অস্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য বাজেট-০১: বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্যখাত
মাননীয় স্পিকার
৮৬। কমিউনিটি ক্লিনিকঃ ‘মিনি ল্যাপটপ হবে ডিজিটাল ডাক্তার- এই স্লোগানকে
সামনে রেখে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে মোট ১৩ হাজার ৮৬১টি মিনি ল্যাপটপ
প্রদানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী টেলিমেডিসিন
সেবা, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য ও স্বাস্থ্য শিক্ষার সুযোগ পাবেন।
৮৭। টেলিমেডিসিন সেবার
সম্প্রসারণঃ ৬৪টি হাসপাতাল এবং ৪১৮টি উপজেলা হাসপাতালে মোবাইল ফোনের
মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। পাশাপাশি, জেলা ও
উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য অফিসগুলোতে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
৮৮।
মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমঃ গরিব, দুস্থ ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ৫৩টি
উপজেলায় চালানো হচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার কর্মসূচি। আরো ২০টি উপজেলায় এ
কর্মসূচি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৩২টি উপজেলায় জরুরি
প্রসূতিসেবা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’
৮৯। জনস্বাস্থ্য
ব্যবস্থার আধুনিকায়নঃ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার আধুনিকায়নে আমরা ‘জাতীয় ওষুধ
নীতি ২০১৪’ প্রণয়ন করছি। একই সাথে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২, ড্রাগ
অ্যাক্ট ১৯৪০, ড্রাগ রুলস ১৯৪৫ ও ১৯৪৬সহ বিভিন্ন সংশোধনী একত্রিত ও
যুগোপযোগী করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
৯০। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি ।
অস্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য বাজেট-০২: ক্রমাগতভাবে কমেছে বরাদ্দ
.
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার
কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতে মোট ১২ হাজার ৭২৬ কোটি
টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। যা এবারের প্রস্তাবিত মোট ২ লাখ ৯৫ হাজার
১০০ কোটি টাকা বাজেটের মাত্র ৪.৩০ শতাংশ। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা
হয়েছে ৭ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৩৩১ কোটি
টাকা।
গত অর্থবছরে এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার কোটি টাকা, যা
ছিল মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি দেখালেও প্রকৃতপক্ষে তা কমেছে।
এবার মোট বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অংশ মাত্র ৪.৩ শতাংশ। গত বছর এই হার
৪.৪৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হলেও পরে তা সংশোধিত হয়ে ৪.৮১ শতাংশে ওঠে। তবে এর
আগে থেকেই ধারাবাহিকভাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫.৬৮%, ২০১১-১২ সালে ৫.০৩%,
২০১২-১৩ সালে ৪.৮৬% এভাবেই কমতে থাকে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট। ২০১৩-১৪
অর্থবছরে একটু বাড়িয়ে ৪.৯৭% করা হলেও চলতি অর্থবছরে তা আবার কমিয়ে ৪.৩% এ
নামিয়ে আনা হয়েছে ।
২০১০-১৪ সময়কালে বরাদ্দের গড় হার ছিল জিডিপির
মাত্র ০.৮৬ শতাংশ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বরাদ্দ ছিল
সর্বোচ্চ, মোট বাজেটের ৬.৭ শতাংশ এবং জিডিপির ১.০৩ শতাংশ।
বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশের বাজেটের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া
উচিত স্বাস্থ্য খাতে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে সরকারিভাবে মাথাপিছু ন্যূনতম
ব্যয় বরাদ্দ ৪৪ মার্কিন ডলারের সমান হওয়া উচিত, যা বাংলাদেশে মাত্র ২৭
ডলার। এ বরাদ্দের হার আমাদের প্রতিবেশী ভারতে ৫৯ ডলার, নেপালে ৩৩ ডলার,
শ্রীলংকায় ৯৭ ডলার, পাকিস্তানে ৩০ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ৯৫ ডলার এবং
ভিয়েতনামে ৯৬ ডলার।
প্রতি বছর দেশে গড়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাড়লেও
আনুপাতিক হারে বাড়ছে না বরাদ্দের পরিমাণ। বরং দেখা যাচ্ছে, বাজেটে
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে ।
একথা যে
কেউ স্বীকার করবেন যে, সুস্থ জাতি গঠনে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ক্রমাগতভাবে
বাড়ানো উচিৎ । কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য, আমাদের দেশে তা ক্রমাগতভাবে আরো
কমানো হচ্ছে !
অস্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য বাজেট-৩ঃ গরীব বানানোর বাজেট
.
