এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...

এক রৌদ্রোজ্বল বিকেলে...
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১

জনগন ও একজন ডাক্তার- ৬ : মানুষের শরীর কোন যন্ত্র নয়

মাঝে মাঝে পত্রিকাগুলোতে ডাক্তারদের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে সংবাদ , সম্পাদকীয় , উপসম্পাদকীয় দেখা যায় । সেসবে 'অপ্রয়োজনীয়' টেস্ট দেয়া ও দামী ওষুধ দেয়া নিয়ে ডাক্তারদের দোষারোপ করা হয় । মজার বিষয় হলো ঐ কলামগুলো লেখেন অডাক্তার সাংবাদিক ও কলামিস্টগন । এটা স্বতসিদ্ধ যে তাদের চিকিত্‍সাবিদ্যা সম্পর্কে যথাযথ ও যথেষ্ট জ্ঞান নেই । তাদের এ বিষয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান নেই । তারা আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেন । জনসাধারনের চিকিত্‍সা ব্যবস্থা সম্পর্কিত সচেতনতা ও সঠিক ধারণা না থাকায় তাদের এসব মন্তব্যে অনেকেই প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত হচ্ছে । এবং এর প্রভাব পড়ছে সামাজিকভাবে । এর প্রমাণ আমরা পাচ্ছি কোথাও কেউ মারা গেলেই তার আত্নীয় স্বজন ডাক্তারদের দোষারোপ করে হামলা চালাচ্ছে । হাসপাতালে ভাংচুর চালাচ্ছে । আদালতে মামলা ঠুকে দিচ্ছে । জজ উকিল মোক্তাররাও টুপাইস কামানোর উদ্দেশ্যে অভিযোগ আমলে নিয়ে হয়রানি করছে । এই প্রবণতার শেষ ফলাফল ভালো নয় । এতে করে ডাক্তাররা আর কোন রোগীকে ঝুঁকি নিয়ে চিকিত্‍সা দিতে আগ্রহী হবেন না । সমস্যা মনে হলেই অন্য কোথাও রেফার করে দেবেন । পথে পথেই চিকিত্‍সা না পেয়ে মারা যাবে রোগী । কিছুই বলার থাকবে না ।

এইসব সাংবাদিক কলামিস্ট এবং জনগনের মুখপাত্রকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি , টেস্ট কিংবা ওষুধ অপ্রয়োজনীয় কিনা আপনি বুঝলেন কেমনে ? এতই যদি বোঝেন , তাহলে কাল থেকে আপনিই চেম্বার দিয়ে বসে যান । রোগী দেখে সঠিক ওষুধ আর টেস্ট নাহয় আপনিই দিলেন ! অন্তত আমার কোন আপত্তি নেই এতে ।

একজন ডাক্তার বছরের পর বছর পড়াশোনা এবং বাস্তব শিক্ষা থেকে যে ওষুধ দিলেন , আপনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখেই বলে দিলেন এটা অপ্রয়োজনীয় ! পা অবশ হয়ে গেলে ডাক্তার যখন সিটিস্ক্যান কিংবা MRI করান তখন তারা সেটাকে 'অপ্রয়োজনীয়'র কাতারে ফেলে দেন । তাদের ধারণা , অবশ হয়েছে পা , মাথার এক্সরে করাচ্ছে কেন ? নিশ্চয়ই কমিশনের আশায় ! সমস্যা প্রস্রাবে , রক্তপরীক্ষা করাচ্ছে কেন ? নিশ্চয় প্যাথোলজি ল্যাব থেকে ডাক্তার কমিশন নেয়ার জন্যই এটা করাচ্ছে ! এটার আদতে কোন প্রয়োজন ছিলনা !
নচিকেতা মজা করে সুর (ভুল বুঝবেনা , শুড় নয় কিন্তু !) দিয়ে গেয়েছেন 'ডাক্তার চাইবেন রক্তরিপোর্ট , খদ্দের পাঠালেই কমিশন !' নচিকেতার গান নিয়ে আগের একটি পোস্টেও বলেছি । Brain function disturbance এর ফলে যে পা নাড়াতে পারছেনা ,পায়ে অনুভূতি পাচ্ছেনা এটাতো নচিকেতার জানার কথা না । রক্তসঞ্চালন অথবা রক্তের উপাদানগুলোর কমবেশির ফলেই যে প্রস্রাবে সমস্যা সেটাতো নচিকেতার মত গায়ক কিংবা সাংবাদিক ভাইদের জানার কথা না । তবু তারা লিখবেন ! তবু তারা গাইবেন ! কারন ,বলার যে কেউ নেই !

