব মানুষ, এতকিছুর খবর জানি না।)
তো, আমার কাছে এগুলো স্রেফ ভড়ং মনে হয়। পুরোটাই অপচয়। এই শেরওয়ানি আর কোনদিন গায়ে দিয়ে কোথাও যেতে পারবেন? শেরওয়ানি পরে বাসায় ঘুমাতে পারবেন? অফিস করতে পারবেন?
নো ইউজ। আসলে তো আপনি বিড়াল, তাহলে কেন এই শের হবার ভড়ং? মনে বাঘ হলে ছুড়ে ফেলে দিন অহেতুক অপচয়ের এই সংস্কৃতি। মেয়ে যেমন ময়দা মেখে সঙ সেজেছে, আপনিও শেরওয়ানি গায়ে একধরণের সঙ সেজেছেন।
বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন এইভাবে ময়দার প্রলেপ মেখে আর শেরওয়ানি গায়ে দিয়ে সঙ না সাজলে কি চলে না? কেন, সাধারণ শার্ট প্যান্ট বা পাজামা পাঞ্জাবিতে সমস্যা কী?
বিয়ে তো হয়েই গেল, মেকাপের মেকি রুপ দিয়ে আপনি আর কাকে ভোলাতে চান?
(বিবাহ কথন-২৮) চলবে...

রবিবার, ১৮ জুন, ২০১৭

পাগলের চোখে জল!

পাড়ার সবাই তাকে অনেকটা পাগলই মনে করতো...নাম তার আশেক। ঘর সংসারের কিছু সে বোঝে বলে আমরাও ভাবিনি। বাপের সাথে নদীতে মাছ ধরে, বাপের সাথে বাজারে যায়। বয়স যখন ১৮ কি ২০, হুট করে একদিন তার বিয়ে হয়ে গেল।
মাস ছয়-সাত পরের ঘটনা। বিকেল বেলায় ঘরে বসে একটা গল্পের বই পড়ছি। আঙিনায় আম্মার সাথে চাচীরা গল্প করছেন। সবার ভেতর বেশ চাপা উত্তেজনা। আশেকের বউয়ের নাকি এবরশন হয়ে গেছে। তার চেয়ে আশ্চর্যের কথা শুনলাম, এবং আমি নিজেও গিয়ে দেখলাম মরা বাচ্চাটা কোলে নিয়ে হুহু করে কাঁদছে পাগলাটে আশেক!!!
সবার মত আমিও খুবই অবাক হয়ে গেলাম। এবরটেড একটা বাচ্চার জন্য... পাগলের চোখে জল... ইজ ইট ফাদারস লাভ?
বুঝলাম, টু বি এ ফাদার, মে বি দেয়ার ইজ সামথিং এক্সট্রাওর্ডিনারি ফিলিংস ইনডিড...
২.
মোজাম্মেল সাহেবের সাথে তার ছেলেদের সম্পর্ক ভালো ছিলনা। প্রায়ই দেখা যেত ও বাড়িতে হৈ চৈ লেগে আছে। ছেলেদের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। গায়ে হাতও তুলতেন। ছেলেরা কান্নাকাটি করতো, ঘর ছেড়ে বেড়িতে যেত... এসব কিছুই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
সেদিন মোজাম্মেল সাহেব তার অফিসের কাজে দূরে কোথাও গিয়েছেন। এদিকে তার এক ছেলে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। রাতে মোজাম্মেল সাহেব বাড়িতে ফিরলে তাকে খবরটা জানানো হলো।
তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে হুহু করে কাঁদতে লাগলেন। দরজার বাইরে থেকে অবাক বিস্ময়ে আমরা তার কান্নার চাপা শব্দ শুনতে পেলাম।
৩.
সিনিয়র কলিগ বলছিলেন, বাবা হও তখন বুঝবা, বাচ্চা কী জিনিস!! বাচ্চাটা যখন কাঁদে, তখন আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। কি ঘুম, কি কাজ... কোনকিছুই ঠিক থাকে না।
বেকায়দা প্রশ্ন করা আমার বদভ্যাস। আমি প্রশ্ন করে বসলামঃ ভাই, ধরেন আপনি ঘুমাচ্ছেন। পাশের বাসার বাচ্চাটা খুব কাঁদছে। তখন তার জন্যও কি আপনার খুব মায়া হয়?
বড় ভাই বললেন, না। তখন বিরক্ত লাগে। আসলে নিজের বাচ্চার জন্য যে অনুভূতি, অন্যের বাচ্চার ক্ষেত্রে সেরকম না। এটা এমন এক ধরণের ভালোবাসা, যা আল্লাহ বিশেষভাবে বাবাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দেন।
৪.
বাবারা সন্তানদের ভালোবাসেন। কিন্তু তারা সেটা বোঝাতে পারেন না। মায়ের চেয়ে বাবার সাথেই কেন যেন দূরত্বটা বেশি থাকে। একটা কারণ হলো, বাবারা বাচ্চাদের সাথে বেশি সময় কাটান না। আর যতক্ষণ থাকেন শুধুই শাসন করেন। একটা সময় তারা হয়ে ওঠেন শুধুই ডিক্টেটর। শুধুই মানি সাপ্লায়ার।
অনেকেই ভালোবাসার বদলে সব সময় একনিষ্ঠ আনুগত্য চান। অনেকেই ছেলেমেয়েদের মনে করেন নিজস্ব 'সম্পত্তি'। তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করতে চান না। তাদের চিন্তাভাবনাকে মোটেও আমলে না নিয়ে, আলোচনার বদলে সবখানেই নিজের সিদ্ধান্তটা চাপিয়ে দিতে চান।
ফলে বাবাদের সাথে সন্তানের তৈরি হয় অদৃশ্য দেয়াল, অনেক দূরত্ব।
এটা ভুল। এটা ক্ষতিকর।
যারা বাবা হয়েছেন, সন্তানদের সাথে মিশুন। তাদেরকে সময় দিন। Be a friend of your child... Let them feel the love you bear for them...
সন্তানদের সৎ, চরিত্রবান ও মানবিক হিসেবে গড়ে তুলুন।
অন্যথায় সে হয়তো বড় অফিসার হবে, কিন্তু আপনাকে রেখে আসবে কোন এক 'ওল্ড হোমে'। এরকম 'বাবা দিবস' গুলোয় হয়তো আপনাকে দিয়ে আসবে কিছু ফুল।
অখন্ড অবসরে তখন আপনার সম্বল হবে কিছু অশ্রুবিন্দু।

শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭

ডাক্তারদের বিয়েঃ দিন বদলাচ্ছে দ্রুতই...

একটা সময় ছিল যখন একজন ডাক্তারের পরিবার মানে ধরেই নেয়া হত- স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার। ডাক্তার বিয়ে করবে ডাক্তারকে... এটা যেন হয়ে উঠেছিল স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু দিন পাল্টাচ্ছে। এখন ডাক্তাররা-- বিশেষ করে ডাক্তার ছেলেরা অনেকেই অন্য পেশার/সাবজেক্টের মেয়ে বিয়ে করছে। অনেকেই পাত্রীর ক্রাইটেরিয়া থেকে বাদ দিচ্ছে 'ডাক্তার'কে। কখনো ডাক্তার মেয়ে এবং তাদের গার্জিয়ানদের প্রতি বিরক্ত হয়ে, কখনো জীবনকে সহজ করার ইচ্ছায়।
তার মানে, ডাক্তার পাত্রদের মূল্য অনেকটা অপরিবর্তিত থাকলেও পাত্রী হিসেবে ডাক্তার মেয়েদের দাম কমেছে। অন্তত ডাক্তার ছেলেদের কাছে।
আর এই ট্রেন্ডটা এখনো ধরতে না পারায়, নিজেকে 'অমূল্য' ভেবে বসে থেকে থেকে অনেক ডাক্তার মেয়েই শেষ পর্যন্ত এখন আর খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের কাঙখিত 'ডাক্তার' পাত্র। বয়স হয়েছে, কিন্তু অবিবাহিত- এমন ডাক্তার মেয়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। একজন ভাই জানালেন, সম্প্রতি তার কাছে ৭-৮ টি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে যেখানে সবক্ষেত্রেই মেয়েরা তার চেয়ে দুই তিন ব্যাচ সিনিয়র!!
ছেলের বাপ-মায়েরা ছেলেকে মেডিকেলে পড়ায় পেশা বা জীবিকার প্রয়োজনে। আর (দুষ্ট লোকেরা বলে) মেয়েদের নাকি পড়ানো হয় ভালো পাত্র পাবার জন্যে। (চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রচুর মেয়ে দরকার সেটা অস্বীকার করছি না, আমি শুধু প্রচলিত মানসিকতাটা তুলে ধরছি।) তো, একটা মেয়ে যখন মেডিকেল স্টুডেন্ট, তখন গার্জিয়ানরা ভাবেন- এখন আবার বিয়ের কথা কেন? ডাক্তার হোক, তখন আমার মেয়ের 'দাম' আরো বাড়বে!! এরপর যখন মেয়ে সত্যি সত্যি ডাক্তার হয়ে যায়, তখন গার্জিয়ানরা ভাবেন- আরে আমার মেয়ে তো 'ডাক্তার'!! এখন আমার মেয়ের জন্যে কত প্রস্তাব আসবে!! প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, প্রেসিডেন্টের নাতি!!
কোটিপতি বাবার একমাত্র ছেলে, সুদর্শন, নামাজী, ভদ্র, ডাক্তার ছাড়া মেয়ের বিয়া দিমু না। মেয়ে কি গাঙ্গের জলে ভাইস্যা আইছে? (এইটা সম্ভবত সর্বাধিক উচ্চারিত সংলাপ) আরে আমার মেয়ে তো 'ডাক্তার'!!!
কোন কোন মেয়ে নিজেও হয়তো একইরকম স্বপ্ন দেখে থাকে।