প্রতি
বছর দেশে গড়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাড়ছে । কিন্তু সেই তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে
আনুপাতিক হারে বাড়ছে না বরাদ্দের পরিমাণ । বরং বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে
বরাদ্দের হার মোট বাজেটের তুলনায় শতকরা হার হিসেবে ক্রমাগতভাবে হ্রাস
পাচ্ছে । এবারের বাজেটেও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফলে এ খাতে ক্রমাগতভাবে
বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় (Out of pocket Expenditure) ।
১৯৯৭ সালে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় ছিল ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ । ২০০৭ সালে
তা
বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ । ব্যক্তিগতভাবে খরচ মেটানোর পরিমাণ
বিশ্বে প্রায় ৩২ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে এ হার প্রায় ৬৫ শতাংশ ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতে
সরকারিভাবে মাথাপিছু ন্যূনতম ব্যয় বরাদ্দ ৪৪ মার্কিন ডলারের সমান হওয়া
উচিত, যা বাংলাদেশে মাত্র ২৭ ডলার । আবার এ খাতে বরাদ্দের অর্ধেকই খরচ হয়
বেতন-ভাতায় । অবশিষ্ট বরাদ্দ যায় ক্রয় ও অবকাঠামো উন্নয়নে । ফলে সময়ের সাথ
সাথে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে বৈ কমছে না।
এভাবে সরকারি ব্যয় কমতে থাকলে মানুষের গরীব হবার সম্ভাবনা বাড়বে ।
সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল হওয়ায় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর
মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়বে । আর বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে
গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়বে অনেক মানুষ । মধ্যবিত্তরা হয়ে পড়বে নিম্নবিত্ত,
নিম্নবিত্তরা ভূমিহীন, আর গরীবরা ভুগবে চিকিৎসাহীনতায়।
অস্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য বাজেট-৪ঃ বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া
.
স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহউপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ
রশীদ-ই-মাহবুব । তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেট দেখে মনে হয় স্বাস্থ্যের
দিকে সরকারের কোনো নজর নাই, মনোযোগ নাই। এই বরাদ্দে চিকিৎসা নিতে
মানুষের পকেটের খরচ বাড়বে। এতে দরিদ্র রোগীদের সেবা পাওয়া কঠিন হবে।’
অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, ঘোষিত বাজেটের ফলে স্বাস্থ্য
খাতে আউট অব পকেট বা ব্যক্তি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। দেশের গরিব মানুষের
চিকিৎসা সেবা পাওয়া খুবই কষ্টকর হবে। দেশে অসুস্থতার হার বাড়বে। যার ফলে
দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে গত বছর যে বরাদ্দ
ছিল এবার দৃশ্যমানভাবে তার চেয়ে আকার কিছুটা বেশি দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে
বরাদ্দ বাড়েনি। তিনি বলেন, যে ১৫শ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে তা শুধু
বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য। ফলে গত অর্থবছরে সরকারে পক্ষ থেকে যে সেবা প্রদান
করা হয়েছে এবার তাও সম্ভব হবে না।
অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব কালের
কণ্ঠকে বলেন,কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে টাকার অঙ্কে বাজেট কিছুটা বাড়লেও
জাতীয় বাজেটের অংশ হিসেবে তা ক্রমেই কমছে। এটা কোনোভাবেই দেশের গরিব
মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ইতিবাচক হতে পারে না।
তিনি বলেন, এমন
পরিস্থিতির ফলে স্বাস্থ্য খাতের পাবলিক খাত দুর্বল হয়ে পড়বে, অন্যদিকে
ফুলে-ফেঁপে উঠবে প্রাইভেট সেক্টর, যাতে করে ব্যবসার মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
ফলে জনগণের চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, প্রাইভেট সেক্টরে
ব্যবসা আর দুর্বৃত্তায়নের ফলে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা নিরুপায় হয়ে
ভিড় করবে পাবলিক সেক্টরে। কিন্তু সেখানকার দুর্বল অবস্থানের ফলে চাপের
মুখে ছিটকে পড়বে একেবারেই নিরীহ গরিব মানুষ।
স্বাস্থ্য খাতের বাজেট
বৃদ্ধির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, মোট বাজেটের মাত্র ৪.৩ ভাগের বদলে আমি
মনে করি স্বাস্থ্য খাতে অন্ততপক্ষে ১০ ভাগ বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এতে করেই
স্বাস্থ্য খাতের যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি। এছাড়া তিনি বলেন,
আমাদের দেশের তৃণমূল স্বাস্থ্য সেবায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করছে। আর সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেটে এটিকে সর্বোচ্চ
গুরুত্ব দেয়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটবে বলে আমি আশা
করি।
বিএমএর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান কালের কণ্ঠকে
বলেন,‘স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধির জন্য আমরা আগে থেকেই দাবি জানিয়ে
আসছিলাম। এ ছাড়া সরকার যেভাবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে
এগোচ্ছিল, তাতে এবার স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে আমরা বড় ধরনের বরাদ্দের
ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম, কিন্তু আমাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে
বরাদ্দ যত বাড়বে, দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা তত বেশি
জোরালো হবে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ
(সিপিডি) বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে
বরাদ্দ কমে যাওয়ায় কঠোর সমালোচনা করেছে। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয়
ভট্টাচার্য বলেছেন, বাজেটে সবচেয়ে অবহেলিত খাতের একটি হচ্ছে স্বাস্থ্য।
সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ২০০৩ সাল থেকে মোট দেশজ আয় (জিডিপি)
বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে। মূল বাজেটের তুলনায়ও বরাদ্দ কমছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৯০ শতাংশ। এবার তা
নেমে এসেছে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশে। চরম অবহেলিত হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত।
চলবে...