শরীরের প্রতিটি অঙ্গ কিভাবে গঠিত ও সজ্জিত হয়েছে , শরীরের প্রতিটি কাজ কিভাবে সম্পাদিত হয় একজন ডাক্তারকে তা জানতে হয় । কোন কারণে কোন সমস্যাটি তৈরি হয় তা জানতে হয় । জানতে হয় প্রতিটি ওষুধের উপাদান কী , ওষুধের উপাদানগুলো কিভাবে কাজ করে , কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সব । পাঁচ বছরের এমবিবিএস কোর্সে (ইন্টার্নশিপ ছাড়া) সাড়ে চার বছরই এসব পড়তে হয় । এই সকল বিষয় বিবেচনা করেই একজন ডাক্তার ওষুধ দিয়ে থাকেন । টেস্ট করাতে দিয়ে থাকেন ।

মানুষের শরীর কোন জীবনহীন যন্ত্র নয় । আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার হলো মানুষের শরীর কিংবা জীবন কোন মানুষ তৈরি করেনি এবং করেনা । এমনকি মানুষের শরীরের সব রহস্য এখনও উদঘাটন করতে পারেনি মানুষ । সব কার্যপ্রণালী এখনো জানতে পারিনি আমরা । ,
তাই কোন অসুখেই ডাক্তাররাও বলতে পারেননা যে এটাই একমাত্র কিংবা প্রকৃত কারণ । বলা সম্ভব নয় এটাই একমাত্র এবং সঠিক ওষুধ ।
অর্জিত জ্ঞান , টেস্টের রিপোর্ট এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধারনা করেই চিকিত্‍সা দেয়া হয় ।

রোগের সঠিক কারণ উদঘাটনের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে । সেগুলোই মেডিকেল টেস্ট । একটা যন্ত্র সমস্যাগ্রস্ত হলে সেটাকে খুলে দেখা যায় । আবার সব পার্টস লাগিয়ে দেয়া যায় । একাজটি করা যায় যখন ইচ্ছে তখনই । যেকোন পার্টস সহজে বদলে ফেলা যায় । কিন্তু মানুষের শরীরের অঙ্গ গুলো কি ইচ্ছেমতন খোলা কিংবা লাগানো যায় ? পেটের সমস্যা হলেই কি পেটটা কেটে দেখা সম্ভব ভেতরে কী হয়েছে ? মাথার সমস্যা থাকলেই কি মাথাটা খুলে পরীক্ষা করা যাবে ? উত্তর -না ।
এজন্যই সকল পরীক্ষা করতে হয় বাইরে থেকে । যতবেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করা যাবে , রোগনির্ণয় হবে তত নির্ভুল । চিকিত্‍সা হবে তত সহজ ,সঠিক এবং উপকারি ।
আমাদের দেশে এখনো CT Scan, Ultrasonogram এগুলোকে উচ্চমানের টেস্ট হিসেবে ধরা হয় । উন্নতবিশ্বে এগুলো রুটিন চেকআপের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে । শুনেছি প্রবাসী অনেক বাংলাদেশি অসুস্থ হলে দেশে চলে আসেন । চিকিত্‍সা করিয়ে আবার চলে যান । কারণ , জ্বর সারানোর জন্য চিকিত্‍সা করতে গেলে যা খরচ- সেই খরচে দেশে আসা যাওয়া , চিকিত্‍সা এবং বাসায় একটা পার্টি দেয়া যায় !



 সোমবার, সেপ্টেম্বর 26, 2011

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১১

মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়নি চেতনার দাবিদাররা

বর্তমান বাংলাদেশ এক জগাখিচুড়ী অবস্থা পার করছে । ক্ষমতায় আছে স্বঘোষিত স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি । তারা নিজেদের প্রয়োজন মাফিক সবাইকে যুদ্ধাপরাধী এবং রাজাকার বলে আখ্যা দেন । সর্বশেষ রাজাকার ঘোষিত হয়েছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী । টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতারা কাদের সিদ্দিকীকে রাজাকার আখ্যা দিয়ে মিছিল সমাবেশ করেন । কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সেখানে সমাবেশ ডাকলে সেটা পন্ড করে দেয় আওয়ামী লীগ । (কাদের সিদ্দীকি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদ করেছিলেন । আজকের সুবিধাভোগীরা তখন গর্তে লুকিয়ে ছিল । কেউ টু শব্দটি করেনি ।)

অপরদিকে বিরোধী দলগুলো সরকারের আজ্ঞাবাহী পুলিশ , গোয়েন্দা সংস্থা , আদালত এবং সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে চরম নিপীড়নের শিকার । চারিদিকে শোষণ , বঞ্চনা ও অব্যবস্থাপনার মহামারীরুপ । এই বিষয়গুলোর সবই পরিবর্তনের নিয়ামক । বিরোধী রাজনৈতিক দল শক্তিশালী হলে পরিবর্তন হবে দ্রুত । অন্যথায় জনগনের বিপ্লব বিলম্বিত হবে ।