কিন্তু বাস্তবতা সেরকম হয় না। কারণ, ডাক্তার ছেলেদের শুরুটা হয় মারাত্মক স্ট্রাগলিং। পাশ করা মাত্রই তারা চেম্বারে বসে লাখ লাখ টাকা কামায় না। এমবিবিএস পাশ করে তাকে আবার নাক ডুবিয়ে পড়তে হয়। বিনা পয়সায় ট্রেনিং করতে হয়। আর নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটা চাকরি করতে হয়, যেটার বেতন তার পরিশ্রমের তুলনায় খুবই নগন্য, এবং তার সমপর্যায়ের অন্য যেকোন অফিসের কর্মচারীর তুলনায় কম।
আমার কাছের একজন ভাই, সে ধনী বাবার ছেলে, ডাক্তার, এমডি কোর্সেও ঢুকেছে। মেয়ের গার্জিয়ানরা নাকি তাকে রিজেক্ট করেছে- 'বিসিএস নাই' বলে!!! আবার আরেক বন্ধু, সে ডাক্তার, বিসিএস ক্যাডারও। তাকে নাকি রিজেক্ট করা হয়েছে 'বড় ডিগ্রী নাই' বলে!!! অদ্ভুত বটে। আরেকজন ছোটভাই, সম্প্রতি ইন্টার্নশিপ শেষ করেছে। এখনো বিসিএস বা ডিগ্রী কোনটাই হয়নি। তাকে বিয়ের আলাপের শুরুতেই-- বলা চলে 'স্ক্রিনিং টেস্টেই' আউট করে দেয়া হচ্ছে।
তারা সব চায়, সব। পরে হলে হবে না, এখনি থাকতে হবে। ছেলের বয়স হতে হবে তিরিশ, ডেজিগনেশন হবে 'প্রফেসর', ব্যাংকে থাকবে কোটি টাকার ব্যালেন্স!!! (ওয়াল্ট ডিজনীর এনিমেশন ছাড়া এরকম ক্যারেক্টার বানানো সম্ভব কিনা আমার জানা নাই।)
আমার কাছে এখন ডাক্তার ভাই বন্ধু জুনিয়ররা কেউ পরামর্শ চাইলে বলি- ভাই, গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসো। ডাক্তার পাত্রী দেখতে পারো, তবে নিজেকে এই গন্ডিতে আটকে রাখার দরকার নাই। নিজের পরিধি বাড়াও। মেয়ে যে সাবজেক্টেই পড়াশোনা করুক- চরিত্র ও অন্যান্য দিক ঠিক থাকলে এগিয়ে যাও। তোমার ক্যারিয়ারে তো কোন সমস্যা হবেই না, হয়তো সংসারটা হবে আরো অনেক বেশি গোছানো। আমার ভাই বন্ধু পরিচিত যারা নন-ডাক্তার বিয়ে করেছে- As far I know, they are not unhappy...
একজন ডাক্তার মেয়ের জন্য অন্য পেশার হাজব্যান্ডের সাথে খাপ খাওয়ানো যতটা কঠিন, ডাক্তার ছেলের জন্য মোটেও সেরকম না। বউ সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি করবে, নন ডাক্তার কোন হাজব্যান্ড সেটা কখনোই 'খুশিমনে' মেনে নেয়ার কথা না। সেক্ষেত্রে একজন ডাক্তার মেয়ের ক্যারিয়ারটা হয়তোবা আর সেভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব না।
ডাক্তার ছেলেদের ক্ষেত্রে এরকম কোন সমস্যা নেই।
সো, ডিয়ার ডক্টর ভাই-বেরাদরস, ডাক্তার পাত্রীর গার্জিয়ানদের এত তেলানোর কিছু নাই। তারা অপেক্ষা করতে থাকুক। তোমরা তোমাদের মত এগিয়ে যাও।
আর হ্যা, সিনিয়র ডাক্তার পাত্রী বিয়ে করতে চাইলে- করতে পারো। আমি নিশ্চিত, এতদিনে তাদের চাহিদা আকাশ থেকে মাটির কাছাকাছি নেমে এসেছে।