ইতিহাস সবসময় শোষণ , বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে । কিন্তু নিপীড়নকারীরা তবুও নিপীড়ন চালিয়ে যায় । চালিয়ে যায় নির্যাতন । একজন মণিষী বলেছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা নাকি এটাই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না । সেজন্যই বারবার ফিরে আসে ইতিহাস ।

প্রথমেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলি । যুদ্ধটা হয়েছিল কেন ? পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পুর্ব পাকিস্তানের জনগনকে নানাভাবে বঞ্চিত করে আসছিলো । তারা পুর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করত । এতে করে মানুষ ক্রমাগতভাবে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছিল । জমা হয়েছিল আক্রোশের বারুদ । কিন্তু তবুও যুদ্ধ শুরু হয়নি ২৩টি বছর । আন্দোলন হয়েছে । পুলিশের লাঠিপেটা , হামলা মামলা গুলি হয়েছে । শেখ মুজিবুর রহমানের মত নেতাকে ষড়যন্ত্রের মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে রাখা হয়েছে । এরপর ২৫ মার্চ ১৯৭১ ।
 রাতের আঁধারে নিরীহ মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে সেনাবাহিনী রাইফেল আর কামান নিয়ে ।
তারপর ধীরে ধীরে সংগঠিত হয় সাধারন মানুষ । শুরু হয় যুদ্ধ । যুদ্ধ শুরুর সময় যারা ছিলো নিরস্ত্র , অপ্রশিক্ষিত । তারাই জিতলো যুদ্ধে । ২৫শে মার্চ সেনাবাহিনী নিরীহ জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে কি যুদ্ধটা শুরু হত ? সম্ভবত হত না । অত্যাচারের চুড়ান্তরুপ ছিলো সেটা । তাই চুড়ান্ত পতন হয় অত্যাচারীদের ।

এটা সবাই জানেন । কিন্তু এ থেকে শিক্ষা নেয়না কেউই । কোন দল বা গোষ্ঠির প্রতি বঞ্চনা , নিপীড়ন করলে তা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে । বঞ্চিত মানুষেরা একসময় ঘুরে দাড়াবেই । আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের দুর্বল মনে হলেও শেষ বিজয়টা তাঁদেরই হবে ।

মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের জোয়ারটা কোথায় শুরু হয়েছিল মনে আছে ? তিউনিশিয়ার মোহাম্মদ বুআজিজি স্নাতক পাশ করে কোন চাকরি পাননি । বেকার বুআজিজি রাস্তার ধারে একটা সবজির দোকান দেন । পুলিশ তাকে সেখান থেকেও উচ্ছেদ করে । রাগে ক্ষোভে দুঃখে আত্নহত্যা করেন তিনি । এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে । একজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু আগুন ধরিয়ে দেয় বারুদের স্তুপে । একের পর এক উত্‍খাত হয় তিউনিশিয়ার বেন আলি , মিশরের হোসনি মোবারক । একই জোয়ারের ঢেউ লেগেছে সিরিয়ায় , ইয়েমেনে ।
শাসকশ্রেণী কি ভেবেছিল এই সামান্য কাজের জন্য এতবড় বিপদ হবে তাঁদের ? ভাবেনি ।

বাংলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার । কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে , তারা মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষাগ্রহন করেনি । ,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল শোষণ বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ । দুর্ভাগ্যজনক যে এই শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানি শাসকদের মত আচরন করছে । বিরোধীদলগুলো এবং জনগনের ওপর এমন আচরন করা হচ্ছে যেন তারা এদেশেরই মানুষ না । নিজেদের মহাশক্তিমান ভেবে সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করছে । জ্বালানি , দ্রব্যমুল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের উর্ধ্বগতি , গ্যাস পানি বিদ্যুতসংকট , দেশবিরোধী চুক্তি , হত্যা ,ধর্ষণ , গুম , দুর্নীতি , শেয়ারবাজার লুট ইত্যাদি মানুষকে দিন দিন ক্রুদ্ধ করে তুলছে । মুখের ভাষা বাধাগ্রস্ত করায় মানুষ হাতের ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে । শান্তিপুর্ন প্রতিবাদে বাধা দেয়ায় প্রতিবাদ হয়ে উঠছে সহিংস । দেশ আবারো চরম সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে না । নিজের দেশেই জীবনের প্রয়োজনে মানুষ মুক্তির জন্য নতুন পথ খুঁজবে । সুত্রপাত হবে হয়তো নতুন যুদ্ধের । সেটা কি গৃহযুদ্ধ হতে পারে ? যাই হোক না কেন , নিপীড়নকারীদের পতন হবেই । সকল ইতিহাস তাই বলে ।


মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর 20, 2011