রবিবার, ১১ জুন, ২০১৭

কম আর পরিমিত রিযকই সর্বোত্তম

হযরত আলী(রাঃ) একবার মসজিদে নামাজ পড়তে ঢোকার সময় দেখলেন একটা বাচ্চা ছেলে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ছেলেটাকে ডেকে বললেন- বাপু তুমি আমার বর্মটা কিছুক্ষণ রাখো, নামাজ শেষে আবার নিয়ে নেবো।
হযরত আলী (রাঃ) নামাজ শেষে ফিরে দেখলেন ছেলেটি তার জায়গায় নেই। আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পেলেন না। পরে বাজারে গেলে তাঁর চোখে পড়ে, এক দোকানে তাঁরই বর্মটি বিক্রির জন্য রাখা আছে। তিনি দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন- এই বর্ম কোথায় পেলেন? দোকানি বললো- এক বাচ্চা ছেলে বিক্রি করে গেছে। হযরত আলী জানতে চান- এটাতো আমার বর্ম, সে কত টাকায় বিক্রি করেছে? দোকানি জানায়- মাত্র ২ দিরহাম।
হযরত আলী আফসোস করে বললেন, "আহা! আমি তাকে ঠিক দুই দিরহামই বখশিস দেয়ার ইচ্ছা করেছিলাম। সে যদি আর কিছুক্ষণ দাঁড়াতো, তাহলে সে চুরি না করেই দুই দিরহাম পেয়ে যেত।"
রিযিকের জন্য আমরাও এরকম অধৈর্য হয়ে যাই। বৈধতা অবৈধতার তোয়াক্কা করি না। অথচ প্রত্যেকের জন্য আল্লাহ তায়ালা রিযিক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যার জন্য যতটুকু রিযিক বরাদ্দ করা হয়েছে, তার একবিন্দু পরিমাণ বাকি থাকতে কেউ মৃত্যুবরণ করবে না।
রিযিক নির্দিষ্টই। তবে একজন মানুষ সেটা বৈধ (হালাল) ভাবে উপার্জন করবে, নাকি অবৈধ (হারাম) ভাবে উপার্জন করবে সেটাই তার জন্য পরীক্ষা। কেউ ঐ ছেলেটির মত চুরি করে ২ দিরহাম আয় করতে পারে, আবার কেউ আরেকটু অপেক্ষা করে ২ দিরহাম বখশিসও পেতে পারে।
২.
সম্পদের পরিমাণের ওপর আমরা একজন মানুষের সাফল্য ব্যর্থতা নির্ণয় করি। আমাদের সমাজের চোখও এভাবেই বিচার করে। আরে অমুকে তো এই সেই করে ফেললো, গাড়ি কিনলো, ফ্ল্যাট কিনলো, এত টাকা তার পার মান্থ ইনকাম-- বলতে বলতে আমাদের চোখ চকচক করে ওঠে। অথবা হতাশায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
কিন্তু ধন সম্পদ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে দেন। এটা কারো যোগ্যতা অযোগ্যতার ওপর নির্ভর করেনা। আবার ধন সম্পদ কারো সাফল্য ব্যর্থতার মাপকাঠিও নয়। আমরা আমাদের আশেপাশে তাকালেই এটা বুঝতে পারবো। অনেক মানুষকেই দেখি- যার খুব বেশি জ্ঞান বা যোগ্যতা নেই। কোন বিষয়ে মতামত দিতে বললে কিছু বলতে পারেনা, কোন মজলিশে কথা বলতে দিলে থতমত খেয়ে যাবে, কাজেকর্মেও খুব একটা পটু নয়- অথচ তার ধন সম্পদ অনেক। আবার অনেক অনেক জ্ঞানী, যোগ্য, দক্ষ লোকও অভাবে দিন কাটান।
পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক মহামানব না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন, ছিন্ন বস্ত্র পরিধান করেছেন, জীর্ণ কুটিরে রাত কাটিয়েছেন। আবার অসংখ্য নরাধম নরপশু জীবন কাটিয়ে গেছে প্রাচুর্যের সমূদ্রে।
কেউ কেউ উত্তরাধিকার সূত্রেই অনেক সম্পদের মালিক হয়, আবার কেউ কেউ অনেক কষ্ট করেও সম্পদশালী হতে পারে না। কেউ সামান্য ব্যবসা থেকেই ফুলে ফেঁপে ওঠে, কেউবা ব্যবসায় নেমেই দেউলিয়া হয়ে যায়।
আল্লাহর একটি নামই হলো- আর রাজ্জাক। তিনিই রিযিকদাতা।
হাদীসে আছে, মায়ের পেটে ভ্রুণের ৪ মাস বয়স হলে আল্লাহর নির্দেশে একজন ফেরেশতা প্রত্যেকের জন্য চারটি বিষয়ে তাকদীর নির্দিষ্ট করে দেন। তার মধ্যে একটি হলো রিযিক।
"আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক প্রশস্ত করে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছা সীমিত করে দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।" (সূরা আনকাবুত:৬২)
৩.
আমরা কতটুকু খাই? কতটা কাপড় হলে শরীর ঢাকা যায়? আমাদের থাকার জন্য কতটুকু জায়গা প্রয়োজন? খুব বেশি নিশ্চয়ই নয়!! কারণ, মানুষের পেটের ধারণক্ষমতা যেমন অসীম নয়, শরীরের আয়তনও তেমনি সীমাবদ্ধ।
অথচ তবু আমরা অল্প সম্পদে সন্তুষ্ট হতে পারি না। বেশি সম্পদের জন্য কত প্রতিযোগিতা!! ধন-সম্পদের পেছনে কত ছোটাছুটি!! সম্পদের জন্য কত হানাহানি।
তাছাড়া, অতিরিক্ত সম্পদ মানেই কঠিন পরীক্ষা। আবার অনেক কম সম্পদও একটা পরীক্ষা। এই দুই অবস্থাতেই মানুষ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা কখনো বেশি সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন, কখনো অভাব দিয়ে পরীক্ষা করেন।
হযরত ওমর (রাঃ) তাই সবসময় দোয়া করতেন- ইয়া আল্লাহ! আমাকে যেন এত বেশি সম্পদ না দেন যাতে আমি সীমালংঘন করে বসি, আবার এত কম যেন না দেন যাতে কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হতে হয়।
কম আর পর্যাপ্ত রিযকই হলো মানুষের জন্য সর্বোত্তম।

বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

স্বাধীন হয়েছি, গোলামী ছাড়ি নাই

প্রতিবার বিসিএস এর গেজেটের পর দেখা যায়, বিসিএস এর প্রিলিমিনারী, লিখিত, ভাইভা সকল ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্মকমিশন(পিএসসি) কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হবার পরেও অনেকেই চূড়ান্ত গেজেটে বাদ পড়ছেন। তাদেরকে 'বাদ দেয়া' হচ্ছে। গত তিন বিসিএস থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত ২৮১ জনকে চূড়ান্ত গেজেটে বাদ দিয়ে নিয়োগবঞ্চিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ৩৫ তম বিসিএস এও বাদ দেয়া হয়েছে পিএসসির সুপারিশকৃত শ'খানেক প্রার্থীকে।
বাদ দেয়া হয় মূলত পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে। এইটা একটা চরম হাস্যকর ব্যাপার যে, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন থেকে পাস করে, লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর ভেতর থেকে ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ন যারা, তাদের চাকরি দেয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নেয় কিনা থানার একজন এসআই অথবা ওসি!! সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এতে পিএসসির অপমান হয় কিনা তা আমার জানা নাই। পিএসসি মানী প্রতিষ্ঠান, জুতা দিয়ে পেটালেও বোধহয় তার মান যায় না।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বিদগ্ধ প্রফেসররা ভাইভা নিয়ে যাদের ক্লিয়ারেন্স দেন, তাদের আটকে দেয় কিনা থানার এসআই!!! কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়, ও ভাইরে!!
এবার যেটা হয়েছে সেটা ভয়ংকর, জঘন্য। প্রার্থীর নিজেরসহ তার বাবা মা ভাই বোন চাচা মামা খালু নানা দাদা সবার রাজনৈতিক পরিচয় নেয়া হয়েছে। বাবা কিংবা চাচা বিরোধী দলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন- সেই কারণ দেখিয়ে নিয়োগ বঞ্চিত করা হয়েছে প্রার্থীদের। পড়ালেখা কোন যোগ্যতা নয়, বাপের রাজনৈতিক পরিচয়ই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কিংবা অযোগ্যতা!!! সেলুকাস! বড় বিচিত্র সিস্টেম!!!
পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য প্রতিবেশি, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে তথ্য নেয়া হয়। এইটা কতটা বাস্তবসম্মত? একই পরিবারেও তো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক থাকে। থাকে পারিবারিক বিরোধ। থাকে ভিলেজ পলিটিক্স। থাকে জায়গা জমি সম্পত্তি বা ব্যবসা নিয়ে বিরোধ। ঐ স্থানীয় নেতা বা ঐ প্রতিবেশি যে ঠিক তথ্য দিচ্ছে তার নিশ্চয়তা কী?
তাহলে কি প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে স্থানীয় নেতাদের তৈলমর্দনের যোগ্যতাই বড়?
একজন প্রার্থীর পরিবারের সব সদস্যও যদি সরকারবিরোধী হয়, তাতেই কি এটা নিশ্চিত হয় যে সেও সরকারবিরোধী হবে? কিংবা একজন মানুষ যদি ছাত্রজীবনে অন্য মতাদর্শ পোষণ করে, জীবনের বাকি সময়েও সে যে একই চিন্তায় থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা আছে? মানুষের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয় না? তাও আমাদের মত দেশে, যেখানে বছর বছর দল পাল্টানোই নিয়ম।
পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার যে মাঠ কর্মকর্তা, তিনি যে বায়াসড হন না তার নিশ্চয়তা কী? উপেক্ষা করার মত বিষয়কে তিনি কি বড় করে দেখাতে পারেন না? ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই আবার আসে- তাহলে কি পিএসসির চেয়ে পুলিশের একজন এসআই এর ক্ষমতা বেশি? গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার ক্ষমতা বেশি? একজন ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, বরং গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট করাটাই তার প্রধান যোগ্যতা?
গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ কর্মকর্তাকে দম্ভভরে এমন কথা বলতে শুনেছি- আপনার চাকরি তো আমার হাতে। আমি যা লিখবো তার ওপর নির্ধারণ হবে আপনার নিয়োগ!!
আর ভেরিফিকেশনের নামে কার পকেটে কত জমা পড়ে, সে হিসাব নাহয় নাই করলাম।
আসি মামলার কথায়। কয়েকজনের নিয়োগ আটকে দেয়া হয়েছে, কারণ- তাদের নামে নাকি মামলা আছে। কারো নামে মামলা থাকলেই তার নিয়োগ আটকে যাবে- কী অদ্ভুত নিয়ম!!! মামলা তো যেকেউ করতে পারে শত্রুতা বশত। এই অযুহাতে চাকরি আটকানো কি বিচারের আগেই শাস্তি দেয়া নয়? এইটা কে না জানে যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মামলাই হয়রানিমূলক, ষড়যন্ত্রমূলক। এমন ঘটনাও আমার জানা আছে, অমুকের ছেলে বিসিএস পাশ করেছে শুনে পরদিনই তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে তমুক।
মজার ব্যাপার হলোঃ মামলা নিয়ে দেশের মন্ত্রী এমপি হওয়া যাবে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের সামান্য কর্মচারী হওয়া যাবে না। সেলুকাস! কী বিচিত্র নিয়ম!!
বিসিএস উত্তীর্ণরা সবাই দীর্ঘদিন ধরে বিসিএস এর প্রিপারেশন নিয়েছে, ধৈর্য ধরে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। প্রজাতন্ত্রের সেবা করার ইচ্ছা ও মানসিকতা না থাকলে কেউ কি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়ার জন্য এত কষ্ট করে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদেরকে সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বঞ্চিত করাতে দল বা প্রজাতন্ত্রের কী উপকারটা হবে?
ব্রিটিশ আমলে আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) এ নিয়োগের জন্য ব্রিটিশরা পুলিশের মাধ্যমে খবর নিত, প্রার্থী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত কিনা। স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত কিনা।
ভারত স্বাধীন হবার পর সত্তুর বছর কেটে গেছে। আমরা দুইবার স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু ঔপনিবেশিক গোলামীর সিস্টেম ছাড়তে পারি নাই।